বোবা কাল
আলী সিদ্দিকী
গরমে আধসেদ্ধ হয়ে মধ্যরাত গড়িয়ে ভোর হয়ে গেলো। সাথে তো আছে মশার ভীতিকর যুদ্ধংদেহী হুঙ্কার আর বিষাক্ত মারণাস্ত্র হুল। যেনো ইউক্রেনে রাশার মিসাইলের তান্ডব নয়তো আফগান তালেবানদের শূলের মুখে মৃত্যু কাতরতায় কাঁপছি। রুয়ানা আধমরা হয়ে নেতিয়ে আছে ফ্লোরে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দু’পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে মাথা টুকে গেলো দেয়ালে। মাদারচোত! এ সময় মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়ার মতো ভয়ঙ্কর গর্জনে চতুর্দিক থেকে ছুটে আসে আজানের চিৎকার। নির্ঘুম রাতের গরম আর মশার অসহনীয় উপদ্রব শেষে বিকট শব্দের এই দানবিক হুঙ্কারে বুক ধড়পড় করে শরীরটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। ধপাস শব্দটি চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পটল তুললো।
চোখ খুলে প্রথমেই মনে হলো, আমি অক্কা পাই নি। রুয়ানা জানালো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। রুয়ানার চোখের কোলে কালচিটে অন্ধকার। সে গতকাল আসা চিঠিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে আঁতকে উঠলো ভীষণ। একমাসের বিদ্যুত বিল তের হাজার টাকা দেখে রুয়ানা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। তিনজন মানুষের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। সারাদিন তো তালাবদ্ধ থাকে ঘর। অথচ প্রতিদিনই লেগে আছে লোডশেডিং। চারদেয়ালের গুমোটে অবরুদ্ধ থেকে প্রাণহীন প্রায় দেহ টেনে তুলে আবার ছুটতে হয় বাঁচার তাগিদে। মেয়ে উপলার পাঁচ পেরুনোর ভেতর দিয়ে যেনো আমাদের স্বপ্নের উচ্ছ্বাসগুলো উবে গেলো। রুয়ানার চাকরি পার্মানেন্ট হচ্ছে না অনেকদিন। জুটছে না নতুন কোনো কাজ। আমারও ডাল বদলে বদলে অথৈ জলে নাক উঁচিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা। পায়ের নিচে শুধুই পিছল মাটি।
এদিকে বন্ধু শওকতের উচ্ছ্বাস অন্তহীন। সে হয়ে গেছে সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার। হলের কেন্টিন সম্পাদকের পরিচয়কে পুঁজি করে নিজের পাটাতন তৈরি করে নিয়েছে। বলে, মেট্রোরেল এসে গেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাচ্ছে। ঝকঝক করছে নতুন নতুন অট্টালিকা। এখন ড্যাশিং বাংলা। হাজার হাজার নতুন মডেলের গাড়ি নামছে রাস্তায়। সেও এখন আউডির মালিক। কোথাও কোন বাধা নেই। তরতর করে এগিয়ে চলছে সবকিছু মসৃণ পথে। বাম চোখ ছোটো করে বলে, ইগো টিগো ঝেড়ে ফ্যাল। দেখবি সবকিছুতেই আলাদিনের চেরাগের মতো চমক লেগে যাচ্ছে।
আমার কিছু বলা দরকার। মাথার ভেতর কলবল করছে অন্ধ স্রোত। এই তো সেদিন হাত পেতে খাওয়ার টাকা, বইকেনার টাকা, এমনকি জামাকাপড় চেয়ে নিতো শওকত। সে ভালো করছে, ভালো কথা। খুশির কথা। বন্ধুই তো। আমি অসন্তুষ্ট হই না। কিন্তু যেভাবে সে ভালো করছে- দুই নম্বরি পথে- সেটাই একমাত্র পথ এটা প্রমাণ করার অপপ্রয়াসে আহত হই। ঘৃণ্য যা তা হয়তো বাহ্যিক সুন্দরের প্রলেপমাখা কিন্তু সেতো দুর্গন্ধময়। শওকতের নিজের অসৎ উপার্জনের অহমিকা দুরুত্ব তৈরি করে দিয়েছে গত কয়েক বছরে। তাই আমি জোরালো কথা বলি না। হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলি, ভালো থাকিস। আমিও থাকবো নিজের মতো। গুডবাই।
বাসায় ফিরতে সিএনজিতে উঠতে যাবো এমন সময় তুহিনের বউ আর ছেলে রিফাতের সাথে দেখা। বেশ অনেকদিন পরই। তুহিনের বউ পলাকে একেবারে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। যেনো প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব থেকে উঠে এসেছেন। রিফাত আমাকে চিনতে না পারলেও পলা চিনেছে। এগিয়ে যাই।
ভাবী, কোথায় যাচ্ছেন?
বারডেমে এসেছিলাম, ক্লান্ত হতাশ কন্ঠ পলার, তুহিন ভর্তি হয়েছে।
তুহিনের সাথে দেখা হয়েছে বছরের উপর হবে। তাও অল্প সময়ের জন্য। ও খুব ব্যস্ত ছিলো। কথা হয়নি তেমন। তবে তখন তুহিনকে অসুস্থই মনে হয়েছিলো। তাই উদ্বিগ্ন হলাম, কি হয়েছে?
কিডনি দুটাই ইনফেকটেড।
বলেন কি! আমার কন্ঠে আতঙ্ক ফুটলো।
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট আর টপার ছিলো তুহিন। বুদ্ধি আর সাহসের সমন্বয়ে সে ছিলো খুবই সম্ভাবনাময়। বেশ ভালোই করছিলো সে। যোগাযোগ কম হলেও খবরাখবর পেতাম। শুনেছিলাম বদসঙ্গে পড়ে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলো। পলার মতো চমৎকার জীবনসঙ্গী পেয়েও তুহিন কেনো অসুখী বোঝা মুশকিল। কিন্তু মানুষের ভেতরের অন্তঃস্রোত একান্তই নিজস্ব নিয়মেই বয়ে চলে। কাছের মানুষও তা অনেক সময় বুঝতে পারে না। ইচ্ছে হলো এখুনি দেখতে যাই তুহিনকে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেলো আজ। রুয়ানা সারাদিন কাজ শেষে উপলাকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে। শুক্রবারে আসার কথা বলে পলাকে ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, ওকে বলবেন আমি শুক্রবারে আসবো।
সিএনজিতে উঠে নিজেকে বকে দিলাম। পলাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। তার চেহারায় হতাশা আর অসহায়ত্ব ভয়ঙ্করভাবে প্রকট ছিলো। অথচ আমি কিছুই তেমন জানতে চাইনি। ভয় পেয়েছি যদি দায়িত্ব এসে পড়ে! আমার যে অবস্থা তাতে আমার পক্ষে কোনোরকম দায়িত্ব নেয়ার কথা ভাবাও যায় না। একে তো বিলম্বে বিয়ে করেছি এবং বাবা হয়েছি তেমনি সবদিক থেকেই ব্যর্থ হয়ে গেছি। নিজের উপরই এখন ভরসা করতে পারছি না অথচ তুহিনের জন্য আমার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। ওর এ অবস্থায় আমার পালিয়ে আসার বিষয়টি খুবই লজ্জাজনক! ছি!
আত্মদহনে দগ্ধ হয়ে বাসার সামনে পৌঁছে দেখি গেটের সামনে মানুষের জটলা। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সর্বত্রই মানুষের জটলা লেগে থাকে। জটলা এড়িয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে একরাম নামের বিল্ডিংয়ের তরুণ ছেলেটা এগিয়ে আসে, স্যার এদিকে আসেন। একরামকে চিনি। ওর বাবা সোবহান সাহেব ভদ্রজন। একরাম ঘুষ দিয়ে এনআইডি না নিয়ে বিল্ডিংয়ের সবার কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সে কলেজে পড়ছে। মনে হয় রাজনীতিও করছে ইদানীং। সে যখন ডাকলো মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। একটু সরে এলে একরাম যা বললো তাতে মাথায় আগুন ধরে গেলো। তিনতলার বাসিন্দা নুর আলমের ছেলে আমির আমার ঠিকে কাজের মেয়ে শাহানার শ্লীলতাহানি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে। শাহানা কাজ শেষে ওর বাসায় ফেরার জন্য লিফটে ওঠে। তখন আমির একা পেয়ে শাহানার উপর হামলে পড়ে। শাহানার চিৎকার শুনে মানুষজন আমিরকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। পুলিশ আমিরকে নিয়ে গেছে। কিন্তু দুই ঘন্টা পর পুলিশ আমিরকে ছেড়ে দিয়েছে। নুর আলম নিজেই ডিএমপিতে কাজ করে। সে সামলে নিয়েছে যথারীতি। শুনে আমার হাতপা নিশপিশ করছে। আমি একবার রুয়ানা আরেকবার উপলার দিকে তাকাই। তারা একেবারে ভাবলেশহীন। তাদের এই নির্লিপ্ততা যেন নৈঃশব্দ্যকে প্রচন্ড ভারী করে তোলে। অসহনীয় এই স্তব্ধতা আমার শ্বাসরোধ করে। আমি হাঁসফাঁস করে উঠে দাঁড়াই। রুয়ানা আমার দিকে শীতল চোখে তাকায়।
রুয়ানা হাতে লেখা একটা কাগজ আমার সামনে তুলে ধরে। তাতে কচি হাতে লেখা, কোনো কথা বোলো না। কোনো প্রতিবাদ কোরো না। কেউ তোমার কথা শুনবে না। উপলার দু’চোখের মিনতি উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। আমিও চুপ হয়ে গেলাম।
মার্চ ৮, ২০২৪
———————————