মায়াবী আগুন
পিওনা আফরোজ
অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবুজ। এলোমেলো চুলগুলোকে ঠিক করতে চিরুনি মাথায় দিতেই মোবাইলে রিং টোন বেজে ওঠে। এদিকে মিনিট পনেরোর মধ্যে না বেরুলেই নয়। এমন অসময়ে কার ফোন? একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে সবুজের চোখে মুখে। অনিচ্ছুক ভাবে হাতের মুঠোফোনটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে মেয়েলী কণ্ঠ। আপা..
কেমন আছিস সবুজ ?
ভালো আপা। তুমি কেমন আছো? মা, কেমন আছে? খুব কৌতূহল নিয়ে জানতে চায় সবুজ।
আমরা ভালো আছি, তুই বাড়ি আসবি কবে?
আগামী মাসের পয়লা সপ্তাহেই অফিস থেইকা দুই তিনদিনের ছুটি নিয়া বাড়ি আসমু। আরতো মাত্র কয়টা দিন। বেতনটা হইলেই বাড়িতে আইসা তোমার সব টাকা শোধ কইরা দিমু।
টাকা কি আর আমার? আমি কি কাজকাম করি। আমি টাকা পামু কই?
আপা আমার উপর রাগ কইর না। তুমি একটু দুলাভাইরে বুঝাইয়া কইও।
কি আর কমু ভাই। তোর দুলাভাইয়ের ধান বেচা টাকা থেইকা আমি তোরে টাকাগুলান দিছিলাম। তুই আইজ দিবি কাইল দিবি কইরা অহন ঘুরাইতেছস। ছয় মাসের কথা কইয়া বছর পার কইরা দিলি। আমিতো পরের ঘর করি। এই টাকার লাইগা আমার কত কথা শুনুন লাগেরে ভাই… । বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে আপার।
আপা আমি তোমারে খুব বিপদে ফালাইয়া রাখছি। সেইটা আমি বুঝি। তয় আর একটু ধৈর্য ধরো আপা। কাঁইন্দো না। টাকার ব্যবস্থা হইবই। তুমি কোনো চিন্তা কইরোনা। আইচ্ছা, এখন তাইলে রাখি। আমার আবার অফিস যাইবার দেরী হইয়া যাইতেছে।
আপাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখে সবুজ।
মুগদা পাড়ার তিনতলা ভবনের মেস। দোতলায় থাকে সবুজসহ আরও তিনজন। মতিঝিলে একটা বেসরকারি অফিসে এক্সিউটিভ পদে অনেক কষ্টে চাকরিটা পেয়েছে সবুজ। দেখতে দেখতে চাকরির বছর খানেক কেটেও গেল। মাঝারি চওড়া রাস্তা ধরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সবুজ। বড়ো রাস্তার দু’পাশে সুন্দর বাড়িগুলো দেখে তারও মনে হয়- যদি কোনোদনি সুদিন আসে তাহলে সেও গ্রামে সুন্দর একটা বাড়ি করবে। বাড়ির সামনে বারান্দা থাকবে। ঘরের ভিতর বাথরুম থাকবে। জানালায় পদ্ম আর রাজহাঁসের নকশাওয়ালা গ্রিল। কিন্তু ছাদ বলতে থাকবে টিনের চাল। বর্ষাকালে টিনের চালের ওপর বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ ভীষণ ভালো লাগে সবুজের। ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ সবই থাকবে। আর থাকবে ভালোবাসার মানুষ মায়া। এ বাড়ির বউ করে আনবে মায়াকে। বাড়ির সামনে ফুলের বাগানে হরেক রকমের ফুল থাকবে। গোলাপ, বেলী, অলকানন্দা, শেফালি, রজনীগন্ধা। বাড়িতে ঢুকতেই কাছারী ঘরের কাছেই কৃষ্ণচূড়া গাছ থাকবে। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম রঙ আর গোধূলি রাঙ্গা স্নিগ্ধ বিকেলবেলা মিলেমিশে একাকার হবে। বাড়ির পিছনে থাকবে ফলের বাগান। এরকম কতশত ভাবনা, শেষ হয় না।
হঠাৎ অফিসের মিনিবাস এসে সামনে দাঁড়ায়। বাসে উঠেও সবুজের ভাবনাগুলো পিছু ছাড়ে না। এমনিতে তার জীবনে তেমন কোনো চমকপ্রদ ঘটনা নেই। বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে ডিগ্রি অবধি পড়াশোনা করেছে, তারপর সামান্য বেতনে শহরে এসে এই চাকরি নিয়েছে। সব ঠিক ভাবেই চলছিল। হঠাৎ করেই সেবার বাবার হার্টের অসুখ ধরা পড়ল। অনেক ধার দেনা করে চিকিৎসা করেও বাবাকে ধরে রাখা গেল না। বকুলতলায় সবুজ ঘাসে ঢাকা কবরে শুয়ে আছেন তিনি। অজান্তেই সবুজের ঠোঁট শুকিয়ে আসে। চোখদুটো ভিজে ওঠে। তার মনে হয় বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটি এই বুঝি বের হয়ে এলো।
(দুই)
সকালের সূর্যটা তখনও ঘুমিয়ে। চোখেমুখে কোনরকম একটু পানি দিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ভোরের আলো আঁধারিতে সবুজ বেরিয়ে পড়ল বাস স্টপেজের দিকে। মুন্সিগঞ্জে নিজ গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়েছে সবুজ। বাস যখন ছাড়ল, তখন আকাশে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। জানালার পাশে বসে ভোরের ঝিরিঝিরি বাতাস খুব ভালো লাগছিল তার। সমস্ত রাতের ঘুমিয়ে থাকা বাতাস, ভোরের আলোর উচ্ছাসে যেন ওর সারা শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মনে পড়ছে মায়াকে। একটা মিষ্টি মুখ। সমস্ত হৃদয় জুড়ে থাকা ভালোবাসার মায়া। কতদিন দেখেনি সেই মায়া ভরা মুখখানি।
সেবার যখন বাড়ি গিয়েছিল, সন্ধ্যের কিছু পরে পুকুরঘাটে মায়ার সাথে দেখা হয়েছিল। আলো আঁধারিতে মায়ার মুখটা চোখের সামনে অপুর্ব হয়ে ফুটে ওঠল। মায়ার সেই মায়াবী দু’চোখের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারের মাঝেও সবুজ যেন হারিয়ে গেল। সেদিন পুকুর ঘাটে বিরাট আম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবুজের চোখে চোখ রেখে মায়া বলেছিল, আপনি বাড়িত আসলেই আকাশে তারার মেলা বসে, দেখেন কি সুন্দর জোছনা ! চারধারের গাছগাছালি সব মনে হইতেছে জোছনায় ভাইসা যাইতেছে। ওর এই একটি কথাতেই সবুজের মনটাও যেন জোছনায় ভেসে গিয়েছিল সেদিন।
রেশমী কাঁচের চুড়ি মায়ার খুব পছন্দ। প্রতিবার তাই বাড়ি যাবার সময় রেশমী কাঁচের চুড়ি নিতে ভোলে না সবুজ। এবারও নিয়েছে।
বাস হুহু করে ছুটে চলছে। রোদের তেজ বাড়তে থাকে। হাইওয়ে রাস্তার দ’ুধারে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানের ক্ষেত। ক্ষেতের ওপর যেন রুপালি রোদ চিকচিক করছে। সবুজ গাছগাছালি, নদী, বিরাট মাঠ, প্রকৃতির অপার সব সৌন্দর্য যেন একসাথে ধরা দিয়েছে। বাইরে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে সবুজ। একটির পর একটি দৃশ্য দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যায়। দূর থেকে ঢের দূরে হারায়।
বাস থেকে নেমে একটি রিকশা নিয়ে গ্রামের ভাঙাচোরা, উঁচু নিচু, কাঁচা রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে রওনা হয় সবুজ। আর ঘণ্টা খানেক পরেই নিজ গ্রামের ছায়ায় পৌঁছে যাবে সে। গেলোও তাই। অনেকদিন পর গ্রামে ঢুকে সবুজের মনে হয় গ্রামটি যেন মায়ের মতো হাত বাড়িয়ে রয়েছে ওরই জন্য। শরতের মিষ্টি রোদ। সেই রোদও যেন অনেকদিন পরে সবুজকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। একটা রিকশায় চড়ে গ্রামের ক্ষতবিক্ষত, উঁচুনিচু, কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে লিচু গাছের ছায়ায় ঢাকা বাড়িতে পৌঁছালো সবুজ। সবুজকে দেখে মা আনন্দে ছুটে এসে বলল,
বাবা আইছিস।
হ, মা। তোমার শরীরটা ভালো তো?
আছি ভালোই। তয় তোর মুখখান এমুন শুকনা লাগতেছে ক্যান? কিছু খাস নাই মনে লয়। তুই হাতমুখ ধুইয়া ল। তোরে খাওন দিতাছি বাপ।
(তিন)
বহুদিন পর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে বিশ্রামে যায় সবুজ। সূর্যের তাপ খানিকটা বাড়লওে কাঁঠাল গাছের পাতায় ঢাকা টিনের চালের ঘরে তেমন গরম অনুভূত হয় না । খোলা জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসের ছুঁয়ে যাওয়া নিবিড় পরশে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত সবুজ। ঘুম যখন ভাঙে তখন পড়ন্ত বিকেল। তখনও ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। ঢাকার দম বন্ধ করা পরিবেশে এমন বাতাসের র্স্পশ কল্পনাও করা যায় না।
মা, সন্ধ্যা হইতে এখনও মেলা সময় বাকি। আমি আপার বাড়ি থেইকা ঘুইরা আসি। ওগো জন্য টুকটাক কিছু জিনিস আনছিলাম। ওগুলা দিয়া আসি, আর আপার লগে দেখাও কইরা আসি।
এত কিছু ক্যান করতে গেলি।
তোমার জন্যও একটা টাঙ্গাইলের শাড়ি আনছি। তুমিতো আবার জরির পাড়ের শাড়ি পরতে পার না। তোমার নাকি গা চুলকায়।
বয়স হইছেত বাপ। অহন আর শরীর সহ্য করতে পারে না।
আমি বুঝিতো মা। এইটাতো পুরাটাই সুতি। তুমি পইরা আরাম পাইবা। এখন যাই। আইসা কথা কমুনে।
সতেজ শরীর আর ফুরফুরে মন নিয়ে আপার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সবুজ। ইট বিছানো সরু পথ। কিলোখানিক দূরে পরের গ্রামটিতেই আপার বাড়ি। শুধু আপার বাড়িই নয়। মায়ার বাড়িও ওপথেই। মায়ার কথা মনে হতেই একটা ভালোলাগার অনুভূতি বুকের মাঝে দোলা দিয়ে যায়। মায়া কি এখন ওর অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে? থাকারই কথা। কখন কোথায় যাবে সবুজ সব কিছুই মোবাইলে জানিয়ে রেখেছে মায়াকে। আর কিছু দূরেই আপার বাড়ি। গাছ গাছালি ঝোপ ঝাড়ের ভিতর দিয়েও চৌচালা টিনের ঘরটি দেখা যাচ্ছে। আপার জন্য তেমন কিছু করা হয়ে ওঠে না। বিয়ের পর থেকে আপার বাড়িতে ভালো মন্দ কিছু পাঠাতে পারেনি। আজকাল শশুরবাড়ির ওপর কত দাবি-আবদারই না থাকে মেয়ে জামাইদের। কিন্তু আপাদের জন্য ওরা কিছুই করতে পারে না। কীভাবেই বা করবে, বাড়িতে সংসার চালানের খরচ, সবুজের ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচ তার উপর বাবার অসুস্থতার সময় তাঁর চিকিৎসার জন্য ধার নেয়া টাকা শোধ করা।
বাবা থাকাকালীন কোনোরকম খেয়ে পরে দিন কাটত তাদের। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। চাকরিটা পাওয়াতে তাও এখন রক্ষা। সামনেই আপাদের বাড়ি। তখন সন্ধ্যা ধীর পায়ে নামতে শুরু করেছে। সূর্যাস্তের আলোয় রাঙ্গা আকাশ সবুজের মনকে আরও যেন বিষন্ন করে তোলে। বাড়িতে ঢুকেই দেখল আপা হাঁস মুরগীগুলো খোয়াড়ে ঢোকাচ্ছে। সবুজকে দেখেই ছুটে আসে আপা।
সবুজ, বাড়িত কখন আইছস?
এই তো আপা, দুপুরের দিকে আসছি।’
আয় আয় ঘরে আয়। তোরে কতোদিন দেখি না।
দুলাভাইরে দেখতাছি না! কখন আইবো?
একটু দক্ষিণ পাড়ায় গেছে। এ্যাক্ষুনি আইসা পড়বো।
ঘরে এসে বসে সবুজ। আপা হাতের কাজ শেষ করে ঘরে ঢোকে। সবুজ ব্যাগ থেকে কয়েকটি প্যাকেট বের করে আপার হাতে দিয়ে বলে, বুবু, তোমাগো লাইগা কিছু টুকটাক জিনিস কিনছি, এই নাও ব্যাগটা ধর।
তুই আবার পয়সা খরচা করতে গেলি ক্যান?
করতে আর পারলাম কই। কত কিছুই তো করতে ইচ্ছা করে। সাধ্য তো নাই। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মনে হল কত কালের জমানো কষ্ট দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে পড়ল। এমন সময় দুলাভাই ঘরে ঢুকল। সবুজের দিকে তাকানোর ভাব দেখে মনে হল, তাঁর উপস্থিতি দুলাভাইয়ের কাছে বিরক্তিকর।
আস্সালামু আলাইকুম, দুলাভাই। সবুজের সালামের উত্তর না দিয়ে উপহারগুলোর দিকে চোখ পড়তেই বলল, এইসব ফালতু জিনিসপত্র দিয়া কোন লাভ নাই। আমার পাওনা টাকা আগে বুঝাইয়া দাও।
বলেই আপার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে উঠানে ছুঁড়ে মারে দুলাভাই। সবুজ বোকার মতো চেয়ে থাকে দুলাভাইয়ের দিকে। প্রতিদিন রিকশার রাস্তাটুকু পায়ে হেঁটে অফিস গিয়ে, মাঝে মাঝে দুপুরে ভাতের বদলে বনরুটি আর কলা খেয়ে একটু একটু করে জমানো টাকা দিয়ে উপহারগুলো কিনেছিল সবুজ। কষ্টে কেনা সেই ভালোবাসার উপহারগুলো এতটাই তুচ্ছ হয়ে গেলো টাকার কাছে? ওগুলো তো শুধু উপহারই ছিল না, এর সাথে জড়িয়ে ছিল বোনের জন্য অনেক যতœ করে জমিয়ে রাখা এক ভাইয়ের ভালোবাসা। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকে সবুজের।
বড়ো আপা অবাক হয়ে দুলাভাইকে বলল, এইটা আপনে কি করলেন?
তুমি এর মধ্যে কোন কথা বলবা না। ধমক দেয় দুলাভাই।
দুলাভাই, আমি আপনার টাকাও আনছি। বলে পকেট থেকে টাকার একটা বান্ডেল দুলাভাইয়ের হাতে দেয় সবুজ।
এত ছোট ক্যান? এহানে কত আছে?
বিশ হাজার দুলাভাই। বাকি বিশ হাজারের জন্য আমারে কিছুদিন সময় দেন। আমি সব শোধ দিয়া দিমুনে। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল সবুজ।
তুমি তো তোমার বোইনরে কইছিলা বাড়িত আইসা সব টাকা শোধ কইরা দিবা। অহন এইডা কী কইতাছো?
দুলাভাই, আমি অনেক কষ্ট কইরা এই টাকাগুলান যোগাড় করছি। এর বেশি আর পারি নাই।
টাকা নাওনের সময় মনে আছিল না যে টাকা কেমনে শোধ করমু? আরে ব্যাটা তোর বাপের বয়স হইছে, মইরা যাইব! এইডাইতো স্বাভাবিক। তার অসুখের চিকিৎসার লাইগা এত পয়সা খরচের দরকার কি আছিল? যাক, অহন আমার সাফ সাফ কথা, আগামী সাত দিনের মধ্যে আমারে বাকী আরও বিশ হাজার টাকা দিয়া যাইবা।
সাত দিনের মধ্যে আমি এত টাকা কই পামু?
কই পাইবা, হেইডা আমার মাথা ব্যথা না। আমার সাত দিনের মধ্যে টাকা লাগব। আর কোনও উপায় না থাকলে ঘর ভিটা বেইচা দাও।
দুলাভাইয়ের কথায় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সবুজের। অবাক হয়ে ভাবে, টাকার জন্য মানুষ এতটা অমানবিক আর নিষ্ঠুর হতে পারে !
ভাইয়ের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে তার বরাবরের নরম মনের আপা এবার মুখ না খুলে পারে না। আপনি এইসব কি কইতাছেন, ভিটা বেচলে মা, সবুজ ওরা কই থাকব?
হেরা কই থাকব, হেই দায় কি আমার? তোমারে না কইছিলাম, কথা কইতে না। টাকা দিতে পারস না, শরম তো নাই উল্টা মুখ দিয়া কথার খই ফুটতাছে। আর একটা কথা কইলে ভাল হইব না কিন্তু।
এরপর রাগান্বিত হয়ে দুলাভাই সবুজকে বলল, ঐ মিঞা সাতদিনই আমার শেষ কথা, তার চেয়ে আর একদিনও বেশি না। এর মধ্যে টাকা না পাইলে জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়মু, কথাগুলান মনে থাকে য্যান।
সবুজ আর এই অপমান সইতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে তখন রাত নেমে এসেছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভাঙ্গামন নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবে অর্থের কাছে মানুষ কতটা অসহায়, কতটা নিরুপায় ! তার অক্ষমতায় আপাকেও আজ এভাবে অপমানিত হতে হলো। যে আপা তাকে এত ভালোবাসে! নিজেকে তার এক অপদার্থ ভাই মনে হয়। সাতদিনেরে মধ্যে টাকা শোধ দিতে না পারলে মাকেও হয়তো ভিটেছাড়া হতে হবে। না, এটা সে দেখতে পারবে না। সইতেও পারবে না। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে ওঠে সবুজ।
(চার)
বাড়িতে ঢোকার পর কোন কথা না বলেই নিজের ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে শুয়ে পড়ে সবুজ। রাতের অন্ধকারের চেয়েও গাঢ় এক অন্ধকার বুকে চেপে বসেছে তার। অপমানের লজ্জা আর কষ্টে বুকটা ভেঙে যেতে থাকে। আজ তার ভালোবাসার মানুষ মায়ার সাথেও দেখা হলো না। আর কখনও হবে কিনা কে জানে! নাই বা হলো। এই জীবন, এই পৃথিবী- মা, বোন, মায়া সবকিছুকেই কেমন যেন অর্থহীন মনে হয় তার। সব বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কীভাবে সেই মুক্তি ঘটবে, তা সে জানে না। শুয়ে শুয়েই সিদ্ধান্ত নেয়, কালই ঢাকায় ফিরে যাবে সে। তারপর যা করার করবে। এমন অনেক ভাবনা ভাবতে ভাবতে, এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সবুজ।
ভোর হতে তখনও বাকি। ঢাকা যাওয়ার সকাল সাতটার বাস ধরতে হবে। তাই আঁধার থাকতেই বেরিয়ে পড়ে সবুজ। শরতের আকাশে সাদা সাদা মেঘ। কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়োাচ্ছে। আহা! যদি ওদের মতো হতে পারতো সে! রাতের ভাবনাগুলো আবার চেপে ধরে তাকে। সেই একই ভাবনা। সাতদিন। বিশ হাজার টাকা। কিন্তু কীভাবে সম্ভব?
দাঁড়ান। আমারে না দেইখ্যা যাইতাছেন ক্যামনে? আমার থাইকা টাকাই বড়ো হইলো? কালো বোরকা পরা মায়াকে আধো আলো আধো অন্ধকারে এভাবে দেখে খুব অবাক হয় সবুজ।
মায়া! তুমি এই আন্ধারে!
হ, আমি । শোনেন, কাল আপনি আসছেন শুইনা আপার বাড়িতে যাইতে নিছিলাম। কিন্তু দুলাভাই এর উঁচা গলা শুইনা আর ঢুকি নাই। পিছনে খাড়ায়া সব শুনছি।
আমারে তুমি ভুল বুইঝ না। টাকার চিন্তায় আমার মাথা ঠিক নাই। তাই তোমার লগে দেখা করতে পারি নাই। তোমার জন্য রেশমি চুড়ি কিনছিলাম। ওইডাও দিতে পারি নাই।
আমারে কিছু দিতে হইবো না। আপনে তো আমারে অনেক কিছুই দিছেন। আমার আর কিছু লাগবো না। কিন্তু আমি আপনারে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দিতে পারি নাই। এইবার দিতে চাই।
আমার আর কিছু লাগব না মায়া। তোমার সাথে দেখা হইছে, এই অনেক।
লাগব। আমি গরিব ঘরের হইতে পারি। আমার হাতে কোনো টাকাও নাই সত্যি, তবুও কইতাছি সাতদিনের ভাবনাটা আমারে দিয়া যান।
এইটা ক্যামনে সম্ভব? তুমি ক্যামনে কী করবা? আর তুমি পারলেও আমি তা নিমু না। আমি যেমনেই পারি টাকার ব্যবস্থা করমুই। তোমারে কিচ্ছু করতে হইবো না।
ক্যান করতে হইবো না? আমার কি আপনার প্রতি অধিকার, ভালোবাসা, দায়িত্ব কিছুই নাই? আমারে কী মনে করেন আপনে?
বলেই আর দাঁড়ায় না মায়া। হালকা অন্ধকার কেটে কেটে দ্রুত চলে যায় সে, ওই সাদা মেঘের মতো ভেসে ভেসে। এ যেন এক নতুন মায়া। স্নিগ্ধ, শান্ত এই মায়ার মাঝে এত আগুন লুকিয়ে ছিল ! কই, কখনও বুঝেনি তো সে! অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো হেঁটে চলে সবুজ। পিছনে পড়ে থাকে এক মায়াবী আগুন। এ আগুন কী নেভাতে পারবে সবুজের দুর্ভাবনা? কীভাবে পারবে? কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সবুজ!