ভাঙন
রুখসানা কাজল
১
স্বমেহনে ভারমুক্ত হয়ে লেখার প্লট এ মন বসাতে চেষ্টা করে রাজনৈতিক প্রবন্ধকার রাজিউদ্দীন আহমদ।
কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। লেখার সূত্রগুলো সুতা ছেঁড়া ঘুড়ির মত উড়েফুঁড়ে কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে। অক্ষরগুলো বিক্ষিপ্ত লাগছে। বিপর্যস্ত হাতের চাপে ককিয়ে উঠছে মাউস। রাজু বুঝতে পারে হিমবাহের ধীর গতিতে ধমনী বেয়ে অবসাদ নামছে। তাৎক্ষণিক তৎপরতায় এ অবসাদ ঝেড়ে ফেলতে না পারলে ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
কুইক রাজু কুইক। এ গাড্ডা থেকেনিজেকে টেনে তুলতে হবে। এখুনি। সময় পেলেই মন খারাপের রাজহাঁসরা লম্বা ঠোঁটে ঠুকরে ছিঁচড়ে কুচি কুচি করে ফেলবে তার হৃদয়। তখন টানা সাতদিন ধুঁকরে কুঁকড়ে কাটাতে হবে মনহারা ভাবনাহারা ইচ্ছেহারা হয়ে। এত কষ্টের লেখাটা ঠিক সময় পৌঁছে দেওয়া যাবে না। পত্রিকা অফিসে সাম্প্রতিক লেখা বিষয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। কারণ লেখাগুলো চলমান ঘটনা সম্পর্কে আঁতেল শ্রেণীর আগ্রহী পাঠকদের চাহিদার উপর তৈরি করা হয়।
নিজের বানানো কালো কফিতে চুমুক দিয়ে নিজের ভেতরে ডুবে যায় রাজু।
তার যৌবন কেটেছে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র গুপ্ত রাজনীতি করে। তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। রাজুর দীপ্র যৌবনকাল। দলীয় পাঠচক্রে তীব্র শ্লেষে ওদের জানিয়ে দেওয়া হল, এ স্বাধীনতা খয়রতি স্বাধীনতা। ভারতের দেওয়া এ খয়রাতি স্বাধীনতাকে তারা হাতি ও গন্ডারের সঙ্গমজাত সন্তান বলে মনে করে । এক কথায় এ স্বাধীনতা বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ, আগ্রাসন আর দাদাগিরির আবর্তে বাংলাদেশকে কব্জায় রেখে অলক্ষ্যে নয়া উপনিবেশবাদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার গুপ্ত কৌশল মাত্র।
তাছাড়া ক্রমশঃ ঘন হয়ে আসা চলমান মুক্তিযুদ্ধের এমন হঠাত দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটানো হয় যে অনেক বাঙালি স্বাধীনতার মূল তাৎপর্য ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হয় না। প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ধর্মহীনতার রঙ দিতে শুরু করে। সেই সাথে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন শহর ও গ্রামে উছৃংখল কিছু মুক্তিযোদ্ধার অনৈতিক কার্যকলাপ সরকারের ভাবমূর্তিকে দ্রুত খবিস করে তুলেছিল। হয়ত এ পরিস্থিতিও সামাল দেওয়া সম্ভব হত কিন্তু সেই সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি লুটতরাজ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে পাঠানো বিদেশি সাহায্য তছরূপ, মূল্যবোধের অবক্ষয় সদ্য স্বাধীন দেশটাকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাধারণ বাঙ্গালীদের কেউ কেউ প্যারোডি বানিয়ে ফেলেছিল, ছিলাম ছিলাম ভালোই ছিলাম পাকিস্তানের আমলে—-
২
সিগ্রেটের মাথায় পতন উন্মুখ ছাইয়ের লম্বা আয়তন দেখে আগ্নেয়গিরির পোড়া ছাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় রাজুর।
পদ্মার ওপারে রাজবাড়ি জেলা। এর কয়েক মাইল ভেতরে রাজুর এক সম্পদশালী জোতদার মামা ছিল। ঝড় বৃষ্টির এক রাতে বিশাল নৌকায় পাড়ি দিয়ে রাজুদের বাড়ি এসেছিল গোপনে। রাগে ফুঁসছিল, কি মজিবরের এতবড় সাহস ! বাপদাদার আমলের শত শত জমি এখন চাষাভুষোদের মধ্যি বিলি করে দিতে হবে ! তারে কি এজন্যি এদেশের রাজা বানাইছি আমরা ! ব্যক্তিগত মালিকানায় জমির সিলিং বেঁধে দেওয়ায় সম্পদশালী ধনবান জোতদাররা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট হয়ে ক্ষেপে গেছিল।
এরই সাথে সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা। যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিল ভারত হয়ে পাকিস্তান এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে তারা নিজেদের ভেতর সংযোগ স্থাপন করে নিয়েছিল। এর সাথে মিশেছিল বিশ্বরাজনীতির কূটকৌশল। ক্ষমতার দুটি বলয় ছিল সে সময়। বাংলাদেশ ক্রমশ ঝুঁকে যাচ্ছিল রুশ ভারত বলয়ের দিকে।
আবার মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ প্রথমে মতাদর্শগত দলীয় কোন্দল পরে স্বজনতুষ্ট সরকারের উপর অনাস্থা এনে ছিটকে বেরিয়ে গেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দল। একই সাথে নকশাল আন্দোলনের গোপনকর্মীরা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু করেছিল খতম রাজনীতি।
ক্ষমতাসীন সরকারের সে এক ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
সেই ক্রান্তিলগ্নে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই রাজু সরাসরি জড়িয়ে গেছিল গোপন বাম দলের সাথে। দু চোখে স্বপ্ন। সিনায় সিনায় সাহস। সহজ অঙ্কের উত্তরের মত ভেবেছিল, যত্তসব জোতদার, মজুতদার, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের খতম করলেই দেশে সাম্যব্যবস্থা কায়েম হয়ে যাবে।
সময়ের স্রোতে সেই সংগ্রাম ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কমরেডদের অনেকেই নির্বিচারে খুন হত্যার শিকার হয়ে গেছিল। কারও ভাগ্য ভাল হলে জেলবাস ছিল অনিবার্য। আর যারা বেঁচে গেছিল তাদের অনেকেইপরবর্তিতে ভিড়ে গেছিল প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সহজপাঠে। ব্যক্তিগত মোক্ষ লাভে অনেকেই ধনপতি হয়ে উঠেছে।কেউবা হয়েছে চতুর বায়স। রাজু শেষ দলের।
ওদের তরুণকালের নিভন্ত সেই সংগ্রামী ছাইভস্মকে এনালোজি করে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে রাজুরা মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের উস্কে দেয়। এশিয়ার রাজনীতি যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন মূলত তা পারিবারিক নেতৃত্ব তিয়াসি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরণের গনতন্ত্রে সুফল যাই থাকুক, কুফলের অভাব হয় না কখনও। তাই যে কোন দলের ক্ষমতাসীন সরকারের অপকর্মের যেমন কোন বিরাম থাকে না, তেমনি আন্দোলনও চলতে থাকে।
দেশের দু একটা প্রতিষ্ঠানও গোপনে রাজুদের পেছনে ফুয়েল যোগায়।
ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছেলেমেয়েরা ধেয়ে আসে উন্মত্তের মত। তাদের মুখে ও মনেজ্বলে প্রতিবাদের গন্গনে রাগ। পোষ্টার ফেস্টুনে শাহবাগ থেকে সমগ্র বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে। পুরনো শ্লোগানগুলো নতুন নতুন কন্ঠে শানিত হয়ে আগুন ছোটায়। রক্ত স্তিমিত হয়ে আসা এক সময়ের বিপ্লবী বুড়োবুড়িরাও নতুন করে চলকে ওঠে উত্তেজনায়।দেশের পত্রপত্রিকা টিভি চ্যানেলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সাহায্যে দ্রুত বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের ধরপাকড় মারপিটসহ আন্দোলনের চুম্বক অংশ এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনে আহত শিক্ষার্থীদের সচিত্র দৃশ্যের করুণ ভিডিও। কিছু কিছু রক্ত ঝরে। কেউ কেউ জেলে যায়। কদিন টগবগ করে ফোটে বাংলাদেশ। মনে হয় বিপ্লব আর দীর্ঘ দূরের কোন ষ্টেশন নয়। খুব কাছে। মাঝারি কিছু নেতা, বিদ্রোহী কোন ছাত্রনেতা অনলবর্ষি বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করে রাখে। প্রতিদিন তপ্ত খবর শোনার জন্যে জনগণের ঘাড় সোজা হয়ে থাকে। ঘরে ঘরে, অফিস আদালতে, রাস্তাঘাট, দোকান বাজার, হাট গঞ্জের সাধারণ মানুষ চোখ মেলে কান পেতে থাকে, তবে কী সুদিন এলো !
কেবল কিছু বুদ্ধিমান মানুষ রূপকথার বেঙ্গমা বেঙ্গমির মত এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে মুচকি হাসে।
৩
মওকা পেয়ে সরকার বিরোধীরা লাগাতার বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদের দাবিদাওয়ার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। তাদের অভিলাষ ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দ্রুত পতন ঘটানো। জনগণের যে অংশ ঘিলু খাটিয়ে চলে তারা অবশ্য চিন্তা করে, এরপর কে আসবে ক্ষমতায় ! দেশে নেই শক্তিশালী কোন বিরোধী দল। যারা আছে তারা পাপেট এবং সরকারি দলেরই অন্য পিঠ। সুতরাং এদের কেউ এলে কতখানি গুণগত পরিবর্তন হবে দেশ ও জনগণের ? ছাই হবে। সেই ত পার্সেন্টাজ খাওয়ার সরকার ! লাউ গিয়ে কদু আসবে। তারচে থাক গে থাক। যা আছে তাই চলুক। অন্তত দেশটা ত স্থিতিশীল আছে।
ওদিকে বড়পর্দার আড়ালে শুরু হয়ে যায় আন্দোলনে্র উল্লেখযোগ্য কিছু নেতাদের সাথে সরকারের দেন দরবার সমঝোতার আলোচনা । প্রকাশ্যে কিছু দাবি মেনে নেয় সরকার। তাতে নেতাদের মান বজায় থাকে আবার পকেটও ভরে যায়। এরপর কিভাবে যেন আন্দোলনরত তরুণ নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়ে। সাধারণ ছাত্রদের অনেকেই বুঝতে পারে আবার অনেকেই বোঝে না। তারা হতাশ স্খলিত মনে রাস্তা ছেড়ে আস্তে আস্তে চলে যায়। আমজনতা যা বোঝার বুঝে যায়।
কেননা ইতোমধ্যে পশ্চাতের ঈশ্বররা সরকারের দেওয়া হালুয়ারুটি পকেটে পুরে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরেছে।তখন ছাত্রদের ভিতরের কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে হাত মেলায়। কেউ আবার নেতা টেতা হয়ে যায়। টিভির টক শোতে এসে একদা রাজুদের বলা কথাগুলোর পূনরাবৃত্তি করে স্ক্রিন গরম করে ফাটিয়ে দেয় অডিয়েন্স।জ্বালাময়ী এসব বক্তব্যের জন্যে কিছু সাংবাদিক ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে কাউকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়। মিডিয়ার বাড়তি খাতির পেয়ে ‘মুই কি হনু রে’ হাবভাব নিয়ে এরা তখন চলাফেরা করে। পেছনে জুটে যায় একদল মোসাহেব। সবাই মিলেঝুলে আয় রোজগারের ধান্ধা খুঁজতে সরকারের বিপক্ষদলের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর চিপাচাপায় থেকে প্রেশার গ্রুপের কাজ করে। আবার এদের মধ্যে যারা একটু বেশি রকমের চালাকচতুর আর ব্যক্তিস্বার্থ বুঝদার তারা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যায় বিদেশ।সেখান থেকে সরকার বিরোধি বিভিন্ন গরম গরম লেখা ছড়িয়ে দেয় নিজের টাইম লাইনে বা সমমর্মি কোন প্রিন্ট এবং ওয়েব পত্রিকার পাতায়।
আন্দোলনের তলানিতে থাকা সাধারণ এবং অতি সাধারণ ছাত্ররা জীবিকার দাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা কর্মক্ষেত্রে। কেউ বেশি কেউবা কম আরামের বশংবদ হয়ে জীবনটাকে বেঁধে ফেলে চিরাচরিতের নিয়মে। স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে বাজার ঘাট স্কোয়ার ফুটে মাথাগোঁজার একটি ফ্ল্যাট নিয়ে সংসার সাজিয়ে নেয়।
এইত রাজনীনৈতিক সিষ্টেম এখন ! বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার দেশগুলোর একই চেহারা। একই স্ট্রাকচার। আজকের রাজনীতিবিদদের বাপ দাদা পর দাদারাও এই সিষ্টেমের চক্করে গড়িয়ে দিয়েছে তাদের স্বপ্ন জীবন ও কর্মকে।
রাজু প্রথম চোটে পারেনি। চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না। তবে ব্যাটে বলে মেলেনি। হয়ত ভাগ্য সদয় ছিল না বা তখনও কিছু আদর্শ, লোকলজ্জার দ্বিধা রাজুর মনের কোণে সংশয় আবিষ্ট হয়ে জেগে ছিল ! সে যা হোক শেষপর্যন্ত তো সে কামিয়াব হতে পেরেছে।
পরিহাসের বিষয় হল, দেশের প্রিমিটিভ এই সিষ্টেম ভাঙ্গার কমরেড হতে গিয়ে রাজু নিজেই সিষ্টেম প্লেয়ার থেকে পলিটিক্যাল ডন হয়ে গেছে !
৪
কফি পানসে লাগছে। বিশ্রী স্বাদ।জিহবা নিতে চাইছে না বলে কফি পাত্র উপুড় করে দেয় বেসিনে। কল খুলে আয়নায় নিজেকে দেখে রাজু। ঝুলে নুয়ে পড়েছে ভ্রুর কাঁচাপাকা চুল। চোখের মণিদুটো ঘষা মার্বেলের মত অনুজ্জল, ধোঁয়াটে। গলার নিচে তিন তিনটে পাকদন্ডি। রাজু দেখতে স্বাস্থ্য উজ্জ্বল, মোটাসোটা টাইপের নয়। বরং রোগা শরীরে কিছুটা আহা রে হতভাগা সুলভ চেহারা। দেখলে সহজেই বোঝা যায়, লোকটা এক সময় বাম আদর্শে নিমজ্জত এবং বিমোহিত হয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। খুব স্বল্প খাবার খায়। সস্তার সামান্য পরিধান ব্যবহার করে। কয়েক বছর হল পাঞ্জাবীর উপর শ্রী ছড়াচ্ছে কালো মুজিব কোট। ঘড়িটড়ি পরে না। চোখে হাজার দুই টাকার হাফ রিম চশমা। গরম কালে পরে বাটার স্যান্ডেল সু আর শীত পড়লে অই বাটা কোম্পানীর কেডস পরতেই আরাম বোধ করে।
বাহ্যিক অতি সিম্পল রাজুর চেয়ে রাজুর গুপ্ত সঞ্চয় অনেক অনেক বেশি।
এ কথা ভাবতেই হাহাকার বেজে ওঠে ওর শরীরে। বুকের ভেতর, হাড় ও মজ্জায় ভূমিকম্প বয়ে যায়। হুহু করে ওঠে মন। কার জন্যে ? কাদের জন্যে সে এতসব করে চলেছে ! কে আছে তার আপনজন ! প্রিয়, খুব প্রিয় একটি কিশোর মুখ জেগে আছে ওর অন্তর জুড়ে। সে কিশোর রাজু ফারহানার গোপন প্রেমের সন্তান। লোকসমাজের সামনে রাজু তাকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় করাতে পারছে না ! কখনও কি পারবে ? সে কিশোর মানুষ হচ্ছে কাকের বাসায়। মানুষই হচ্ছে। কোকিলের ছানা হয়ে নয়। রাজুর পক্ষে পুরবীকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করা অসম্ভব ছিল জেনে ফারহানা আর দেরি করেনি। দীর্ঘদিনের প্রবাসী কাজিনকে বিয়ে করে চলে গেছে জার্মান। স্বামী সন্তানদের নিয়ে ভাল আছে।
পেটমোটা একটি ভদকার বোতল বের করে রাজু। কফি কাপে ঢেলে কয়েক টুকরো লেবুর শুকনো ছিলকে দিয়ে বারান্দার আলো আঁধারিতে এসে বসে।
দলছুট বাতাসে উগ্র পানীয় আর সিগ্রেটের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে বাইরে। পাশাপাশি বারান্দায় পাথর হয়ে বসে থাকা পূরবীর মন ভেসে যায় দুঃখে। কন্টকিত কাঁকড়া বিছের মত হয়ে গেছে রাজু। শিরায় শিরায় প্রতারক। সারাক্ষণ হুল খাড়া করে থাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুডে। তবু ওর খারাপ লাগে। এত এত কষ্ট সহ্য করে কি পেলো রাজু ! কিছুই না। টনটন করে ওঠে পূরবীর মন। রাজু যা পেয়েছিল সে সব সামাজিক সম্মান, সমর্থক প্রিয়তা আর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য হারানোর ভয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। রাজুর দ্বিতীয় প্রণয়ের সন্তানটি মানুষ হচ্ছে বিদেশে। প্রতিপালনের খরচ রাজু দিলেও পিতৃপরিচয় দিতে পারেনি। রাজুর অল্পবয়েসি প্রেমিকা রাজুকে সে সুযোগ দেয়নি। চাচাতো ভাইকে বিয়ে করে বেশ ভাল আছে মেয়েটি।ফেসবুকে ছবি দেখে অন্তত তাই মনে হয়। তবে ছেলেটি যত বড় হচ্ছে চেহারায় রাজুর আদল তত বেশি ফুটে উঠছে। দেখতে অনেকটা রাজু পূরবীর ছোট মেয়ে মিতিলের মত লাগে ছেলেটিকে।
পূরবীর মনের কোণে জ্বলে ওঠে এক বয়েসি জোনাক।মায়া মমতার আলোছায়ায় ওড়াওড়ি করে পূরবীর প্রাণ ধরে সে টান দেয়। অমনি কলকল করে ছুটে আসে ভালবাসা দল। রাজুর জন্য মায়া আর ভালবাসায় পুরবী কেঁদে ফেলে।
ভালবাসা সে তো পাথরকুচি পাতার মতন অশেষচক্র। জন্মান্তর পিয়াসী। অক্ষয় অশেষ। শেষ কোথায় ভালবাসার ! শেষ নাহি যে ! বেচারা রাজু।