You are currently viewing বিষ্ণু বিশ্বাস ও তাঁর কবিতা >  লাবণী মণ্ডল

বিষ্ণু বিশ্বাস ও তাঁর কবিতা > লাবণী মণ্ডল

বিষ্ণু বিশ্বাস ও তাঁর কবিতা

লাবণী মণ্ডল

আশির দশক। দেশজুড়ে চলছিল আন্দোলন-সংগ্রাম। স্বৈরাচারী বিরোধী ওই আন্দোলনে যুক্ত হয় বাংলার ছাত্রসমাজ। তখন প্রতিদিনই দেখা যেত মিছিল, স্লোগানে মুখরিত থাকত রাজপথ। সবার একই ধ্যানজ্ঞান স্বৈরাচার হঠাও, গণতন্ত্র কায়েম করো। কেউ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, কেউবা কবিতা-গান-নাটকে।

কবিদের সংগ্রাম ভিন্ন। কখনও ভাতের অভাবে মরতে হয়, কখনও গুলিতে ঝাঝরা হয় বুকের পাঁজর। ইতিহাস খুব নির্মম। সুকান্ত-সোমেন চন্দদের ইতিহাস সে কথাই স্পষ্ট করে। আশির দশকে কবিতা লিখতেন বিষ্ণু বিশ্বাস। ১৮ বছরের টগবগে যুবক। তেজস্বী। আর ওই তেজস্বী মনোভাবের কারণে তিনিও কবিতার মাধ্যমে যুক্ত হন সংগ্রামে। যে কারণে আজও প্রাসঙ্গিক তিনি। যে ইতিহাস অতলগহ্বরে তলিয়ে গেছে, তা বাঁচিয়ে রাখার দায় নিয়েছেন কেউ কেউ। তারাই বিষ্ণু বিশ্বাসদের কথা আজও স্মরণ করেন।

বিষ্ণু বিশ্বাস। ১৯৬২ সালের ২৯ মে, জৈষ্ঠ্যের দাবদাহে ঝিনাইদহ জেলা সদরের পাশে বিষয়খালি গ্রামে তাঁর জন্ম। ঝিনাইদহের প্রতিটা জায়গা ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরা। জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে–নলডাঙ্গা রাজবাড়ী, সাতগাছিয়া মসজিদ, বারোবাজারের প্রাচীন মসজিদ, গাজী কালু-চম্পাবতীর মাজার, শৈলকূপা জমিদার বাড়ি, খালিশপুর নীলকুঠি, গলাকাটা মসজিদ, জোড় বাংলা মসজিদ, পায়রা দূয়াহ্, শাহী মসজিদ, শিব মন্দির, ঢোল সমুদ্র দীঘি, মিয়ার দালান, পাঞ্জু শাহ’র মাজার, কেপি বসুর বাড়ি, বলুদেওয়ানের মাজা। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর থাকার কারণেই কবির ভেতর হয়তো প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি মায়াবোধটাও তৈরি হয় সেখান থেকেই।

ঝিনাইদহের নলডাঙা ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে এসএসসি এবং ১৯৮১ সালে ঝিনাইদহ সরকারি কে সি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। সেখানে পড়ার সময় তিনি যুক্ত হন ছোটকাগজ ‘পেঁচা’ সম্পাদনার সঙ্গে। ভরাট কণ্ঠের বিষ্ণু ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বনন’-এর তারকা আবৃত্তিকার। পরে ১৯৮৫ সালে অনার্স পাস করে চলে আসেন ঢাকায়।

প্রকৃত কবি মাত্রই তাঁর যাপিত জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে কাব্যের রসদ সংগ্রহ করেন। অতপর চিন্তা, কল্পনা, উপলব্ধির রসায়ন প্রয়োগে কাব্য প্রাণ পায় সুসজ্জিত শব্দের ঝংকারে। ‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’ প্রবন্ধে গবেষক মাসুদুল হক বলেছেন, ‘তার কবিতার নন্দনতত্ত্বে পুরাণ, ঐতিহ্য ও সংগীতধর্মিতা লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার নান্দনিক সৌন্দর্যে দুর্বিষহ ক্ষয়িষ্ণুতা, স্তূপীকৃত অন্ধকার, জন্মের অসারতা, মৃত্যুবিষয়ক উপলব্ধি একটি বিশাল অংশ জুড়ে উপস্থিত।’ আবার ‘বাঁকের কবিতা : আশি ও নব্বইয়ের কবিতার সংক্ষিপ্ত পাঠ’ প্রবন্ধে আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেছেন, ‘এক প্রকার কাহিনী তৈরির প্রবণতা যা তার কবিতাকে ক্রমশ পরিণতির দিকে ধাবিত করে। কাহিনী বর্ণনায় তার দক্ষতা তাকে আলাদা করে দেয় অন্যদের থেকে। বিষ্ণুর কবিতার বিশাল ল্যান্ডস্কেপে, চিন্তার প্রগাঢ়তা পাঠককে অন্তর্লোকে নিয়ে যায়, সৃষ্টি করে গভীর দর্শন বোধের।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাসের সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে তৎকালীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে পংক্তি কবি উচ্চারণ করেন, তা যেন আজকের বাস্তবতায় আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। যে কারণে কবি বিষ্ণু বিশ্বাস আজও প্রাসঙ্গিক ও বর্তমান। তখন যে দ্রোহের ধ্বনি কবি রচনা করেন, সেখানে ছিল গণমানুষের মুক্তির বাণী। কবিতা মানে তা অনন্য। কবি লিখেছেন—

অসংখ্য চলেছে ধূলিপথে

যে পথ গিয়েছে জঙ্গলে আদি পাহাড়ে

মরণের যাবতীয় উপচার যেখানে, মারণের

আগ্নেয় স্রোতে বিচূর্ণ পাথরের ছাই

তুলে নাও, ছড়াও, সমগ্র ঊষর ভূমিতে।

সময়ের খোলা চোখ, অস্ত্রের সাধনা তোমার

প্রগতি, গতি, পথ এবং পাথেয়-সৌন্দর্যের

শিল্পের সামগ্রিকে নিমগ্ন শিল্পী হাঁটু ভাঙ্গা কাদাখোঁড়া পাখি, সামগ্রী, শব, শব, শব আমি শবের অধিপতি।

‘এগারো জন মৃত সংঘর্ষে’

‘ওদের কবর দাও’

‘ধর্ষিতা সাতটি মেয়ে

রক্তাপ্লুত, রক্তনিঃস্ব’

‘তারার আঁধারে আপাতত থাকো, রাখো অবগুণ্ঠন

লাল কমল নীল কমল ঝলমল

ধুয়ে দেবে শরীর ও মন’

‘তোমার বয়স পনেরোর নিচে, যাও, ঘুমাও

অথবা সাজো ধূলিযুদ্ধের জেনারেল

ওরা আসবেই–ডালিম কুমার।’

‘চূর্ণিত রক্তের শার্ট পথে ও পাথরে

কাটা মুণ্ডু অথবা সময়ের হাড়ের গোলা

পাবেই নিশ্চিত রক্তজবার মালাকৃতি

অথবা, মালা।’

‘ওখানে তিনজন সৈন্যের লাশ আর

নপুংসক চাঁদের ওপারে তারা নিবুনিবু

ঘৃতধৌত হেলমেট ঝুলে আছে মস্তকে-মৃতের।’

‘আর দ্যাখো, অগ্নি

চিতায় পুড়ছে শঙ্খের চাবুক

চিতা পোড়ে দাউ দাউ।’

‘আর দুগ্ধপোষ্য শিশু বিধবা ঝলসানো পাঁচজন কৃষিকার

চোখের কোটরে আগুন এখনো একটু একটু জ্বলে

গেয়েছিল ওরা

অগ্নিশুদ্ধির গান সারা রাত সারা দুপুরবেলা।’

‘ছড়িয়ে দাও ওখানকার ও পথের ধূলি

মন্ত্রপূত ধূলি

ধূলির ভিতরের শাদা শাদা ফুল শাদা ডানা

শটীর বনের হাহাকার ও হাওয়া। হাওয়া।’

‘এখানে রক্ত। রক্ত রক্ত রক্তের দিঘি;

‘কেউ চেনো কি, চেনে কেউ যারা মৃত, কেউ চেনো, চেনে কেউ, চেনো কি, কেউ চেনে?’ ভাঙো পথ ব্রিজ

সমর্থ বৃক্ষ থাক কামানের আগে

নোনা রক্তে বাদামি পাল

কালো সমুদ্রের হাওয়া

দোলা দোলা

সূর্যের গুঁড়ি গুঁড়ি অগ্নির দানা

সবুজে আরো সবুজে

আর কালো হাড় জ্বলে অন্ধকারে

যেন সঙ্গীত, মেঘমুক্তির মোহমুক্তির

প্রত্যাশার নদী শুধু বয় যেন ডন। (ভোরের মন্দির)

 

হ্যাঁ, ‘প্রত্যাশার নদী’ শুধু বয়। যার কোনো কূল-কিনারা থাকে না। অনবরত বইতে থাকে। কখনও হতাশ করে, কখনও উদ্বেলিত করে। কবি হয়ত সে রকম কোনো ভাবনা থেকেই এটি লিখেছেন। যেখানে সবুজের বর্ণনা রয়েছে। সূর্যের সৌন্দর্যের বর্ণনার প্রকাশ রয়েছে। চারদিকে হাহাকার। রক্তাক্ত। রক্ত দিয়ে হোলি খেলার ইতিহাসটুকুও এ কবিতায় রয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রচিত কবিতা আজও সমধিক প্রাসঙ্গিক, ফ্যাসিস্ট গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে। এখনও মুক্ত বিহঙ্গে উড়ার জন্য, মানুষ গান গায়। নাটক বানায়। কবিতা লিখে। এর রূপ কখনও প্রতিবাদী, কখনও ছন্দময়ী। কখনও প্রেমের আকুলতা থাকে, আবার কখনও দৃপ্ত তেজে জ্বলে উঠার জয়গান থাকে। যেটি ছিল বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায়।

সমাজ-রাষ্ট্রে যে বিরূপ বাস্তবতা–রাজনীতি যেখানে প্রতিশ্রুতি সর্বস্ব, সংবাদমাধ্যম যেখানে সেন্সরশিপে আড়ষ্ট–সেটি উপলব্ধি করে কবি তা তুলে ধরেন ‘সংবাদপত্রে একটি জনসভার রিপোর্ট’ কবিতায়। সেখানে বিষ্ণু বিশ্বাস বলেন–

‘তবে আমি বিচারক নই–আমি, তোমাদেরই মতো যন্ত্রণার শিকার। আমি বলবো, যা ঘটেছে, ঘটতোই এবং আরো ঘটবে যতক্ষণ না রক্তঝর্নার মতো ঘটনাগুলোর মুখরিত উৎসারণ আটকানো যাবে এবং একটি সত্য ধৃত হবে, সূর্য সত্যির মতো আলোময়। আমি চাই, শান্ত হোক, কুলীন কোলাহল, অনিরীহ নৃত্য। আমি বলছি, আমাদের সমস্ত মূর্খ নারী পুরুষের জন্য শহরময় নাচ গান মজার হুল্লোড়, নিরিবিলি যৌনতার ব্যবস্থা হবে। সাতদিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে প্রত্যেকের জন্য বিদ্যাকানন, খেলার মাঠ অরণ্যে যাবার সাইকেল। পাহাড় ফেরত পাবে পাথরের জল এবং তৃষ্ণার নিবৃত্তি শেষে তারা, তখন মধুময় স্বপ্নের মৌমাছি। ব্যস্ত কর্মী। খুব মধুর গুনগুন হবে ওদের চলাফেরা-গনগনে। তার ভাষণ কখন যে শেষ হয়েছে, কেউ টের পেল না। দশ লক্ষাধিক জনতা ধীরে ধীরে ফিরে চলল যে যার ঘরে। তারা নীরব ও আত্মমগ্ন ছিল।’

সে সময় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্দোলনমুখর ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে ছিল না। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবসমাজের চেতনায় আগুন জ্বলছিল। আগুনমুখো সময়ে কবি-সাহিত্যিকেরাও বসে থাকেননি। কবিতা-সাহিত্য রচনার মাধ্যমে চলেছে সে প্রতিবাদ। যেটি বিষ্ণু বিশ্বাসরাই দেখিয়েছিলেন। এ সময়ে এমন এক অবরুদ্ধ কাল অতিবাহিত হচ্ছে, যেখানে বিষ্ণু বিশ্বাসদের মতো কবিতা রচনাটা প্রায় অকল্পনীয়। আর এখানেই বাস্তব হয়ে উঠে বিষ্ণুর কবিতা।

 

বিষ্ণু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিশাত জাহান রানা বলেছেন–

‘…গানে কবিতায় নাটকে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর ঘৃণা উদ্গীর্ণ হতো সকাল-সন্ধ্যা। আগুনমুখো সেই সময়ে  মতিহারে যে কিশোর কবির চোখ ছিল স্বপ্নাচ্ছন্ন আবেগে থরো থরো, তার নাম বিষ্ণু বিশ্বাস। ইতিহাসের ছাত্র বিষ্ণু ছিল আমার অনুজ বন্ধুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম। ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা আমাদের দিনভর সঙ্গীতে-কবিতায় বিষ্ণু ছিল অক্লান্তপ্রাণ। বন্ধু এবং অনুরাগীর কোনো অভাব ছিল না ওর। ছিল আদর কাড়ার প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘…অনার্স করেই বিষ্ণু চলে আসে ঢাকায়। ভিড়ে যায় এখানকার সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষ্ণুরা ক’জন মিলে বের করে কবিতা-বিষয়ক ছোটকাগজ–পেঁচা।  দীর্ঘ-বিরতির পর ঢাকায় আরো ২/৩টি সংখ্যা বের হয় শামসুল কবির কচির উদ্যোগে। বেশ কিছু ছোটকাগজে মুদ্রিত হয় বিষ্ণুর কবিতা।

‘এর মধ্যে বাবরি মসজিদে হামলা। ভেতরে ভেতরে কত যে হিন্দু নিপীড়ন হলো তার সব খবর কেউ জানে না। বিষ্ণু কীরকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেল। একটা সাদা গাড়ি অথবা ছুরি হাতে কেউ ওকে তাড়া করে ফিরছে এ রকম ভীতিবিচলিত হয়ে ছুটে আসত মাঝে মাঝে। অসংলগ্নতা বেশ বেড়ে যাওয়ায় ওকে নিয়ে গেলাম মনোচিকিৎসকের কাছে। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত। একমাস রাখা হলো চিকিৎসাধীন। অব্যাহতি দেওয়ার সময় ডাক্তার ওর সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ওপর জোর দিলেন। কিন্তু বন্ধুদের সব নজরদারি ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ বিষ্ণু উধাও হয়ে গেল।…’

উধাও। ফিরে আসা। এ যেন রুটিন হয়ে গেল। এভাবে চলল কিছুকাল। কখনও রাজশাহী, কখনও ঝিনাইদহ। এভাবে একসময় মাতৃভূমির প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু নেই কোনো খবর। দিশাহীন বন্ধুরা। পরিবার। নিকটজন। কিন্তু তাঁর কোনো খবর নেই। একেক সময় একেক খবর রটে। যার কোনো ভিত্তি থাকে না। এভাবে চলল বহুদিন। এরপর খবর মিলল কবি শারীরিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি আছেন পশ্চিমবঙ্গে। নিশ্চিত তথ্য পেয়ে এখান থেকে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছেন কয়েকজন বন্ধু।

স্বৈরাচারী আগ্রাসন, বাবরি মসজিদে হামলা। এসব ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন বিষ্ণু বিশ্বাস। কিন্তু এত এত হানাহানি, রক্তারক্তি—এসবই তাঁকে অস্বাভাবিক করে তোলে। সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাহীনতা আজও সমান বাস্তবতা। যে কারণে সাদাত হোসাইন মান্টো মুম্বাই থেকে করাচি চলে যেতে হয়। সে ভয় বিষ্ণুর ভেতরেও ছিল। রাষ্ট্র এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এখানে চিন্তাশীলতাই যেন অস্বাভাবিকতা! মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এ আগ্রাসন থেকে আজও মুক্ত নয় চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ।

বিষ্ণু বিশ্বাসের পরিবারের ট্র্যাজেডিও তাঁকে অনেকটা আঘাতপ্রাপ্ত করে। বাবার আত্মহত্যা, তাঁকে আরও মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। বন্ধুদের আশঙ্কা ছিল, তিনিও ও পথেই পা বাড়াবেন। কিন্তু তা নয়! আরও ভিন্ন পথে, ভিন্নভাবে। যেটিতে রয়েছে রহস্য!

বিষ্ণু বিশ্বাস সবসময় নিজেকে নিয়ে ছিলেন শঙ্কিত। তার এই শঙ্কা ছিল সর্বৈব সম্প্রীতির। ‘রাতের সঙ্গীত’ কবিতায় কবি নিজেই সে শঙ্কার কথা বলেছেন–

মাঝে মাঝে মনে হয় কখনও নিশ্চয়

খুন হব আমি

লাল রক্তধারার বলিষ্ঠ এক স্রোত

আলতার আল্পনায় রাঙাবে একখানা পাতা যার রঙ মূলত হলুদ,

যে মূলত ঝরা।

এইখানে

একটি গল্পের শুরু এবং সারা-ও হতে পারে-। কিন্তু চলুক না রক্তস্রোত

ঝরা পাতা থেকে বৃক্ষ অব্দি

আর আমি ভাবি

ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে এনেছি

ঝরা, একটি পুষ্পদম্পতি, অদ্ভুত।

 

ইচক দুয়েন্দে ছিলেন কবির ‘জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধু’। এ প্রসঙ্গে ইচক দুয়েন্দে বন্ধুর জন্য ব্যাকুলতার কথা জানান। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়–বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা একবিংশ শতাব্দীতে এসে কতটা ছাপ ফেলতে পেরেছে, যদি সেটি না পারে–কেন পারেনি? একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে তাঁর কবিতা সম্পর্কে জানানোর দায় আপনাদের রয়েছে কি?

জবাবে ইচক দুয়েন্দে খুব স্পষ্টভাবে বলেন, “তাঁর সবচেয়ে উত্তম কবিতাগুলো নিয়ে ‘ভোরের মন্দির’ গ্রন্থটি প্রকাশিত ও প্রচলিত আছে। যুক্ত কর্তৃক প্রকাশিত। তাতে আমার যৎসামান্য ভূমিকা আছে। আমরা (পেঁচা) কোনো সুসংগঠিত দল নই। আমরা সবাই (পেঁচার লেখকরা) কমবেশি অসহায় ও পাগল। সময় বিষ্ণুকে বা আমাদেরকে মনে রাখবে বা ভুলে যাবে। আমরা জোর করব না।’ এটাই মূল কথা। সময়কে ধরে-বেঁধে রাখা যায় না। সময় তার প্রয়োজনেই অতীতকে ধারণ করবে, জানবে-বুঝবে-শিখবে। ইচক দুয়েন্দের প্রকাশে কিছুটা আবেগ, কিছুটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এটিই স্বাভাবিক। কারণ তিনি এ সমাজের প্রতি ক্ষুব্ধ। যে সমাজ বন্ধুকে হারাতে উৎসাহ জোগায়, সে সমাজের প্রতি ক্ষুব্ধতা অস্বাভাবিক নয়।

 

‘একা আছি’ বিষ্ণু বিশ্বাস লিখেছেন–

একা আছি

অনেক দিন অন্ধকারে

অনেক দিন রক্তের ভিতরে স্তম্ভিত আকাশ সমুদ্র দ্যাখে নি

বিশাল বিমূর্ত অতীত জুড়ে অন্ধকার অনেক নক্ষত্র জ্বলেছে আকাশে

বিক্ষোভে

সূর্যের কাছাকাছি সূর্যের মতো পুড়েছে

আলোর বহুধা রাস্তার প্রান্তে

বার বার অন্ধকার

সময় থেমেছে

শব্দহীন।

 

জীবনের চলার পথে বার বার অন্ধকারের দেখা মেলে। কখনও সময় থেমে যায়। শব্দহীন হয়ে পড়ে। আবারও বাঁচার লড়াইয়ে মত্ত হয়, এটিই জীবন-সংগ্রাম। যে জীবন কখনও বিষাদময়, কখনও আনন্দময়। কবির জীবনও এর বাইরে নয়। যে কারণে তিনি কতবার হয়ত ভেবেছেন আর নয়, কিন্তু পরমুহূর্তেই বয়ে বেড়াচ্ছেন জীবনকে।

মানুষ ইতিহাস আশ্রিত। ভবিষ্যতের পানে তাকাতে গেলে বার বার অতীতের দিকে ফিরে তাকায়। ইতিহাসের পথপানে চেয়ে থাকে। কেননা ইতিহাসই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। জীবনের পরিক্রমায় যত অর্জন-বিসর্জন, জয়-পরাজয়, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, রাজনীতি-অর্থনীতি সবই একসময় ইতিহাসে স্থান করে নেয়। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা ইতিহাস হয়ে আছেন। কেউবা একটা কবিতা বা গান লিখে। যে কবিতায় সাধারণের জীবন থাকে না, মানুষকে জাগানোর মতো অনুভূতি তৈরি না হয়; সে কবিতা জনগণের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না! শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জনগণের জীবন সংগ্রামের চিত্র ফুটে না উঠলে তা সার্থকতা পায় না। বিষ্ণু বিশ্বাস তেমনই একজন কবি। যিনি কয়েক বছর মাত্র সক্রিয় ছিলেন কবিতার জগতে। তবুও ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন।

২০১০ সাল। তখন তাঁর বয়স ৪৯। বয়সের ছাপ পড়েছে। চুল দাড়ি পেকে গেছে। অযত্নে অবহেলায় থাকতে থাকতে শরীরের উপর পড়েছে রুগ্নতার ছাপ। সে সময় তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠজনরা জানতে পারেন তিনি বনগাঁয় আছেন। অসুস্থ। কথা একদমই বলেন না। কবি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে। বয়স ছিল ৩১ বছর। এখন তার বয়স ষাট পেরিয়ে। এ সময় তাঁকে নিয়ে লিখছি। এ লেখায় কবি বিষ্ণু বিশ্বাস উঠে আসবেন না। অন্তত তাঁর প্রাসঙ্গিকতা জানান দেওয়ার চেষ্টা।

ভালোবাসা জানবেন কবি। সাম্য-ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে উঠার মধ্য দিয়েই একমাত্র আপনাদের নিরুদ্দেশ জীবন থেকে মুক্তি মিলবে।

 

লেখক পরিচিতি : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক