বিমান-হামলার সাইরেনে কথোপকথন: যুদ্ধকালীন সাহিত্যে ওদেসার লেখকেরা
ওদেসার সৌধ: দূক দে রিচেলিএ (ছবি কৃতিত্বে আন্না হলুবস্কি)
[গত ২৪ শে মার্চ, ২০২২ তারিখে প্যারিস রিভিউ ম্যাগাজিনে ইউক্রেনের ১৩ জন কবি ও সাহিত্যিকের একটি কথোপকথন প্রকাশিত হয়। ওদেসার সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ইয়েভজেনি হলুবস্কির অনুরোধে কথোপকথনটি সমন্বয় করেন ইউক্রেনীয়–অ্যামেরিকান কবি ইলিয়া কমিনস্কি। রুশ আর ইউক্রেনীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন ইলিয়া কমিনস্কি, কেইটি ফার্যিস, নাট্যালিয়া বারিসনিকৌভা, লুইস ট্রেইন, অ্যানাস্টেইশা দায়াটলৌভা, এনকে এবং ইউহাঙ্কা দেলগাদো।]
উদ্যোক্তা ইয়েভজেনি হলুবস্কির
আন্না হলুবস্কি (ছবি কৃতিত্ব)
ইলিয়া কমিনস্কি
আমাদের আজকের গল্পের শুরু সেই ত্রিশ বছর আগে, আশির দশকের শেষ দিকে। যখন ওদেসার বেশ ক’জন কবি নিউজপেপারে কাজ করতেন, যার অনেকগুলোই ছিল নড়বড়ে। সেইসময় এক প্রকাশক এলেন আমাদের স্কুল ভিজিট করতে।
“তোমাদের মধ্যে কে কে নিউজপেপারে লিখতে চাও?”
এক-ঘর হাত উঠল উপরে।
“ফ্রিতে কে কে লিখতে চাও নিউজপেপারে?”
একটাই হাত উঠল উপরে—আমার। বয়স তখন বারো।
কাগজের অফিসের ব্যস্ত হলওয়ে ধরে এগিয়ে যেতেই, ক্যান-হাতে এক বুড়োর সাথে দেখা, ভ্যালেন্টিন মর্যজ—ইউক্রেনীয়-ভাষার কিংবদন্তী কবি, যার সাথে সোভিয়েত পার্টির কর্মকর্তাদের ঝামেলা চলছিল কিছু। তিনিই আমার পাশে ম্যান্ডেলস্টাম পড়ছেন, স্থির বসে থাকতে পারছেন না যেন, শান্তভাবে পড়ে যেতেও পারছেন না। একেকটি স্তবক পড়ছেন আর তাঁর কণ্ঠ যেন কাঁপছে উত্তেজনায়: “শুনতে পাচ্ছ? তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? এই হচ্ছে ম্যান্ডেলস্টাম, কুত্তার বাচ্চা ম্যান্ডেলস্টাম, এই কুত্তার বাচ্চার চেয়ে ভালো আর কেউ লিখতে পারে না। তুমি কি জানো না ম্যান্ডেলস্টামকে?”
বললাম, জানি না।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বিল্ডিঙের বাইরে কাছের একটা ট্রাম স্টেশানে। অফিস থেকে স্টেশানে আর স্টেশান থেকে তাঁর এপার্টমেন্ট পর্যন্ত যেতে যেতে পুরো রাস্তায় কবিতা শুনিয়ে গেলেন।
আমাকে ব্যাগভর্তি ম্যান্ডেলস্টামের বই আর একটা হাতে-লিখা নোট দিয়ে বললেন এগুলো পড়ে শেষ করে অন্তত কিছু কবিতা মুখস্ত না-করা পর্যন্ত অফিসে আসার দরকার নেই।
এইভাবে আমার শিক্ষার শুরু।
একই বছর আমি সাক্ষাৎ পেয়েছিলেম ইয়েভজেনি হলুবস্কির, তিনিও ওদেসার একজন কিংবদন্তী সাংবাদিক, আমার স্কুলে এসেছিলেন কথা বলতে। মর্যজ তাঁর কথাবার্তায় একটা পয়েন্ট আমাকে উল্লেখ করেছিলেন, ম্যান্ডেলস্টামের সর্বশেষ গ্রেফতার আর তাঁর ট্রানজিট ক্যাম্পে ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর পর এই হলুবস্কিই প্রথম তাঁর রচনাসমূহ পুনরায় পাবলিশ করা শুরু করেন। এরপর তাঁর বিধবা স্ত্রী নাদেসদা তাঁর কিছু অপ্রকাশিত রচনা শেয়ার করেন, যেগুলোর কিছু লিখা ছিল সিগারেট পেপারে। কিন্তু হলুবস্কি যখন এইসব রচনা সমস্ত আইনের বিরুদ্ধে গিয়েও প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি করেন, তখন নাদেসদা বিশ্বাস করতে পারেন নি, মাথা নেড়ে হেসেছিলেন।
কিন্তু তারপরও তিনি তা করে দেখিয়েছেন। হলুবস্কি এমনই এক মানুষ।
আমার পরিবার ওদেসা ছাড়ে ১৯৯৩ সালে। মর্যজ মারা যান ২০১৯এ, তবে হলুবস্কি আর আমার যোগাযোগ সবসময়ই আছে। এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে যখন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, তিনি আমাকে ইমেলে সব জানিয়েছিলেন, এয়ার-রেড সাইরেন আর আতঙ্ক, আর শেষ করেছিলেন বলে, “এখন সব শান্ত। গ্রীষ্মের কী সুন্দর উজ্জ্বল এই দিন!”
হ্যাঁ, হলুবস্কি এমনই এক মানুষ।
আমি জানতে চাইলাম কীভাবে আপনার উপকারে আসতে পারি, তিনি বললেন, “আহা, কিছুই লাগবেনা আমার।” এরপর আবারও যখন জিজ্ঞেস করলাম, বললেন, “পুতিনেরা বারবার আসে আর যায়। বাদ দাও ওসব। শোনো, আমরা একটা সাহিত্য পত্রিকা করতে যাচ্ছি। যদি পারো তোমার কিছু কবিতা দিও।”
হলুবস্কি সবসময়ই নতুন কিছু না কিছু শুরু করতে থাকেন। এই তো কয়েক বছর আগে বিভিন্ন বয়সী এক গাদা লেখকদের চা-পানের আমন্ত্রণ জানান। আর এইভাবেই শুরু হয় গ্রিন ল্যাম্প, বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। “দুই-শত-সাতাশ-বছর-বয়সী-পুরনো শহর, ওদেসাএখনও অপেক্ষাকৃত তরুণ,” তিনি আমাকে লিখে পাঠান,
কিন্তু তার এই দুইশত বছরেরও বেশি এই সময় পুরো বিশ্বের সাহিত্য মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। নানান লেখক, যেমন লর্ড বাইরন, মার্ক টোয়েন, আর পুশকিন ওদসাকে নিয়ে লিখেছেন। পোল্যান্ডের জাতীয় কবি অ্যাডাম মিকেভিচ ওদেসায় ছিলেন কিছু দিন, লিখেছেন ওদেসা সম্পর্কে। কিংবদন্তী আন্না আখমাতোভা এখানেই জন্মেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই, ওদেসা অর্জন করে তার নিজস্ব—খুবই বিচিত্র ও বহুভাষিক—সাহিত্য ঐতিহ্য : আইজ্যাক বেইবেল আর ইউরি ওলেশারুশ ভাষায়, ইয়ানস্কি আর সোজিউরা ইউক্রেনীয় ভাষায়, সলেম এলিখেম ইদ্দিশ ভাষায় এবং এইরকম আরও অনেক রচনা।
আর আজ সেই হলুবস্কি ওদেসার খোয়া-বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটেন আর দেখতে পান ট্যাঙ্ক-প্রতিরোধী যন্ত্র পড়ে আছে এখানেসেখানে, শুনতে পান মাথার উপর দিয়ে বিস্ফোরণের আওয়াজ। তাঁর ইমেলগুলোয় তিনি যেমন সাহিত্যের পুরনো ঐতিহ্যের গুরুত্বের কথা বলেন, তেমনি তাগাদা দেন নতুন স্বরেরও। তাঁর পরামর্শেই আমি গ্রিন ল্যাম্পের সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার পরিকল্পনা করি। “তোমার কাছে আমার কিছু আশা রয়েছে” যুদ্ধ শুরুর প্রথম দু’সপ্তাহে হলুবস্কি আমাকে লিখেছিলেন, “আমি চাই না অবিরত বিমান-হামলার সাইরেনের ছন্দে তোমার দিন কাটুক। কী যে যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই শহরের আর সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনের। এমন যন্ত্রণা, যা লেখকদের বুকের হাড় ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে অনবরত।”
এলেইনা অ্যান্দ্রিচিকৈভা
“আর তুমি, কেমন আছ?”
এই প্রশ্নে শুরু হয় প্রতিটি সকাল। নিজেকেই প্রশ্ন করি, নিজে। ফ্যামিলিও জিজ্ঞেস করে, বন্ধুরা জানতে চায়, কলিগরা আর পরিচিত জনেরাও জানতে চায়: আমার প্রতিরক্ষার বাক্যগুলো। বিশ্বাস করুন, এখনও আমার মাথায় ঢোকে না কীভাবে সম্ভব—ইউক্রেনে এই যুদ্ধ? রাশিয়ার আক্রমণ? ওরা আমাদের শহরগুলোয় বোমা মারছে? এইতো যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগেই, আমার নতুন উপন্যাসটি লিখে শেষ করেছি। যেখানে নায়ক যুদ্ধের স্বপ্ন দ্যাখে—স্বপ্নগুলো তার দাদীর গল্প দিয়ে প্রভাবিত, যিনি সালাস্পিলস ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। কিন্তু উপন্যাসটি আবারও পড়ার মনোবল পাচ্ছি না আর। বিরক্ত ও বিক্ষিপ্ত লাগছে নিজেকে।
একদিন হয়তো পুনর্লিখনের সাহস ফিরে পাবো আবার। প্রত্যক্ষদর্শীর মতোই কথা বলবো তখন। এক সাধারণ বৃহস্পতিবার ভোরে যখন বিমান-হামলার সাইরেন বেজে ওঠে তখন কতোটা ভীতিকর লাগে। এসবে চিন্তিত নই বোঝাতে চেয়ে পাগলের মতো গোছাতে গিয়ে কীভাবে যে হাসি ছেলের দিকে চেয়ে। অথচ দুশো ফুটেরও কম দূরত্বে একটা গুদামঘর চোখের সামনে বোমায় বিস্ফোরিত হয়ে পুড়ে গেল। উফ্,কীভাবে যে আমরা ওদেসার একটা রুট সেলারে জ্যামের জারে ঘেরা একটি রাত কাটিয়েছি। দেখলাম সবে খারকিভ থেকে আসা আমার টিন বছরের ভাতিজা ভয়ে তোতলাচ্ছিল আর কাঁদছিল। বুঝতে পারছিলাম না, স্বামীর সাথেই থাকব নাকি বাচ্চাদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে দেব। এরপর রাতের অন্ধকারে ওদেসা ছাড়লাম :কুকুর, বিড়াল, নারী ও শিশু সহ আটটি গাড়ী। কেউ কেউ তো সে’রাতেই জীবনে প্রথম ড্রাইভ করছিল। এক সময় একটা চেকপয়েন্টে আমাদের থামানো হল। রাতের বেলা কোনও গাড়ী চলার অনুমতি ছিল না। এক মহিলা হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে বলল, “আমি পাসওয়ার্ড জানি! আমার স্বামী যুদ্ধে যাবার আগে আমাকে লিখে দিয়ে গেছে।”
আমরা নিজেদের তথ্য যুদ্ধে লড়ছি। প্রতিদিন একটিই আশা নিয়ে ঘুম ভাঙে, শুনব যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমরা আবার বাঁচতে পারব, ভাবতে পারব, নতুন উপন্যাস লিখতে পারব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কেবল তোমাদের একটাই কথা বলতে পারি, “আর তুমি? কেমন আছ তুমি?” যেখানে উত্তর শুনতে পাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।
ভ্লদিস্লাভা ইলিনস্কাইয়া
এক সপ্তাহ স্তব্ধতার মধ্যে কাটানোর পর, আমি ওদেসার রাস্তায় বেরিয়ে এলাম অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক দুর্গ দেখতে, বালির ব্যাগের তৈরি ব্যারিকেডগুলি রাস্তাগুলিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। খাবার আর কাপড়ের দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষ বন্দুক হাতে রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আর আমি একটা ট্যাক্সিতে বসে এইসব লিখছি। আর কিছুক্ষণ পর একটা চেকপোস্টে আমাকে থামিয়ে সার্চ করা হল। অত্যন্ত ভীতিকরভাবেই আমি এমন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আজ।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল নীরবতা, যখন আপনি জানেন সারা দেশ রক্তাক্ত ঝোলে ফুটছে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার আর বিস্ময়কর, আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন সংহতি আর পরস্পরের প্রতি এমন যত্ন আগে কখনও দেখিনি।
একটা অদ্ভুত অনুভব এসে ভর করেছে। মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তের আগে আমরা কেউ বাঁচিনি। যেন একধরনের খোলস ফেটে গেছে যা আমাকে গভীরভাবে শ্বাস নিতে বাধা দিচ্ছিল। যুদ্ধের আগে কি করেছিলাম ভুলে গেছি। বাস্তবতার সাথে এইভাবে জড়িত থাকার এমন প্রয়োজন সম্পর্কে এতোটা সচেতন ছিলাম না কখনও।
আত্মরক্ষার্থে মানুষ ব্যাগের ভেতর বালি ভরছে দুর্গ বানাতে (ছবি কৃতিত্বে আন্না হলুবস্কি)
ভিটা ব্রেভিস
যুদ্ধ আমার জীবনে এসেছে যখন লাভিভে ছিলাম। সেখানে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ বাড়ি ফেরার তাড়নায় ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না কেন ওদেসার দিকে ফিরছিলাম যখন আর সবাই যাচ্ছিল লাভিভের দিকে কিংবা আরও পশ্চিমে, দেশের বাইরে, নিরাপত্তার খোঁজে। লভিভের স্টেশানে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। পশ্চিমের সীমান্তের দিকে যেতে বহু মানুষ ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু একেকটা ট্রেন প্রায় পাঁচ/সাত ঘণ্টা লেট করছিল। কিছু লোক তো ক্লান্তিতে তাদের সুটকেসের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাচ্চারা কাঁদছিল। ঠিক যেমন যুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রে দেখা যায়।
আজ মার্চের ১১ তারিখ। ষোলতম দিন। গুলি আর বোমায় পরিপূর্ণ যুদ্ধ এখনও শুরু হয়নি ওদেসায়। কিন্তু তুমি এই চিঠিটি পড়তে যাচ্ছ আরও পরে এবং তুমি হয়তো আমার চেয়ে আরও বেশি জেনে থাকবে তখন। তোমাকে ঈর্ষা হয়।
শুরুর দিকে আমার জানালাগুলো আড়াআড়িভাবে টেপ মেরে দিয়েছিলাম যেন কাছাকাছি বোমা পড়লে অন্তত তার তরঙ্গ আমার পুরো এপার্টমেন্টে ঢুকে না-পড়ে, কাচের দেয়াল ভেঙে না-ফ্যালে। আরও ভালো সুরক্ষার জন্য একটা বড় ড্রেসার এনে জানালার সামনে রেখেছিলাম। এরপর যতই দিন গড়াচ্ছে আমরা ভয় পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। তাই এখন ড্রেসার সরিয়ে ফেলেছি। টেপও তুলে ফেলেছি।
অন্যান্য শহরে বোমা ফেলা হয়েছে, মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে। রাশিয়ার সৈনিকেরা রাস্তা ধরে হেঁটে গেছে আর বিনোদনের জন্য স্থানীয় সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরেছে। এখন যারা ওদেসা ছেড়ে যাচ্ছে তারা দেখতে পাচ্ছে যুদ্ধের অন্য আরেকটি দিক : শিশুরা কাঁদছে, প্রায় ৩০/৪০ ঘণ্টা মালদোভা সীমান্তে অপেক্ষা করছে মানুষ, জানে না কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কোথায় গোসল করবে, আর কবেইবা বাড়ি ফিরবে।
আমি বিল্ডিঙের একুশতলায় থাকি। আশপাশে কেউ নেই। আটটি এপার্টমেন্টের কেবল একটিতে এখনও বাসিন্দারা আছে :আমার কুকুর, আমার বিড়াল আর আমি। যখনই সাইরেনের কান্না শুনতে পাই, বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াই মিসাইল আসছে কিনা দেখতে।
ইউজিন ডেমেনক
প্রাগ আর ওদেসা, এই দুটি শহরে ঘুরে ফিরে থাকছিলাম আমি। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হল, আমার পরিবার তখন নিউইয়র্কে বেড়াতে গেছে। প্রাগের ফ্লাইট ধরার আগ পর্যন্ত আমরা হোটেল থেকে খুব একটা বের হইনি, কেবল যুদ্ধ বিরোধী প্রোটেস্টে অংশ নেয়া ছাড়া। পুরোটা সময় আমরা নিউজ স্ক্রল করে গেছি আর বন্ধুবান্ধব, আত্মিয়সজনকে ফোন করেছি।
প্রাগে ফিরে মনে হল, আমরা কাজে লাগতে পারি। কেননা, চেক রিপাবলিক প্রায় দুই লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। শরণার্থী সংহতকরণ কেন্দ্র, রেল স্টেশান, আর একটি কমিউনিটি রেসিডেন্সে সময় কাটাতে লাগলাম। সেখানে আমার বন্ধুরা নিজ খরচে ৭২ জন শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন।
আমি কিছু লিখতে পারছি না এ মুহূর্তে। এখন এর জন্য সহ্য ক্ষমতা, ইচ্ছা বা সময় কোনওটাই নাই। অনেকদিন ধরে আমি হেনরি মিলার আর ডেইভিড বারলিকের পরস্পারিক চিঠিপত্র বিনিময় নিয়ে কাজ করছিলাম। এই প্রথম মিলারের কিছু চিঠির ইউক্রেনীয় অনুবাদ প্রকাশ করব আমি। কিন্তু তবুও আমার সকাল শুরু হয় ফোন কলে আর চিঠি পেয়ে, যেখানে কেবল সাহায্যের আবেদন। স্বেচ্ছাসেবকের কাজে আমার সারাটা দিন কেটে যায়। শেষে যখন ফ্রি হই, কাজ শেষে বাসায় ফিরি তখন অলরেডি অনেক রাত।
ভ্লাদিস্লাভ কিতিক
একটা সিগাল, তালগোল পাকানো পালক নিয়ে, বাতাসের বিপরীতে পিয়ের প্রান্তে গিয়ে বসে। তখন সাগরে একটা ধারালো বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে তার ধূসর জলের প্রতি মনোযোগ বিঘ্ন হয় আর সে ডানা মেলে উড়াল দেয় আকাশে।
সিগালেরা জানেনা যুদ্ধ কী জিনিস। কিন্তু ১৬ দিনের মাথায় ওরাও শিখে যায় খুব বেশি উড়ে যাওয়ার দরকার নেই যখন ক্যানন ফায়ার বা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে আকাশ কেঁপে ওঠে। কিংবা লুকোবার কিছু নেই যখন সাইরেন বেজে ওঠে।
ওদেসার ব্যস্ত রাস্তার ভিড়ের উপর দিয়েই সাধারণত সিগালেরা ওড়ে। কিন্তু আজ এক বিরল পথচারী ওই অস্পর্শিত রাস্তার তুষারে ফেলে যায় তার পায়ের ছাপ। নিঃশব্দে, বিখ্যাত পোটেমকিন সিঁড়ির ঢাল বেয়ে নেমে আসে, বালি ভর্তি ব্যাগের নিচের দিকে নেমে যায়। যেখানে আর্টিলারির বিদ্বেষ থেকে বাঁচাতে শহর-প্রতিষ্ঠাতার মূর্তিকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সিগালেরা বালি ভালোবাসে।
রাস্তাগুলো এন্টি-ট্যাঙ্ক যন্ত্র দিয়ে ঝাঁঝরা করে রাখা হয়েছে। তারপরও ওগুলো কি আমাদের আধুনিক মিসাইল আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারবে? পারবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু হেজহগ নামে পরিচিত এই ছয়-পয়েন্টের ক্রসগুলিতে কিছু ছদ্মবেশী কটমট আছে।সেই ১৯৪১ সালেও এইরকম হেজহগ এখানে দাঁড় করানো ছিল। আর এখন যেন অতীতের অতল থেকে সময় লাফিয়ে উঠে এসেছে এইখানে।
পাখিগুলো ঘরবাড়ির উপর দিয়ে চক্কর দিয়ে আবার সমুদ্রের দিকেই উড়ে যাচ্ছে।
ঘান্না কসতেঙ্কো
কিছুদিন আগে, ভেবেছিলাম রাচম্যানিনফের দ্বিতীয় কনসার্ট দেখব। আমি এটিকে আমার হাতে একটি শাখার মতো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম, যাতে আমি রাশিয়ান সমস্ত কিছুর প্রতি শত্রুতার আঠালো কাদায় পিছলে না যাই। রাচম্যানিনফ নির্দোষ—পুতিনের অপরাধের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কিছু করার নেই। যেমন গ্যোটে নির্দোষ ছিলেন হিটলারের পাগলামির সময়।
গতকাল এক বিমান-হামলার সময় বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। আর পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম, আমি ঘৃণার ডোবায় ডুবতে চাই না। আমি নিজের জন্য একটা পথ বেছে নিয়েছি। সেই পথেই আমি স্থির থাকব। কারণ, ঘৃণা আমার শ্ত্রুর ভাষা হতে পারে। আমার না। ওটা ওদের শক্তির উৎস হতে পারে। আমার না। আর, কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তুমি—কিন্টারগার্ডেন, মেটারনিটি ওয়ার্ড কিংবা হাসপাতালে বোমা বর্ষণকে?
আমি ফিরে আসি হাইনার কাছে, যিনি বলেছিলেন, প্রতিটি নতুন যুগে নতুন পাঠক প্রয়োজন, প্রয়োজন নতুন ধরনের চোখ,দেখার জন্য।
ভিক্তোরিয়া করিতনিয়ানস্কাইয়া
যুদ্ধের সময় জীবন বলতে কী বুঝায়? এর উত্তরে ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন—আমার মনে হয় জীবন তখন সীমাবদ্ধ হয়ে আসে সাধারণ কিছু জাগতিক কর্মকাণ্ডে :টিভিতে খবর দেখা, মুদি দোকান থেকে সদাই কেনা, সাধারণ খাবার রান্না করা, থালা বাসন ধোয়া—এইসব। আমি অবশ্য বই পড়ি আর যুদ্ধের সময় ওদেসার শিল্পীদের অবস্থা নিয়ে একটি রচনা লিখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আবার মনে হয়, কেন এসব করছি? কালই হয়তো আমি—কিংবা এই শহর—ওদেসা আর থাকবে না। যুদ্ধ আসলে লেখার আনন্দ কেড়ে নেয়।
যুদ্ধ আরও অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। এমনকি সাগরের পাড়ে প্রাণ খুলে হাঁটা যায় না—রাশিয়ানদের রুখতে লুজানোভকার সৈকতে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। ওদেসা এখন একটা স্থির সাসপেন্সের মধ্যে আছে। গোলাগুলি, বিমানহামলা কিংবা রাসায়নিক হামলার জন্য অপেক্ষায় আছে। আমরা অপেক্ষার প্রহর গুনছি।
বিস্ময় এখন সবদিকেই : প্রায় প্রতিটি মোড়ে বালির বস্তা আর কংক্রিটের ব্লক দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। ভলান্টিয়াররা রুটি আর সস সরবরাহ করছেন। আবার আরও বিস্ময়কর ব্যাপার যে, গত তিন দিন ধরে তুষার পড়ছে এখানে—ওদেসা, ছুটি-কাটানোর এই শহরে, তুষারপাত হচ্ছে এই মার্চেই! আর আমার প্রতিবেশী বৃদ্ধা, যিনি হিটলারের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, যার বয়স আশিরও ওপরে, আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন সবসময়, বলছেন, “সর্বদা গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে থাকবে, ওরা বোমা মারলেও যেন তোমাকে পরিষ্কার দেখায়..”
এই সব কিছুর পরও আমি নিশ্চিত, এর ভেতর দিয়েই আমরা অতিক্রম করে যাব এক সময়। কেননা, ইতিমধ্যেই সামনের সমস্ত বাগানে সাদা তুষারপাতের মধ্যেই বেগুনী ফুল ফুটেছে, কবুতরগুলো আমার জানালায় কুঁকড়াচ্ছে, আর আমরা অতিক্রম করে যাব কারণ আমাদের অন্তর্গত ভিত মজবুত।
কারও প্রয়োজন আছে কিনা—এই মুহূর্তের সাহিত্য নিয়ে ভাবিত নই আমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে লিখিত আমার রচনগুলো, যা আমি বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনে লিখেছিলাম, তা আরপ্রাসঙ্গিক নেই আজ। কারণ, আজ আমদের সম্পূর্ণ আলাদা এক যুদ্ধ রয়েছে, একেবারে নিজস্ব অভিজ্ঞতার। আর আমার অন্য রচনাগুলো—যে গল্পগুলো এঞ্জেলদের নিয়ে লিখেছিলাম—আজকের সময়ের তুলনায় তা খুব হালকা ধাঁচের। রুশ ভাষায় যা লিখেছিলাম তা আর সময় উপযোগী নেই। আমার মনে হয় আজ অথবা কাল ওদেসার প্রত্যেক লেখকই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন, আমি কি রুশ ভাষায় শুধু ওদেসার জন্য লিখব নাকি ইউক্রেনীয় ভাষায় সমগ্র ইউক্রেনের জন্য লিখব? কোনটা বেছে নেব?
ওদেসার অপেরা থিয়েটার (ছবি কৃতিত্বে আন্না হলুভস্কি)
ভাদিম লন্ডা
আমি আর আমার বউ পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ওদেসা ছেড়ে এসছি। বন্ধুরা মিলে ৯ জনের একটি দল, ট্রেনের ৪ জনের কামরায় ভিড় করে লাভিভ গিয়েছি। তারপর গাড়ী করে সীমান্ত পেরুতে চেয়েছি, কিন্তু আমাদের গাড়ী থামিয়ে দেয়া হয়। বরফের উপর দিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে প্রায় মাইল খানেক গিয়ে একটা বর্ডার চেকপোস্টের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছি। সেখানে ভীষণ ভিড় ছিল। ওপর প্রান্ত থেকে যখন কিছু ট্রাক আসতে দেখা যায় তখন বর্ডার গার্ডরা আমাদের ছেড়ে দিয়ে ওইদিকে মনোযোগ দেয়। মাঝেমধ্যেই ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ না কেউ চিৎকার করছিল, “ডাক্তার! ডাক্তার!” বলে। বৃদ্ধ মহিলারা অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। শেষে, বর্ডার গার্ডরা আমাদের বিল্ডিঙের ভেতর ঢুকতে দেয়। প্রায় মুহূর্তের মধ্যে বিশাল হলঘরটি ভিড়ে জমে গেল। ঘণ্টাখানেক ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন একজন গার্ড চিৎকার করে বললেন, “পরের হল ঘরের দিকে দৌড়ে যান সবাই।” ভিড় প্রবাহিত হল পরের হল ঘরের দিকে। দেখতে পেলাম বাইরে যারা আমাদের পেছনে ছিল তারাই এখন সামনে।যেসব মায়েদের কোলে ছোট বাচ্চা ছিল, তারা প্রায় হিস্টিরিয়া গ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল।
এ এক অসম্ভব মুহূর্ত, এক বর্ডার গার্ড আমাদের পাসপোর্টে ষ্ট্যাম্প মেরে দিল আর আমরা পোলিশ অঞ্চলে ঢুকে গেলাম। সেই গার্ড, শান্তা ক্লজ সেজে, প্রতিটি বাচ্চাকে চকলেটও দিচ্ছিল। তবে, এইভাবে পোলিশ বর্ডার পেরুতে আরও ঘণ্টা দুই লেগে গিয়েছিল। তারপর একটি বাসে করে তথ্যকেন্দ্রে এলাম। আরেকটি বাসে করে ট্রেন স্টেশান। দ্বিতীয় শ্রেণির এক হাফ-স্লিফলেস রাত। ভিড়ে পরিপূর্ণ চলন্ত ট্রেনের হলওয়েতে সুটকেস পেতে বসে ছিলাম পুরো রাস্তা। চেষ্টা করেছি আয়নায় নিজেদের না দেখতে।
শেষ পর্যন্ত পৌঁছুলাম পোল্যান্ড, বন্ধু-বান্ধব আর স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছেন। এইভাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ কি? সাহস করে কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর?
আর লেখালেখির বিষয়ে বলতে পারি, আর কিছু না, আমি এখন শুধু খবরই পড়তে পারি। তাই, দয়া করে সাহিত্যের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। রুশ ভাষার প্রতি আমার মনোভাব বদলায় নি। না, আমি আমার দেশ দখলকারীর ভাষায় কথা বলি না। ছেড়ে আমি দিই নি। আসলে ওরাই আমার ভাষা লুট করেছে।
ম্যারিনা লিন্ডা
এই দুই সপ্তাহে আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে: আমি যে বিশ্বকে জানতাম তা শর্টব্রেডের মতো ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তবে যে মানুষগুলো দুর্বল ছিল, তারা আজ ইস্পাতের মতো মজবুত হয়ে গেছে। আমি নিজেই তো নিজেকে এক লৌহকাঠামোর মতো অনুভব করি, যার উপর পুরো বাড়ি ভর করে আছে, ভর করে আছে আমার ভীতসন্ত্রস্ত ছেলেমেয়েরা, আমার বিড়াল, আর আমার পরিচিত সব যা আমার জানার মধ্যে আছে এ মুহূর্তে। এমনকি আমার আপন মনের স্বচ্ছতাও।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি : চারপাশের সবকিছুই এখন এমনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে যা একসময় আমি যুদ্ধের বইয়ে পড়েছি। কী দারুণ এক ভিন্ন জগতে ভিন্ন সময়ে বাস করতাম আমি। কিন্তু আজ এটা কোনও ভিন্ন সময় নয়। এই মুভিই আজ আমার জীবন, আমার পরিবারের, আমার শহরের জীবন। এটি খুব মাঝারি মানের মুভি। আর না। আমি এই থিয়েটারের আলো জ্বালিয়ে দিতে চাই।
আন্না মিহালেভস্কাইয়া
রাতে বিড়ালগুলো ক্যামন আর্তনাদ করছে, বিমান-হামলার সাইরেনের মতো ওদের চিৎকার। আজকাল অদ্ভুত জিনিসের মধ্যেই সৌন্দর্য খুঁজে পাই আমি—পলেস্তরা ছাড়ানো দেয়ালে গ্রাফিতি, মেরামতের জন্য খোঁড়া রাস্তা—এইসব। লোভাতুর প্রত্যাশায় তাকাই সব দিকে। জানি না এই রাস্তাটি কিংবা ওই রাস্তাটিও আবার দেখতে পাব কিনা। বিধ্বস্ত খারকিভের ছবিগুলো দেখি, দেখি বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়া কিয়েভের ছবি। সব কিছুই কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যদি কিছু করতে চাও তোমাকে তা এখনই করতে হবে।
কিছু করা, যে কোনও কিছু, এই সময়ে ঔষধের মতো কাজ করবে। যদি কাউকে সাহায্য করতে যাই, ভুলে যাই যুদ্ধে চলছে। আমার মনে হয় বহু মানুষেরই এমন হয়।
আমাদের যুদ্ধপূর্ব জীবন ইতিমধ্যে অবাস্তব আর দূরের বলে মনে হচ্ছে। সে জীবন অনেক কিছু নিয়েই পরিপূর্ণ ছিল। কখনও অভিনন্দন জানাইনি। সব সময়ই তাড়াহুড়ো করেছি, নতুন প্রজেক্টের পেছনে দৌড়েছি। মৌলিক কথাটুকু পর্যন্ত বলার সময় হয় নি। কিন্তু এখন এত কথা, তবু দুশ্চিন্তায়। নির্মমভাবেই, এই পরিস্থিতি আমাদেরকে পরস্পরের কাছে নিয়ে এসেছে।
নেইল মাইরাতভ
যুদ্ধের এই প্রথম কয়েকদিনে ওদেসায় কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? হ্যাঁ। না। গ্যাস স্টেশানে মানুষের লম্বা লাইন লেগে আছে যা রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করছে। লম্বা লাইন লেগে আছে গ্রোসারি দোকানগুলোয়। দোকানের তাক থেকে যেন সব কিছু সংগ্রহ করে নেবে—খাদ্যশস্য, চিনি, লবণ, দিয়াশলাই সব—এই হুলস্থুল, এইসব মানব-স্তুপ শহরের স্বাভাবিক শান্তি বিঘ্নিত করছে।
চেকপয়েন্ট বসানো হয়েছে, তবু কিছু গাড়ী ঠিকই এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন কাজে মানুষ এদিক সেদিক যাচ্ছে। সুপারমার্কেট, ছোট ছোট দোকান এখনও খোলা রয়েছে। সোমবার, স্কুল ইউনিভার্সিটির ক্লাস খুলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউ জানি না ভবিষ্যতে কী ঘটবে।
যুদ্ধের সময়ে লিখালিখির খুব বাজে অবস্থা দাঁড়ায়। কি করবে তুমি? কারণ যা ঘটছে তোমার মন তার কোনও মানে দাঁড় করাতে অপারগ।
অনেকেই চলে গেছেন। আর যারা আছেন, তারা একত্র হয়ে আছেন। সেদিন আমার বিরানব্বই বছরের মা দোকান থেকে কিছু সংরক্ষিত ক্যান নিয়ে ফিরেছেন, যেগুলো তাঁকে এক মহিলা দিয়েছিলেন যাকে তিনি চেনেনই না।
তাইয়া নেইদেঙ্কো
যুদ্ধের প্রথম দিন খারকিভ, কিয়েভ আর লাভিভের যারা রুশ ভাষায় কথা বলতেন কিংবা দোভাষী ছিলেন, সবাই ব্যাপকভাবে ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার না পেরে শেষে হার মেনে নিজ ভাষা রুশ-এ ফিরে গেছে। প্রথমে তাদের বলতে শোনা গেল—“যাতে সমস্ত রাশিয়ান শত্রুদের বোঝা যায়।” – তারপর, ধীরে ধীরে, ফিরে গেল কোনও যৌক্তিকতা ছাড়াই। যখন,দ্রুতই, বিমান হামলার মাঝখানে, তোমার অনুভূতি আর ভাবনাগুলোকে স্পষ্ট করে তুলতে চাই, তখন আপনাআপনি ফিরে যাও তোমার সহজাত ভাষায়, যা তুমি শৈশবকাল থেকে চর্চা করে আসছো। কিন্তু অন্যরা তাদের শপথ রক্ষা করে—রুশ ভাষায় আর একটি বাক্যও নয়। আর আমার মনে হয় তারা যুদ্ধের পরও ইউক্রেনীয় ভাষী হিসেবে স্থির থাকবে।
রাশিয়ার এই আগ্রাসন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে সাধারণ ভাষার শব্দও কী করে শত্রুতা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু ভীতি প্রদানকারী, এমনকি অন্যান্য দেশের কিছু লোকও, আমাকে নির্বোধ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে, “যুদ্ধের পর ইউক্রেনেওরা রুশ ভাষা নিষিদ্ধ করে দিতে পারে।” আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই:আপনি রাশিয়ান ভাষায় যা মনে করেন তা বলা শুধুমাত্র পুতিনের রাশিয়ায় নিষিদ্ধ।
আন্না স্ত্রেমিন্সকাইয়া
এটা মোটেও ভালো ইম্প্রেশান না যে কোনও শহর তার প্রতিরক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করছে। কারণ তুমি খুব সহজে শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে চলে যেতে পারবে না। সব জায়গায়ই কাঁটাতার, বালির বস্তা আর ট্যাঙ্ক-ট্র্যাপ।
দিনের মধ্যে বহুবার বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও বোমা থেকে বাঁচার আশ্রয় নেই। আমার পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা মাকে তখন বাথরুমে লুকিয়ে ফেলি। তার জন্য এটাই কিছুটা নিরাপদ জায়গা।
এতো কিছুর পরও, ওদেসাবাসী তাদের রসবোধ হারায় নি। শহরের দেয়ালে দেয়ালে তারা বড়ো কিছু ব্যানার টাঙিয়েছে। রাশিয়ান সৈনিকদের উদ্দেশ্যে যেখানে লিখা আছে,পাশের স্নেক আইল্যান্ডে যেমন রাশিয়ার যুদ্ধ-জাহাজকে যে বিখ্যাত উপদেশ দেয়া আছে, সেটাই করতে। যুদ্ধের সময় অশ্লীলতা অবশ্য ক্ষমার যোগ্য। কারণ তা মানসিক চাপ কমায়।
মানুষ সব জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে। সাগর পাড়ে ব্যাগগুলোতে বালি ভরছে। গান গাচ্ছে, “তুমি একজন ওদেসাবাসী, মানে হচ্ছে যন্ত্রণা কিংবা দুর্ভাগ্য, কিছুতেই তুমি ভীত নও হে!”
যুদ্ধ নিয়ে বহু কবিতা আমি লিখেছি। একজন কবি মানেই এমন একটি স্পন্দিত তার, যা আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা সবকিছুর প্রতিক্রিয়া জানায়। আমার কবি বন্ধুরা যা লিখছে তাও পড়ছি নিয়মিত। বুঝতে পারছি তাদের কবিতার মান অনেক উন্নত হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হয়ে উঠেছে অনেকটাই সংবদ্ধ আর মজবুত।
খারকিভে, মারিউপোলে আর অন্যান্য শহরে রাশিয়ার সেনাবাহিনী যা করছে, ভাষায় প্রকাশ করার মতো তার জন্য কোন শব্দ বা যুক্তি নেই। তবুও, কবিতার কাজ হল শব্দ খুঁজে বের করা, যখন কোনও শব্দ নেই, তখনও।
বাংলা ভাষান্তর:
ঋতো আহমেদ
কবি, গদ্যকার ও অনুবাদক
২৮/০৩/২০২২