You are currently viewing বৃষ্টিরাতের অভিসারিণী / কাজী রাফি

বৃষ্টিরাতের অভিসারিণী / কাজী রাফি

বৃষ্টিরাতের অভিসারিণী

কাজী রাফি 

গুলশানের মূল রাস্তার দুপাশের কৃষ্ণচূড়া এবার যেন বেশি সবুজ। তার ফুলগুলোতে লালিমা আরো বেশি ঢলঢল করছে। জাপানিজ চেরি ব্লুসমের অনবদ্য সৌন্দর্য সেই লালের সাথে এমন দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে যে, এলাকাটি তার আভিজাত্য নিয়েও নববঁধূর মতো বিনয়ী। বিকেলে এই সৌন্দর্যটুকু বড় অনন্য বলে বিকেলে এই পথে হাঁটার প্রবল ইচ্ছা হয়। কিন্তু বিদেশি অ্যাম্বাসিতে নতুন যোগদান করায় কাজ গোছাতে গোছাতে আমার সন্ধ্যা হয়ে যায় বলে সেই ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে হয়।

কাজ শেষে সন্ধ্যায় ক্লান্ত পায়ে ঘরে ফিরছিলাম। ঘর মানে, একটা অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘর, ড্রয়িং রুম, শৌচাগারসহ ভাড়া নেওয়া একটামাত্র সুপরিসর ঘর। অভিজাত এই পাড়ায় এমন ব্যবস্থা আছে তা জানতাম না। পরিপাটি করে গুছিয়ে নেওয়া আমার ঘরটা আমার বড় প্রিয়। প্রিয় আমার সোফা কাম বিছানা এবং পড়ার টেবিলটাও।

মধু জৈষ্ঠ্যে এখন রোজা শুরু হয়েছে। ইফতারের পর ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল। গত সন্ধ্যায় কালবৈশাখির ঝড়বৃষ্টির পর তাপদহের পরিবর্তে আজ মিষ্টি, স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। আমার কানের দুপাশে চুলগুলো বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছিল। বুঝতে পারছি, আবার একটা ঝড় আসছে। আবহাওয়ার সংকেতে দূর্যোগের ঘনঘটা। ফণি নামের প্রবল ঝড় নাকি সাগর তছনছ করে এগিয়ে আসছে। তার মানে আজ রাতটাও হবে দারুণ বর্ষণমুখর। ঝর ঝর বৃষ্টির একটা রাতের কথা ভাবলেই আমার কেমন যে আনন্দ হয় –তা ঠিক বুঝাতে পারব না। বাতাস আপাতত আমার চুলকে এলোমেলো করে সেই আনন্দঘন রাতের আগমনকে স্পষ্ট করছে। চুলে বাতাসের সেই এলোমেলো স্পর্শ আমাকে বলছিল, আমার পেছনে কেউ একজন আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। সেই ছায়াটি আমার চেয়ে নিশ্চিতভাবে লম্বা। পেছনে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলাম। পেছনের ছায়াটি কাছাকাছি হয়ে নারীকণ্ঠে সুমধুর স্বর তুলে বলল,

ওয়ান নাইট কস্টস অনলি এইট থাইজেন্ড, স্যার। বাট আই অ্যাসিওর ইউ ইনজয় মোর দ্যান ইয়োর মানি।

মেয়েটি আমার পাশাপাশি এলো। একটা পাতলা কালো জ্যাকেট তার পরণে। বাংলাদেশের এই গ্রীষ্মকালে আমরা দুজনেই একই ধরণের পোশাক কেন পরে আছি –তা নিয়ে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। মেয়েটি তাহলে আমার মতোই দামী কোনো অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের শীতে জর্জরিত থাকে? তা হলে ওমন প্রস্তাব দেয় কীভাবে সে? আমি তার মুখের দিকে তাকানোর আগে পায়ের দিকে তাকালাম। সে কম করেও দুই ইঞ্চি উঁচু কালো জুতা পরে আছে। সেই জুতাদ্বয়ের সুদৃশ্য কাটা কাটা অংশে সাদা বোতামগুলো নক্ষত্রের মতো তাকিয়ে আছে। তাই হয়তো আমার চেয়ে তাকে দুই ইঞ্চি লম্বা লাগছে। তবু, কম করে হলেও তার উচ্চতা পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চি হবে –এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মেয়েটা মনে হয়, নিজেও নক্ষত্র হতে চেয়েছিল অথবা এখনো চায়। সে কি এই ধারণা পোষণ করে যে, নক্ষত্রের রাতের পরিপার্শ্ব যত অন্ধকার ততই সে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে?

তার ঋজু মেদহীন দীর্ঘ শরীর থেকে কোনো এক পাহাড়ি বনের ভেজা পাতার ঘ্রাণ ভাসছে। সেই ঘ্রাণ পরিণত হচ্ছে ক্যামেলিয়া-জবা আর আপেলের মিশ্রিত কোন সৌরভে। আমার স্মৃতি এবং চেতনায় সৌরভটুকু ছড়িয়ে গিয়ে আমাকে তার প্রতি আরো মগ্ন এবং আগ্রহান্বিত করছে। তার ছেড়ে দেওয়া চুলগুলো যদিও কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। কিন্তু তার কেশগুচ্ছ কালো জ্যাকেটের সাথে তার গোলাপি মুখমণ্ডলের আভাকে আরো স্পষ্ট করে তুলছে। তাকে ভালো করে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। মুখে বেশ কয়েকটা ব্রুণ তার উদ্ভিন্ন যৌবনের উন্মত্ত প্রতীক হয়ে আমার হৃৎস্পন্দনকে ছলকে তুলল। তার মোহনীয় গভীর কালো চোখ দুটোতে চোখ পড়তেই আমি সব ভাষা হারিয়ে ফেললেও সে মিষ্টি হেসে বাংলায় বলল,

আমি জানি, সম্মতি না দেওয়ার মতো কাপুরুষ তুমি নও। এই যে, মিষ্টি জারুল ফুল দেখছ, বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও আমি এই জারুল ফুলগুলোর মতোই নরম।

বলে সে আমার হাত ধরল এবং এমন ভঙ্গিতে সে সামনে পথ এগুতে থাকল যেন সে, নিজের বাড়ির পথে হাঁটছে। এবার স্পষ্ট করেই তার শরীরের সৌরভ আমাকে আছন্ন করল। নিজের অজান্তে কখন তার বাহুর ভিতর আটকে থাকা আমার বাম হাতের আঙুল দিয়ে তার লম্বা আঙুলগুলো জড়িয়ে নিলাম। আমার মনোযোগ পথের দিক থেকে হারিয়ে তার মাঝে যত নিবিষ্ট হলো, মেয়েটার কাছে গন্তব্যটুকু ততই যেন স্পষ্ট বলে তত সে পথের দিকে মনোযোগি হলো। এই মনোযোগেও তার কেমন এক আনমনা অভিব্যক্তি আমাকে ক্রমশ সেই রহস্যময়ীর উন্মাতাল আহবানের মাঝে ডুবিয়ে নিতে থাকল।

সে আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটটা চেনে দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যদিও একবার সে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তাকে আশ্বস্ত করলাম,

এটাই আমার অ্যাপার্টমেন্ট।

বলে দরজার তালা খুললাম। বুটজোড়া খুলে বাইরে না রেখে সন্তর্পণে তা সে ঘরের ভিতর এনে দরজার পাশে রেখে দিল। যেন চায় না, বাইরের কারো এই ফ্ল্যাটের ভিতরটুকু নিয়ে আগ্রহ জন্মাক। সে ভিতরে ঢুকে চিরচেনা ভঙ্গিতে তার জ্যাকেট খুলে সোফার উপর ফেলে দিল। শরীর মেদহীন হলেও ভি গলার লাল গেঞ্জিতে তাকে চেরি ফলের মতোই স্নিগ্ধ আর জারুল ফুলের মতোই উদ্ভিন্ন লাগছিল। সে সোফাতে গা এলিয়ে বলল,

আজকের বিকেল আর মাত্র ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাটা সুইজারল্যান্ডের নীল খালটার পাশে সুন্দর হোটেলটিতে কাটানো সেই রাতের মতো… তাই না?

কী আশ্চর্য, অনেক চেষ্টা করেও আমি জুরিখে তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো স্মৃতি মনে করতে পারলাম না। মাত্র চারদিন থেকেছি সেখানে, কিন্তু সত্যি হলো এই- অনেক ভাড়া বলে লেকের পাশে হোটেলে কখনোই থাকা হয়নি। এই মেয়েটা কি অবলীলায় মিথ্যা বলছে! কিন্তু তাকে তার মিথ্যাটুকু ধরিয়ে দিতে চাই না। সে কি কাকতালীয়ভাবে অন্য কোন তরুণের স্থলে আমাকে ভেবে ভুল করছে? এই মিথ্যা আর ভুল ধরিয়ে দিলেই যদি সে এখনোই, ‘ওহ, স্যরি, ইউ আর নট দ্যট ম্যান আই’ভ থট ফর’ -বলে চলে যায়? তার চলে যাওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারছি না। আমার নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন জীবন তাহলে বন্ধুর খোঁজার তাড়নায় চরম ভুলপথে পা বাড়াবে। আমার বেতন আমার বয়সি যে কারো কাছে ঈর্ষনীয় হলেও তা বেশ আকর্ষকও বটে। সুতরাং আমার কেমন বন্ধু জুটতে পারে এই পাঠহীন, মননের আকাল লাগা, অভাবীদের রাজধানীতে? তার চেয়ে আমার সংগ্রহীত গ্রন্থের মাঝে, আমার কল্পরাজ্যে ডুবে থাকাই আমার জন্য বেশ নিরাপদ।

আজ আবার টাকার গন্ধেই কি মধুমাছি এলো? আট হাজার টাকা বড় কোনো বিষয় নয়। আমার ভাবনা তাড়িত হচ্ছে অন্য বিষয় নিয়ে। তা হলো – সুইজারল্যান্ডে এক সেমিনারে অংশ নেওয়া  আমার স্মৃতিকাতরতার সেই সুইচ রাতগুলো। কাকাও সমৃদ্ধ চকলেটের ঘ্রাণ আর স্বপ্নবোনা উদার প্রান্তরে আমি কী সব বুঁনো ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিলাম। বারবার হোটেলের বারান্দায় গিয়ে জোছনায় নববঁধূর অবগুণ্ঠনের মাঝে নিজের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখা আল্পসের সাথে বিস্তৃত নীল জলের খালের প্রকৃতিকে দেখছিলাম। ওমন দৃশ্যপানে চোখ রেখে আনমনা হয়েছি আর বার বার, শতবার যৌবন শুরুর দিনগুলোতে ফেলে রাখা কী যেন স্বপ্নঘোরে তলিয়ে গেছি। অবগুণ্ঠনের ভিতর লুকানো একজোড়া চোখ খুঁজেছি আনমনে। কৈশোর কাল থেকেই প্রবল অথবা টিপটিপ বৃষ্টির দিনে যে চোখজোড়া আমি খুঁজেছি মেঘের চাদর দিয়ে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতির মায়াবী আলো-আঁধারিতে।

আজো তা খোঁজার নেশায় মেয়েটার দিকে তাকালাম। আমার আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে হয়তো দেখেছি অথবা দেখিনি সেই সম্মোহনী নেত্রদ্বয় –সাথে সাথে বুকের মাঝে ছলকে উঠেছে রক্তের বান। জুরিখের সেই রাতগুলোতে কল্পিত চোখের সাথে মেয়েটার চোখ মেলাতে গিয়েই বুকের রক্তস্রোত হৃদপিণ্ডের মূল অলিন্দ ছেড়ে প্রবাহিত হতে থাকল শিরায়-শিরায়। সবুজ আল্পস থেকে ছলকে পরল তারা জুরিখ লেকের নীল জল থেকে আকাশের ঊর্ধ্ব সীমানায়। মেয়েটাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম,

তোমার নাম কি এমা? কিন্তু তাকে হারানোর ভয়ে মুখে তা উচ্চারণ করলাম না। সে বাম পায়ের উপর ডান পা তুলে আয়েশের সাথে বলল,

আমার নামটা ভুলে গেছ, তাই তো? এত তাড়াতাড়ি? হ্যাঁ, আমি এমা।

তাই তো, হ্যাঁ মনে পড়েছে। এমাই তো। সাথে সাথে তাকে বলতে চাইলাম, তোমার বাম বাহুর নিচে বুকের বাকের কাছে একটা লাল দাগের স্পর্শ আছে। যেন, চিরন্তন এক চুমোর বদল জিহবার রক্তস্পর্শ!

কিন্তু লজ্জায় তা আর বলা হলো না। এমা হাসল। তার চোখে খেলা করল ছলনা আর রহস্য। বলল সে,

আমাকে নিয়ে তোমার দ্বন্দ্ব কাটছেই না দেখি। পরিচয় দেওয়ার পরিবর্তে তোমার কাছে আট হাজার টাকা কেন চাইলাম –তাই ভাবছ তো?

কী আশ্চর্য, আমি তাই-ই ভাবছিলাম। এমা তখন বলেই চলছে,

ওটা জাস্ট মনে করিয়ে দেওয়া যে, ত্রিশ দিনে তুমি কত বেতন পাও। আমার জন্য এক রাত মানে তোমার এক দিনের বেতন তো। মাসে তাহলে কয়টা রাত তোমার অভিসারিনী হলে তোমার পকেটের কোনো সমস্যা হয় না–এই আর কি! জীবন তো খুব ছোটই; না?

এবার সে উঠে দাঁড়াল। বাম পাশের বাতির বিচ্ছুরিত আলোতে ডান দেয়ালে এমার ছায়ার প্রতিবিম্ব দেখে আমি চমকে উঠলাম। তাই তো, আমি এই নারীকে চিনি বহুকাল আগে থেকে। এমার চেয়ে তার ছায়াটা আমার কাছে বেশি পরিচিত। হ্যাঁ, অনেক মুহূর্তও কেটেছে আমার তার সাথে। কিন্তু, কোথায়, কখন কীভাবে সেই মুহূর্তগুলো স্মৃতি থেকে অতল স্মৃতিতে তলিয়ে যাচ্ছে –তা ধরতে আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সেই সমস্যাটাও কেটে গেল যখন এমার ছায়াটা তার শরীরকে আরো ঋজু এবং ধারালো করে তুলল। হ্যাঁ, সে শরীর থেকে কাপড় খুলছিল এমন ভঙ্গিতে যেমন ঘরে প্রবেশের সময় জুতা খোলা বাধ্যতামূলক। ছায়া ছাড়া এমার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। খুব ভয় করছিল, তার দিকে তাকালে কী পরিণতি হবে –এই ভেবে। স্বপ্ন-কল্পনার নারীকে পাওয়ার নেশায়  আমি কি এই ক্ষণের জন্য সারাজীবন ‘অপেক্ষা’ নামের চরম মানসিক ভোগান্তিতে এত ভুগেছি যে, সেই অপেক্ষার অবসানকালে আমার হৃৎস্পন্দন এমন বল্গাহীন!

কোমর থেকে বেল্ট আর জিন্স খুলতে খুলতে এমা এবার আক্ষেপের সাথে বলল,

কিন্তু, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, জুরিখ থেকে ফেরার পর তুমি আর কোনো নারীর সাথে মিলিত হওনি?

তাকে কীভাবে তা বিশ্বাস করাই? সে কী বোঝে না, আমার জীবনে কল্পনার যে সমীকরণ তার সাথে এই শহরের মেয়েদের জীবনাচরণ যায় না। কার সাথে মিলিত হয়ে কোন ফ্যাসাদে আমি জড়িয়ে যাব –তা কি সে বুঝতেই পারে না। কে কখন, কীভাবে আমাকে তারপর আড়ি পেতে আমার ব্যক্তিগত জীবনের যা কিছু –তা নিঃশেষ করে দেবে –তা কি সে ঢাকায় এসেও বুঝতে পারে না? বোঝে না কেন সে, এখানকার ঋতু বৈচিত্র্য আর জারুলগুলো অনন্য হলেও আস্থা আর বিশ্বাসের জায়গায়টুকুতে বিরাট এক গহবর। যেখানে মানুষ আত্মা-সত্তা চেনার চেয়ে তার সামাজিক অবস্থানকে শুধু চিনতে চায় সেখানে কি ভালোবাসার মানুষ পাওয়া যায়? কিন্তু, এক রাত কাটানোর বিনিময়ে এমারাও তো টাকা খোঁজে… তবু কেন তাকে নিয়ে এত অস্থির লাগছিল আমার?

এমা জিন্সটা ছুড়ে ফেলে দিল সোফার প্রান্তে। এবার ডান পায়ের ওপর বাম পা তুলে বলল,

হুম, এটাও ঠিক –এই শহরের বাতাসে সালফাইডের গন্ধ। কার্বনের হলাহল, মানুষের খুব বেশি কোলাহল। ভালোবাসার অনুভব হারিয়ে যায়।

এই কথার পর আমি ছায়া থেকে মুখ সরিয়ে রক্ত-মাংসের এমার দিকে তাকালাম। তার ভয়ংকর শরীরি সৌন্দর্য আমার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত করার পরিবর্তে বরং থামিয়ে দিল। আমি ভিতরে ভিতরে ঘেমে উঠছিলাম। আমাকে ওভাবে স্থির বসে থাকতে দেখে সে বলল,

তুমি কি দ্বিধান্বিত! আহা, যদি জানতে পৃথিবীর মানুষের কর্মকাণ্ড –তাহলে বুঝতে ভালোবাসাবাসির সময়টুকু ছাড়া মানুষ শুধু ধ্বংসের মাঝেই লিপ্ত হয়ে আছে। আগামী চব্বিশ ঘণ্টা পৃথিবীর মানুষ যা করবে তা যদি তুমি ঈশ্বরের স্থানে গিয়ে একটা খোলা পাতার ন্যায় দেখতে সক্ষম হতে …

এমার জ্ঞানগর্ভ কথা আমাকে বিস্মিত করল। তাকে এবার জিজ্ঞাসা করার লোভ সামলাতে পারলাম না,

তাহলে কী দেখতাম?

চব্বিশ ঘণ্টায় বিশ্বের মানুষগুলো দুই লক্ষ গাড়ি তৈরি করবে যার জন্য ৮০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল প্রয়োজন। তারা এক কোটির অধিক গাছ কেটে ফেলবে অথচ এর মাঝে আমরাসহ নতুন জন্মানো আরো তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বাচ্চার প্রতিজন গড়ে ২৩০০০ বার শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করব। ১৫০ থেকে ২০০ প্রজাতির জীব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জেফ বেজোস একাই ২৭৫ মিলিয়ন ডলার আয় করলেও ঢাকায় দরিদ্র একজন হয়তো ২৭৫ টাকা আয় করতে গলদঘর্ম হবে। অস্ত্র উৎপাদন হবে সীমাহীন যার মধ্যে আমেরিকার জনগণ কিনবে ৫৭,০০০ –এর বেশি আগ্নেয়াস্ত্র। শুধু ব্রাজিলেই হত্যা করা হবে ১৬৮ জনকে।  বিভিন্ন অপরাধের কারণে চব্বিশ ঘণ্টায় ২৯০০০ জন গ্রেফতার হবে। ভালো কাজও হবে। এক কোটি আশি লক্ষ মানুষ তাদের জন্মদিন পালন করবে, ছয় হাজার পাঁচশটা বিয়ে হবে আমেরিকাতেই (যদিও এশিয়া মহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভাঙবে তার চেয়ে বেশি)। কিন্তু তুমি যদি ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, যুদ্ধ, ধর্মীয় উগ্রতা, গুম-খুন, মানব-পাচার, দখল এবং উৎখাতের সংস্কৃতিসহ মানুষের অন্যান্য কুকীর্তির পরিসংখ্যান দেখো –তাহলে নিশ্চিতভাবে তোমার মনে হবে –মানুষ বস্তুত মেতে আছে ধ্বংসযজ্ঞে। এসো আমরা ভালোবাসি এবং অনুভব করি জীবনের অন্তত একটা অনাবিল আনন্দের রাত।

তুমি প্রজ্ঞাময়ীও বটে।

তুমিও কম যাও না। সুইজারল্যান্ডে দেয়াল-লিখন নিষেধ, অথচ সেখানকার অনেকগুলো দালানের দেয়ালে, পাহাড়ের গায়ে, তোমার হোটেলের জানালার গ্লাসে লিখে রেখে এলে যে, আমাকে তোমার প্রয়োজন।

সেজন্যই তুমি এলে?

দেখো, জুরিখে আমার সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে। কিন্তু, তোমার মতো করে আমাকে কেউ কখনো চায়নি। আল্পস পর্বতশিখর থেকে নেমে আসা খালের নীল জলে তোমার মতো করে আমার প্রতিচ্ছবি আর কেউ দেখেনি। তুমি যে জাহাজের পেছনে দাঁড়িয়ে তার পেছনে ফেলে আসা অযুত জলরাশির মাঝেও ‘এমা’, ‘এমা’ শব্দগুলো লিখেছিলে, তা এখন ইউরোপের বাতাসের গায়ে গায়ে মোম হয়ে গলতে গিয়ে আরো শক্ত হয়ে লেপ্টে যাচ্ছে।

কিন্তু…

খটকা তোমার লাগতেই পারে। বিনা পয়সায় অথবা শ্রমে কেউ আমাকে পাক তা আমি চাই না। আমি কারো আনন্দের পানসে স্মৃতি হতে চাই না। তোমার হৃদয়-ক্ষতের রক্তে লেখা সেই আমাকে একান্ত করে পাওয়ার চেয়ে এই অর্থমূল্য নিশ্চয়ই বেশি কিছু নয়।

এমার শেষ কথাগুলো যেন একটা পুরো কাঁচের দেয়ালে বৃষ্টির ঝাপটা অথবা বরফঝরা শীতল রাতের কুয়াশার মতো লেপ্টে লেপ্টে গেল। শব্দগুলো গলে গলে পড়তে গিয়েও অক্ষরের শরীর হয়ে অবশেষে আমার কানে অনুরণন তুলল। এতক্ষণ পর আমার মনে পড়ল, এমা আমার স্মৃতিঘোরে রেখে দেওয়া আমার স্বপ্নকল্পনাকে আমার চেয়েও বেশি লালন করে রেখেছে। তাইতো, এমাকে আমি যৌবনের প্রথম অনুভবে খুঁজে পেয়েছিলাম প্রবল বর্ষণের এক মধ্যাহ্ণে। তাকে সেই গল্প বললাম।

নির্জন মাঠের মাঝে বিরাট এক জলাশয়। তারই পাড়ে আম-জামের ঘন ছায়া ঘুমকাথায় জড়িয়ে নিয়েছে মেঘের কোল থেকে ঝরা বৃষ্টিলগ্নের আঁধারকে। না দিন, না সন্ধ্যা, না ভোররাত –সময় নিয়ে আমার কোনো ধারণাই স্পষ্ট হচ্ছিল না। সকাল-বিকেল এমনকি সন্ধ্যা আলোর পার্থক্য ঘুঁচানো সেই সময় ঘন ডালপাতার ভিতর গোলাপি-ত্বকের এক পরি খিলখিল করে হেসে আমাকে ভয় পাইয়ে দিল। ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার অনুভূতিতে নিজের দাঁতে দাঁত লাগার শব্দ পাচ্ছিলাম। সেই পরি তার লকলকে শরীরের উষ্ণতা আর আলো দিয়ে আমার পাশে নেমে এলো। মনে হলো গ্রিক কোনো বৃষ্টি-দেবীকে দেখছি। বৃষ্টির কোনো ফোঁটা, আঁধারের কোনো কণা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু কি আশ্চর্য, খেয়াল করলাম; সেই দেবীর বাম কাঁধের নিচে আমার শৈশবে হারিয়ে যাওয়া মায়ের কাঁধের তীলের মতোই একটা তীল রয়েছে! বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমি তাকে দেখলাম এবং অস্ফুট কণ্ঠে তাকে সম্বোধন করলাম ‘এমা’ বলে।

তার শরীরে ক্যামেলিয়া-জবা এবং আপেল মিশ্রিত বৃষ্টিভেজা রাতের ঘ্রাণ। বড় বড় কাজল আঁকা চোখে স্বর্গীয় স্নিগ্ধতা। আমাকে সে অভয় তো দিলই, চোখে চোখ রাখল। তার গাঢ় নিশ্বাসের ওঠানামাকে মনে হচ্ছিল নিবিড় কোনো জীবানাশ্রয়। বৃষ্টি থামল। দুপুর গড়িয়ে সময়টা যে শেষ বিকেল তা টের পেলাম ঘন কালো মেঘের ফাঁকে হেসে ওঠা সূর্যের অন্তিম এবং ভুতুড়ে আলোয়। সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও তাকে ছেড়ে আমার আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করেনি।

সন্ধ্যা রাতে হারিকেনের আলো নিয়ে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হওয়া গ্রামের লোকগুলোকেই তখন আমার বিরক্ত লাগছিল। এমা নামের সেই পরিকে ছেড়ে যেতে আমার তখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।

হ্যাঁ, তুমি লেক-জুরিখের জলের মাঝে আমার প্রতিবিম্বকে সেদিন এই গল্পটা বলেছিলে।

বলেছিলাম?

বলেছিলে। আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম যে, আমি সেদিন থেকেই তোমার কাছে আসার পথ খুঁজছি।

এতদিন সময় নিলে? সেখানে তো একাই ছিলাম, কেন এলে না?

সময় কই নিলাম? সেখানেই দেখা হলে আমাকে তুমি হারিয়ে ফেলতে। বিশেষত নারী হয়ে বিখ্যাত হওয়ার কত জ্বালা তা তোমাকে কীভাবে বুঝাই। তবে, ভয় পেয়ো না। এই কার্বাইড এবং কার্বনের অত্যাচার যত কমবে, যত প্রবল বর্ষণের রাতগুলো প্রলম্বিত হবে –তোমার কাছে আসা আমার জন্য তত সহজ হবে …

৩.

আমি তার অর্ধনগ্ন শরীরের পাশে গিয়ে বসলাম। সেই প্রবল বর্ষণের দিনে তাকে এত কাছ থেকে দেখেছিলাম। তার শরীরের আভার সংস্পর্শে নিবিড় হতে হতে তার তাপে মোমের মতো গলে গলে যেতেও একটা প্রশ্ন আমার মনের মাঝে নিবিড়ভাবে উঁকি দিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

তোমার বাম কাঁধের নিচে একটা লালচে বর্ণের তিল ছিল…

ওহ, তোমার মনে আছে? বলে সে তা দেখানোর জন্য তার শরীর উন্মুক্ত করেই চলল। যেন অনন্তকাল ধরে আকাশসম শরীরের মেঘের পর মেঘ খুলে খুলে নিজেকে উন্মোচন করেই চলছে। তার বিস্ময়কর সৌন্দর্য দেখে আমি তাকে অনুরোধ করলাম, আর আমাকে কখনোই ছেড়ে না যেতে। সে আমাকে জানাল,

জুরিখে তোমার হোটেলের ওয়ারড্রবে আমার শরীরের তীলটা খুলে লুকিয়ে রেখে এসেছি, তীলবর্ণের মতো আমার লালচে অন্তর্বাসের এক ভাঁজে। তুমি তো আবার সেখানে ফিরে যাবেই। তাই না? তুমি এখন পরিপূর্ণ এক যুবক। ছোট্ট এক তীলের জন্য তোমার অস্থির হওয়াটা মানায় না। অন্তত কার্বাইডের ঘ্রাণে ভরা ভেজাল বাতাসের এই শহরে।

আমি তীলের কথা ভুলে এমার অতল আদরে ডুবতে ডুবতে দূরে কোথাও হারিকেনের আলোয় কয়েকজন গ্রামবাসীকে ফিসফিস স্বরে কথা বলতে শুনলাম। তারা যেন আমাকে খুঁজে না পায় তার জন্য এমার ত্বকের ভাঁজে ভাঁজে অযুত মেঘরাশির ভিতর নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইলাম। এমা আদুরে কণ্ঠে বলল,

তুমি জুরিখের একখণ্ড সাদা মেঘের গায়েও কীভাবে আমার নাম লিখে এসেছিলে –তা ভেবে আমি নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ি –বার বার।

তাহলে আমার সাথে থেকে যাও। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, এই অন্ধকার বৃষ্টির বনে।

এমা মিষ্টি হেসে বলল,

আগামীকাল আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। প্যারিসে। আমি কোনো এক সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই আসব।

তুমি কি সত্যিই আসবে! শীত নামার আগেই? বরফ আর শীত আমি যেমন খুব ভয় পাই তেমনি ভালোওবাসি। তোমার মতো একজন পাশে থাকলে ভয়ের মাঝে কী যে আনন্দ –তা তো সেই কবে শিখেছি। প্রথম যৌবনের তারুণ্যে।  তুমি যদি আবার ফিরে এসো আমার কাছে তাহলে তোমার লম্বা আঙুলগুলো ছুঁয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করব, তোমার আগমন এবং প্রত্যাগমনের সাথে শীত শীত অনুভূতি অথবা তুমুল বৃষ্টিক্ষণের কী সম্পর্ক।

বৃষ্টির ঝাপটা পেরিয়ে হারিকেনের আলো ক্রমশ কাছে আসছিল। ফিসফিস অক্ষরগুলো এবার শব্দের শরীর হলো। তারা বলল,

ছোটবেলায় থেকেই ছেলেটার কী এক বদভ্যাস… বৃষ্টি হলেই নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে যায়।

কিন্তু তাদের কথায় মনোযোগ নেই আমার। শুনলাম কোনো এক নারীকণ্ঠ মিষ্টি স্বরে বলছে-

ওয়ান নাইট কস্টস অনলি এইট থাইজেন্ড, স্যার। বাট আই অ্যাসিওর ইউ ইনজয় মোর দ্যান ইয়োর মানি।