You are currently viewing বেদনার নীল রং – শাহাব আহমেদ

বেদনার নীল রং – শাহাব আহমেদ

মুখটাও শুকিয়ে গেছে বেশ। হাড়গুলো বের হয়ে আছে বেঢপভাবে। আগের সেই চকচকে জৌলুস নেই, চোখের আলোটাও কেমন স্তিমিত। আগে পাশে পাশে থাকতো, পাশে পাশে হাঁটতো। আমরা খেতে বসলে সে ৩য় চেয়ারটিতে বসতো অথবা তার পাশে সোফার উঁচু কাঁধে বসে হাত পা নেড়ে জানানি দিতো, “হে হে ! আমি পাশেই আছি আমার কথা ভুলে যেওনা।” কিন্তু এখন ওর কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়না। খেতে বসি, আসেও না।

পড়ার রুমে বই নিয়ে বসলে লাফ দিয়ে টেবিলে উঠে আমার খোলা বইয়ের ওপরে বসে পড়তো পিঠ দেখিয়ে। অথবা কম্পিউটারে কাজ করতে থাকলে কী-বোর্ড হোত তার বসার মাদুর। মৃদু ঘর ঘর আওয়াজ করতো এবং ওর শরীর কাঁপতো তৃপ্তির আত্মমগ্নতায়।

“একটু পিঠটা চুলকে দেবে? আচ্ছা, না হয় একটু হাত বুলিয়েই দাও।”

আমি চটে যেতাম, “যা সর, আমার কাজ অনেক।”

ভ্রুক্ষেপ নেই। হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চাই, ম্যা….এ….এ…কিন্তু সরবেনা। জোর করলে ম্যাও ম্যাও ম্যাও- কী সরব প্রতিবাদ তার। “সারাদিন কাজ করো, কাজ- কাজ – কাজ, সবকিছু বাদ দিয়েছো, কাজ ছাড়া কোনো জীবন নেই তোমার, আনন্দ- ফুর্তি নেই, বন্ধু-বান্ধব নেই, আর কত? আমাদের একটু সময় দেবে কবে? জীবন কী সীমাহীন?”

কথাগুলো আগেও বহুবার শুনেছি।

বিরক্তিতে মাথায় রক্ত চড়ে যায়, একশটি প্রেসক্রিপশন পাঠাতে হবে, পঞ্চাশটি চার্ট শেষ করা হয়নি, তিনশটি ল্যাব রিভিউর হ্যাঙারে ঝুলে আছে। বন্ধুর লিটলম্যাগে লেখা দেবো দেবো করে তিনমাস ঝুলিয়ে রেখেছি, সে উপেক্ষিত অনুভবে গালে বেলুন ফুলিয়েছে।

সামনে থেকে দুহাতে তুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে দেই ওকে।

“যা, ভাগ এখান থেকে।”

উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেই ঠাস করে। ওপাশে ওর প্রতিবাদের কণ্ঠ অবহেলার অপমানের জানাননি দিয়ে চলে যায়।

 

এখন বাথরুমের কার্পেটে নেতিয়ে থাকে সে। ডাক দেই, মাশা।

মাথা তুলে চোখ খুলে তাকায়। অর্থহীন, শূন্য দৃষ্টি।

কেমন আছিস?

মিঁয়াউ!

গায়ে বল নেই?

মিঁয়াউ!

কোথাও ব্যথা হচ্ছে?

মিঁয়াউ!

প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেয় সে।

আগে খুব খেতে পছন্দ করতো।কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে একেবারে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। খেলেই বমি করে। ওজন কমে যাচ্ছে দ্রুত। মোটেও মোটা ছিলোনা, কৃশও নয়, বেশ সুন্দর ছিল শরীরটি। পশমগুলো চিক চিক করতো, হাত বুলাতে গেলে যেন হাত পিছলে যেতে। চেহারায় ছিল সপ্ত আসমানের অলৌকিক ঝিলিক। এখন কেমন একটা মলিনতা সারা শরীরে। প্রতিটা হাড় গোনা যায়।

আমরা রাতে বিছানায় গেলেই যেখানেই থাকুক ছুটে আসতো। না ঘুমানো পর্যন্ত মুখ দিয়ে হাতে গুতা দিয়ে পিঠে গলায় মুখে হাত বুলিয়ে দেবার দাবী করতো। যখন তন্দ্রা এসে যেতো, হাত থেমে যেতো, সে পাশে বসে সামনের দুইপা তুলে দিতো বুক বা পেটের ওপরে। কখনও আমার, কখনও শ্বেতার। পেটের কোমল ওম দিয়ে জড়িয়ে রাখতো কম্বলের মত। গত ৯ বছর এই ছিলো রুটিন।

ইদানিং পুলের দরজা খুলে দিলে, বাইরে গিয়ে বসে দূরে তাকিয়ে থাকে। আগে দরজাটা বন্ধ করলে ছুটে আসতো

সন্ত্রস্ত খরগোসের মতো, ম্যাও ম্যাও করে কান ঝালাপালা করে দিতো দরজা না খোলা পর্যন্ত। একটা উদ্বেগ বা অযৌক্তিক দু:শ্চিন্তা কাজ করতো ওর মধ্যে, দরজাটা যদি আর না খোলে, সে আর ফিরে আসতে পারবে না। সে হারাবে তার আশ্রয়, আদর ও নিরাপত্তা। মাশা কুড়িয়ে পাওয়া। অতি শৈশবে ঘোড়ার পায়ের নীচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া বাস্তুহীন পথের প্রাণি। কিন্তু আশ্চর্য তার সে উদ্বেগটা মিইয়ে গেছে এখন, দরজাটা বন্ধ করে দিলেও আর হাঁসফাঁস করেনা, নির্জীব বসেই থাকে। তাকিয়ে থাকে দূরে। দূর এখন আর দূর নয়, চোখের পাতায় এসে ভর করেছে। চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে এসেছে। মুদে আসে। ঘরে ফিরে আসা বা না আসায় কোনো তফাত আর নেই, খোলা অথবা বন্ধ দরজা আদতে একই- সে বুঝতে পারে।

ডাঃ টেইলার কল করেছিলো গতকাল। মাশার লিউকোসাইট খুব হাই!

কত?

৫৫

সময় খুব নেই, কষ্ট পেতেই থাকবে। ঘুম পাড়িয়ে দেয়াই হবে ওর জন্য সহজ ও নীরব নিষ্ক্রান্তি।- ডাঃ বলেছিলো।

ছন্দা হাউ হাউ করে কাঁদে। শ্বেতার মুখের মিমিক বিকৃত হয়ে আসে অবিশ্বাসে। ৯ বছর সে যত্ন করেছে মাশার, ৯ বছর কত বিরক্ত করেছে মাশা তার আপন সন্তানের মত।

২ সপ্তাহ অতিক্রম হয়েছে। মাশা এখন আর ফ্লোর থেকে ওঠেনা, ম্যাও ম্যাও করে না, চোখও খোলে না। মৃত্যুপূর্ব ট্রান্সের মধ্যে আছে সে, স্বপ্ন দেখে অন্তহীন একটি সিঁড়ির ওপরে উঠে যাওয়া যার মেঘগামী আরোহী সে। অনেক ডাকাডাকি করলে মাঝে মাঝে ওর কণ্ঠ থেকে যে আওয়াজটি বের হয় তা কান্নার গোঙরানির মত শোনায়। কালো গুমোট মেঘে ঢাকা আকাশ। ওক পাতায় ছোট ছোট অশ্রুকণা। বাড়িতে আপনজন হারানোর বরফ জমাট কষ্ট।

তিনদিন হলো মাশা কিছুই মুখে দিচ্ছেনা। ছন্দা ডিপ্রেশনে ভুগছে। সে সব কাজ ছেড়ে মাশাকে কোলে নিয়ে কাঁদে। চোখ মুখ ফোলা। তার বাইপোলারের শক্তিশালী মেডিসিনগুলোও কাজ করছেনা। মুড সুইং হচ্ছে ঝড়ে সমুদ্র-তরঙ্গের মত।

রাতে সে মাশাকে নিয়ে ঘুমায়। অথচ মাশা ছেড়া ন্যাকড়ার মত এখন- থেকেও নেই।

ঘুম পারিয়ে দেয়া দরকার- বলি কিন্তু বুকে ঝড় উথাল পাথাল করে। কেউ রাজি হতে চায়না।

কষ্ট দীর্ঘতর হচ্ছে, শান্তিপূ্র্ণভাবে যেতে দেয়াই মানবিক- আমাকেই সিদ্ধান্তটি দিতে হয়।

আমি গাড়ি চালাচ্ছি, মাশা শ্বেতার কোলে একটা বেতের ঝুড়ির মধ্যে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। দুই পাশে ঘন বন। লম্বা লম্বা পাইনগাছ আকাশ ছুঁয়েছে। মেঘের ছায়ার ছাই রং চারিদিকে।

ম্যাঁও – ওর ক্ষীণ কণ্ঠ আওয়াজ করে। চোখ মেলে তাকায়, তারপরে উঠে দাঁড়ায়। শ্বেতার মুখে তাকায়, আমার মুখেও। তারপরে জানালা দিয়ে বাইরে দেখে। সম্পূর্ণ সজাগ।

কতদিন হলো এমনটা দেখিনি অথচ মাত্র ২০ মিনিট দূরে খোলা দরজা। সে কি টের পেয়েছে?

“মাশা ঘুমা ঘুমা”- ফিস ফিস করে শ্বেতা ওর পিঠে হাত বুলায়। মাশা শুয়ে পড়ে।

গাড়ি থেকে বের হবার সময়, আমিই ঝুড়িটি নিই। মাশার খুব প্রিয় এই ঝুড়িটি। এতেই সে ঘুমাতো অনেক সময়। তুলোর ওপরে পাতলা কম্বল বিছিয়ে নরম বিছানা করে দিয়েছিল শ্বেতা।

অফিসে ঢোকার মুখে আবার ওর কণ্ঠ শুনি।

খুবই নরম কণ্ঠ।

ডা: টেইলর বলে, “২ সপ্তাহে ওজন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। সেও আমার কথার প্রতিধ্বনি করে, “সি ইজ সাফারিং, ইটস দি মোস্ট ইউম্যান থিং টু ডু।”

সেডেটিভ ইনজেকশন দেয়া হয়।

কিছুক্ষণ পরে মাশা বমি করে। তারপরে কিছুক্ষণ কেমন একটু ছটফটে ভাব। ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে চায় কিছু, “দাস্ বিদানিয়া?” (বিদায়?)

তারপরে শুয়ে পড়ে নির্জীব, সামনের পা দিয়ে মুখ ঢেকে।

সে এখন শ্বাস নিচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর, পেট উঠছে নামছে কামারের হাপড়ের মত। কোন শব্দ নেই। শ্বেতা ওকে ধরে কাঁদছে হাউ হাউ করে। নার্স এসে সামনের পায়ের কিছু অংশের পশম শেভ করে দেয়। ডা: টেইলর শিরায় ফেনোবার্বিটাল পুশ করে। তারপরে স্ট্যাথোস্কোপ স্থাপন করে বুকে। নৈশব্দের অনুপল-যুগ।

“হার্ট বিট থেমে গেছে।” ডা: টেইলরের কণ্ঠ কাঁপে।

মাশার চোখ খোলা, সবুজ চোখ, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক।

ফিরছি মাশাকে নিয়ে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।

শ্বেতার কান্না থামছেনা। বলি, “মাশা তো যত্নেই ছিলো। কষ্ট পাচ্ছিল। কষ্টের অবসান হলো। কেঁদোনা।”

কথা সুন্দর, শব্দ সুন্দরতর, কিন্তু বুকতো অনুভূতি ল্যাত ল্যাতে। ঘরে ঢুকতেই গুবি ঝুড়িটা শুঁকতে থাকে। কোনোমতেই থামবে না, সরবে না।

“গুবি সরে যা”-শ্বেতা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে।

“থাকনা- ও হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে।”

অনিন্দ্য চোখ মুছতে মুছতে কবর খনন করছে ব্যাকইয়ার্ডে। ঝুড়ি হাতে সেখানে এগিয়ে যাই। গুবি পিছু ছাড়ে না। সচরাচর গলায় রশি ছাড়া ওকে বাইরে যেতে দেইনা। বড় চঞ্চল, স্বাধীনতা পেলেই ছোটাছুটি করে।

দরজা খুলে ডাকি, “আয়।”

শ্বেতা বলে, “না না, দৌড়ে কোথাও চলে যাবে।”

গুবি আজ কোথাও যায়নি।

গুবি মানুষ নয়, কিন্ত অনুভূতি মানুষের মতই।

৪ ফিট মাটি খোঁড়া হয়েছে।

পুস্ত্ জিমলিয়া বুদিত তিবিয়ে পুখম* মাশা- শ্বেতা ওকে শুইয়ে দেয় মাটির বিছানায়। অনিন্দ্যের কোদাল নড়ে ধীরে ধীরে।

মোটা একটি গাছের ডাল কেটে পিতা-পুত্র দুজনে একটি ক্রুশ তৈরি করি। ঈশ্বরপুত্র এমনি একটি ক্রুশ কাঁধে গলগোথা পাহাড়ের খোলা দরজার দিকে গিয়েছিলেন।

এপিলগ

চার দিন অতিক্রম হয়ে গেছে মাশা চলে যাবার পর।

বাইরে শ্রাবণরাত নির্জনে ঝরছে।

ভোর চারটা।

শ্বেতা কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে সন্তানহারা মায়ের মত। প্রতিটি রাতই কাঁদে। আমি তার চুলে বিলি করে দিচ্ছি এবং আমার মুখে সি-প্যাপ মেশিনের মাস্ক জলে ভিজে গেছে।

জুন ১৮-জুলাই ১১, ২০২১

*মাটি তোমার জন্য পাখির পালকের মত নরম হোক।