বোধিবৃক্ষের ধ্যান
ঋতো আহমেদ
১।
এরই মধ্যে
তুমি হয়তো থেকে যাওয়ার কথাই ভেবেছ। কিন্তু, কিছুই কি থাকে শেষ পর্যন্ত?
সমস্তই সমস্তই
মগ্নমরীচিকা নয়?
২।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা এমনও নয় যে সব সময় তুমিই যোগাযোগ স্থাপন করবে। সৃষ্টির আদি থেকে, যখন কথাও শেখেনি মানুষ, তখন থেকে, কিংবা হয়তো তারও পূর্বে, তুমি নিজেই অবস্থান করে আছ মানুষের ভেতর। সেখান থেকেই তুমি সেইসব কথা পৌঁছে দিচ্ছ তাদের। অথচ মানুষ, নিজেকে জানে? জানে, তারই অন্তরাত্মার দূতকে? কিন্তু, তুমিও তো নিজেকে উন্মুক্তই রেখেছে। তোমারই উপর দিয়ে চালিত হচ্ছে বিশ্বাস। আর এভাবেও, কারও কারও ক্ষেত্রে, তুমি জীবনে আর জীবন তোমাতে ওতপ্রোত হয়। দুলে ওঠে ব্রহ্মাণ্ডের গোপনতম পর্দা। আর তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন কথা বলে উঠবে তুমি তাদের সঙ্গে। সুখদুঃখ আনন্দবেদনার অস্তিত্বকে দিয়ে থাকবে প্রাণের প্রলেপ।
৩।
কিইবা রেখে যেতে পারবে তুমি? বৈরাগ্যের আকাঙ্ক্ষায় বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ভবিষ্যৎ।
যখন দিনের শেষে ফিরে আসতে হয় দীর্ঘ পথ পেরিয়ে—তখনও রঙবাহাদুর তুমি নও—
তোমার ভর ছুটে গিয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের দক্ষিণ দিকে। নিরুপায় দুশ্চিন্তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে
মাঝেমধ্যেই। আর জীবন যেখানে দুলছে, সেইখানে, একটা মাঠ শুয়ে থাকবার কথা
নদস্রোতের পাশে, একটা স্থির অশ্বত্থ দাঁড়িয়ে থাকবার কথা বোধিবৃক্ষের ধ্যানে। যাও,
চাপা পড়ে থাকো তাদের মধ্যে। সুখদুঃখ/আনন্দবেদনার বিশ্বাস চালিত হোক তোমার অন্তরাত্মায়—
গড়ে তোলো শব্দবন্ধ
আর,
গড়ে তোলো ব্রহ্মশৈলী
৪।
আমাকে যারা জঙ্গল আর পাহাড়ে প্রতিফলিত অন্ধকার ভেবেছ
তাদের জন্য বলছি
আমাকে যারা মেঘের জমাটবদ্ধ স্তুপ কিংবা বাতাসের ঠুনকো শরীর ঠাউরেছ
তাদেরকে বলছি
তোমরা যারা মন্ত্রসিদ্ধ ঘুমঘোর এলিজিও ভাবছ আমাকে—
শোনো,
একসময় তোমরাও সাক্ষ্য দেবে হে
জলদগম্ভীর রাত বলতে কেবল অলৌকিক অশ্রুছায়াই বোঝায় না
সুড়ঙ্গের ভিতর নিঃসঙ্গতার আলোক কোনও অলীক কাণ্ডও নয়
সমস্তই
মোহরঞ্জন মোহরঞ্জন মোহরঞ্জন
৫।
তাহলে, তুমিও তোমার অন্তরাত্মার ভূত; নয়তো তুমি দ্যাখো-নি তোমাকে
ছায়ামূর্তির মতো উঠে আসতে, সন্তর্পণে,
যখন অবিস্ফোরিত বীজগুলো সূর্যশক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিল তোমারই দিকে।
দ্যাখো-নি
জীবন-মৃত্যুর গূঢ় মগ্নতা।
৬।
আজ এই পরাক্রান্ত ভাষা নিয়ে কতদূর যেতে চাইবে বলো!
মানুষের মধ্যে
ব্রহ্মপুত্র তোমার সম্মোহনী জ্বলন্ত সময়কে বইয়ে দিচ্ছে দ্যাখো
একের পর এক মৌনসুতোয় গেঁথে। কী ভাববে তুমি?
অন্বেষার পাড় ভেঙে কালঘূর্ণির পাঁকের ভেতর ডুবে আছে তোমাদের তুমুল কৈশোর।
অতলকে স্পর্শ করবে বলে
শিরোনামহীন জীয়নবাক্যগুলো
কোথাও পড়ে থেকে নেই আর। হ্যাঁ, হয়তো এইজন্যই
কিছুদিন আরও কাটাতে পারবে তোমরা
অবাধ জলীয় লীলায়।
৭।
এখন পৃথিবীকে যেমন দেখছ তুমি
তার চেয়ে ঘনীভূত সে কখনোই ছিল না।
একটা নির্জন পাছার মতো
পথ হারানো পথিক তুমি।
মেতেছ অনন্ত বিস্মরণের খেলায়।
মুখোমুখি
জীবন ও মৃত্যু
মুখোমুখি বিভ্রান্ত – বিষণ্ণ স্মৃতির বহ।
যার আমরা কেউ উথালপাথাল চাইনি।
তবুও
বাবাকে ছেড়ে এসছো তুমি।
একটা পুরনো ভাঙা বাড়ির বিছানায়।
[উঠে দাঁড়াতে পারেন না।
অথর্ব হাড়গোড় মাত্র।]
যেখান থেকে বেরিয়ে এলে
মাটিও সরে যায়
পলেস্তরা/ইট/কাঠ দেয়াল
ভেঙে পড়ে একে একে।
তুমি তাকে ওই অবস্থায় ফেলে আসতে পারো।
কারণ তোমার নামটি উচ্চারিত হয়
পরম আদরে
বৃদ্ধ ঠোঁটের কোণে। আহা—
পৃথিবীটা বেঁচে থাকার জন্য নয়
পৃথিবীটা, বিষ-বিপন্ন মশকরাই
৮।
তোমরা তাকে শুনেছ। আর সেও শুনছে তোমাদেরকে।
এইভাবে
দেখতে দেখতে
অজস্র মহাজাগতিক কল্লোল এসে পৌঁছে গেল এক সময় মনুষ্য বোধের পাড়।
এখন যে ইতস্তত অন্তর্দাহ পুনর্লিখনের দাবী উঠছে—
যেই শাপ-নির্জন প্রমাদগুলোকে
শেষ দৃশ্যে ঝুলিয়ে রেখেছ—
মানুষ কি সেই ইঙ্গিতময় লীলা সমূহের নিসর্গের ভিতর
হয়ে উঠতে পারে অনিবার্য মেঘের মতোই উদ্বায়ী?
কিংবা সেই কল্লোল
যখন কালতরঙ্গ হয়ে আছড়ে পড়ে
মানুষ কি তার লৌকিক ছায়ার থেকে পারে
চ্যূত হতে?
হ্যাঁ,
তোমাদের
এইসব জেনে থাকবার কথা
জানতে পারার কথা।
নয়তো
আমার ভ্রষ্ট আঙুল যখন নিখিল বিশ্বের দিকে
অপার্থিব হয়
তখন তোমাদের রাক্ষুসে জ্ঞান এসে
গভীর বেদনার সাথে মিশে, দ্যাখো, ক্যামন ওতপ্রোত
ক্যামন লীন!
৯।
তাকে আমরা মিথ্যে বলেছি, আর ততক্ষণে সূর্যও
প্রবেশ করেছে
পাথুরে অন্তর্দেশে।
মৃত আত্মর শুশ্রূষায়, সেইখানে, আমরা তার
নাম দিয়েছি আলোকমিতির ভূত।
কিন্তু
সিমার বলে আমরা কি চিনতাম কাউকে
কারা ওইসব বধের গল্পগুলোকে নগ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে ব্রহ্মাণ্ডে
মানুষের মধ্যে কারাইবা বাতাস, কেইবা জল ও রক্ত—?
পাল্লা দিচ্ছে। কুরে কুরে খাচ্ছে ওই জৈব কসমস
কারও আবার অজস্র পাপ-ফোয়ারা।
আহা
তোমরাই কি স্মৃতিভ্রষ্ট ফসিল
তোমাদের নীরব মৃত্যুই কি সৌন্দর্য
১০।
তুমি এবার ফিরতে পারো
ঘুঘুদের বাড়ির দিকে। পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে
তোমার জন্যই অপেক্ষা করে আছে
নীম গাছের এক ভূতম।
কবে একবার ভয় পেয়েছিলে
তারপর থেকেই এড়িয়ে যাচ্ছ।
কেবল অবিশ্বাস। কেবল গূঢ় গন্ধ
ভ্রমের আলোয় ঘেরা।
******************
=============