ভাত দে
অলকানন্দা রায়
আমারে একটু পানি দিবা? নামাজের সময় ওইয়া গ্যালো জ্ঞা…। ক্যারা যাও এইহান দিয়া? ও বউ হুনছো…? ও সকিনার মাও, কতক্ষণ ধইরা ডাকতাছি হুনোও না। তোমরা এবা ক্যা? আমি বুড়া অইয়া গেছি। হাত রথ গেছে সুমসারে আমার আর কদর নাই। বুঝবা বুঝবা! দিন তুমগোরও আবো। হক্কল হিসাবই তহন মিটান নাগবো।
ওই সামিনা, সকিনারে হুনছস! ফাঁডা কপাল! ওই ছেড়া সবজল… এক নাগাড়ে ডাকতে ডাকতে মিইয়ে আসে নব্বই কী পঁচানব্বই পেরুনো বৃদ্ধ মোয়া খাঁর গলা। তার ঘরের কোণা-কানচিতে টুক-পলান্তি খেলছে তারই নাতি নাতনি আমিনা, শরিফা, সামিনা, ছকিনা, বুলবুলি, সবজলদের বিশাল দল।
ঘরের সামনে দিয়ে এ কাজে, ও কাজে হনহনিয়ে যাচ্ছে আসছে ছেলে বউরাসহ তার নিজের বউও। তাদের কাঁখে ধান ভর্তি ধামা। হয় বারবাড়িতে শুকাতে নিয়ে যাচ্ছে নয়তো শুকনো ধান ঘরের গোলায় তুলতে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। নয়তো যেখানে সদ্যই কামলারা ক্ষেত থেকে কেটে এনে তেলের ড্রামে বা শক্ত কাঠের ওপর পিটিয়ে পিটিয়ে আঁটি থেকে ধান ছাড়াচ্ছে সেখান থেকে ভেজা ভেজা ধান তুলে নিয়ে যাচ্ছে খোলায়, দক্ষিণা ফিনফিনে বাতাসে ধান উড়িয়ে খড়-কুটো পরিস্কার করতে। আবার সেই পরিস্কার ধান তুলে নিয়ে উঠোনের রোদে ছড়িয়ে দিচ্ছে শুকাতে। একটু পর পর আবার ছুটে আসছে সেই ছড়ানো ধান দু’পায়ের নিপুণ কায়দায় উল্টেপাল্টে দিতে। যাতে সমান ভাবে শুকোয় প্রত্যেকটা ধান। ধানগুলো চড়া রোদের আঁচে খসখসে সোনা রঙ খোসার ভেতরের শাঁসটা শুকিয়ে শক্ত দানা হলে তবেই না নোটে ফেলে রাতজুড়ে বাড়ির বউ, ঝি মিলে ঢেঁকিতে পাড়ের পর পাড় দিলে বেরিয়ে আসবে চাল। সেই চালই আবার হাঁড়িতে মাপা জল, তাপে সেদ্ধ করলে উথলে ওঠা ঘন ফ্যানের ভেতর উঁকি দেবে ভাত। আহা! ভাত। সাদা সাদা ভাত। বিলের জলে সাত সকালে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের পাপড়ির মতো সাদা!
এতটুকু জিরোবার সময় নেই কারো হাতে। না বউ, না ছেলে, না বৌমাদের, না নাতি-নাতনিদের। সকলেই এদিক দিয়ে যাওয়া আসার পথে শুনতে পায় ‘‘কেউ একটু ওজুর পানি দিবা গো?” কিন্তু কারো এক চিমটি সময় নেই অশতিপর সেই সাথে অকর্মন্য বৃদ্ধের ডাকে তৎক্ষনাৎ সাড়া দেবার।
নাতি-নাতনিরা খুব যে ছোট তা নয় আবার খুব যে বড় তাও নয়। বৃদ্ধ দাদার ওজুর পানি তারা এনে দিতে পারে এতটা বড় তারা হয়েছে। ক’ আঁটি ধানও তারা কাটতে পারবে। মাথায় তুলে বাড়ি বয়ে আনতেও পারবে। এমন প্রায় সব বাড়ির ছেলেমেয়েরাই হাত পা একটু বড় হতেই করে থাকে। আসলে তাদের করতে হয়! এদের বাবা-মা চুলের ঝুঁটি ধরে কাজে নামায় না তবে আরেক বাড়ির ছেলেটা মেয়েটা বড় হয়ে গেছে তবুও কাজ করে কম তা নিয়ে বিস্তর কানাঘুষো করে।
সাত গাঁয়ের ডাকাবুকো ঝগড়– মানুষটি তাদের দাদী হওয়া সত্তে¡ও নাতি নাতনিরা কেমন করে যেন ছাড়া পেয়ে তাই খেলছে তো খেলছেই। তবে খেলাই যে তাদের কাজ তা নয় চরম ঝগড়া-ঝাটি, কুটনামি, বদনাম, অন্যের খেলনাবাটি চুরিতে তারা সিদ্ধহস্ত। গালাগাল- গলাবাজিতে দাদীর ওপরে!
এত কিছুর চাপে তাদের সময় হয় না বুড়ো মোয়া খাঁর ওজুর পানি এনে দিতে। ইচ্ছেও করে না তাদের।
মোয়া খাঁ ফের ডাকতে থাকে ‘‘একটু ওজুর পানি দেও গো… বেইল পইড়া গ্যালো… খিদা নাগছে।
ওই ওই ছেড়ি তুই কেড়ারে? গোসাইর বুইনে? একটু ইনু আহেক ছে! টিপ টিপ পায়ে এগিয়ে যায় ও বাড়ির গোসাইর বোনটা। লাঠি হাতে চৌকির কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে মোয়া খাঁ। বয়েসের ভারে সমস্ত শরীরটা বেঁকে ইংরেজি ইউ হরফের মতো হয়ে গিয়েছে। মুখের চামড়ায় অজস্্র ভাজ। ঝুলছে হাতের চামড়া। কাছে যেতেই খপ করে মেয়েটার হাতটা শক্ত করে ফেলে প্রায়ান্ধ মোয়া খাঁ। পরম পাওয়ার মতো ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে জানতে চায় “তুই হুমারে?” মেয়েটি উত্তরে হ্যাঁ জানালেও মোয়া খাঁ আরো খানিকটা চিৎকার করেই ফের প্রশ্ন করে ‘‘তুই হুমা? মেয়েটি এবার মুখ মোয়া খাঁর কানের কাছে নিয়ে একটু জোরেই বলে, ‘হ্যাঁ’। শুনতে পেয়ে খুশি মোয়া খাঁ আব্দারের সুরে বলে, আমারে একটু ওজুর পানি আইন্না দিবি?
-হ্যাঁ দেবো।
– ওইখানে বদনি আছে। ডান হাতের তর্জনী তুলে চিড়ে-চ্যাপ্টা ঘরের দরজার কোণ দেখায়। হাতের আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখতে পায় একটা সীসার অতি পুরানো বদনা ঘরের মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মেঝে খানিটা ভেজা। বৃদ্ধ মোয়া খাঁর মতো শতবর্ষী হাজারটা ট্যাপ খাওয়া বদনিটায় বোধহয় ফুটো আছে। তার গায়ের ময়লা জমে জমে এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে মেয়েটির কেমন ঘিনঘিনে ভাব হয়। তবুও তো…
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে বদনা আনতে গেলে বৃদ্ধ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আরো জোরে হাতখানা চেপে ধরে। যদি সে পালিয়ে যায়! মেয়েটি তাকে আশ্বস্ত করে-
-আপনাকে পানি এনে দেই।
– না না বদনিটাসহ আমারেও কলপাড়ে নিয়া যা। ওইহানেই কল চাইপা এক বদনা পানি দেইস।
মেয়েটি এক হাতে প্রাচীন বদনা, অন্য হাতে প্রাচীন মোয়া খাঁকে ধরে ঘরের বার হয়ে পা টিপে টিপে কলপাড়ে নিয়ে যেতে থাকে। খেলে বেড়ানো বৃদ্ধর নাতি নাতনির দল এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে একচোট হেসে নেয়। বুইড়্যা আইজকা তোরে ধরছে! ভালাই অইছে তুই বুইড়ার হাতে (সাথে) অজু অজু খ্যাল।
তারা যেমন ঝড়ের বেগে এদিকে এসেছিলো তেমনি ঝড়ের মতেই পুব থেকে পশ্চিমে নাকি উত্তর থেকে দক্ষিণে ধেয়ে যায় অসভ্য বানের জলের মতো কলকল খলখল করতে করতে। ধানের ধামা কাঁখে নিয়ে হনহনিয়ে দেখেও না দেখার ভানে চলে যায় মোয়া খার বয়সী বউ। গা থেকে প্রায় খুলে পড়ছে তার এক প্যাচে পরা বারো হাতি শাড়িটা। পেটিকোট, বøাউজের বালাই নাই। আড়াল থেকে নয় প্রায় সরাসরিই দু’পাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে তার শুকিয়ে ঝুলে পড়া স্তন জোড়া। মেঝ ছেলের বউ ছকিনার মা দেখতে পেয়ে যেতে যেতে বলে যায়, হুমা তোর ভালা অবো রে। তোর ভালা অবো। বুড়া মাইনষ্যেরে অজুর পানি আইন্না দিলে আল্লায় তার ঠিকই ভালা করবো। কে জানে! ছকিনার মায়ের চুন লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়া সাদা মার্বেলের মতো চোখে কী খেলা করে!
মোয়া খাঁ অজু করে পরম ভক্তি ভরে। কোন এক সুরা আওড়াতে আওড়াতে মেয়েটির ছোট হাতে ভর করে ফের ঘরে ঢোকে। একটা প্রায় শেষ হয়ে আসা দিনে এই একরত্তি মেয়েটা ছাড়া আর কেউ তার কাছে আসে নাই। তাই বুঝি হাতটা সে ছাড়তে চায় না। বয়সী খসখসে মুঠোর দখলে রেখেই সে বলে,
-ওই হুমা আমারে এক থালি ভাত দিবি? খামু।
মেয়েটি চমকে ওঠে ভাত! ভাত সে কোথায় পাবে? নিজের বাড়ির হাড়িতে এক থালা ভাত তো দূর, এক কনা ভাতও নেই। ঘরের কোণে ধোয়া মোছা হাঁড়ি পাতিল উপুড় করে রাখা। একটা চালই যে তাদের ঘরে নেই। ভাত হবে কী করে? ক্ষিধেয় পেট তারও যে জ্বলতে জ্বলতে থেমে গেছে সেই কখন! কাঁদো কাঁদো কন্ঠে সে জানায়
-আমি ভাত কোথায় পাবো? আমাদের ঘরে তো ভাত নাই। মোয়া খাঁ যেন শুনেও শুনতে পায় না। অবুঝ ছেলের মতো বায়না করে বলতেই থাকে,
-ওই হুমা খাড়াইয়া রইছস ক্যা? দে-রে চাইড্ডা ভাত। মেলা খিদা নাগছে। চোখে আন্ধার দিতাছে। হেই কোন বিয়ানবেলায় দুইডা পান্তা দিছাল… মেয়েটির দুই চোখ ভরে জল আসে। ফুলে ফুঁপিয়ে ওঠে ঠোঁট জোড়া। বুক খুলে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, “মাআআআ!” সে আর থাকতে পারে না। জোর করে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালায়।
ছুটতে ছুটতে শুনতে পায় মোয়া খাঁ আহির ভৈরবে গাইছে, ‘‘আমারে এক থালি ভাত দিবি? খিদা নাগছে। আমি খামু-উ-উ-উ…।’’