বোর্হেস ও আমি
হোর্হে লুইস বোর্হেস
বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর
সবকিছু ওই লোকটাকে নিয়ে ঘটে- লোকে যাকে বোর্হেস বলে ডাকে।
আমি বুয়েনোস আয়ারেসের রাস্তা ধরে সটান হেঁটে যাই- যন্ত্রচালিতের মতো দাঁড়িয়েও পড়ি মাঝেমধ্যে, প্রবেশ তোরণের নকশা আর গ্রিলের কারুকাজ একচোখ দেখে নিই। বোর্হেসকে আমি চিনি- চিঠির উপর এই নামটা দেখি, অধ্যাপকদের নামের তালিকায় এই নাম থাকে, আবার জীবনীকোষেও পাই।
আমার ওই গ্লাসগুলো ভালো লাগে- যেখানে উপরের অংশে বালু রাখা হলে আস্তেধীরে বালু নিচের অংশে পড়ে- তাতে একঘন্টা সময় লাগে। মৌজার দাগখতিয়ান, পুরনো হস্তলিপি দেখতে ভালো লাগে, কফির আমেজে দারুণ চাঙ্গা হয়ে উঠি আমি, স্টিভেনসনের গদ্যভাষা বড় টানে আমাকে- তার লেখায় এই ব্যাপারগুলো থাকে। কিন্তু কায়মনোবাক্যে না করার কারণে ফলাফল সন্তোষজনক হয় না- মনে হয়, একজন অভিনেতা এগুলো খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আবার আমাদের দুজনের একদম সাপে-নেউলে সম্পর্ক, এটা বলাও ঠিক হবে না।
আমি আছি, সুখে-দুঃখে চলে যাচ্ছে; ওই কাগজে কলমের যে বোর্হেস- সে মনের মাধুরি মিশিয়ে লেখাজোখা করে; তার লেখাপত্রে আমাকে কবুল করে।আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সে কিছু কাজের জিনিস করেছে, কিন্তু এইসব দলিল দস্তাবেজ আমাকে উদ্ধার করে দেবে না। কেননা, সত্যিসত্যিই যদি ভালো কিছু থাকে ওখানে- সেগুলো কারো হিস্যা নয়- এগুলো আমার নয়, সে-ও নিজের বলে দাবি করতে পারে না। কেউ-ই ভালো কোন কিছুর সত্ত্বাধিকারী নয়- তার মালিক আমাদের ভাষা ও পরম্পরা।
মৃত্যুর হাতে আমার নিয়তি বাঁধা, একে পাশ কাটিয়ে সামান্য কিছুই হয়তো তার কলমে উঠে আসে। অবশ্য ছিঁটেফোঁটা করে আমার সবই ওকে দিয়ে দিয়েছি। যদিও আমি জানি, সে নিরেট সত্যে কামড় দিয়ে থাকে না, লেখার খাতিরে খানিকটা নড়ে যায়, সরে যায়- কিছুটা বানিয়ে বলে। স্পিনোজা আলবৎ জানে- তাদের সজ্ঞায় এ-ব্যাপার তারা হেব্জ করে।
পাথর পারমার্থিকভাবে আবার পাথর জন্ম চায়, বাঘেরও অভিপ্রায় বাঘের জীবন অব্যাহত রাখা। আমিও আমার নয়- বোর্হেসের মধ্যেই থেকে যেতে চাই। আমি যদি আদপেই কেউ হয়ে থাকি- আমি তার বইয়ের মধ্যেই নেহায়েত জীবন্ত দেখতে পাই, আমি বরং নিজেকে অনুভব করি অন্যান্য কাজে; কেউ যদি মনেপ্রাণে গিটার বাজায়- মনে হয়, ওখানে বরং আমি নিজেকে বেশি খুঁজে পাই।
বেশ আগের কথা বলছি- একবার ভাবলাম, আমি বরং নিজেকে বোর্হেসের নাগপাশ থেকে খুলে নিই। করলাম কী- আগিলা কালের মায়াদারি পিছনে ফেলে সময়ের স্ফূরণ আর তার হাতে অনন্তের বাজি ধরে বসি- কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারি, ওই খেলোয়াড়ি বোর্হেসের দখলে; আমি ফতুর হয়ে গ্যাছি।
আমার হয়েছে শনির দশা- আমার সবকিছু হয় খুইয়েছি বোর্হেসের কাছে, নয় গ্যাছে সর্বনাশের হাতে। এই যে একপাতা লেখা হলো, আমি তা-ও জানি না- আমাদের দুজনের মধ্যে কে আসলে এটি লিখেছে!
================================
বদরুজ্জামান আলমগীর: নাট্যকার, কবি ও অনুবাদক
=================================