মার্সেল প্রুস্ত : সমাজ পরিবর্তনে সাহিত্য যখন মোক্ষম অস্ত্র
আদনান সৈয়দ
[মার্সেল প্রুস্ত একজন ফরাসি কথা সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক,কবি এবং প্রাবন্ধিক। বিংশ শতাব্দির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক প্রুস্ত। অনেকেই তাঁকে বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলে অভিহিত করেছেন। ’ইন সার্চ অব লস্ট টাইম বা ’হারিয়ে যাওয়া সময়ের খোজে’ লেখকের বিখ্যাত উপন্যাস। ১০ জুলাই মার্সেল প্রুস্তের জন্মদিন]
বিংশ শতাব্দীর এমন কোনো লেখককে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি প্রুস্তের সাহিত্য দিয়ে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত হননি। প্রুস্ত তাঁর সমকালীন দেখা মানুষের মন, বিশ্বাস, হাহাকার, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাগুলোকে একই সুতায় বেঁধে সাহিত্যের মালা গেঁথেছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না প্রুস্ত যে সময়টায় প্যারিসে বেড়ে উঠেছিলেন তখন সে শহরজুড়ে ছিল মানুষে মানুষে ভেদাভেদের চাদরে ঢাকা একটি সমাজ। বিশেষ করে রাজা ফ্রান্সিস-এর সময়ে সমাজে ভেদাভেদ ছিল তুঙ্গে যা প্রুস্তের লেখায় ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রুস্তের মাস্টারপিস বলে খ্যাত In Search of Lost Time গ্রন্থটিকে আমরা সমাজে থার্ড রিপাবলিকের অসম বিন্যাসের একটি স্ন্যাপশট ধরতে পারি। এই গ্রন্থটি দিয়ে তিনি সমাজকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিষ্কার করেছেন এবং নতুন করে বিনির্মাণ করেছেন।
অনেকেই ভাবেন প্রুস্ত-সাহিত্যের পাঠ জটিল একটি বিষয়। কারণ তাঁর সাহিত্যশৈলীটি গতানুগতিক সাহিত্য থেকে একটু আলাদা। কথাসাহিত্যিক ভøাদিমির নভোকভ-এর ভাষায়, ‘তাঁর রচনা সহজ ও সরল আবার সহজ মনে হলেও এত সহজ নয়।’ তবে অধিকাংশ সাহিত্যামোদীদের ধারণা এ একবিংশ শতাব্দীতেও প্রুস্ত অবশ্যপাঠ্য। আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রুস্ত তাঁর সাহিত্যে যে নতুন বাঁক নির্মাণ করেছিলেন সে নির্মিত পথে সাহিত্য এখনো হাঁটছে। কেউ কেউ আবার আরও এক কাঠি এগিয়ে বিশ্বাস করেন কথাসাহিত্যে প্রুস্তের নির্মিত পথ থেকে আমরা এখনো খুব বেশিদূর এগুতে পারিনি। অতএব প্রুস্ত যে তাঁর কাজ দিয়ে সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৮৭১ সালের ১০ জুলাই প্রুস্তের জন্ম। ফ্রানকো-প্রুশিয়া যুদ্ধের পর ফ্রান্সের তৃতীয় রিপাবলিক রাজনৈতিক মেরুকরণ যখন ঘটছে ঠিক সে অস্থির সময়ে মার্সেল প্রুস্তের জন্ম। বলার অপেক্ষা রাখে না তখন সময়টা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। একদিকে প্যারিসের রাস্তায় শ্রেণিবৈষম্যের উৎপাত অন্যদিকে মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র আর্তনাদ। নাগরিক বোধের একদিকে যেমন রয়েছে দীপ্র আধুনিকতা অন্যদিকে তার উল্টোপিঠে রয়েছে নগরজীবনের ক্লেদ, রুগ্নতা, হীনতা, নিঃসঙ্গতা ও অসহায় আর্তনাদ। মানুষের আকাঙ্খা এবং সমাজবিচ্ছিন্ন মানসিকতা চর্চার প্রভাব প্রুস্তের চিন্তার জগতে কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আবার কখনো প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছিল এবং তাঁর কৈশোরকেও ভিন্নমাত্রায় রাঙিয়ে দিয়েছিল। সে কারণে প্রুস্তের In Serch of Lost Time গ্রন্থে ফরাসি ঔপনিবেশিকতার পতন, শ্রেণিসংগ্রাম, মধ্যবিত্তের উত্থান এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির চিত্রগুলোর ক্যানভাস ছিল স্বতস্ফূর্ত।
কৈশোরোত্তীর্ণ সময় থেকেই প্রুস্ত লেখালেখিতে জড়িয়েছিলেন। তৎকালীন ফরাসি সমসাময়িক সাহিত্যপত্রিকা যেমন- La Revue Verte and La Revue Lilas দুটোতেই তিনি লিখেছেন। পরবর্তীতে তিনি একজন সাহিত্যসমালোচক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি নিজেই সাহিত্যসমালোচনাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সাহিত্যপত্রিকা চালু করেন যা পরবর্তীতে ফ্রান্সের অন্যতম সমালোচনাপত্রিকা হিসাব স্বীকৃতি পায়। সে পত্রিকাটির নাম ছিল La Revue Blanche। ১৮৯৬ সাল থেকে প্রুস্তের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করে। সে সময় প্রকাশিত হয় তাঁর গ্রন্থ Les Plasisirs et les jours। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন আঁনাতল ফ্রান্স। আর প্রচ্ছদ করেছিলেন Mme Lemaire। উল্লেখ্য যে লেমায়ার ছিলেন একজন সৌখিন আঁকিয়ে এবং প্রুস্তের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল যে পাঠক গ্রন্থটির মূল্যের দ্বিগুণ দাম দিয়ে ক্রয় করতেও দ্বিধা করেননি।
প্রুস্ত তাঁর জীবনে গভীরভাবে বেশ কয়েকজন লেখকের লেখায় প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং নিজেকে ঋদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে থমাস কারলাইল, রাফ ওয়ালডো এমারসন ও জন রাসকিন অন্যতম। তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় প্রুস্ত নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করেন এবং পাশাপাশি নিজের সাহিত্যসমাজকেও সমৃদ্ধ করেন। অনেকেই মনে করেন সে সময় প্রুস্তের লেখায় জন রাসকিন-এর প্রভাব ছিল অনেক। বিশেষ করে রাসকিনের প্রকৃতিপ্রেম এবং সেখানে মানুষের আত্মপরিচয় সম্মিলন ঘটানো ছিল প্রুস্তের অন্যতম শৈল্পিক কাজ। রাসকিনের The Seven Lamps of Architecture, The Bible of Amiens and Praeterita এ তিনটি গ্রন্থ ছিল প্রুস্তের আত্মার খোরাক। প্রুস্ত রাসকিনের কিছু লেখা ফরাসি ভাষায় অনুবাদের কাজে হাত দেন। নিজে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী না হলেও তিনি অনেক বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় কিছু কাজ অনুবাদ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে প্রুস্তের এ অনুবাদ নিয়ে তাঁর কিছু লেখকবন্ধু দাবি করেছিলেন যে প্রুস্ত ইংরেজি ভাষাটা তেমন আয়ত্ত করতে পারেনিনি। তাই অনুবাদ সঠিক হয়নি। কিন্তু প্রুস্ত এ সমালোচকদের দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন- ‘আমি দাবি করছি না যে ইংরেজি ভাষাটা আমি জানি, তবে আমি দাবি করছি আমি রাসকিনকে জানি।’
১৯০৩ সালে বাবার মৃত্যু আর ১৯০৫ সালে মার মৃত্যুর পর প্রুস্ত অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি স্বাধীন এবং লেখালেখিতে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সে সময়টিই ছিল প্রুস্তের লেখালেখির পক্ষে সবচেয়ে ভালো সময়। দেখতে পাই কয়েকটি উপন্যাসের কাজ তিনি সে সময় থেকেই শুরু করেছিলেন। মনে রাখতে হবে তৎকালীন ফ্রান্সে ব্যালজাক, ফ্লবোর্ট, রেনাঁ, সেইন্ট সিমন এবং অনেক বিখ্যাত লেখক প্যারিসে বেশ প্রতাপের সাথে কথাসাহিত্য শাসন করছিলেন। সন্দেহ নে সেখানে শক্তপোক্ত করে একটি জায়গা দখল করা এত সহজ কাজ ছিল না। প্রুস্ত সে সময় ফরাসি শিল্পসাহিত্যের আলোচনার মূল কাঠামোগত সমস্যাগুলো তুলে ধরেন এবং সেখানে নতুন একটি ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেন। নতুন ধারাটি হলো সাহিত্যের জীবনদর্শন। লেখকের কাজ সে দর্শনকে জাগিয়ে তোলা। এ নিয়ে তিনি দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখেন (Contre Sainte-Beuve) যা সে সময়ের গতানুগতিক শিল্পসমালোচকদের গালে কষে চড় মারার মতোই ঘটনা। তিনি সেখানে জোর দেন একজন শিল্পীর দৃষ্টি নিয়ে সাহিত্যকে কীভাবে আলোচনা করা উচিত। শিল্পীর কাজ হলো চিন্তার যথাযথ বিস্তার। আবার যে চিন্তাগুলো সমাজে সমাধিস্থ হয়েছে, যে ভাবনার কথা মানুষ ভুলতে বসেছে বা এখনো ভাববার সুযোগ পাচ্ছে না সে ভাবনাগুলোকে বাস্তব দুনিয়ার মোড়কে তুলে নিয়ে আসা।
১৯০৮ সালটি ছিল প্রুস্তের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। এ বছরের প্রথম দিকে তিনি প্রচুর প্রবন্ধ লিখেন। এসব প্রবন্ধ আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি প্রকাশ হতে থাকে। সন্দেহ নেই প্রবন্ধ রচনার সময় প্রুস্ত তাঁর নিজের লেখায় একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করার সুযোগ পান। একই বছর তিনি বিভন্ন বিষয়ের উপর লেখালেখিতে মনোযোগ দেন এবং যার ফলশ্রুতিতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Contre Sainte-Beuve প্রকাশিত হয়। প্রুস্ত নিজেও তাঁর কাজে ভয়ানক খুশি ছিলেন। তাঁর বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেন, ”আমি আমার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার লেখায় একটি সমাজকে তুলে ধরার কাজে হাত দিয়েছি। একটি পারাস্য উপন্যাসের উপর প্রবন্ধ লিখেছি, সেইন্ট বুয়েভের উপর একটি প্রবন্ধ লিখেছি, নারীবিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখেছি, সমকামীতা (যেটি পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করা এত সহজ নয়) নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছি।’ এসব ভাবনা থেকে প্রুস্ত তাঁর উপন্যাসে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। একজন শিল্পীর সৃষ্টিশীল জগৎ নিয়ে আরেকজন শিল্পী যখন ধ্যানে মগ্ন হন এবং তা যখন উপন্যাসে রূপ নেয় তথন সে উপন্যাসটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ হতে বাধ্য। সেইন্ট বুয়েভের কাজ এবং তাঁর জীবনী হয়ে ওঠে উপন্যাসের পটভূমি। সে সঙ্গে উপন্যাসটিতে সমকামিতাবিষয়ক নানা রকম রসদ ছিল ভরপুর। অনেক কষ্ট আর শ্রম দিয়ে পান্ডুলিপিটি তৈরি করে তার নাম দেওয়া হলো Swann in Love, কিন্তু এই ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাসটি প্রকাশ করতে সেই সময় কোনো প্রকাশকই সাহস করলেন না। শেষ পর্যন্ত ১৯১০ সালে যখন উপন্যাসটি শেষ হয তখন এর নাম ঠিক হয় La recherché du temps perdu (In search of lost time)। এ উপন্যাসটির পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে মেটাফোর, মোহ, সংগীত ও মানুষের জীবনের নানা রকম জটিল সম্পর্ক।
সাত খন্ডে লিখিত এই উপন্যাসটি প্রুস্ত এর সবচেয়ে উল্যেখযোগ্য একটি কাজ হিসেবে ধরা হয়। বিস্তৃত পটভুমি, এবং সমাজের বিন্যাস নিয়ে আঁকা বিশাল এক ল্যান্ডস্ক্যাপ হল এই উপন্যাস। অনেকে সাহিত্য সমালোচক মনে করেন এই সাতটি খন্ড হল সমাকামী সমাজের ধারাবাহিক পর্ব । উনিশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দির শুরু পর্যন্ত এই বিশাল পটভুমিকায় লেখা এই উপন্যাসটি কথাসাহিত্যের ইতিহাসে অবাক করা একটি ঘটনা। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯২৭ সময়টাও ছিল বিস্তৃত। প্রুস্ত এর মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত তিনি এই উপন্যাসটি নিয়ে কাজ করেছেন। কথাসাহিত্যক এডমন্ড হোয়াইট এর ভাষায়, “ বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্যেখযোগ্য উচ্চশ্রেণীর একটি উপন্যাস”।
কী ছিল সে উপন্যাসটিতে যে প্রকাশকগণ প্রকাশ করতে এত ভয় পেয়েছিলেন? উপন্যাসে একটি জনপদ, সে জনপদের ঘেরা কিছু মানুষের হুংকার এবং একই সঙ্গে আর্তচিৎকার, প্রেম আর অপ্রেমখেলা, সমকামিতা, মানুষের স্বপ্ন, হতাশা, হাহাকার সবকিছুর মিশেল এ উপন্যাসটি প্রুস্তের লেখালেখির জগৎকে আও বেশি সমৃদ্ধ করেছিল। তাঁর এ উপন্যাসে প্রুস্তের শৈশব, তাঁর গ্রামের বাড়ির মানুষদের বিচিত্র ভাবনা এবং সে সমাজের খ-চিত্র তুলে এনেছিলেন। সন্দেহ নেই প্রুস্ত তাঁর সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন। তিনি উপন্যাসে তাঁর নিজের জীবনের সমকামী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তবে সেখানে তিনি বিষয়টি এমনভাবে সংযোজন ঘটিয়েছিলেন যে সমকামিতা উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে নারীর প্রতি পুরুষের সহজাত প্রেম-ভালোবাসা অন্যদিকে পুরুষের প্রতিও সমানভাবে শরীরিক আকর্ষণ এ মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে অসাধারণ শিল্পের তুলিতে উপন্যাসটিতে তুলে এনেছিলেন।
প্রুস্ত নিজে এ বিষয়ে খোলামেলা আলাপ না করলেও তাঁর লেখায় সমকামী প্রসঙ্গ বারবার চলে এসেছে। তাঁর এ গ্রন্থে কয়েকটি প্রধান চরিত্র এসেছে যারা ছিলেন সমকামী অথবা উভগামী। প্রুস্ত ধর্ম নিয়ে যারা গোঁড়া বা মুনি-ঋষি তাদের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিকে থেকে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের তৃতীয় রিপাবলিক মতবাদের মানুষ। তাঁর বিশ্বাস হলো মানুষের মন বন্ধনহীন। মানুষের চিন্তাও বন্ধনহীন। এবং মানুষের এ মুক্ত চিন্তাকে ধর্ম বা পুরুত কে নোভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। পারে না।
প্রুস্ত ব্যাক্তিগত জীবনে সমকামী ছিলেন কি ছিলেন না সেটি আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি একটি উপন্যাস দিয়ে তাঁর সময় ও সমাজকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পেরেছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, প্রুস্ত ছিলেন ফ্রান্সের অভিজাত একটি শ্রেণীর ফসল। তাঁর কৌলিন্যের কারণে সমকামিতাকে সমাজের সামনে টেনে তুলে ধরা এত সহজ ছিল না। আমরা জানি ব্যাক্তিগত জীবনে প্রুস্ত সমকামী ছিলেন। অন্তত তাঁর জীবনীকার এবং নিজের জীবনভিত্তিক উপন্যাস সে কথাই প্রমাণ দেয়। যদিও প্রুস্ত নিজে এ বিষয়ে কখনো মুখ খুলেননি। কারণ বিষয়টি ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। জানা যায় প্রুস্তের সঙ্গে সংগীতজ্ঞ রেনালদো হানের একটি প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তা ছাড়া তাঁর একান্ত সচিব আলফ্রেড আগস্টিনেলির সাথেও একটা রোমান্সের সম্পর্ক ছিল। ১৯১৮ সালের ১১ জানুয়ারি প্যারিসের রাস্তায় পুলিশের এক অভিযানে সমকামী যৌনপল্লি থেকে প্রুস্তকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রুস্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি পল মোরাঁদ তাঁর জার্নালে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘প্রুস্ত সমকামীদের খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। এটি তাঁর জন্য একটি অ্যাডভ্যাঞ্চার ছাড়া আর কিছুই নয়।’
বিষয়বস্তু ভাবনা এবং নতুনত্বে À la recherche du temps perdu (In search of lost time) সন্দেহ নেই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কথাসাহিত্য। আধুনিক কথাসাহিত্য-যাত্রায় এ উপন্যাসটিকে বলা হয় অন্যতম মাইল ফলক। আগেই উল্লেখ করেছি তিনি উপন্যাসটিতে তাঁর অতীত জীবনের অভিজ্ঞতা এমনভাবে মিশিয়েছেন যে তা ছিল তৎকালীন পরিধি থেকে অনেক পথ এগিয়ে। মানুষের জীবনের ভিন্নমুখী অভিজ্ঞতা, ভালোবাসাহীন জীবনের কান্না, হাহাকার, পাপপুণ্যের ভীতি, নৈতিকতা, মানুষের বিচিত্র মনের সৌন্দর্যের জন্য আকুতি সবকিছুর অসাধারণ শিল্পীত প্রকাশ ঘটেছে এ উপন্যাসে। এটাই মার্সেল প্রুস্তের নিজস্ব ঢং। প্রুস্ত তাঁর সাহিত্যে ঠিক এ বিষয়গুলোই তুলে এনেছেন।
প্রুস্তের সাহিত্য পাঠের প্রধান বাণী হলো ভালোবাসা, শিল্প, সময় ও স্মৃতি। এ কয়টি বিষয় অসাধারণ দক্ষতার সাথে তাঁর প্রতিটা সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। উপন্যাসের শুরুতেই প্রুস্তের নিজস্ব একটা গতিময় শুরু আছে। সেটি হলো সংগীত ও শিল্পের একীভূতকরণ। তাঁর উপন্যাস পড়লে পাঠক নিজেই নিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হন, ‘আমি কে? আমার আত্মপরিচয় কী?’
পৃথিবীর জাঁদরেল কথাসাহিত্যিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে প্রুস্ত মানুষের মনের গভীরে যেতে পেরেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্যের শক্তি দিয়ে। তিনি সমাজের সাজানো চরিত্রটিকে ভেঙে দিতে পেরেছেন এবং সেখানে মানুষের বিচিত্র মনকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর উপন্যাসে আরেকটি বিষয় হলো শৈশবের স্মৃতিময় গল্পগুলোকে খুঁড়ে খুঁড়ে নতুনভাবে আবিষ্কার করা। আবার সে গল্পগুলোর সঙ্গে বর্তমান সময়ের যোগসাজস ঘটিয়ে নতুন একটি পরিচয় নির্মাণ করা।
প্রুস্তের সাহিত্যের গঠন ও পঠন বুঝতে হলে বুঝতে হবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ককে। বুঝতে হবে সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটও। লেখক চরিত্রগুলোকে নিয়ে নানাভাবে গড়েছেন আবার নানা রকম ঘটনার জন্মও দিয়েছেন। লেখক নিজেই যেন নিজেকে ভেঙে একটি নতুন চরিত্র তৈরি করছেন। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আর প্রতিটা চরিত্রের রযেছে নিজস্ব ভাষাও। À la recherché গ্রন্থে যেমন লেখক নিজেই নিজের চরিত্রকে নানাভাবে উপাস্থাপন করেছেন। যে বিষয়গুলো সমাজ এখনো নিতে পারছে না তা তিনি অবলীলায় সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন। একজন মানুষের চিন্তার ক্ষমতা যত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে প্রুস্ত সে অবধি তাঁর কথাসাহিত্যের সীমানা তৈরে করেছেন। মানুষের ভাবনার স্বাধীনতা প্রুস্তের সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে মানুষ তখন হয়ে ওঠে শিল্প নির্মাণের অনন্য কারিগর। সন্দেহ নেই প্রুস্ত সে কারিগরদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যে তিনি তাঁর নিজের স্বাতন্ত্র্য, গতি, শক্তি, ক্ষমতা, মেটাফোর এবং একই সঙ্গে জীবন বাস্তবতার ছবিটি অনেক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
=====================================
আদনান সৈয়দ: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
******************************************************