You are currently viewing বিষবৃক্ষ এবং উইলিয়াম ব্লেইক > ঋতো আহমেদ

বিষবৃক্ষ এবং উইলিয়াম ব্লেইক > ঋতো আহমেদ

বিষবৃক্ষ এবং উইলিয়াম ব্লেইক

ঋতো আহমেদ

I was angry with my friend:

I told my wrath, my wrath did end.

I was angry with my foe:

I told it not, my wrath did grow.

 

And I water’d it in fears,

Night and mornings with my tears;

And I sunned it my smiles,

And with soft deceitful wiles.

 

And it grew both day and night,

Till it bore and apple bright;

And my foe beheld it shine,

And he knew that it was mine.

 

And into my garden stole

When the night had veil’d the pole:

In the morning glad I see

My foe outstretch’d beneath the tree. 

[A poison tree/William Blake]

 

কবিতাটি ফেসবুকে পোষ্ট করে পাঠকদের আহ্বান করা হয়েছিল সংক্ষেপে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে। কে কী লিখেছিলেন, আসুন পড়ে দেখি।

অর্থপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যমে সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পাওয়ার অক্ষমতাই সাধারণত মানুষের পারস্পারিক সংঘাতের কারণ। তাই জীবনের প্রত্যেকটি ধাপে প্রত্যেকটি বিষয়কে পরিষ্কার করে নেয়াই উত্তম, নয়তো ওইসব অস্পষ্টতা জীবনের জতিলতাই বাড়ায় কেবল। [আব্দুল মাজিদ]

যেমন কর্ম তেমন ফল। অর্থাৎ ইতিবাচক আবেগ রোপণ করুন, আপনি ইতিবাচক ফসলই পাবেন; বিপরীতে… নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে তাড়াতাড়ি তুলে ফেলুন যাতে এটি কোনও বিষাক্ত উদ্ভিদের মতো বৃদ্ধি না পায়। [ক্লেওফি মুরিওল্লো-আমোর] 

আটকানো এবং চাপা আবেগ আর দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সম্পর্কে এই কবিতা এক শক্তিশালী ভিত্তি। মূলকথা হচ্ছে ঘৃণাকে প্রশমিত হতে দিন; কারণ ঘৃণা এবং খারাপ অনুভূতিগুলো আপনাকে গ্রাস করে ফেলবে। ক্ষমা করুন, ত্যাগ করুন এবং ভুলে যান। [ডোরিস ভিঞ্চেন্টি]

অবদমিত রাগ অন্য অনেক উপায়ে বেরিয়ে আসতে পারে। এখানে ব্লেইকের প্রতিশোধ হচ্ছে ওই ‘ঠাণ্ডা খাবার পরিবেষণ’। [এন্ড্রু ফেরচায়েল্ড]

এখানে ইডেন উদ্যানের অন্তর্নিহিত রেফারেন্স বিবেচনা করা যেতে পারে, যেমন জেনেসিস, খ্রিস্টান ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম যে বইটা। পরবর্তীতে, বিবেচনা করা যায় যে ব্লেইক একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তৃতীয়ত, মনে রাখা যেতে পারে এই কবিতাটি অভিজ্ঞতার গান থেকে এসেছে, ইনোসেন্সের নয়। অনুগ্রহ করে কখনোই ব্লেইকের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করবেন না। [ক্লাইভ গুডহেড]

হ্যাঁ, সঙ্গে এটাও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে যে ব্লেইক ইবনে আরাবির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। [আলী কাশিম]

কবিতা হল আবেগের একটি অভিব্যক্তি যাকে মূল্যবান মনে করা উচিত। প্রায়শই কবিতা, লেখকের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে কাজ করার একটি উপায় হিসেবে উদ্ভূত হয়। রাগে আঘাত করা দুঃখ বা ইত্যাদি যা-ই হোক। আমি কবিতাটি উপভোগ করেছি, বিশেষ করে উইলিয়াম ব্লেইকের এই কবিতাটি অত ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এটা তাঁর অভিব্যক্তি। [ক্লেয়ার টেন্যান্ট]

রাগ অবদমনের বিরুদ্ধে শক্তিময় যুক্তির উপস্থাপন ব্লেইকের এই কবিতা। তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন রাগ ঝেড়ে ফেলার সুবিধা আর অবদমনের বিপদকে। নৈতিকভাবেই ক্রোধের অবদমন হয়ে ওঠে বিপজ্জনক, যা কেবলমাত্র আরও ক্রোধ, এমনকি সহিংসতার দিকেও পরিচালিত করতে পারে। রাগ দমন করার বিপদ বোঝাতে ব্লেইক দুটি স্বতন্ত্র পরিস্থিতি উপস্থাপন করেছেন। কবিতার প্রথম দুই লাইনে, তিনি তার বন্ধুর কাছে তার ‘ক্রোধ’ স্বীকার করার বর্ণনা দিয়েছেন; আর তা করার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্রোধও শেষ হয়ে যায়। সততা এবং অকপটতাকে স্পষ্ট করে তোলায় রাগ অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্যদিকে, কবিতার দু’নম্বর লাইন থেকে ১৬ তম লাইন পর্যন্ত দেখা যায় একরকম চাপা ক্রোধের নেতিবাচক পরিণতির বিবরণ দেয়া। এই লাইনগুলিতে, ব্লেইক, রাগান্বিত হওয়ার বিষয়ে একদমই মুখ খোলেন না। বরং, সক্রিয়ভাবে তার বা তার ক্রোধের দিকে ঝোঁকেন যেন এটি একটি বাগান, একে ‘ভয়’ এবং ‘অশ্রু’ দিয়ে জল দেয়ার মতো পরিচর্যা করেন; এবং ‘হাসি’ আর ধূর্ত প্রতারণা দিয়ে একে ‘রোদ’ দেন, যা এক ধরনের অসুস্থ আনন্দের ইঙ্গিত বহন করে। এই রাগ-বাগানে যত্নশীল চাষের অর্থ হচ্ছে প্রথমে যা কিছু আমাকে রাগান্বিত করেছে তার পরিচর্যা; আর, সেইসাথে নেতিবাচক আবেগের স্ব-চিরস্থায়ী প্রকৃতির থেকে এগিয়ে যেতে অক্ষমতাও বোঝায়; ভয়, হতাশা এবং প্রতারণাকে উত্সাহিত করে, যা, পরিবর্তে, কেবল আরও ক্রোধকেই বাড়িয়ে তোলে। এইভাবে আবেগের অবদমন নেতিবাচকতার একটি চক্র শুরু করে যা শেষ পর্যন্ত আমাদের পুরো জীবনটাকেই গ্রাস করে ফ্যালে। ক্রোধের দমনকে গাছের বৃদ্ধি আর এর বিষাক্ত আপেলের মাধ্যমে একটি চক্রাকার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে দেখানো হয়েছে। যা সমস্যাটিকে আরও খারাপ করে তোলে। অথচ আমাদের আর আমাদের ‘শত্রু’র মধ্যকার সমস্যাগুলি নিয়ে আগেই কথা বললে হয়তো এতোটা খারাপ পরিস্থিতি নাও হতে পারতো। কবিতাটি একটি নৈতিক পছন্দকে স্পষ্ট করে তোলে: হয় কথা বলুন আর সমাধান খুঁজুন, অথবা চুপ করে থাকুন এবং সুদূরপ্রসারী, বিষাক্ত প্রভাবগুলিকে কার্যকর করে তুলুন। আর সেটা হয় তখনই, মানুষ যখন তার রাগান্বিত আবেগগুলিকে বুকের খুব কাছে ধরে রাখে।

উইলিয়াম ব্লেইক। ইংরেজি ভাষার এক আশ্চর্য কবি। প্রায় তিন শতাব্দী পর এখনও তিনি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখনও তিনি সমানভাবেই হয়ে উঠতে পারেন ইঙ্গিতময়, দুর্বোধ্য ও বিবেচ্য। কখনওবা তাঁর স্বর অদ্ভুত প্রোফেটিক। কখনও রোম্যান্টিক। মোরাল। কখনওবা পৌঁছান আধুনিকতাকে ছাপিয়ে আধুনিকোত্তর ভুবনে। ১৭৫৭ সালের ২৮শে নভেম্বর লন্ডনে জন্মেছিলেন এই কবি। তাঁর বাবা জেমস ছিলেন হোসিয়ারি বিক্রেতা। থাকতেন লন্ডনের ২৮ নং ব্রড স্ট্রিটের নজিরবিহীন কিন্তু সম্মানজনক এক পাড়ায়। সব মিলে সাত সন্তান জন্মেছিল জেমস আর ক্যাথরিন দম্পতির। কিন্তু শৈশবেই দু’সন্তান মারা যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম ব্লেইক ছিলেন একাধারে কবি, চিত্রকর, খোদাইকারী এবং স্বপ্নদর্শী। তিনি তাঁর সমাজ ব্যবস্থা এবং মানুষের হৃদয়, উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনতে কাজ করে গেছেন।

এই ব্লেইকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন পলাশ দত্ত হঠাৎ করেই একটা মোটা বই নিয়ে ঢাকা থেকে সাস্টে এসে হাজির হলেন। এমদাদের মদিনা মার্কেটের বাসায় তখন নিয়মিতই আড্ডা বসতো আমাদের। সেইখানে অনুবাদ করতে বসে গেলেন তিনি ব্লেইক। তখনও অবশ্য সেইভাবে তাকে আবিষ্কার করতে পারিনি সবাই। অন্তত আমার কিছুটা সময় আরও লেগে গিয়েছিল। কারণ সেই বয়সে ব্লেইক আমার জন্য অতটা সহজ ছিলেন না। যতদূর জানতে পারা যায়, ব্লেইকের শৈশব ছিল শান্তিপূর্ণ। তেমন কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে যেতে হয় নি তাঁকে, তাই আর বাল্যকাল হয়ে ওঠে আরও আনন্দময়। অল্প বয়সে তিনি লন্ডনের রাস্তায় আপন মনে ঘুরে বেড়াতে পারতেন এবং সহজেই পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যেতেন। তাঁর কৈশরের ঘটনাগুলোয় আলোকপাত করলে দেখতে পাব তাঁর সে সময়ের অনন্য মানসিক ক্ষমতা তাঁর জন্য কিছুটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, তাঁকে বুঝতে পারবেন এমন কেউ তখন তাঁর পাশে ছিলেন না। হয়তো এইজন্য সবার কাছেই তিনি বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিলেন। ওভাবে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করতে যেয়ে একবার তিনি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, ‘দেবদূতে ভরা একটি বৃক্ষ, উজ্জ্বল সে’সব দেবদূতের ডানাগুলো নক্ষত্রের মতো গাছের প্রতিটি শাখায় দুলছে।’ কিন্তু এই কথা যখন বাড়িতে এসে বললেন, সবাই তাঁকে পাগল বলল। কেউ বিশ্বাস করলো না। মজাও পেল না। কেবলমাত্র তাঁর মায়ের অনুরোধে সে যাত্রায় বাবার পিটুনির হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা-মা অবশ্য তাঁর শৈল্পিক প্রতিভাকে উত্সাহিত করেছিলেন এবং তরুণ ব্লেইক ১০ বছর বয়সেই পার্সের ড্রয়িং স্কুলে ভর্তি হন। শিল্পে ক্রমাগত আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যয় বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই তাঁর পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৪ বছর বয়সে উইলিয়ামকে একজন মাস্টার খোদাইকারীর কাছে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রথমে তার বাবা তাকে অত্যন্ত সম্মানিত খোদাইকারী উইলিয়াম রাইল্যান্ডের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু ব্লেইকের লোকটিকে পছন্দ হয়নি। তাই তার বাবাকে বলে এই ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন, বলেছিলেন, “লোকটির মুখ আমার পছন্দ না: দেখে মনে হয় যেন সে ফাঁসিতে ঝুলতে পারলে বেঁচে যাবে!” কিন্ত কে জানতো এই ভবিষ্যৎবাণীটিই ১২ বছর পর সত্য হয়ে যাবে! পরে রাইল্যান্ডের বদলে তাঁকে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত খোদাইকারী জেমস বাসিরের কাছে পাঠানো হয়। হয়তো বাসির তাঁর জন্য ভালো মাষ্টার ছিলেন আর তিনিও তাঁর শিল্প নৈপুণ্যের একজন ভালো ছাত্র হয়ে ওঠেন।

তবে ২১ বছর বয়সে বাসিরের শিক্ষা শেষ করে তিনি রয়্যাল একাডেমিতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে একজন ভ্রাম্যমান খোদাইকারী হিসেবে তাঁর জীবিকা অর্জন শুরু করেন। সেই সময়ের বই বিক্রেতারা তাকে ডন কুইক্সোটের মতো উপন্যাস থেকে শুরু করে লেডিস ম্যাগাজিনের মতো সিরিয়াল পর্যন্ত প্রকাশনার চিত্র খোদাই করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। 

ওই সময়ের একটি ঘটনা ব্লেইকের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তখন ১৭৮০ সালের জুন মাসে লর্ড জর্জ গর্ডনের ক্যাথলিক বিরোধী প্রচার এবং আমেরিকান ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের প্রতিরোধের কারণে লন্ডনে দাঙ্গা শুরু হয়। ধ্বংসের দিকে ঝুঁকে থাকা বাড়িঘর, গীর্জা এবং কারাগার সমস্ত কিছু কতিপয় অনিয়ন্ত্রিত জনতা একে একে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। দুর্ঘটনাক্রমে এক সন্ধ্যায়, ব্লেইক নিজেকে নিউগেট কারাগার পুড়িয়ে ফেলা ভিড়ের সামনে দেখতে পান। হয়তো ওইসব সহিংস ধ্বংস এবং লাগামহীন বিপ্লবের চাক্ষুষ ঘটনাচিত্র ব্লেইককে ‘ইউরোপ’ (১৭৯৪) এবং ‘আমেরিকা’ (১৭৯৩) এর মতো কাজের জন্য শক্তিশালী উপাদান সরবরাহ করেছে।

হ্যাঁ, যুবক বয়সে তাঁর সমস্ত অগ্রহ কেবল শিল্প আর রাজনিতিতেই আবদ্ধ ছিল না। প্রথম প্রেমটি তাঁর জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও, পরে তাঁর দেখা মেলে ক্যাথরিন বাউচারের সঙ্গে। প্রায় এক বছরের এই প্রেমের পরিণতি ঘটে ১৮ আগস্ট ১৯৮২ সালে তাদের বিয়ের মাধ্যমে। প্যারিশ রেজিস্ট্রি ঘাঁটলে দেখা যায় সেখানে ক্যাথরিনের কোনও স্বাক্ষর নেই। অন্য অনেক মহিলার মতো তিনিও প্রথমে অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন। পরে ব্লেইক তাঁকে লেখা পড়া শেখান। যদিও তাদের বিয়েটি ছিল সফল, কিন্তু তাদের কোনও সন্তান ছিল না। 

ব্লেইকের বন্ধু জন ফ্ল্যাক্সম্যান, রেভের স্ত্রী সুশিক্ষিতা হ্যারিয়েট ম্যাথিউর সাথে ব্লেইকের পরিচয় করিয়ে দেন। হেনরি ম্যাথিউ এর ড্রয়িং রুম প্রায়শই শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞদের মিলনস্থল ছিল। সেই আসরে ব্লেইক প্রায়শ তাঁর প্রথম দিককার কবিতা আবৃত্তি আর গান গেয়ে পরিচিতি লাভ করেন। ফ্ল্যাক্সম্যান এবং মিসেস ম্যাথুর সমর্থনের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। কারণ, তাদের সহযোগিতায় ব্লেইকের কবিতার একটি পাতলা সংকলন ‘পোয়েটিকাল স্কেচ’ (১৭৮৩) শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এই কবিতাগুলির অনেকগুলিই ছিল ধ্রুপদী মডেলের অনুকরণ, পড়লে মনে হতে পারে অনেকটা প্রাচীনকালের মডেলের স্কেচের মতো যা তরুণ শিল্পী তার ব্যবসা শেখার জন্য তৈরি করেছিলেন। এমনকি, এইসব কবিতাতেও অবশ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং রাজাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখতে পাওয়া যায়। পোয়েটিকাল স্কেচের মাত্র ৫০ কপি মুদ্রিত হতে পেরেছিল বলে জানা যায়। ব্লেইকের অর্থ উপার্জনের ভালো কোনও উদ্যোগ ছিল না। ১৭৮৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে যে অর্থ ক’টা পান তা দিয়ে বন্ধু জেমস পার্কারের সঙ্গে প্রিন্টসেলার হিসেবে দোকান খোলেন। ভাইদের পাশাপাশি, পারিবারিক বাড়ির কাছে, ২৭ ব্রড স্ট্রিটে চলে যান। কিন্তু ব্যবসায় ভালো করতে পারেন না। আর দ্রুতই সরে আসেন সেখান থেকে।

ব্লেইক সর্বদা অনুভব করতেন মৃত ছোট ভাই রবার্টের আত্মা তার সাথেই আছে। এমনকি তিনি ঘোষণাও করেছিলেন, রবার্টই তাকে জানিয়েছিলেন কীভাবে তার কবিতাগুলিকে ‘আলোকিত লেখায়’ চিত্রিত করতে হবে। ব্লেইকের কৌশলটি ছিল একটি দুর্ভেদ্য তরল দিয়ে একটি তামার প্লেটে তার পাঠ্য এবং নকশা তৈরি করা। প্লেটটিকে অ্যাসিডে ডুবানো হয় যাতে পাঠ্য এবং নকশা স্বস্তিতে থাকতে পারে। যেন সেই প্লেটটি কাগজে মুদ্রণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং চূড়ান্ত অনুলিপিটি তখন রঙিন হয়ে ওঠে। ‘প্রাকৃতিক কোনও ধর্ম হয় না, সমস্ত ধর্মই এক’ (১৭৮৮) শিরোনামে এক নীতিবচন সিরিজে এই পদ্ধতিতে নিরীক্ষা করার পর, ব্লেইক যে সিরিজটির প্লেট তৈরি করেন তা হচ্ছে ‘দ্য সং অব ইনোসেন্স’ (যার শিরোনাম পৃষ্ঠায় দিনক্ষণ লিখা ছিল ১৭৮৯এর)। এইভাবে ব্লেইক আলোকিত লেখার প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং ১৭৯৪ সালে ‘অভিজ্ঞতার গান’ শিরোনামের কবিতাগুলির সাথে প্রাথমিক কবিতাগুলিকে একত্রিত করেন। তাতে যে সম্মিলিত সেট তৈরি হয়, তার শিরোনাম দেন ‘মানব আত্মার দুই বিপরীত অবস্থা’ [দ্য টু কন্ট্র্যারি স্টেটস অব দ্য হিউম্যান সোল]। প্রতিটি সিরিজের সূচনা কবিতাগুলি ‘পাইপার [বাঁশি ওয়ালা]’ এবং ‘বার্ড [চারণ কবি]’ উভয় হিসাবে কবি ব্লেইকের দ্বৈত চিত্র প্রকাশ করে। কবিতায় মানুষ যেমন পবিত্রতা আর অভিজ্ঞতার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে যায়, কবিও তেমনি পবিত্রতা আর অভিজ্ঞতার বিভিন্ন পর্যায়ে থাকেন। কবিতার মনোরম গীতিমূলক দিকটি ফুটে উঠেছে ‘পাইপার [বাঁশি ওয়ালা]’ এ। আর কবিতার অস্পষ্ট প্রোফেটিক প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে দারুণ চারণকাব্যধর্মীতার ভিতর দিয়ে। কবি যে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছেন তা হল ব্লেইকের প্রাচীন অনুশাসনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ, কবিতার আনন্দ এবং নির্দেশ উভয়ই হওয়া উচিত। ব্লেইকের এই কবিতাগুলোয় আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন চারণ কবি এবং নবীদের পবিত্র কথন যা বিভিন্ন জাতির কাছে বারবার পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য অভিজ্ঞতা আর পবিত্রতার দুটো অবস্থাই সবসময় কবিতায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে না। কখনও কখনও দুটো অবস্থাকে যুগপৎ উপস্থিত থাকতেও দেখা যায়। যেমন ‘পবিত্র বৃহস্পতিবার’ শিরোনামের কবিতাগুলোয় দেখতে পাই লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে দরিদ্র শিশুদের জোরপূর্বক মার্চ করানো হচ্ছে। নিষ্পাপ অবস্থায় বক্তা শিশুদের ওই অগ্রগতি উষ্ণতার সঙ্গে অনুমোদনও করছেন:  

’Twas on a Holy Thursday their innocent faces clean
The children walking two & two in red & blue & green
Grey headed beadles walkd before with wands as white as snow
Till into the high dome of Pauls they like Thames waters flow[.]

নির্মম পরিহাস হল এই যে সত্যিকারের ‘নিরীহ’ শিশুদের, এই পৃথিবীতে এমন কিছু দুষ্ট লোক আছে যারা দমন করতে পছন্দ করে। গবাদি পশুর পালের মতো ঘিরে রাখে এবং ধার্মিকতা দেখাতে বাধ্য করে। কবিতার এই নির্দোষ অবস্থায়, অভিজ্ঞতা অনেক বেশি বর্তমান। অর্থাৎ অভিজ্ঞতার যদি নির্দোষতার জগতে হামাগুড়ি দেওয়ার উপায় থাকে, তবে নির্দোষতারও অভিজ্ঞতায় লতানোর উপায় রয়েছে এখানে। সোনালি সেই দেশ যেখানে ‘সূর্য ওঠে’ আর ‘বৃষ্টি পড়ে’, সেই দেশে রয়েছে প্রচুর ধার্মিকতা, রয়েছে নির্দোষতাও। কিন্তু এইখানে, এই বরকতময় দেশে শিশুরা রয়েছে অনাহারে। দুটি অবস্থার মধ্যে তীব্র এই বৈসাদৃশ্য সামাজিক ভাষ্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং কবিতাটিকেও শক্তিশালী করেছে। 

১৭৮৯ সালে বাস্তিলের ঝড় আর ফরাসি বিপ্লবের দ্বন্দ্বের সেই তরঙ্গ-ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল ইংল্যান্ডেও। যার অভিঘাতে কেউ কেউ ইংল্যান্ডের স্বাধীনতায় অনুরূপ প্রাদুর্ভাবের আশা করেছিলেন, আবার কেউ কেউ সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ারও আশঙ্কা করেছিলেন। ব্লেইক তার লেখার বেশিরভাগ অংশে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের ‘তিরিয়েলে’ (আনুমানিক ১৭৮৯ সালে লিখিত) একজন অত্যাচারী রাজার পতনের উপায় সন্ধান করেছেন। তৎকালীন প্রকাশক জোসেফ জনসনের বাড়িতে রাজনীতি কথোপকথনের প্রধান বিষয় ছিল, সেখানে ব্লেইক প্রায়শই আমন্ত্রিত হতেন। ব্লেইক সেখানে উইলিয়াম গডউইন, জোসেফ প্রিস্টলি, মেরি ওলস্টোনক্রাফ্ট এবং টমাস পেইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ করতে পারতেন। বলা হয়ে থাকে সে আসরে টমাস পেইনকে তার আসন্ন গ্রেফতার বিষয়ে সতর্ক করে তাঁকে বাঁচিয়ে ছিলেন ব্লেইক। এই ঘটনার সত্যতা কতোটুকু জানা নেই তবে, সেটা সত্য হোক বা না হোক, এটা স্পষ্ট যে ব্লেইক তার সময়ের কিছু নেতৃস্থানীয় উগ্র চিন্তাবিদদের সাথে পরিচিত ছিলেন। ফরাসি বিপ্লবে ব্লেইককে ফ্রান্সে গণতন্ত্রের উত্থান এবং রাজতন্ত্রের পতন উদযাপন করতে দেখা যায়। রাজা লুই যে রাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন তা ছিল পুরানো এবং মৃত। তিনি লিখেছেন, অসুস্থ রাজা অলস এবং কাজ করতে অক্ষম: “আমার জানালা থেকে ফ্রান্সের পুরানো পাহাড় দেখতে পাচ্ছি, বয়স্ক পুরুষদের মতো, বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।” তাঁর ‘জনগণের কণ্ঠস্বর’ প্যারিস থেকে রাজার সৈন্যদের অপসারণের দাবি করে এবং প্রথম বইয়ের শেষে তাদের প্রস্থান গণতন্ত্রের বিজয়ের ইঙ্গিত দেয়।

‘দ্য ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশান’ বইয়ের শুরুতে লিখেছিলেন এরকম আরও সাতটি বই আছে তাঁর। কিন্তু বাস্তবে একটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। জনসন তাঁর ওই কবিতাগুলো প্রকাশ করেন নি। কারণ তিনি ভয় পেতেন। বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে। কিংবা হয়তো ব্লেইক নিজেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আমরা জানি না আসলেই কী ঘটেছিল। অবশ্য জনসনের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও ছিল। এর্‌ডম্যান উল্লেখ করেছিলেন, একই বছরে টমাস পেইনের বই বিক্রি করার জন্য বই বিক্রেতাদের জেলে পাঠানো হয়েছিল। ‘অ্যামেরিকা’ (১৭৯৩) বইয়ে ব্লেইক তাঁর বিপ্লবের ধারনাকে কিছুটা ব্যাখ্যা করেছিলেন। অ্যামেরিকার প্রকৃত বৈপ্লবিক ঘটনা সমূহের বর্ণনার পাশাপাশি বিপ্লবের সার্বজনীন নীতির কথাও তুলেছেন। 

 The fiery joy, that Urizen perverted to ten commands,
What night he led the starry hosts thro’ the wide wilderness,
That stony law I stamp to dust; and scatter religion abroad
To the four winds as a torn book, & none shall gather the leaves.

যে শক্তি ঔপনিবেশিক মানুষদের রাজা জর্জের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে সেই শক্তিই প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিকৃত নিয়ম ও বিধিনিষেধকে উৎখাত করে। অ্যামেরিকার ওই বিপ্লব ব্লেইককে ভাবতে উৎসাহিত করে যেন ইংল্যান্ডেও ওইরকম বিপ্লব শুরু হয়। তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই রাজা, মিশরের প্রাচীন ফারাওদের মতো, বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমেরিকায় মহামারী পাঠান, কিন্তু উপনিবেশবাসীরা ধ্বংসের ওই শক্তিকে ইংল্যান্ডেরই দিকে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ব্লেইক যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে দাঙ্গা এবং ইংরেজ সৈন্যদের বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা ভাবছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ ত্যাগ করেছিল। ১৭৯০ এর দশকে এই কবিতাটি লেখার সময়, ব্লেইক অবশ্যই ইংল্যান্ডের উপর ফরাসি বিপ্লবের সম্ভাব্য প্রভাব কল্পনা করেছিলেন। ১৭৯০ এর আরেকটি কবিতা হল ‘স্বর্গ ও নরকের বিয়ে’। ১৭৯০ এবং ১৭৯৩ সালের মধ্যে লেখা এবং খোদাই করা, ব্লেইকের কবিতাটি চার্চ এবং রাজ্যের নিপীড়ক কর্তৃত্বকে নির্মমভাবে ব্যঙ্গ করে। কবিতাটির শক্তিশালী সূচনা এক অদ্ভুত সহিংস জগতের ইঙ্গিত দেয়: “রিন্ত্রাহ গর্জন করে এবং দায়-ভারাক্রান্ত বাতাসে তার আগুন কাঁপে / ক্ষুধার্ত মেঘ গভীরে দোল খায়।” আগুন আর ধোঁয়া যুদ্ধক্ষেত্র আর বিপ্লবের ইঙ্গিত দেয়। সংকেত দেয় বিশৃঙ্খলার। যেই বিশৃঙ্খলার কারণ কবিতার শুরুতেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পৃথিবী উলটপালট হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ চার্চ এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরে গেছে, এবং তার জায়গায় মূর্খ এবং ভণ্ড যারা আইন-শৃঙ্খলা প্রচার করে কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যারা বিধিনিষেধমূলক নৈতিক নিয়ম এবং নিপীড়নমূলক আইনকে ‘ভালো’ বলে ঘোষণা করে প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাই মন্দ। তাই এই দমন-পীড়নকে মোকাবেলা করার জন্য, ব্লেইক ঘোষণা করেন তিনি ‘ডেভিলস পার্টির’ যিনি স্বাধীনতা, শক্তি এবং তৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার পক্ষে থাকবেন। তাঁর ‘জাহান্নামের হিতোপদেশ’ স্পষ্টভাবে পাঠককে তার সাধারণ ধারণা থেকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেন পাঠক বুঝে নিতে পারেন কোনটি ভাল এবং কোনটি মন্দ:

Prisons are built with stones of Law,
Brothels with bricks of Religion.
The pride of the peacock is the glory of God.
The lust of the goat is the bounty of God.
The wrath of the lion is the wisdom of God.
The nakedness of woman is the work of God.

‘স্বর্গ ও নরকের বিয়ে’র প্রধান কবিতাগুলিতে বিকশিত মৌলিক ধর্মীয় ধারণাগুলোর অনেকগুলিই উপস্থিত রয়েছে। ব্লেইক আসলে প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গির বিকৃতি হিসাবে সংগঠিত ধর্মের বিকাশকে বিশ্লেষণ করেছেন: “প্রাচীন কবিরা ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক প্রতিভা দিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে অ্যানিমেট করেছিলেন। তাদের নাম ধরে ডাকতেন এবং তাদেরকে কাঠ, নদী, পর্বত, হ্রদ, শহর, জাতির বৈশিষ্ট্য দিয়ে সজ্জিতও করেছিলেন। এমনকি আর যা যা তাদের বর্ধিত এবং অসংখ্য ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারতেন, সব।” প্রাচীনকালে, মানুষ ভৌত জগতে যে আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলি উপলব্ধি করেছিলেন তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য তারাই সেইসব দেবতাদের কল্পনা করেছিলেন, সৃষ্টি করেছিলেন। এইভাবে দেবতারা মানুষের থেকে আলাদা হয়ে তাদের নিজস্ব জীবন নিতে শুরু করেছিলেন: “একটি ব্যবস্থা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত, কিছু সুবিধা নিয়েছিলেন, এবং বিভিন্ন বস্তু সমূহ থেকে মানসিকভাবে দেবতাদের উপলব্ধি বা বিমূর্ত করার চেষ্টার মাধ্যমে দাসত্ব শুরু করেছিল মানুষ: এইভাবে শুরু হয়েছিল পুরোহিতত্ব।” ‘সিস্টেম’ বা সংগঠিত ধর্ম মানুষকে শারীরিকভাবে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি থেকে বিরত রাখে। দেবতাদেরকে মানুষের থেকে আলাদা হিসাবে দেখা হয় এবং দেবতাদের কাছে যাওয়ার জন্য পুরোহিতদের একটি অভিজাত জাতি গড়ে ওঠে: “এইভাবে মানুষ ভুলে গেছে যে সমস্ত দেবতা মানুষের বুকে বাস করে।” দূরবর্তী বেদিতে ঈশ্বরের খোঁজ না করে, ব্লেইক সতর্ক করে বলেন, মানুষকে তার নিজের ভিতরে তাকাতে হবে।

১৭৯০ সালের আগস্টে ব্লেইক টেমসের ওপারে পোল্যান্ড স্ট্রিটে ল্যাম্বেথ নামে পরিচিত এলাকায় চলে আসেন। ওই বাড়িতে প্রায় ১০ বছর বসবাস করেন। তাঁর আশপাশের ওই পাড়া ধীরে ধীরে তাঁর কবিতায় পৌরাণিক হয়ে ওঠে। সেখানে ফেলফাম ছিল একটি ‘সুন্দর উপত্যকা’, গাছ এবং খোলা তৃণভূমির একটি জায়গা, কিন্তু এতে মানুষের নিষ্ঠুরতার লক্ষণও রয়েছে, যেমন অনাথদের জন্য ঘর। ব্লেইক তাঁর বাড়িতে শুধু তাঁর আলোকিত কবিতা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, অর্থ উপার্জনের জন্য দৈনন্দিন কাজেও ব্যস্ত ছিলেন। ১৭৯০ এর দশকে ব্লেইক একজন খোদাইকারী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং অসংখ্য কমিশন পেয়ে আনন্দিতও ছিলেন। ১৭৯৩ থেকে ১৭৯৫ সালের মধ্যে ব্লেইক আলোকিত কাজের একটি অসাধারণ সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন যা ‘মাইনর প্রফেসিস’ নামে পরিচিত। ‘ইউরোপ’(১৭৯৪), ‘দ্য ফার্স্ট বুক অব উরিজেন’ (১৭৯৪), ‘দ্য বুক অব লস’ (১৭৯৫), ‘দ্য সং অব লস’ (১৭৯৫) আর ‘দ্য বুক অব অহনিয়া’ (১৭৯৫) তে ব্লেইক তার সর্বজনীন পৌরাণিক কাহিনীর প্রধান রূপরেখা তৈরি করেছেন। এই কবিতাগুলোতে ব্লেইক মানুষের পতন পরীক্ষা করেছেন। ব্লেইকের পৌরাণিক কাহিনীতে মানুষ এবং ঈশ্বর একবার একত্রিত হয়েছিল, কিন্তু পরে মানুষ নিজেকে ঈশ্বর থেকে আলাদা করে ফেলেছিল এবং আরও বিভক্ত হওয়ার সাথে সাথে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছিল। সর্বজনীন পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনাটি ব্লেকের নিজের সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িত। ১৭৯৩ সালে রাজা লুই XVI এর মৃত্যুদন্ড একটি অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার দিকে পরিচালিত করে এবং ইংল্যান্ড শীঘ্রই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণ এবং বিপ্লবী চেতনাকে দমন করার প্রচেষ্টাই তাঁর ‘ইউরোপ’এ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেই দমন-পীড়নের শক্তিই অর্কের বিপ্লবী চিত্রে এর বিপরীত চিত্র দেখাবে: “এবং লাল ফ্রান্সের দ্রাক্ষাক্ষেত্রে তার ক্রোধের আলো দেখা দিয়েছে।” সেই দমনের কারণ সমূহ দ্য ফার্স্ট বুক অব উরিজেনে পরীক্ষা করা হয়েছে। উরিজেন শব্দটি ‘আপনার কারণ’ এবং ‘দিগন্ত’ নির্দেশ করে। অর্থাৎ তিনি মনের সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন যা ক্রমাগত সংজ্ঞায়িত করে এবং মানুষের চিন্তা ও কর্মকে সীমাবদ্ধ করে। কবিতার সামনের অংশে তাকে চিত্রিত করা হয়েছে একজন বয়স্ক মানুষ হিসেবে, যিনি অন্য বইতে দুই হাত দিয়ে একটি বিশাল বই লেখার উপর কুঁকড়ে আছেন। তার পিছনে ১০টি আদেশের ট্যাবলেট দাঁড়িয়ে আছে, এবং উরিজেন অবশ্যই অন্যদের অনুসরণ করার জন্য লিখেছে ‘thou shalt nots’। তার বাঁকানো শারীরবৃত্তীয় অবস্থানটি ‘মানুষের স্বর্গীয় রূপ’ কী হওয়া উচিত সেই বিকৃতিকে দেখায়। কবিতাটি মানুষের মনের একটি পৃথক অংশ হিসাবে উরিজেনের জন্মের সন্ধান করে। জোর দেয় সকলের অনুসরণযোগ্য আইনের উপর:

One command, one joy, one desire
One curse, one weight, one measure,
One King, one God, one Law.

উরিজেনের দমনমূলক আইন কেবল আরও বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বংস নিয়ে আসে। সে নিজেই যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তাতে আতঙ্কিত হয়ে, উরিজেন বিশ্বকে বিভক্ত করে ফ্যালে। লসের চরিত্রটি উরিজেন থেকে আলাদা হওয়ায় বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। লস, ‘শাশ্বত নবী’, মানুষের মনের আরেকটি শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। লস মনের সৃজনশীল দিকগুলিকে শিল্পে রূপান্তরিত করে। উরিজেনের মতো তিনিও সীমাবদ্ধ, কিন্তু তিনি যে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেন তা সৃষ্টিশীল এবং প্রয়োজনীয়। কবিতায় লস উরিজেনের ক্রমাগত বিশৃঙ্খল বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটাতে ‘জাল এবং ফাঁদ’ গঠন করে। লস আবদ্ধ উরিজেনের চিত্র দেখে আতঙ্কিত হয় এবং তার করুণা দ্বারা পৃথক হয়, “কারণ করুণা আত্মাকে বিভক্ত করে।” লস নিজেই পুরুষ এবং মহিলা হিসেবে বিচ্ছেদ সহ্য করে। তার মহিলা রূপটিকে বলা হয় এনিথার্মন, এবং তার সৃষ্টিকে দেখা হয় সমীহের সঙ্গে:

Eternity shudder’d when they saw
Man begetting his likeness
On his own divided image.

পৃথক যৌন পরিচয়ে এই বিচ্ছেদ মানুষের পতনের আরেকটি লক্ষণ। ‘ইটারনালস’ নিজেদের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা উভয় রূপই ধারণ করে, কিন্তু মানুষ বিভক্ত এবং দুর্বল। এনিথার্মন জ্বলন্ত অর্কের জন্ম দেয়। যার সহিংস জন্ম এক পতিত পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তনের জন্য কিছু আশার উদ্রেক করে। কিন্তু অর্ক লসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ঈর্ষার শিকার। এনিথার্মন একটি ‘বিশাল জাতি’র ভার বহন করে চলেছে। তবে এটি পুরুষ এবং মহিলাদের এক জাতি যারা দুর্বল এবং বিভক্ত এবং যারা অনন্তকালের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছে। পতিত অবস্থায় মানুষের ইন্দ্রিয় সীমিত থাকে এবং অসীমকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। ঈশ্বর থেকে বিভক্ত এবং ধর্মের সংকীর্ণ ফাঁদে আটকে থাকা, তিনি ঈশ্বরকে কেবলমাত্র একজন অশোধিত আইনদাতা হিসাবে দেখেন যাকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ‘দ্য বুক অব লস’ মানুষের পতন এবং উরিজেনের বাঁধনকেও পরীক্ষা করে, তবে লসের দৃষ্টিকোণ থেকে, যার কাজটি উরিজেনের দ্বারা শুরু হওয়া বিশৃঙ্খল বিচ্ছেদের সীমাবদ্ধতা স্থাপন করা। ক্ষয়প্রাপ্ত পৃথিবী আসলে অজ্ঞতারই একটা ফসল যেখানে আগুন থেকে কোনও আলোর উদ্ভাস ঘটে না। এমন বিশৃঙ্খলা থেকে মানুষের রূপের শূন্য রূপরেখা প্রদর্শিত হতে শুরু করে: 

Many ages of groans, till there grew
Branchy forms organizing the Human
Into finite inflexible organs.

বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক প্রদত্ত ‘পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দর্শন’ যে যুক্তি প্রদান করে সেখানে যেই জগত্‌ এবং মন, শিল্প যন্ত্রের মতো যা নির্দিষ্ট আইন দ্বারা চালিত হয়, কিন্তু সেটা কল্পনা, সৃজনশীলতা বা কোনো আধ্যাত্মিক জীবন বর্জিত। নিউটন এবং লকের লেখায় বিশ্ব সম্পর্কে এই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দাই করেছেন ব্লেইক। যদিও মানুষ একটি পতিত অবস্থায় রয়েছে, কবিতাটির শেষে এসে আমরা দেখতে পাই তিনি আগত পুনর্জন্মের দিকেই নির্দেশ করছেন:

Orc, raging in European darkness,
Arose like a pillar of fire above the Alps,
Like a serpent of fiery flame!

দ্য বুক অফ অহনিয়াতেও মানুষের বিচ্ছেদ পরীক্ষা করা হয়েছে, যা ব্লেইক পরবর্তীতে ভালা, বা দ্য ফোর জোয়াসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। দ্য বুক অব অহনিয়াতে উরিজেন আরও বেশি করে বিভক্ত হয়েছে নারী ও পুরুষে। উরিজেন তার মেয়েলি ছায়া দ্বারা বিতাড়িত হয় যাকে বলা হয় অহনিয়া:

He groan’d anguish’d, & called her Sin,
Kissing her and weeping over her;
Then hid her in darkness, in silence,
Jealous, tho’ she was invisible.

‘অহনিয়া’ শুধুমাত্র একটি ‘পাপ’ যেখানে তাকে এই নামই দেওয়া হয়েছে। ‘উরিজেন’, আইন প্রণেতা, যৌন আনন্দের মুক্তির দিকগুলি গ্রহণ করতে পারেন না। কবিতার শেষে, অহনিয়াকে চিরকালের হারানো আনন্দের জন্য বিলাপ করতে শোনা যায়:

Where is my golden palace?
Where my ivory bed?
Where the joy of my morning hour?
Where the sons of eternity singing.

 যৌন মিলনের শারীরিক আনন্দগুলি আধ্যাত্মিক অবস্থার প্রবেশদ্বার হিসাবে উদযাপিত হয়। পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক মিলন আধ্যাত্মিক মিলনের চিহ্ন যা এমনই হয়ে আসছে চিরকাল। দ্য ফোর জোয়াস এর সাবটাইটেল হচ্ছে, “প্রাচীন মানব অ্যালবিয়নের মৃত্যু এবং বিচারে প্রেম এবং ঈর্ষার যন্ত্রণা।” কবিতাটিতে ব্লেইক অ্যালবিয়নের পৌরাণিক কাহিনী গড়ে তুলেছেন, যিনি সমগ্র ইংল্যান্ড এবং সমস্ত পুরুষদের একত্রীকরণের প্রতিনিধিত্ব করেন। অ্যালবিয়ন এখানে ‘ফোর মাইটি ওয়ানস’ নিয়ে গঠিত: থার্মাস, উরথোনা, উরিজেন এবং লুভা। মূলত, ইডেনে, এই চারটি ‘ইউনিভার্সাল ব্রাদারহুড’-এর ঐক্যে বিদ্যমান। প্রথম দিকে মানুষের সমস্ত জাত নিখুঁত সম্প্রীতিতে বাস করত, কিন্তু এখন তারা যুদ্ধ শিবিরে পতিত হয়েছে। কবিতাটি অ্যালবিয়নের এই পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে:

His fall into Division & his Resurrection to Unity:
His fall into the Generation of decay & death, & his
Regeneration by the Resurrection from the dead.

কবিতাটি থার্মাস দিয়ে শুরু হয়ে মানুষের পরিচয়ের প্রতিটি দিকের পতন পরীক্ষা করতে থাকে। প্রতিটি জোয়া চূড়ান্ত একীকরণের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটি অনৈক্য থেকে ঐক্যের দিকে অগ্রসর হয়। রহস্য-উন্মোচক ‘নাইট দ্য নাইনথ’-এর শেষ বিচারের অশান্তিতে নিপীড়নের কুফলগুলি উল্টে দেওয়া হয়েছে: “রাজাদের সিংহাসন কেঁপে উঠেছে, তারা তাদের পোশাক এবং মুকুট হারিয়েছে / দরিদ্ররা তাদের অত্যাচারীদেরকে আঘাত করেছে, জেগে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত ফসলের দিকে।” মৃত ব্যক্তিদের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, খ্রিষ্ট, ‘ঈশ্বরের মেষশাবক’কে আবার জীবিত করা হয় এবং দূর করা হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মান্দ্য:

Thus shall the male & female live the life of Eternity,
Because the Lamb of God Creates himself a bride & wife
That we his Children evermore may live in Jerusalem
Which now descendeth out of heaven, a City, yet a Woman
Mother of myriads redeem’d & born in her spiritual palaces,
By a New Spiritual birth Regenerated from Death.

১৭৯০ এর দশকের ব্লেইকের কবিতার খুব কমই সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। শিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি ছিল মিশ্র। তার শিল্পের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রশংসা থেকে উপহাস পর্যন্ত, কিন্তু তিনি খোদাইকারী হিসাবে কিছু খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন তখন। তবে ব্লেইক খুব বেশি উপার্জন করতে পারতেন না। অবশ্য তাই বলে তাঁকে কখনও নিরুৎসাহীও মনে হয়নি কারও। ১৭৯৯ সালে ব্লেইক জর্জ কাম্বারল্যান্ডকে লিখেছিলেন, “আমি ফরচুন নিয়ে হাসছি এবং চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

১৮০৩ সালে ব্লেইক ফেলফাম ছাড়েন আর ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। এপ্রিলে বাটসকে লেখেন শহরে ফিরে এসে তিনি যার-পর-নাই আনন্দিত, “বিরক্তিহীনভাবে আমি আমার স্বপ্নদর্শী শিক্ষা-কাজ চালিয়ে যেতে পারছি এই শহরে। আমার শাশ্বত বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, কল্পনা করতে পারি স্বপ্নের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎবাণী করতে পারি। দৃষ্টান্তগুলো অবলোকন না-করেও অন্যান্য মানুষের সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকতে পারি।” একই চিঠিতে তিনি তাঁর মহা-কবিতা মিল্টনের উল্লেখ করে বলেন, “কিন্তু আমার তিন বছরের রচনাগুলো ‘সাগর তীরে ঘুমানো’ কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, যদি না সে তার আত্মায় সেগুলোর প্রতিফলন দেখতে পায় কিংবা পাঠ না করে আমার আইনের উপর লিখা সেই দীর্ঘ কবিতা।” কবিতাটির মুখবন্ধে, ব্লেইক তার পাঠকদের কাছে যুদ্ধের আর্তনাদ জারি করেছেন, শিল্পের নিছক ফ্যাশনেবলকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য:  

“জেগে উঠো, হে নব যুগের যুবক! মূর্খ ভাড়াটে কর্মীর সামনে মাথা নত কর তোমার! কারণ ক্যাম্প, কোর্ট এবং ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ভাড়াটে কর্মী রয়েছে। তারা যদি পারতো, চিরকালের জন্যই মানসিক বিষণ্নতা আর শারীরিক যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতো। তাই চিত্রকরদের বলছি! আমি তোমাকে ডাকছি। ডাকছি ভাস্করদেরও! স্থপতিদেরও! কেতাদুরন্ত মূর্খেরা, আপনারা ক্ষমতাকে দমিয়ে ফেলতে গিয়ে ভুগবেন না যেন, যেন তারা নিন্দনীয় কাজটাই করে দেয়ার ভান করতে পারে। কিংবা তাদের ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন গর্ব করে বলতে পারে তাদের কাজ এমনই। খ্রিস্ট আর প্রেরিত নবীদের বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন যে এমন একটি শ্রেণির লোক রয়েছে যাদের কাজ সম্পূর্ণ আনন্দকে ধ্বংস করা। আমরা গ্রিক কিংবা রোমান মডেল চাই না। যদি আমরা কেবল সৎ থাকি আমাদের নিজস্ব কল্পনার প্রতি, সেই চিরন্তন বিশ্বের প্রতি, সেখানেই আমরা আমাদের যিশুর মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকব।”   

‘ক্যাম্প’, ‘দ্য কোর্ট’ এবং ‘ইউনিভার্সিটিতে ‘অজ্ঞ হায়ারলিংস’ [মূর্খ কর্মী]-কে আক্রমণ করার সময়, ব্লেইক ইংরেজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি পরিচিত ভিন্নমতের পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর তাঁর ‘আমাদের নিজস্ব কল্পনার প্রতি ন্যায্য এবং সত্য’ হওয়ার জেদ তার কবিতার পাঠকের উপর একটি বিশেষ ভার রাখে। কারণ তিনি স্পষ্ট করেই তাঁর পাঠকদের কাছে সৃজনশীল কল্পনার অনুশীলন দাবী করছেন। পরবর্তী সুপরিচিত লিরিকটিতে, ব্লেইক আধুনিক দিনের ইংল্যান্ডে খ্রিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করেছেন:

I will not cease from Mental Fight,
Nor shall my Sword sleep in my hand
Till we have built Jerusalem
In England’s green & pleasant Land.

কিন্তু একজন স্বপ্নদর্শী কবি কী করবেন? অবশ্যই পাঠককে মানুষের পতিত অবস্থা থেকে দূরে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করবেন, নিয়ে যেতে চাইবেন এক পুনরুজ্জীবিত অবস্থার দিকে, যেখানে মানুষ অনন্তকালকে উপলব্ধি করতে পারবে। ব্লেইক আমাদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেখাতে চান যে তাঁর এইসব পৌরানিক কাহিনী আমাদের থেকে খুব একটা দূরের কাহিনী নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাঠকের নিজেরই পতন, আর দৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সেই অনুষদগুলি পুনরুদ্ধার করার সম্ভাবনাই বর্ণনা করেছেন ব্লেইক।

‘মিল্টন’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ব্লেইক পাঠককে কবি ও নবীদের ক্রমানুসারে সূচনা করেন। প্রথম বইয়ের প্রক্রিয়াটি ২য় খণ্ডেও অব্যাহত রাখেন ব্লেইক। একজন কবির বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি পাঠককে। মানুষের অভ্যন্তরীণ জগতের বিস্তৃত পরীক্ষার একটি প্রাথমিক পর্যায় হল বাইরের জগতকে উল্টে দেয়া। কবির বিকাশের একটি প্রয়োজনীয় পর্যায় হলো আত্ম সম্পর্কে অনুসন্ধান। মিল্টনকে বলা হয়েছিল প্রথমে নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে: “অতঃপর আপনার নিজের সম্পর্কে বিচার করুন: আপনার চিরন্তন লাইনগুলি অন্বেষণ করুন, / কী চিরন্তন এবং কী পরিবর্তনযোগ্য, এবং কী বিনাশযোগ্য।” নিজেকে বিচার করার প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হলো মানুষের পরিচয়ের সেই ধ্বংসাত্মক অংশের সঙ্গে একটি সংঘর্ষ, যেমনটা ব্লেইক সেলফহুডকে বলেন, যেটা ‘মানুষের সৃজনশীলতার কেন্দ্র’কে অবরুদ্ধ করে। ব্লেইক বিশ্বাস করতেন, শুধুমাত্র আত্মাকে ধ্বংস করার মাধ্যমেই কেউ কবিতার দূরদর্শী অভিজ্ঞতায় অংশগ্রহণের আশা করতে পারেন। সেলফহুড আমাদের পথ আটকানোর জন্য দুটি প্রবল শক্তি রাখে আমাদের সামনে: ‘প্রেম’ এবং ‘কারণ’ এর সামাজিক স্বীকৃত মূল্যবোধ। বিশুদ্ধতম অবস্থায় প্রেমকে দেয়া হয় অবাধে, কোনও সীমাবদ্ধতা ছাড়াই; এমনকি বিনিময়ে তারে ফিরে পাবার আশা না করেই। আর পতিত অবস্থায় প্রেমকে এক ধরনের বাণিজ্যে পরিণত করা হয়: “তোমার ভালোবাসা নির্ভর করে তুমি তাকে ভালোবাসো কিনা তার উপর, এবং তার প্রিয় ভালোবাসার উপর / নির্ভর করে তোমার আনন্দ, যা তুমি ঈর্ষার ছুরিতে কেটে ফেলেছ।” ‘নারীর প্রেম’ শুধুমাত্র প্রাপ্ত ভালবাসার বিনিময়েই দেওয়া হয়। একে বলা যায় মানুষের আবেগের বিনিময় মাত্র এবং তা আদৌ প্রেম নয়। মিল্টন যখন তার নিজের স্বত্বের নিন্দা করেন, তখনই তিনি ‘নারীর প্রেম’ ত্যাগ করেন এবং অবাধে আর প্রকাশ্যে ভালোবাসেন। ব্লেইক যেমন প্রেমের ধারনাকে আক্রমন করেন, তেমনি তিনি পাঠককেও যুক্তির উপর নির্ভর করে সমাজের মূল্যবোধকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেন। উরিজেন, যিনি মানুষের যুক্তির সীমিত শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন, সাথে তার সংগ্রামে, মিল্টন যুক্তি শক্তির মরণশীল প্রভাবকে বাদ দিতে এবং কল্পনা শক্তির জন্য মনকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ সেলফহুড ধ্বংস করায় মিল্টন অন্যদের সঙ্গে একত্রিত হতে পারেন। তিনি ব্লেইকের পথে নেমে আসেন এবং ব্লেইকের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যান যা প্রথম বইতে শুরু হয়েছিল। এই মিলনটি লসের সঙ্গে ব্লেইকের মুখোমুখি হওয়ারও একটি প্রতিফলন যা প্রথম বইতে বর্ণিত হয়েছে এবং বই দুটিতে চিত্রিতও হয়েছে।

আসলে ব্লেইকের দর্শনের শীর্ষস্থান হল ঈশ্বরের সিংহাসনের সংক্ষিপ্ত চিত্র। আপ্তবাক্যে, ঈশ্বরের সিংহাসন সম্পর্কে জনের দৃষ্টি সর্বনাশেরই একটি ভূমিকা। একইভাবে ব্লেকের সিংহাসনের দৃষ্টিভঙ্গিও আসন্ন রহস্য-উন্মোচনের একটি ভূমিকা বলা যায়। ব্লেইকের দৃষ্টি আকস্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যখন চারটি জোয়াস চারটি ট্রাম্পেট বাজায়, যা পৃথিবীর মানুষের বিচারের আহ্বানকে ইঙ্গিত করে। ট্রাম্পেটগুলি ব্লেইকের দৃষ্টিকে থামিয়ে দেয়, যখন সে মাটিতে পড়ে যায় এবং তার নশ্বর অবস্থায় ফিরে আসে। কারণ রহস্য-উন্মচনের এখনও বাকী। লেখক ঈশ্বরের সিংহাসনের দর্শন এবং আসন্ন সর্বনাশের ভয়ঙ্কর শব্দের সামনে পড়ে যান। যাই হোক, লেখকের দৃষ্টি কিন্তু তার সাথে মাটিতে পড়ে যায় না। ব্লেইক তাঁর অজ্ঞানতা বর্ণনা করার পরের লাইনে, আমরা তাঁর দৃষ্টিকে উর্ধ্বমুখী হতে দেখি: “তাৎক্ষণিকভাবে তামাশাটি ফেলফামের উপত্যকায় বিঁধে জোরে কেঁপে ওঠে।” আর আমরা তামাশাটিকে লসের বার্তাবাহক এবং অনুপ্রেরণার বাহক হিসাবে দেখেছি। এখানে এর আকস্মিক উড্ডয়ন প্রমাণ করে যে কবিতার দৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। লসের গেটে তামাশার উড়াল অনুসরণ করা এবং মিল্টনের দৃষ্টিভঙ্গি চালিয়ে যাওয়াএই সমস্ত কিছুই আসলে শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে পাঠকের উপর। 

ফেলফাম ছেড়ে লন্ডনে ফিরে আসার আগে, এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁকে বিরক্ত করে তুলেছিল, বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ব্লেইকের অজান্তেই, তার মালী জন স্কোফিল্ড নামে একজন সৈনিককে কাজে সাহায্য করার জন্য তাঁর বাগানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু সৈনিককে দেখে ব্লেইকের মনে হয়েছিল সেখানে তার কোন কাজ নেই, তাই তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি এতোটা গুরুতর হয়ে উঠেছিল কারণ, সেই সৈনিকটি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করে বলেছিল যে ব্লেইক রাজদ্রোহী শব্দ উচ্চারণ করেছেন, বলেছেন, ‘রাজার খেতা পুড়ি’ [Damn the King]। ব্লেইক এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাঁকে আগাম বেইল নিতে হয়েছিল এবং কোর্টে হাজির হতে হয়েছিল। ১৮০৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ব্লেইক ফেলফাম ত্যাগ করেন আর লন্ডনের সাউথ মল্টন স্ট্রিটের একটি বাসভবনে চলে আসেন। তার বিচার পরবর্তী জানুয়ারিতে চিচেস্টারে নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারে সৈনিকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত হয় আর ব্লেইক বেকসুর খালাস পেয়ে যান। তবে ব্লেইকের উগ্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে নিপীড়নের ভয় দেখিয়েছিল, এবং তিনি ভাবতেন যে স্কোফিল্ড তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য পাঠানো কোনও সরকারী এজেন্ট কিনা। পরে তাঁর মহাকাব্য জেরুজালেমে তাকে আক্রমণ করে যে কোনো এক ঘটনায় ব্লেইক চিরকালের জন্য ওই সৈনিককে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

যে কোনও দিক থেকেই ‘জেরুজালেম’ হচ্ছে ব্লেইকের এক অনন্য রচনা। ১০০ আলোকিত প্লেট নিয়ে গঠিত এক মহাকাব্য। শিরোনাম পৃষ্ঠায় ১৮০৪ লিখা ছিল। কিন্তু মনে হয় তখন থেকে পরবর্তী অনেক দিন পর্যন্ত ওই মহাকাব্যটি নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। জেরুজালেমে তিনি মানুষের পতন এবং মুক্তির অন্বেষণ করার জন্য আরও এক পৌরাণিক কাহিনী গড়ে তোলেন। আখ্যানটি শুরু হওয়ার সাথে সাথে, মানুষ ঈশ্বর থেকে পৃথক হয়, এবং পৃথক পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। কবিতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিভক্ত পরিচয়গুলি একীভূত হয়, এবং মানুষ তার মধ্যে থাকা দেবত্বের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয়।

To open the Eternal Worlds, to open the immortal Eyes
Of Man inwards into the Worlds of Thought, into Eternity
Ever expanding in the Bosom of God, the Human Imagination.

কখনও কখনও ব্লেইকের কবিতার জটিল পৌরাণিক কাহিনীতে হারিয়ে যাওয়া এবং ভুলে যাওয়া সহজ যে তিনি বাইরের ঘটনা নয় বরং মনের মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ‘মানসিক লড়াই’ বর্ণনা করছেন। জেরুজালেমের বেশিরভাগ অংশ মানুষের ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করার ধারণায় নিবেদিত, যাতে পাঠক সর্বত্র উপস্থিত আধ্যাত্মিক জগতকে উপলব্ধি করতে পারে। কবিতার শুরুতে আমরা দেখতে পাই, যীশু পতিত অ্যালবিয়নকে সম্বোধন করছেন: “আমি দূরের ঈশ্বর নই, আমি তোমাদের একজন ভাই এবং বন্ধু; ‘আমি তোমার বক্ষের মধ্যে থাকি, আর তুমি আমার মধ্যে থাকো।’” কিন্তু পতিত অবস্থায় অ্যালবিয়ন ঈশ্বরের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ মিলনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং যীশুকে ‘অতি উত্তপ্ত মস্তিষ্কের ফ্যান্টম’ বলে বরখাস্ত করে! ঈর্ষায় চালিত অ্যালবিয়ন তার উদ্ভব লুকিয়ে রাখে, জেরুজালেমে। কিন্তু ঈশ্বরের কাছ থেকে এই বিচ্ছেদের পরিণাম হিসেবে হয় অগণিত পুরুষ এবং মহিলা আকারে অন্তহীন বিভাজন এবং বিভিন্ন বিবাদের সৃষ্টি করে আরও বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। 

ব্লেইক বর্তমান সময়ের বর্ণনা দিয়ে মানুষের পতিত অবস্থাই বর্ণনা করেছেন। পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে জড়িত তৎকালীন বর্তমান লন্ডনের উল্লেখ রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘অ্যালবিয়নের রোগ’ আরও বিচ্ছেদ এবং ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। যেহেতু মানবদেহ তার ঐশ্বরিক উত্সের একটি সীমিত রূপ, তাই এখানে ইংল্যান্ডের শহরগুলি মানুষের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের সীমিত এক উপস্থাপনা। আর সৌভাগ্যবশত মানুষের জন্য, ‘সংকোচনের একটি সীমা’ রয়েছে এবং পতন অবশ্যই শেষ হতে হবে। তাই হয়তো পাপ এবং প্রতিশোধের ত্রুটিতে ধরা, অ্যালবিয়ন আশা ছেড়ে দেয় এবং মারা যায়। নৈতিক আইনের ত্রুটিপূর্ণ ধর্মগুলি তাকে বাঁচাতে পারে না: “অনন্তকালের দৃষ্টিভঙ্গি, সংকীর্ণ উপলব্ধির কারণে, / সময় ও স্থানের দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেছে,  স্থির হয়ে গেছে মৃত্যুর খাঁজে।” আমাদের সীমিত ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের জীবনকে অনন্তকাল থেকে আলাদা করে আর স্থান-কালে আবদ্ধ হিসাবে ভাবতে বাধ্য করে। এই ধরনের কাঠামোর মধ্যে শারীরিক মৃত্যুও অস্তিত্বের সমাপ্তিকে চিহ্নিত করে। তবে মৃত্যুরও একটি সীমা রয়েছে, আর অ্যালবিয়নের দেহ ত্রাণকর্তা কাছে সংরক্ষিত।

উইলিয়াম ব্লেইক, ইংরেজি কবিতার রোম্যান্টিক যুগের এই অগ্রদূত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন ১৮২৭ সালের ১২ই আগস্ট। অত্যন্ত মহিমান্বিতভাবে। তিনি বলেছিলেন তিনি সেই দেশে যাচ্ছেন যা তিনি সারাজীবন দেখতে চেয়েছিলেন এবং নিজের আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, যীশু খ্রিস্টের মাধ্যমে পরিত্রাণের আশায় তিনি মারা যাওয়ার ঠিক আগে তাঁর চেহারা ন্যায্য হয়ে ওঠে। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং স্বর্গে যা দেখছিলেন তার গান গাইতে শুরু করেন।

 

২৮.০৪.২০২৩; কালীবাড়ি বাইলেন, ময়মনসিংহ।

=========================