মন্ত্রকাব্য নাকি ব্যক্তিক কাব্য …একটি শাশ্বত প্রশ্ন
পারমিতা ভৌমিক
মন্ত্রকাব্য আর ব্যক্তিককাব্য নিয়ে মননের আগে এ সম্পর্কে একটা ধারনা করে নিতে হয়। মন্ত্র মানেই সংহত ও শক্তিপূর্ণ। সেখান থেকেই কাব্যজার্নি শুরু। আজ এসে দাঁড়িয়েছি ব্যক্তিক কাব্যের দুয়ারে। অবধারিত বিবর্তনের পথে। বলাবাহুল্য এই আধুনিক ভাব ভাবনা চিন্তা মননের সামনে দাঁড়িয়েও প্রথম ঊষার কাব্যচেতনার রেশ মানুষের মন থেকে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায় নি।
আশ্চর্য এই যে পৃথিবীর কাব্যসাহিত্য পর্যালােচনা করলে দেখতে পাওয়া যাবে কবিরা কেউ কেউ সচেতন ভাবেই ফিরে পেতে চেয়েছেন আদিকাব্যের আগের কবিতা।
ফরাসি কবি ম্যালার্মে একেই সূত্রাকারে বলেছেন —জানতে চাও
হােমরের আগে কি আছে? আছে অর্ফিয়ুস।।
ম্যালার্মে চেয়েছিলেন অর্ফিক কাব্যকে ফিরিয়ে আনতে, যে কাব্যের জগতে মানুষের সঙ্গে দেবতার সংযােগ ছিল নিবিড়, একান্ত গভীর। সে কাব্যজগৎ ছিল মন্ত্রকাব্যের। মন্ত্র– শব্দটি উচ্চারণ করলেই মন চলে যায় বাল্মীকিরও অনেক অনেক যুগ আগে। সেখানে রয়েছে এক বিরাট কাব্য মঞ্জুষার নিদর্শন। আমরা জানি, বাল্মীকি একক প্রতিভার কবি। কিন্তু তার আগে কে বা কারা কবি ? আমরা এও জেনেছি সে তাে একজন নন, অসংখ্য। তখনই আমরা সাক্ষাৎ পেয়েছি কয়েক যুগব্যাপী এক শক্তিমান কবিমণ্ডলীর – উশনা, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, দীর্ঘতমা, বামদেব, মধুছন্দা, ঘােষা … ইত্যাদির।
একথা যথার্থই প্রণিধানযোগ্য যে গ্রীসের অর্ফিক বা এল্যুসিনীয় গুহ্যতত্ত্বের (orphic and Eleusinian Mysteries) খুব কম
নিদর্শনই পরবর্তী যুগে এসে পৌঁছেছে। তুলনায়, ভারতবর্যের ক্ষেত্রটি কিন্তু আলাদা। ভারতের প্রাচীন কাব্য ঐশ্বর্যের এক বিপুল আবেশ নানা ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও পুরােপুরি অবলুপ্ত হয়ে যায় নি। এখানেই ভারতবর্ষের শীর্ষতা।
আমাদের সৌভাগ্য যে বৈদিক সাহিত্যের একটা বিরাট এবং প্রধান অংশ আমরা প্রায় নিখুঁত অবস্থাতেই পেয়েছি। তাহলে, বাল্মীকিকে আদি কবি কেন বলা হল? এ এক প্রশ্ন বটে। এর তবে একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা ভাবতে পারি। বাল্মীকির কাব্যে ঋষিদৃষ্টির প্রকাশ আছে, তবে সর্বত্র নয় আর এই ঋষিদৃষ্টিই হল বৈদিক কাব্যের প্রধান কথা। বাল্মীকির কাব্যের স্বাতন্ত্র্য এই যে, ঋষিদৃষ্টি ছাড়াও পরে পরে ক্রমশ দেখা গেছে প্রাকৃত। মনের কল্পনা এসে স্থান অধিকার করেছে এখানে।
অবশ্য সেসব কল্পনা মিথ্যা নয়, কারণ কল্পনা কখনও সত্যকে আশ্রয় না করে গড়ে উঠতে পারে না। কিন্তু তাতে নেই বৈদিক কাব্যের মতাে উর্ধ্বতম সত্যের উজ্জ্বল প্রকাশ। এ কথা সত্য। একথা আধুনিক কবির্মণীষীরাও বলে গেছেন। তবে, বাল্মীকির কাব্যে, কিম্বা কালিদাসের কাব্যে মন্ত্র’ একেবারে নেই, এমন কথা বললে ভুল বলা হবে। কিন্তু তবুও একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সেই মন্ত্রস্বভাবটি সমস্ত কাব্যকে পরিব্যাপ্ত করে নেই। সেখানে মন্ত্রদীপ্তি এসেছে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুঝলকের মতাে।কতকটা ইতস্ততভাবে সে দীপ্তিরাজি ছড়ানাে রয়েছে সমগ্র কাব্যখানির মধ্যে।
তা হলে একথা স্পষ্ট যে মন্ত্ৰকাব্য ও প্রাকৃতকাব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট তফাৎ একটা আছে। বেদ হল সেই বাক্, যা মন্ত্র হয়ে জীবনের গুহ্যসত্যকে রূপ দিয়েছে চিত্রকল্পের আর প্রতীকের সহায়তায়। দিব্য সেই আবিষ্কার। সেখানেই প্রমূর্ত হয়েছে শব্দের অন্তর্নিহিত শক্তি। সে সব শব্দ দার্শনিক, যুক্তিবাদী বা রূপতাত্ত্বিক বুদ্ধির জগতের শব্দ নয়। সে সব শব্দ হল প্রজ্ঞায়ণ এবং প্রেরণাময় ছান্দিক অভিব্যক্তি। এর নামই ‘মন্ত্র’।
পরের যুগে কিন্তু আমরা ক্রমশ শব্দকে করে নিয়েছি প্রাকৃতমনের দাস। কবিরা শুদ্ধ সত্যের পরিবর্তে বুনেছেন সত্য অসত্যের স্বপ্নজাল। এটাকেই কেউ কেউ মানব মস্তিষ্কের অনিবার্য রূপান্তর ও অভিব্যক্তি বলে থাকেন। কাব্য যেখানে মন্ত্রস্বরূপ হয়ে ওঠে, বাক্ সেখানে স্বয়ং প্রকট করেন নিজের গােপনতম রূপটি। কবি সেখানে শ্রদ্ধায় সরে দাঁড়ান। বাক প্রমূর্ত হতে থাকেন। মন্ত্রসৃষ্টির এই রহস্য, এইই জন্মকথা। তাই একথা অনস্বীকার্য যে সমস্ত মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য অপৌরুষেয়।
বেদ মন্ত্রস্বরূপ, তাই বেদও অপৌরুষেয়। এইই সত্যিকার নৈর্ব্যক্তিকতা। সৃষ্টির মধ্যে যদি ব্যক্তিগত অস্মিতার ছাপ পড়ে তখন সেখানে কবি মন্ত্ৰকৃৎ ঋষি হয়ে উঠতে পারেন না কিছুতেই। কেবলমাত্র কবি হয়েই থাকেন। এই যে এখানে, পরবর্তীকালের কথা বলা হল, এখানেই দেখছি স্পষ্টতই কবি ও ঋষির মধ্যে তফাৎ-এর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বেদের যুগে এ পার্থক্য ছিলই না একেবারে।
সুতরাং বলা যেতে পারে আদিকবির সময় থেকেই এই পার্থক্যের সূত্রপাত ঘটেছে। বাল্মীকির আগে, বেদের যুগে, মন্ত্রকাব্য বা আর্ষকাব্য ছিল বিরাটের স্ফুট রূপ। পরের যুগে রইল তারই আস্বাদন মাত্র। পূর্ণ স্ফূটের পূর্ণশক্তির অনুভব নয় তা। কাশ্মিরী রূপতাত্ত্বিক ভট্টতৌত তাই বলেছেন ঋষিদৃষ্টি ছাড়া কাব্য অসম্ভব। একথা সত্য, কবি আর ঋষি একই সত্তার দুটো দিক মাত্র। তবে দুজনের কাজ কিন্তু আলাদা –কবির অন্তর্মধ্যস্থ ঋষিসত্তা দেখেন, আর কবিসত্তা তা বর্ণনা করেন।
কবিসত্তা ক্রিয়াশীল হলে হলে ব্যাক্তিক ঋষিসত্তাটি হবেন নীরব, মৌন। তাই আবার দেখি, ঋষিসত্তা না হলেও কবিসত্তা সম্পূর্ণতা পায় না অভিপ্রকাশের পথে। তা হলে একথা বলা যেতেই পারে ――
■কাব্য হল ঋষিদৃষ্টি আর কবিকৃতির সত্যকার সমন্বয়
একথা প্রনিধানযোগ্য যে বেদের কবিরা কোনাে অলংকার শাস্ত্র রচনা করেন নি, অথচ বেদের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে সেই সব গহন গহনা বা অলংকার যা নাকি মূল্যবান সব ইঙ্গিত ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকটিত হয়েছে এবং যা তাদের আশ্চর্য কবিকৃতির চিহ্নও বটে।বেদ অপৌরুষেয়, নৈর্ব্যক্তিক…তার মানে এই নয় যে, কবিরা বেদের ঋক রচনাকালে তাদের কবিকৃতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। বেদের কবিরা জানতেন বাক্ যেখানে স্বয়ং প্রকট, সেখানেকাব্য চিরন্তন হবেই। সে সব কবিতা ক্ষণস্থায়ী আনন্দের খােরাক হবে না।
বেদের মন্ত্রকাব্য ঋতাবরী। ঋতকে বহন করে নিয়ে চলেছে তা যুগ যুগান্তর ধরে। আবার দেখেছি, ব্যক্তিক প্রাকট্যের অভিঘাতে ভবভূতি খুঁজেছেন সমানধর্মাকে কিন্তু বৈদিক কবিরা বলেছেন অন্য কথা―― তাঁদের মতে শ্রোতা বা পাঠক যদি কাব্য বুঝতে না পারে তবে তা অনেকাংশে কবির দোষ, কেননা তাঁরা কবিতার কথা, বৃহতের শক্তি, ছন্দে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
কবি শব্দমধ্যে দিতে পারেন নি সেই শক্তি যা সব বাধাকে
ধ্বংস করে সহৃদয় সমাজের অন্তরে গিয়ে পৌঁছতে পারে।
অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে কবিরা বাক্যের সত্যতা থেকে দূরে সরে গেছেন। “সখায়ঃ সখ্যানি” জানতে—- আমাদের প্রাত্যহিক অসংস্কৃত বাক্যকে কবি তাঁর প্রজ্ঞাময় মন দ্বারা বিশােধিত করেন যখন, তখনই সখাগণের কাছে সেই বাক কল্যাণময়ী হয়ে পৌঁছে যায়।
অস্মিতাহীন কাব্যে কবি-মনের যে ছাপ পড়ে তা ভদ্রালক্ষ্মীর, তা কল্যাণের ছাপ। তাই সেসব শব্দও অপৌরুষেয়, অতএব সবার।
এইই হল জনপ্রিয়তার মৌল শর্ত। বেদ তাই আজো সবার কাব্য, তা একক ব্যক্তিত্বের দ্বারা সৃষ্ট নয় বলে।
কাব্য ও মন্ত্র এক কথা নয়,তবে কাব্যের মন্ত্র হয়ে ওঠাই উচিত। কাব্যের শ্রেষ্ঠ রূপ বা পরাকাষ্ঠা হল মন্ত্র। মন্ত্রেরই উৎস কাব্য।
অনেকক্ষেত্রেই মন্ত্রও দেখা দিয়েছে কাব্য হয় তবে সেরকম কম ঘটেছে। যেমন, গীতা, উপনিষদ বা বেদ হল সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যের পর্যায়ভুক্ত। প্রাকৃত বা লোকায়ত যে কোনাে রসময় রচনাই কবিত্বের মর্যাদায় বেদ, উপনিষদ, গীতাকে অতিক্রম করেনা, এমনকি আদি কবি বাল্মীকি, হােমর, শেকস্পীয়রের সাহিত্য বস্তুও না।কেউ একমত নাও হতে পারেন কিন্তু তাতে সত্য বদলাবে না।
আমরা জানি শিল্পসৌন্দর্য যে যতটা উচ্চস্তরের সে ততটাই নিজেকে লুকিয়ে রাধে ―― the highest art is to conceal art.” উপনিষদ কিম্বা গীতার কবি যে ভাবে আত্মগােপন করে রয়েছেন তা অত্যন্ত অদ্ভুত ও আকর্ষণীয়। বলাবাহুল্য এসব মন্ত্রকাব্য আস্বাদন করলে আমরা খেয়ালই করি না যে কবিত্বের চরম শিখরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তবুও স্বীকার করতেই হবে যে , কাব্য ও মন্ত্র – এই দু’ক্ষেত্রেই একটা সূক্ষ্ম সীমানা আছে, যদিও দুটিই বাকের প্রকাশ।
একদিকে বাক হয়ে ওঠে মন্ত্র, অন্যদিকে বাক্ হয়ে ওঠেকাব্য। বাক্য যখন আপনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জাহির করে না, যখন বাক কস্তুরীমৃগের মত আপন গন্ধে আপনি আত্মহারা হয় না; কেবল নিয়ে মনােহারিত্ব নয়, তাকে অন্তঃস্থ রসবস্তু বলে আস্বাদন করে, তাতেই যখন সে শরবৎ তন্ময় হয়ে থাকে তখন তার নির্দোষ বৈকুণ্ঠিত প্রকাশই হয় মন্ত্র।
আমরা এ আলোচনার ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখব যে , মন্ত্র মানেই অধ্যাত্ম সাধনা বা ধর্মতত্ত্ব বােঝাবে এমন নয়। বাল্মীকি, দান্তে, শেকসপীয়রে সহজ সাধারণ কথাও রসবস্তু হয়ে গেছে। অধ্যাত্মসাধনা বা ধর্মতত্ত্ব নেই তাতে। এইসব কাব্যে উপলব্ধি অনুভূতি ও অন্তর্নিহিত রসবস্তুর দোল ও রোল অত্যন্ত স্বচ্ছ ও বাহল্যবর্জিত হয়েছে।
মণ্ডনশিল্পের প্রাকট্যের স্থান এখানে নেই, বহিরঙ্গ সাজ জোর করে বা বাইরে থেকে কাব্যদেহে অতিরিক্ত হয়ে ওঠেনি।
প্রয়ােজন মতো নিয়ন্ত্রিত বস্তুর সঙ্গে থেকেও সেসব অঙ্গীভূত ও একীভূত হয়েছে।
কয়েকটি ছত্রের উদাহরণ দেয়া যাবে ――
(1) “And in this harsh world draw thy breath in pain… (Shakespeare. Hamke:
| Act-5 Scene2)
(2) অপহৃতা শচীং ভার্যাং মামেকমিন্দ্রস্য জীবিতুম।
ন চ রামস্য ভার্যাং মামোপনীয়াস্তি জীবিত।।
(বাল্মীকি থেকে) ইত্যাদি।
কবিগণের মধ্যে কালিদাস শ্রেষ্ঠ। তিনি কিন্তু কবিই। তিনি যখন বলেছেন-
বৈদেহি পশ্যামলয়াদ্বিভং
মৎসেতু ও ফেনিলমম্বুরাশিম্
ছায়াপথেন এব শরৎপ্রসন্ন
আকাশমাবিষ্কৃত চারুতরম্ ..’ (রঘুবংশ ১৩-২)
তখন আমরা চমৎকৃত হই। তবু একথা ঠিক যে, এ সেই বস্তু নয় যেখানে বাক স্তব্ধ চেতনাও সমাহিত। তবে কোথাও কোথাও কালিদাসেও ভাষা ও ভাব আর পৃথক করে অনুভব করা যায়নি , একথাও সত্য। ম্যাথু আর্নল্ড কবিওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্পর্কে এমন বলেছেন যে ওয়াডর্স্ওয়ার্থ যেখানেই কবিত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, কবিস্বয়ং সেখানে অন্তর্হিত হয়েছেন। সেখানে প্রকৃতি স্বয়ং এসে তা লিখে দিয়েছেন।
মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য যদি অপৌরুষেয়তা হয়, যদি তা নৈর্ব্যক্তিকতা হয়, তখনই কবি মন্ত্ৰকৃৎ স্রষ্টা হয়ে যান। সকলেই জেনেছি, অস্মিতার ছাপই সৃষ্টিকে মাকাব্য করে তােলে।
অতএব , আমরা বলতেই পারি, একশ্রেণির কবিদের কণ্ঠে মুখরিত ও উচ্চকিত হন ‘বৈখরী’ বাক্ স্বয়ং আর অপর শ্রেণীর কবিকণ্ঠে প্রকট ও প্রমূর্ত হন ‘পশ্যন্তি’ বাক্। বাংলার কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘বৈখরী’বাক। তবে পশ্যন্তি’বাক যা দুর্লভ তা থাকলেও তাকে আমরা
চিনতে পারি না সবসময়। আজকের এই আমাদের অভ্যস্ত চোখ কান ও কাব্যধারা ‘বৈখরী’ প্রকাশেই মগ্ন। সুন্দর কাব্য প্রচুর সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু ঋষি কবির আর্ষকাব্য কই? রবীন্দ্রনাথের কাব্যে কাব্যশক্তির পরমপ্রকাশ আছে কিন্তু ‘গীতাঞ্জলি’-তে ছাড়া মন্ত্রশক্তি কোথায়? এখানেই গীতাঞ্জলি স্বীকৃত এবং অমর। একথা কিছুতেই আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।
এ ছাড়াও বলি, আমাদের এই বিপুল কাব্যসৃষ্টির প্রকাশে আর্ষবাক্য কতটা মেলে?
আধুনিকের কাব্যভূমিতে নতুন ধারণা, নতুন ধরন, নতুন সংগ্রহ ও নতুন সব আবিষ্কার এসেছে, স্বীকার করতেই হয় অথচ
দরকার ছিল নতুন সৃষ্টির জন্য নতুন অনুপ্রেরণা। সে কোথায়???
অভিনব চিন্তাচাতুর্য আর অভিনব গঠনবৈদগ্ধ্য
―– এই দুটো প্রক্রিয়ার ওপর আধুনিকরা জোর দিলেন।
আধুনিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল ―― আত্মসচেতনতা ও তার আনুষঙ্গিক বৃত্তি রূপে আত্মবিশ্লেষণ।
প্রাচীন কবিরা সৃষ্টি করতেন একটা আবেগের বশে, নিরঙ্কুশ সে আবেগে প্রায় আত্মহারা হয়ে সৃজনক্রিয়া চলতো……..
infine frenzy rolling…।
আধুনিক সেখানে একটা সুচারু পরিকল্পনায় চলেন। আধুনিকরা, আত্মচেতন ও বিশ্বচেতন, দুইই। কবিচিত্তে বিভিন্ন স্তর জমা হয়েছে এভাবেই। দেশে ও কালে ভূগােলও ইতিহাসের জ্ঞান এবং সমগ্র অতীত বিবর্তনের এক প্রকার অনুভূতি ও উপলব্ধি আধুনিকের
চেতনায় সঞ্চিত হতে থেকেছে। মানবপ্রবাহের মাইক্রোচিপে তা স্টোর হতে থেকেছে। এভাবেই তাঁদের কবিতা হয়ে উঠেছে বহুস্তরীয়।
আধুনিকের দৃষ্টি আজ আর কেবল মাত্র আকাশে, বাতাসে, আলােয় বিচরণ করছে না। তার নজর এখন ভূতলে ও পাতালেও। মানুষের উত্তমাঙ্গ, তার জ্ঞান, তার আস্তিক্যবুদ্ধি, তার হৃদয়বার্তা আজ আধুনিকের কাছে কেবলমাত্র অকারণ শােভা মনে হয়েছে।
পরিণামে, প্রাতিভাসিক বস্তুর তলায় তারা খুঁজেছে কেবল ক্লেদ আর বিষ। (পাঠক এ আমার অনুভব ক্ষমা করবেন )
তপস্বীর তপস্যায়, সাধুর সাধুত্বে, কবির কবিত্বেও আজ আর মানুষের সহজ পরিচয় প্রকাশিত হয় না।
এখন মানুষের স্বরূপ খোঁজা হয় তার Libido, তার Oedipus Complex এর মধ্যে। জীবন আজ সেইমতো চলছে বলেই, সাহিত্যে তাইই আসছে অকুণ্ঠভাবে।আসবেই। আসতেই হবে। সাহিত্য জীবনের দর্পণ। আধুনিকেরও অবশ্যই নিজস্ব মত, পথ, আদর্শ আছে তবে তা তাদের নিজস্ব পথ ও ধরনের মধ্যেই আটকে গেছে। জানি অনেকেই একথায় একমত হবেন না। আমাকে পুরোনোচিন্তক বলে উড়িয়ে দেবেন। সবাইকে পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি আমি শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে সত্যের কথাই বলতে চাইছি। অবচেতনা ও নিশ্চেতনার স্থূল জাগরণেই মাটির পৃথিবীর জড়ের মধ্যে অন্তর্গূঢ় প্রাণের সংবেদনা ও তার স্পন্দন জেগেছে আজ, জেগেছে আধুনিকদের মধ্যে। মানুষ বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে তার প্রাণময়সত্তা কি চায়, সেই ভাবনাতে। এই প্রাণময় চেতনাজাত আকুতি আধুনিকের একটা বৈশিষ্ট্যও বটে।
প্রাচীন ও আধুনিকের কবিদৃষ্টির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। প্রাচীন আমরা কবিদের সচরাচর বলি classical কবি। এঁদের দৃষ্টির বৈশিষ্ট্য হল দ্রষ্টাভাব, সাক্ষীভাব। বস্তু, বিষয় ও সত্যকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখে যাওয়া ও তার প্রতিমূর্তি রচনা করা এঁদের সাধনা ছিল।
যা দেখছেন ধ্রুপদী কবিরা তার মধ্যেই খুঁজে পেতেন এক অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। একেই শিল্পরূপ দেন classical-রা। এই রীতিতে পাই প্রশান্ত স্থিতি। তার মানে অবশ্য এই নয় যে classic-এ কারুণ্য বা বিষাদভাব নেই। তবে তাঁরা ট্রাজেডিকেও গ্রহণ করতেন স্থির সত্য বলেই। তাকেই তাঁরা রূপ দিয়েছেন অকম্পিত রেখায়। এঁরা স্থৈর্যশীল দৃষ্টিতে সব দেখতেন। এই উদারচেতনা, প্রশান্তি, নির্বিকার ঔদাসীন্যে প্রথম বিক্ষোভ, অস্বচ্ছতা আনলেন Romantic–রা।
এঁরা বস্তুকে as it is – গ্রহণ না করে চাইলেন বাইরের বস্তুর পরিবর্তন। শুধু বিষয়ীর নয়, বিষয়ের পরিবর্তন ও রূপান্তর চাইলেন। এঁরা সে অর্থে বিদ্রোহী বটে। অনেকেই এঁদের সমালােচনা করে বলেন Satanic poets…। রোমান্টিকের যন্ত্রণা আছে নিজস্ব। তাঁদের স্থিতিচ্যুতির যন্ত্রণা। প্রাচীন কবিরা সত্য ও সুন্দরের স্থিতির মূর্তি গড়েছেন, তারই গতিমান মূর্তির আবিষ্কার করেছেন আধুনিকরা। আধুনিকের আলোচনা অন্যত্র করা যাবে।।