মাটির টান
পলি শাহীনা
‘ সবক’টা জানালা খুলে দাও না
আমি গাইব, গাইব বিজয়েরই গান।
ওরা আসবে চুপি চুপি,
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ। ’
রান্নাঘরে মা গুণগুণ করে গাইছেন। এটা মায়ের খুব পছন্দের গান। তাঁর গানের কথাগুলো স্পষ্ট বুঝা না গেলেও সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বাবার হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ, চুমুক দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যান। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বাবা এগিয়ে যান রান্নাঘরের দিকে। মা তখনো খালি গলায় আপনমনে গেয়ে চলছেন – ‘চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু, এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই।’ এবার বাবাও মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সুর করে গাইতে থাকেন। ঘরের ওপর ছাতার মতো ছায়া দেয়া বাগান বিলাস গাছের ফাঁকফোকর গলে বারান্দায় সূর্যের আলো এসে পড়েছে। সেখানটায় চাদর মুড়ি দিয়ে খেজুর গুঁড়ের সঙ্গে গরম রুটি খেতে খেতে দাদা রোদ পোহান। দাদার চাদরের উষ্ণতায় বসে তন্ময় হয়ে আমি বাবা-মা’র গান শুনছি। ভোরের বাতাসে একটা মিঠে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। দেখি, ডান দিকের জানালার শার্সিতে নিরিবিলি বসে আছে একটা নীল পাখি। দাদা বললেন, নীল বিষের চিহ্ন! নীল পাখি তার নীল ঠোঁটে নীল পান করে নেয়! মনোযোগ দিয়ে দাদার কথা শুনছিলাম আর নীল পাখিটি দেখছিলাম, ঠিক এই সময় লোহার গেটের তীব্র ঠকঠক শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
ঘুম ভেঙে বাইরের গমগম আওয়াজে বুঝতে পারি, ওঁরা চলে এসেছে। এরমধ্যে মা এসেও তাড়া দিয়ে গেছেন, দ্রুত ওঠে ফ্রেশ হয়ে যেন ঘরের বাইরে আসি। শীতের দিনে কম্বলের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে যে কিছুটা সময় লাগে, কীভাবে যে মাকে সেটা বুঝাই! উঠবো উঠবো করেও আরো বেশ কিছুটা সময় কম্বলের সঙ্গে আলসেমি উদযাপন করি। এই সময় ছোটবেলার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। টিন শেড চৌচালা ঘরের বারান্দায় রোজ সকাল-সন্ধ্যায় কবিতা-গান-পুঁথির আসর বসতো। দাদা পুঁথি পাঠ করতেন। বাবা-মা কখনো গাইতেন, কখনো বা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের কবিতা পড়তেন। সোহান ভাই আর ছোট্ট আমি চুপচাপ মুগ্ধ হয়ে তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম, শুনতাম। সোহান ভাই মাঝেমধ্যে দাদার সঙ্গে পুঁথি পাঠে অংশ নিতো। আড্ডা শেষে দেখতাম, দাদা নিঃসীম শূন্যতায় উদ্দেশ্যহীন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন, আর বাবা উঠোনে নেমে এদিক-ওদিক দ্রুত পায়চারী করতেন। শীতের দিনেও তাঁর মুখে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করতে দেখেছি। মা ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা। অথচ, এর মাঝখানে স্রোতের মতো অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। বাবার মৃত্যু, সোহান ভাইয়ের বিদেশে চলে যাওয়া, আমার বিয়ে, সবমিলিয়ে এই বাড়ির চিরাচরিত রুপ বদলে গেছে সেই কবে। এত বছর পরও ছবির মতো অতীত ঘটনাগুলো চোখের মণিতে এসে ভীড় করে। ভীষণ ইচ্ছে করছে ফেলে আসা দৃশ্যের কাছে ফিরে যেতে, ফেরা হয় না। জীবন একমুখী, বিকেলের বাঁকে কখনো সকালের রোদ খেলে না। সময়ের নদীতে কেবলই ভাটার টান!
মায়ের হাঁক পাকে স্মৃতির পাতা ওল্টানো বন্ধ করে দ্রুত কক্ষ থেকে ঘরের বাইরে এসে আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। ইতিহাসে আমি ভালো হলেও অংকে বরাবর কাঁচা। অংক বুঝাতে গিয়ে আমাদের গৃহ শিক্ষক সবসময় বলতেন, আমার মাথায় গোবর ছাড়া নাকি আর অন্য কিছু নেই। শিক্ষকের কথা শুনে নানু হাসতে হাসতে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলতেন, মাথায় গোবর বলেই তো চুল এত ঘণ, আর বড়। আমাদের দেশে অংক জানা হলো মেধার সর্বোচ্চ ধাপ। বঙ্গদেশে জন্ম নেয়া মেধাহীন আমি ঘরের বাইরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো মানুষ গুণতে গুণতে হাঁপিয়ে উঠি। গতকাল মায়ের তৈরি করা একশো ব্যাগ চাল-ডাল, এবং একশো কম্বল শতাধিক মানুষের মধ্যে কীভাবে ভাগ করবেন, ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ততক্ষণে হিমাঙ্কের নীচে।
বোধ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছি, প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বাবা তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে শীতবস্ত্র দেন। শুনেছি, এই কাজটা দাদা শুরু করেছিলেন। দাদা গত হওয়ার পর বাবা এই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখেন, এখন মা করেন। এই বাড়ীর শরীরে লেগে থাকা অনেক সংস্কার সময়ের আবর্তে মুছে গেলেও ১৬ ডিসেম্বর শীত বস্ত্র দেয়ার রীতিটি জীর্ণ শরীরে মা এখনো ধরে রেখেছেন। মায়ের অনুপস্থিতিতে সোহান ভাই, কিংবা আমি এই ধারাটি ধরে রাখবো কী না, জানি না। মা আমাদের জীবনে কখনো থাকবেন না, প্রকৃতির এই অমোঘ চক্রটি ভেবে বুক ধক করে ওঠে। মায়ের শরীরটা অনেক ভেঙে পড়েছে। বাবা চলে যাওয়ার পর গানের পরিবর্তে মাকে দেখি যখন তখন কারণে-অকারণে কান্না করেন। নিষ্পত্র গাছের মতো কেমন ধূসর হয়ে পড়েছেন। একদম হাসেন না, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকেন। ‘ চল শুভ্রা কাজ শুরু করি ’ ঘাড়ের কাছে মায়ের ডাক পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে আসি। মা, এইতো দেখছি মানুষের সমুদ্র, একশোটা ব্যাগ কেমন করে দিবে এত মানুষের মধ্যে? আমার মাথা তো লাটিমের মতো ঘুরছে। আমার কথা শুনে মা দীর্ঘশ্বাস টেনে বলেন, ‘ ওরা কেউ সাধ করে আসে নি। অসহায় মানুষগুলো শীতের কষ্টে দূরদূরান্ত থেকে এসেছে। তাঁদের অনেককেই আমি বলি নি, চিনিও না। এত মানুষ দেখে আমিও চিন্তিত, কিন্তু কিছু করার নেই। সোহান থাকলে ভালো হতো আজ।’
মা-মেয়ে নিঃশব্দে কিছু সময় মুখ চাওয়া-চাওয়ি শেষে গেট খুলে যা ছিল আমাদের ভান্ডারে তা নিয়ে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। লক্ষ্য করি, চাদরে মোড়া মা শীতের মধ্যে ঘামছেন। সবগুলো ব্যাগ শেষ হয়ে গেলে মা নগদ টাকা সহ ঘরের কিছু সরঞ্জামাদি দিয়ে সেদিনের মতো ব্যাকুল চোখের মানুষদের বিদায় জানান।
শীতের বিকেল তখন পাতলা আঁধারের কাছে সমর্পণের পথে। মায়ের মুখটা বড় ক্লান্ত দেখায়। প্রতি বছর এই দিনে শীতবস্ত্র দেয়ার আগে মায়ের চোখেমুখে যতটা আনন্দ থাকে, দেয়ার পর কয়েকদিন তিনি কেমন নিষ্প্রাণ, অন্যরকম হয়ে থাকেন। কেন এমনটা হয়, জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাই নি। মা কখনো বিষন্ন, কখনো প্রাণবন্ত, কখনো বা অভিমানী। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সন্তান হয়েও মায়ের মনের মানচিত্র আজো ভালোভাবে জানি না। ধীরে ধীরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে মাকে বিশ্রাম নিতে বলে নিজের কক্ষে ফিরে যাই। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে কখন যে ঘুমের দেশে কাদা হয়ে যাই, টের পাই না।
মুখের উপর টুপটাপ পানির ফোঁটার স্পর্শে জেগে উঠি। চোখ মেলে দেখি, আমার মুখের উপর মায়ের কান্না ভেজা মুখ। ‘একটু ওঠ মা, যেতে হবে।’ এত রাতে কোথায় যাব, বলে লাফ দিয়ে আমি শোয়া থেকে উঠে বসি। মা বিছানার এক কোণে বিষন্ন হয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখেমুখে তীব্র কষ্টের ছায়া। কিছুই বলছেন না, শুধু চোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো অশ্রু ঝরছে। এমন এক অবস্থায় মা বসে আছেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে মানুষ মনে হয় না, মনে হয় পাথর। রাণীর মতো আমার ঐশ্বর্যময়ী মাকে এমন করুণ ভাবে কাঁদতে দেখে আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কী বলে সান্ত্বনা দেবো, সেই ভাষা খুঁজে না পেয়ে সোজা বললাম, চলো মা।
মায়ের হাতে টর্চ লাইট আর কম্বলের ব্যাগ, আমার হাতে আরেকটা ব্যাগ, আমরা পাশাপাশি হাঁটছি। দিনের বেলায় মা কখন চাল-ডাল, আর কম্বলের একটা ব্যাগ সরিয়ে রেখেছিলেন, খেয়াল করি নি। শুভ্র কাফনের কাপড়ের মতো কুয়াশা ঢেকে রেখেছে সমস্ত চরাচর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা ছাড়া পথে আর কোনো জনমানব নেই। থেমে থেমে দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছিল কানে। পড়াশোনার জন্য অনেক বছর আগে এই গ্রাম, বাড়ি ছেড়েছিলাম, আর ফেরা হয় নি। মাঝেমধ্যে অতিথির মতো এসেছি, চলে গিয়েছি। ভাবছি, ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনের ব্যস্ততায় ডুবে অনেক বছর ধরে শুধু বাড়ি নয়, মা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। কাজের জায়গায় আমি সফল হলেও সম্পর্কের জায়গায় অসফলতা এই গভীর রাতে আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ব্যস্ততা আমাকে মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে ভেবে বুকের গহীনে একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে।
মাকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেশ কিছু দূরে একটা বড় বেড়ি বাঁধের পূর্ব পাশের বাঁশ ঝাড়ের কোণে একটা ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে থামি। এমন রাতবিরেতে একটা ভয় ঘিরে ধরে আমাকে। মা কোথায় এলেন, কিছু না বুঝে আমার মাথাটা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘কালুর মা ‘ বলে বারকয়েক ডাকার পর ভেতর থেকে দরজা খুলে যায়। লাঠিতে ভর দিয়ে ছেঁড়াফাঁড়া শাড়িতে বেরিয়ে আসা কালুর মায়ের দিকে তাকিয়ে পথের পাঁচালী সিনেমার ইন্দির ঠাকুরণের মুখটা ভেসে ওঠে আমার চোখে। কুঁজো হয়ে হাঁটা, চুল, মুখের আদল, দৃষ্টি, সব মিলিয়ে অনেক মিল, আপনমনে আওড়াতে থাকি। আমার মা আর কালুর মা, তাঁরা একে অপরকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ অনড় হয়ে ছিলেন। অন্ধকারেও আমি তাঁদের মুখের উজ্জ্বলতা দেখতে পাই। বাঁশ ঝাড়ে রাতজাগা পাখিরা তখন নিঃস্তব্ধতা ভেঙে তুমুল বেগে শিস দিয়ে যাচ্ছে। কালুর মা মাদুর বিছিয়ে আমাদেরকে বসতে দেন, মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে আদর করেন। কুপির আলোয় কিছু সময় তাঁরা গল্প করেন। গল্পের পাট চুকে গেলে কালুর মা’র থেকে বিদায় নিয়ে টর্চের আলোয় ভরসা করে আমরা অন্ধকার সাঁতরে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকি।
বাড়ি পৌঁছে মায়ের মুখে একটা প্রশান্তির প্রলেপ দেখতে পাই। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তিনি যেন সদ্য সশরীরে স্বর্গ আরোহন শেষে মর্ত্যে ফিরে এসেছেন। তাঁর মন প্রফুল্ল দেখে পাশে শুয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করি,
• কে এই কালুর মা?
• তিনি একজন বীরাঙ্গনা।
মায়ের উত্তর শুনে বিহবল হয়ে পড়ি। লক্ষ্য করি, মায়ের হাত মুষ্টিবদ্ধ, খানিক আগের তাঁর উজ্জ্বল মুখখানা জখমি চাঁদের আলোর মতো ম্লান হয়ে যায়। কালুর মায়ের জন্য আমার মনে মেঘ জমে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজেকে সামলে পুনরায় জানতে চাই,
• তাঁর বয়স কত, মা? স্বামী, সন্তান কই?
• তাঁর বয়সের হিসেব আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারী তাঁর স্বামীকে হত্যা করেছে।
• কালু কই?
• কালুর ভালো নাম, কালাচাঁদ। বাপের রঙটা পেয়েছে ছেলে। মা আদর করে কালু বলে ডাকতো। ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার জের ধরে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সহিংসতা এই গ্রামেও ছড়িয়ে পড়লে কালু তখন ভারতে ওর আত্মীয় – স্বজনের কাছে চলে যায়।
• কালুর মা যায় নি কেন?
• মাটির টানে যায় নি। যে মাটির বুকে তাঁর স্বামী চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছেন, সে মাটিতে তিনিও ঘুমাতে চান, এবং এটাই তাঁর অন্তিম ইচ্ছে। কালু মাকে সঙ্গে নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, তিনি যেতে রাজি হন নি।
• বয়স হয়েছে, তাঁর সংসার চলে কীভাবে?
• আগে তোর বাবা সাহায্য করতো। কালুর মা-ও গান শিখিয়ে কিছু অর্থ পেতো। আমি তাঁর কাছেই গান শিখেছিলাম। বহু আগের কথা হলেও তখন ভালো দিন ছিল। মানুষ সংস্কৃতিমনা ছিল। হিন্দু – মুসলমান ভাই ভাই ছিল। এখন দেশটা, সময়টা অন্যরকম হয়ে গেছে। হুজুর নির্দেশ দিয়েছেন, কালুর মা যেন গ্রামের বাচ্চাদের গান না শেখান। অবশ্য, বয়সের ভারে শারীরিক, মানসিকভাবে তিনিও ভেঙে পড়েছেন।
• এখন তাহলে কীভাবে চলে তাঁর?
• সোহান আর তোর সাহায্যে।
• বুঝলাম না!
• বিভিন্ন উৎসবে তোরা আমাকে যা টাকা পয়সা দিস, আর যা তোদের থেকে চেয়ে নিই, সেখান থেকে তাঁকে সাহায্য করি।
• তাঁর প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে অবাক হচ্ছি, মা!
• কালুর মায়ের রক্ত পান করেছি, তাই তাকে এত ভালোবাসি। মৃত্যু অবধি তাঁর প্রতি আমার ঋণ পরিশোধ হবে না।
• কী বলছ এসব?
• হ্যাঁ, আমি আর কালুর মা একই ক্যাম্পে বন্দী ছিলাম। রাতভর মিলিটারী আর রাজাকারের অত্যাচারে প্রায় বেহুঁশ আমি, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, মনে হচ্ছিল মারা যাচ্ছি, তখন পাশে পড়ে কাতরাতে থাকা কালুর মায়ের ঠোঁট ফাটা রক্ত জিভ দিয়ে টেনে পান করে গলা ভিজিয়েছি। কালুর মায়ের রক্ত পান করে সেদিন আমার জীবন বেঁচেছিল। আমার এই নরক যন্ত্রনা বাসের কথা জানে শুধু তোর মুক্তিযোদ্ধা বাবা, আর তোর নানা-নানি।
• যে শরীরে আমার জন্ম, এতদিন কেন সেই শরীরের নিদারুণ কষ্টগুলোর কথা ভাগ করে নাও নি, কেন জানাও নি, মা?
• তোর বাবার বারণ ছিল। আর ক’দিন বাঁচব, জানি না। সোহান বিদেশে চলে যাওয়ায় স্বস্তি পেয়েছি। তুই দেশে আছিস, আজ আমার মনে হলো তোর জানা দরকার, তুই একজন বীরাঙ্গনার সন্তান।
ফজরের আজান শুনে মা উঠে যান নামাজ পড়ার জন্য। ঘরের ভেতর আমার দম নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে বেরিয়ে পড়ি খোলা আকাশের নিচে, উঠোনে। দাদার মতো শূন্যে তাকিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলে বুকের চাপ কিছুটা কমে আসে। জানালার শার্সিতে ছোটবেলায় দেখা নীল পাখিটি খুঁজতে থাকি। আমার ইচ্ছে করে, নীল পাখি হয়ে মায়ের সমস্ত কষ্ট পান করে নিতে। আকাশ তখনো ফর্সা হয় নি। ‘সবক’টা জানালা খুলে দাও না ’ অনেকদিন বাদে মা আজ গাইছেন। ধীরে ধীরে পুবাকাশে সূর্য ওঠে। প্রথম ভোরের কাঁচা আলোয় উবু হয়ে নারকেল পাতার শলা দিয়ে আমি মাটির বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকি। মা আমাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে সেই মানচিত্রের উপর চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ি ছিটিয়ে দেন।
********************************