You are currently viewing বিনয় মজুমদার: ‘ফিরে এসো, চাকা’ ও একটি কবিতা/ বাকী বিল্লাহ বিকুল

বিনয় মজুমদার: ‘ফিরে এসো, চাকা’ ও একটি কবিতা/ বাকী বিল্লাহ বিকুল

বিনয় মজুমদার : ‘ফিরে এসো, চাকা’ ও একটি কবিতা

বাকী বিল্লাহ বিকুল

বাংলা কবিতার ট্রাজিক নায়ক বিনয় মজুমদার (১৯৩৪-২০০৬)। তিনি বাংলা কবিতায় নতুন তত্ত্বের আবিষ্কর্তা। কবিতা লিখবার ক্ষেত্রে তেরো রকম পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন- কবিতায় গাণিতিক রূপ এবং গণিতের রূপ দিয়েছিলেন, গণিতকে দেখেছেন জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে। কবি মনে করতেন ‘সাহিত্যের গতি গণিত’-  যে-কারণে জীবন ও গণিত তাঁর কবিতায় একাকার হয়ে আছে। ‘বিনয়ের কবিতাতত্ত্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কবিতা কীভাবে ও কেন বহুমাত্রিক বা বহু অর্থবিশিষ্ট হয় তার ব্যাখ্যা। গণিতবিদ বিনয় এই ব্যাপারে গণিতশাস্ত্রের সাহায্য নিয়েছেন।’ কবিতায় শূন্যতত্ত্বের যে-ধারণা তা বিনয় সৃষ্ট। বিনয়ের শূন্যতত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণার কাগজপত্র আজো আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। বিনয় মজুমদারের নানা রচনা থাকলেও ফিরে এসো, চাকা’র মধ্য দিয়ে তিনি প্রেমকাব্য রচনায় মানবপ্রজ্ঞার শীর্ষস্তর স্পর্শ করেছেন। কবি তাঁর এ-কাব্যগ্রন্থ মুখস্ত বলতে পারতেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (জ.১৯৪২) বিনয় মজুমদারকে বাংলার দান্তে বলে আখ্যায়িত করেছেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী নামধেয়া এক নারী অবশ্য বিনয়কাব্যের চাকা বা ঈশ্বরী হিসেবে সমধিক আলোচিত।

উপমা বিনয়কাব্যের এক বিশেষ গুণ। তাঁর বিশেষ কাব্য ফিরে এসো, চাকা-তেই আছে তিনশত উপমা। তাঁর কবিতা ইংরেজি, জার্মান, গুজরাটি, অসমিয়া, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। লেখক তারাপদ রায় (১৯৩৬-২০০৭) তাঁকে পয়ারের মিথ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ষাটের দশকের বিখ্যাত কবি শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) কবি সম্পর্কে বলেছেন- ‘তাঁর শ্রেষ্ঠ বই, ফিরে এসো, চাকা, একটা মেয়ের সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমের কথা।’ ফিরে এসো, চাকা-র কয়েকবার সংস্করণ হয়েছে, নাম পরিবর্তিত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে- ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রথম নাম ছিল গায়ত্রীকে। ১৯৬১ সালে মাত্র চৌদ্দটি কবিতা নিয়ে তা বের হয়েছিল। এর সঙ্গে আরো তেষট্টিটি কবিতা যুক্ত হয়ে মোট সাতাত্তরটি কবিতার সমন্বয়ে গায়ত্রীকে পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত হয়ে ফিরে এসো, চাকা নামে প্রকাশিত হয়; প্রকাশ করেন ‘গ্রন্থজগৎ’এর শ্রী দেবকুমার বসু, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর। ফিরে এসো, চাকা এরপর আমার ইশ্বরীকে নামে প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই প্রকাশিত ঈশ্বরীর কবিতাবলী’তে আমার ঈশ্বরীকে’র সমস্ত কবিতা পুনর্মুদ্রিত হয়। আমার ঈশ্বরীকে নামটি পালটে আবার ফিরে এসো, চাকা নামে এই গ্রন্থের কলকাতা সংস্করণ প্রকাশ করেন মীনাক্ষী দত্ত, ১ মার্চ, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ফিরে এসো, চাকা’র অরুণা সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং এই অরুণা সংস্করণই পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। ফিরে এসো, চাকা উৎসর্গিত হয়েছিল গায়ত্রী চক্রবর্তীকে। এই গায়ত্রী চক্রবর্তী নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে।

অনেকেইে ধারণা করে থাকেন বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদ, নারীবাদী, সমাজকর্মী, মার্কসীয় ধারার লেখিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকই ছিলেন বিনয় মজুমদারের কাব্য প্রেরণা ঈশ্বরী। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। উল্লেখ্য যে বিনয় যে সময়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, সেই সময় অনিন্দ্যসুন্দরী গায়ত্রী চক্রবর্তীও ছিলেন সেখানকার ইংরেজিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী। বিনয়ের ঈশ্বরী নারী, রবীন্দ্রনাথের পূরুষ। কিন্তু গায়ত্রী-বিনয়কে নিয়ে যে কাব্যভাবনার সৃষ্টি, নানা কথা ও আলোচনা সে-প্রসঙ্গে মীনাক্ষী দত্ত আমাদের জানাচ্ছেন :

বিনয় মাঝে মাঝেই কোনো না কোনো মেয়েকে ওর ‘ঈশ্বরী’বানিয়ে নিতো। অজিতা চক্রবর্তী, ফুল্লরা গঙ্গোপাধ্যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী এরকম অনেক। চাকা বোধহয় চক্রবর্তী থেকেই। এদের কাউকেই ও চিনতো না। মানুষ যেমন মূর্তি গড়ে পুজো করে, সেই মূর্তিকে কাপড় গয়না পরায় দাঁত মাজায়, স্নান করায়, নাম দেয় এও তেমনি। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা পুরুষ, বিনয়ের নারী ঈশ্বরী। কোনো বিশেষ রমণীর সঙ্গে এর সম্পর্ক খোঁজা হাস্যকর। … এটা ভুল, কারণ পরে গায়ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি গায়ত্রী বিনয়কে চিনত না। একবার বোধহয় দেখেছিল- এছাড়া ওর বিষয়ে গায়ত্রী আর বিশেষ কিছু জানেন না।

এ-প্রসঙ্গে আরো যা জানা যায় তাহলো :

বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-কে উদ্দেশ করেই ‘ফিরে এসো, চাকা’-র কবিতাবলী রচিত হয়েছে- এ-কথা বিনয় নিজে বলেছেন ও লিখেছেন। এই গায়ত্রী চক্রবর্তীর বাবা ও মায়ের নাম হল পরেশচন্দ্র চক্রবর্তী এবং শিবানী চক্রবর্তী। গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় ছিল না। বিনয়ের সাক্ষাৎকারে আর এক গায়ত্রী চক্রবর্তীর খোঁজ পাওয়া যায় যিনি তাঁর মাস্টারমশাই, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তীর কন্যা। বিনয় নিশ্চয়ই এই দুই গায়ত্রী চক্রবর্তীকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

কিন্তু এসব কথার বিপরীতেও কথা রয়েছে। এ-প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার তাঁর এক সাক্ষাৎকারে কি বলছেন সেটাও জেনে নেওয়া যাক :

একদিন জিজ্ঞেসই করলাম- ‘গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?’

-আরে ধ্যুত, আমার সঙ্গে তিনচার দিনের আলাপ- প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের- তারপর কোথায় চলে গেলেন- আমেরিকা না কোথায় ঠিক জানি না।

-তাহলে ওকে নিয়ে কবিতা কেন?

-কাউকে নিয়ে তো লিখতে হয়- আমগাছ কাঁঠালগাছ রজনীগন্ধা নিয়ে কি চিরকাল লেখা যায়?

ফিরে এসো, চাকাই সেই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কাব্য-ভুবনে, যা বহু আলোকিত আলোচিত- বহু চর্চিত- বহু পঠিত এবং বহু-বহুতর তরুণ কবি-র (তথা উদ্ভিদের) জন্মদাতা। ফিরে এসো, চাকা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের একটি দারুণ বিজ্ঞাপনের সন্ধান পাই আমরা। মীনাক্ষী দত্ত [বিখ্যাত কবি, লেখক বুদ্ধদেব বসুর কন্যা এবং জ্যোতির্ময় দত্তের সহধর্মিণী] কর্তৃক ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ফিরে এসো, চাকা’র কলকাতা সংস্করণের জন্য এই বিজ্ঞাপনটি রচিত ও প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনটি প্রস্তুত করেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত (জ. ১৯৩৬)। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল :

ফিরে এসো, চাকা এই কবিতাগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় সাত বছর আগে। বিশাল পাঠকসমাজ যদিও এটির অস্তিত্ব অবগত ছিলেন না, বাংলা কবিতার সবচেয়ে অগ্রসর পাঠক ওয়াকিবহাল পর্যবেক্ষক মহলে ‘ফিরে এসো, চাকা’ এই কয় বছরে একটি গুপ্ত ক্লাসিকের স্থান করে নিয়েছিলো। অবশ্য এমনকি এইসব মহলেও এর খ্যাতির ভিত্তি ছিল প্রধানত কল্পনা, জনশ্রুতি ও কবির জীবন-বিষয়ে কিংবদন্তী; বইটির প্রথম সংস্করণ খুঁটিয়ে পড়া তো দূরের কথা, এমনকি হাতে ধরার, এমনকি চোখে দেখার সৌভাগ্যও মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র রসিক, অন্তরঙ্গ, অধ্যবসায়ী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের হয়েছে। ফলে ‘ফিরে এসো, চাকা’ গ্রন্থে কেবল এক সংকীর্ণ গোষ্ঠীর ছিলো অধিকার। বর্তমান কলকাতা-সংস্করণ এই গুপ্ত ও সাম্প্রদায়িক গ্রন্থটিকে সর্বসমক্ষে উন্মোচিত করেছে। এবং এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কেবল কোনো ক্ষুদ্র, ভুগর্ভস্থ গোষ্ঠীর গোপন সম্পদ নয়, তা বাংলা কবিতার প্রধান ধারারই এক অর্ধচক্রাকার বাঁক। ‘ফিরে এসো, চাকা’ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কি ‘অর্কেস্ট্রা’-র তুল্য গ্রন্থ। এবং এর কবি কেবল জীবিত নন, তিনি বাংলা কবিতার অমরদের একজন।

উপর্যুক্ত বিজ্ঞাপনে বিনয়প্রতিভা সম্পর্কে আমরা সামান্য পরিচয় পাই, প্রকৃতপক্ষে তিনি তারও বেশি শক্তিশালী প্রতিভাধর ব্যক্তি-কবি ও নানা অভিজ্ঞতায় জারিত জীবনের অধিকারী। অনেকটাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এর মতো নিয়তি নির্ধারিত জীবন পেয়েছিলেন বিনয় মজুমদার। দুঃখ, দারিদ্র্য, বেদনা ও অসুস্থতা প্রায়ই সমান সমান। কবি ফিরে এসো, চাকার ছাব্বিশটি মাত্র কবিতা রচনা করার পর মাত্রই ছাব্বিশ বছর বয়সে জটিল ও দুরারোগ্য, মানসিক ব্যাধি স্কিট্সোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। এর ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে যেতে হয়েছে কারাগারে এবং বহুবার যেতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালে- বিনয় যাকে ‘পাগলাগারদ’ বলে মনে করতেন। কবিকে এ-সময় ছয় মাস মতো চিকিৎসার জন্যে হাসপাতলে থাকতে হয়। চিকিৎসা শেষে সাময়িক সুস্থতা নিয়ে ফিরে আসেন আবার লেখার টেবিলে। সমাপ্ত করেন ফিরে এসো, চাকা। কিন্তু কবি তাঁর সমগ্র জীবনে আর স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন ফিরে পাননি। ফিরে এসো, চাকা-র ৭৭টি কবিতার রচনাকাল ৮ মার্চ ১৯৬০ থেকে ২৯ জুন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ কাব্যগ্রন্থটি রচনা করতে বিনয় মজুমদারের ২ বছর ৩ মাস ২২ দিন সময় লেগেছিল। ফিরে এসো, চাকা নিয়ে একজন প্রাবন্ধিক মন্তব্য করেছেন :

‘ফিরে এসো, চাকা’-র ‘অমূল্যমণি’-সুলভ প্রত্নযোগ্যতা রয়েছে- এই কাব্যগ্রন্থটি চির-সংরক্ষণযোগ্য, অন্তত কবি ও কবিতাপ্রেমিক মানুষজনের ঘরে- যেমন বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ সংরক্ষিত আছে। কবিতাগুলি লিখে উঠতে গিয়ে বিনয় একই সঙ্গে বিধ্বস্ত ও সুরম্য হয়ে উঠেছেন- তাঁর সামনে আরেক বিশ্বভুবন উন্মোচিত হয়ে গেছে, যার ফলশ্রুতি পরবর্তী আরও বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ : ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’-য় দেখতে পাই।

ফিরে এসো, চাকা বিরহানুভূতির কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বহুল আলোচিত। বিনয়ের আরো বহুবিধ লেখা থাকলেও এ-কাব্যগ্রন্থ দিয়েই তিনি সমধিক পরিচিত ও তুমুল জনপ্রিয়। এই কাব্যের ৫-সংখ্যক কবিতা ‘কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা প্রয়োজন আজ’- আমাদের বিচার্য। কী আছে এই কবিতাটিতে তার আদ্যপান্ত খুঁজে দেখার দেখার প্রয়াস রাখি। ফিরে এসো, চাকা-র এই কবিতাটি কবি লিপিবদ্ধ করেন ১৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে। মূল কবিতাটির উল্লেখ প্রয়োজন বোধ করছি :

কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা প্রয়োজন আজ।

প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অষ্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।

সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু

কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও

মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

ভালোবেসে বয়োপ্রাপ্ত জিহ্বা লালাসিক্ত হলে এখন মানুষ

মনে মনে লজ্জা পায়- সুন্দর কৌতুক স্নিগ্ধ লজ্জা পেয়ে থাকে।

বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থুল ব’লে মনে হয়,

অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।

 

হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে।

এই যে অমেয় জল – মেঘে মেঘে অনুভূত জল –

এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে, বলো।

ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।

তবু কী আশ্চর্য, দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে

তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

বিনয় মজুমদার-এর এই কবিতাটিসহ অনেকগুলো কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত। সেই অনূদিত কবিতাটি নিম্নে উপস্থাপিত হলো :

কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ।

STRONG SMELL OF MEET

I have pen and paper but perhaps it is better if I sit still?

A reassessment seems to be in order, since each mistake

Can be explained differently and although every arrangement

May seem complete, the precise relations may be hard to establish.

Man has long visited with an enchanted heart those sorceresses, the flowers

But he still loves best the smell of meat in the pot.

Wait, fall back, Random, jittery daubs have the power to emerge

Into a painting if only the viewer fell back a few paces.

 

Waste there has been all the time

Vast seas go up in clouds and come down in rain

how little of this monsoon churning of sea and sky

is essential for our meek crops?

The paddy has a slender throat,

The bloated earth soaks up most of it.

But what wonderment, when the mosquito leaves its germinal puddle

The sound of its flying is not wholly unmusical.9

আমার বিবেচনায় উপরোল্লিখিত অংশটির ভাবানুষঙ্গ এ-রকম :

কাগজকলম নিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকা প্রয়োজন আজ;

প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কী অষ্পষ্ট আত্মচিন্তা সঙ্গে নিয়ে আসে।

কবি লিখতে বসেছেন, আজ আর তাঁর লিখতে মন চাইছে না, রাজ্যের ক্লান্তি-অবষাদ তাঁকে ঘিরে রেখেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে চিন্তার পাহাড়। বিনয় বিষয়-বৈভব থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে কবিতার জন্য এক বিরল বিশেষণ হয়ে ওঠেন। বিনয় নিজের হাতেলেপা লাল পারদ প্রলেপের আয়নায় নিজেকেই শুধু দেখেন। বিনয় মনে করেন :

সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু

কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।

অর্থাৎ জীবনের বিশেষ এক পর্যায়ে এসে তিনি মনে করেন সমস্ত সম্পর্কের দিন শেষ হয়ে গেছে, এখন নির্ভুলভাবে নিজেকে উপস্থাপন ও তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পন করা কঠিন হয়ে যাবে। কবি এ-কবিতায় মনে করছেন :

সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও

মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

ভালোবেসে বয়োপ্রাপ্ত জিহ্বা লালাসিক্ত হলে এখন মানুষ

মনে মনে লজ্জা পায়-সুন্দর কৌতুক স্নিগ্ধ লজ্জা পেয়ে থাকে।

মানুষের ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন বিনয়, কিন্তু সেখানে দুঃখটার ভাগই ছিল বেশি। তিনি যে-কারণে মনে করেছেন, মানুষ নিজেকে মানবসমাজে দেখায়, উপস্থাপন করে যে তারা ফুলবিলাসী, ফুলকেই তারা ভালোবাসে, কত মোহনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা ফুলের কাছে যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়- মানুষ ভালোবাসে স্বার্থ, রান্নার সুগন্ধি ঘ্রাণ। একদিকে ফুল অন্যদিকে হিংস্রতার ছবি। সে-কারণেই কবি মনে করেন মোহনীয় ফুল নয় মাংস রান্নার ঘ্রাণই মানবের সবচেয়ে পছন্দের। কবিতাটির এ-অংশের শেষ দু’চরণে কবি অধিক বয়সে ভালোবাসা, আর তার লোভাতুর জিহ্বার ভিতরেও যে একধরনের লজ্জা কাজ করে অবশেষে সে-কথাও বিনয় এখানে দৃঢচিত্তে স্বীকার করেছেন। বিশিষ্ট কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩-১৯৯৫) উপরোক্ত পঙ্ক্তির ব্যাখ্যায় বলেছেন :

আসলে ক্ষুধা ও শিল্পক্ষুধা এক নয়। ক্ষুধা অনেক বৃহত্তর, কিংবা বৃহত্তর নয়! অথচ … মানুষ, বলে ফুল বলে গন্ধ, কিন্তু রন্ধনকালীন মাংসের গন্ধে আন্তরিকভাবে উচাটন হয়। এই-ই মানুষ, উপায়হীন পেট-পোঁদসমেত মানুষের চরিত্র এরূপই। মানুষের আবেগ ও উত্তেজনাগুলি, যেহেতু চরম আনন্দময় আদান-প্রদানকালে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে থাক (কাকে) তা আবার অন্ধকারে, যার (তারই) ফলে লজ্জা বাধা এমনকি শারীরিক ক্ষত,/আঘাত প্রাপ্তির ব্যথা দেহমিলনের কালে লক্ষ্যই করে না।১০

এর পরের পঙ্ক্তি বিশ্লেষণে আমরা দেখি :

বর্ণাবলেপনগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থুল ব’লে মনে হয়।

অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্ব হেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।

এ-রকম একটি পর্যায়ে এসে, জীবনের সবকিছু ক্ষয়ে যাবার পর কবির মনে হয়, লিখে তাঁর জীবনে কি হলো, তিনি কি পেলেন বর্ণখেলায়, এই গোধূলীবেলায়। যে-কারণে কবির লিখিত মূল্যবান বর্ণমালাগুলো খুব কাছ থেকে আজ মূল্যহীন ও স্থ’’ল মনে হচ্ছে, কিন্তু তিনি এটাও ভেবে সান্ত¦না পান যে, একদিন তিনি হারালে, তাঁর প্রতিমূর্তির প্রস্থান ঘটলে, তাঁর লেপনকৃত বর্ণমালা মধুর হয়ে, হৃদয়গ্রাহী-মনোলোভা হয়ে মানুষের কাছে ধরা দেবে। বিনয় আবার দুঃখ করে বলেন :

হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;

এই যে অমেয় জল  মেঘে মেঘে অনুভূত জল –

এর কতটুকু আর ফসলের দেহে আসে, বলো।

ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।

কবিতার ভাষায় একটি চমৎকার জীবন, সেই জীবনের কি পরিমান ক্ষতি ও ক্ষত, কীভাবে অপচয়িত হয়েছে এক মেধায় পূর্ণ বর্ণাঢ্য জীবন। আমরা জানি যে বিনয় ডাকসাইটে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে তাঁর চাকরির প্রস্তাব ছিল, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন, ভারতের বিভিন্ন চাকরিতে তিনি স্থির হতে পারেননি, ভালো লাগেনি, শুধু মন চেয়েছে কবিতার কাছে ফিরে যেতে। তাঁর ঈশ্বরী তাঁকে বারবার কবিতার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ এখন তিনি মনে করেন অন্য দশটা মানুষের মতো তারওতো সুন্দর জীবন হতে পারতো, সাজানো ঘর থাকতো, স্ত্রী-পরিজন, সংসার থাকতো অথচ তাঁর কোনোটাই তাঁর হয়ে ওঠেনি, হয়নি। তার ওপর যে-সমস্ত মানুষেরা তাঁকে কথা দিয়েছিল তাঁকে দেখে রাখবে, ভালোবাসবে, খোঁজখবর নেবে, তাঁরা শেষপর্যন্ত কথা রাখেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর ছিল গভীর অভিযোগ। তিনি মনে করতেন এরা তাঁকে কৌশলে পাগল বানিয়েছে, তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি ছিল নিদারুণ অভিযোগ- তারা তাঁর জীবনকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছিল। তিনি পালাতে চেয়েছেন- একবার বাংলাদেশে আরেকবার পাকিস্তানে। কোথাও স্থির হয়নি জীবন। সেই বার্মা মুল্লুক থেকে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন শুরু, সেই দুঃসহ জীবনের সমাপ্তি ঘটেনি কবির সমগ্র জীবন। বিস্ময়কর বিষয় যা তাহলো, কবির অসুস্থতায়, কবিকে এক সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বিনয় মজুমদার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কারো করুণা গ্রহণ করতে চাননি। জীবনের এ-পর্যায়ে এসে কবির ভিতরে একধরনের দহন কাজ করেছে। নিঃসঙ্গতায় আর বিচ্ছিন্নতাবোধে জীবন ভেঙে চুরমার হয়েছে। তিনি মনে করেন এইসব প্রতিমূর্তির নিদারুণ অপচয় হয়, মূল্যহীন হয় মেধাবী মানুষের জীবন, যেমন মেঘে মেঘে কত জল ঝরে, এই পৃথিবীর পরে, যার অধিকাংশ শুষে নেয় শক্ত মাটি, তাতে ফসলের কি হয় আর কতোটুকুই বা ফসলের মাঠের উপকারে আসে। আসলে ফসলের দেহে বৃষ্টির জল যাওয়াই হলো একমাত্র সার্থকতা। কবি এ-কবিতার শেষাংষে দারুণ এক প্রশ্ন রেখে এই কবিতাটির সমাপ্তি ঘটিয়েছেন :

তবু কী আশ্চর্য, দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে

তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

আর তাহলো, বসে থাকা কোনো মশা উড়ে গেলে প্রকৃতপক্ষে মরে গেলে তার এই উড়ে যাওয়ার ভিতরে থেকে যায় সংগীতের মূর্চ্ছনা, থেকে গানের রেষ, রেখে যায় ডানা ঝাপটানোর রঙ। কবির দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়েছে শেষোক্ত লাইন দুটোতে। কবিরা সবকিছু করে এসে কবিতা লিখতে বসেন, বিনয় তা করেননি, তিনি সবকিছু ছেড়ে এসে কবিতা লিখতে বসেছিলেন। কবিতার জন্যেই জীবনকে উৎসর্গিত করেছিলেন। বিনয় মনে করেছেনে যে মশাটি বসে ছিল দীর্ঘক্ষণ, তারপর সে হঠাৎ উড়ে চলে যায়, এই চলে যাওয়ার ভিতরেও জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরেছেন তিনি। কবির বিশ্বাস হলো এখন তাঁর যে জীবন, সমাজের কাছে মূল্যহীন, তা একদিন মহামূল্যবান হয়ে ধরা পড়বে। ফিরে এসো, চাকা গ্রন্থের এই কবিতাটিতে আসলে একজন মানবের পুরো জীবনচিহ্ন বিদ্যমান। সর্বোপরি বিনয়ের কবিতার মূল বিষয় হচ্ছে সমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তির পারক্যবোধ- যা অতিক্রম করার একটি উপায় হচ্ছে নারীর প্রতি প্রেম।

এ-কবিতাটি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক জ্যোতির্ময় দত্তের বিশেষ মন্তব্যটিকে সম্মুখে আনয়ন করা যেতে পারে :

এই অংশটি উদ্ধৃত করেই আমি একটু দ্বিধায় পড়েছি। এই ছয় লাইন পড়ে পাঠকের দুই বিপরীত অনুভূতি হতে পারে; হয় আমার এই গদ্যের প্রতি ক্লান্তি আসবে তাঁর, আরো উদ্ধৃতি, বিনয় মজুমদারের আরো কবিতা পড়ার ইচ্ছে হবে, অথবা তাঁর এই কবিতার শব্দচয়ন মনে হবে অপটু, ‘উপবিষ্ট মশা’ কিংবা ‘উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়’ তাঁর মনে হবে গুরুচ-ালী দোষে দুষ্ট। তবু তো এই ‘দোষ’ এখানে ততটা স্পষ্ট নয়।১১

বিনয় মজুমদার-এর মতো একজন মেধাবী ছাত্র ও সৃজনশীল মানুষ তাঁর সমগ্র জীবনে সুখ খুঁজে পাননি, অবশ্য সুখের জন্যে তাঁর কোনো বাড়তি ক্রন্দন ছিল না, তাড়া ছিল না, বাড়তি ভাবনা দেখা যায় না কোনোকালে এবং কারো কাছ থেকে কোনো করুণাও প্রত্যাশা করেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকর-এর ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’- এই উক্তির প্রতি বিনয়ের প্রথম জীবনে বিশ্বাস থাকলেও জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। চিরবিরহী, চিরকুমার এই মানুষটি শুধু কবিতা লিখবার জন্যে সমগ্র জীবনটাকে খরচ করে দিয়েছিলেন। এসব কষ্ট চিহ্ন তাঁর উপরোক্ত কবিতাটির মধ্যে দীপ্যমান। কবি জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে শিখেছেন, তিনি দেখেছেন মানুষের দ্বৈত রূপ। শুধু বাইরের জগতের মানুষ নয়, নিজের পরিবারের অপনজনের কাছ থেকেও তিনি ব্যথায় পূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ফিরে এসো, চাকা রচনাকালেই কবি বিনয় মজুমদার মানসিক অসুখে আক্রান্ত হয়ে ছয়মাসকাল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি এ-কাব্যের ছাব্বিশটি কবিতা রচনা করেছিলেন। তারপর হাসপাতাল থেকে সাময়িক সুস্থতা নিয়ে ফিরে এসে তিনি ফিরে এসো, চাকা’র বাকি একান্নটি কবিতা রচনা করেন। বিস্ময়কর বিষয় হলো বহুকাল অসুস্থ থাকার পর ফিরে এসে কবিতা লিখতে গিয়ে কোনোরূপ সমস্যায় পড়েননি তিনি, এবং এ-কাব্যে তাঁর কোনো বিন্দুমাত্র ছায়াপাত পড়েনি। বিনয় বাংলা ভাষার শব্দ ও ছন্দ-সচেতন কবিদের একজন। ফিরে এসো, চাকা-য় কবি মিলহীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন। যদিও বিনয় এ-ছন্দকে বলতেন ‘অমিল পয়ার’। তবুও এ-কাব্যের কবিতাগুলোতে মিল ব্যবহার না করেও শ্রুতিমধুররূপে কবিতাগুলোকে সাজিয়ে ছিলেন। যেখানে পড়বার সময় অমিলের কোনো ভাব প্রকাশ পায় না। ‘নিজের কবিতা লেখার বাহন হিসেবে গদ্যছন্দ এবং সমিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে বর্জন করে অমিল অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে নির্বাচন করা কবিতার প্রকরণ বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তাভাবনার পরিচায়ক।’১২ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বিনয়ের কবিতা নানা ভাষায় অনূদিত হযেছিল। তন্মধ্যে ইংরেজি ভাষা প্রধান। এ-প্রসঙ্গে কবি ও প্রাবন্ধিক জ্যোতির্ময় দত্ত-এর মূল্যবান মন্তব্য স্মরণযোগ্য:

তাঁর সম্পর্কে স্পষ্ট শুধু এইটুকু : বিনয় মজুমদার একজন বেদনার্ত, সত্যদ্রষ্টা কবি, একজন শহিদ, যিনি নিজের সবটুকু কবিতায় নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছেন এবং যাঁর কৃপায় আমরা অনেক নতুন অভিজ্ঞতা আস্বাদনে সমর্থ হয়েছি, বিনয় মজুমদারের আবির্ভাব তিরিশের কবিদের পর বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রধানতম ঘটনা।১৩

শেষ কথা :

‘ফিরে এসো, চাকা’র, কবিতাগুলো শুধু প্রেমের কবিতা নয়। তার মধ্যে আছে আরো গূঢ়, দেখার-বোঝার-জানার বাইরেও অতিরিক্ত কিছু। ‘প্রেম’ এ-কাব্যে শুধুমাত্র বাহ্যিক খোলস মাত্র। আর খোলস ছাড়ালেই গহন দর্শনমেশা রহস্যময় জিজ্ঞাসা আর দেখাগুলো পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে থাকে। চোখে ভেসে ওঠে বস্তু পৃথিবীর বিপ্রতীপ রূপ। অন্য জিজ্ঞাসা। ফিরে এসো, চাকা পড়বার সময় বেশ সহজবোধ্য মনে হয় অথচ এর ভিতরে নিহিত রয়েছে অন্তহীন এক গভীর রহস্যময় জীবন ও পরিবেশ। মনে হয় তিনি এ-কাব্য এক অচেনা জগত থেকে, ভিনগ্রহ থেকে রচনা করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। একজন প্রাবন্ধিক সে-কারণে উল্লেখ করেছেন :

যা সব দৃশ্য, রূপ, অভিজ্ঞান, বিজ্ঞান, আত্মপরদর্শন, বেদনা থেকে জাত এক উন্নত মনন, নিবেদন অথচ পুরোপুরি সমর্পণ নয়, আহ্বানময় অথচ কেমন এক অফেরতযোগ্য সুদূর থেকে সুদূরতর হয়ে-যাওয়া, মৃদু অথচ চিরবিচ্ছেদী তীব্রতার অনুভব ও প্রত্যাবর্তন- আশ্চর্য এক ভারসমতা- কোনওদিনই ফাটল জুড়ে না-যাওয়ার সম্ভবনা ফুটে উঠেছে এই কবিতাগুলিতে। এ জিনিস ইতিপূর্বে (বা পরেও) কদাপি ঘটেনি বাংলা কবিতাভুবনে- এজন্যই কবিতাগুলি স্মরণযোগ্য- অমোঘ এর আকর্ষণ।১৪

বিনয় মজুমদার হতাশার, বেদনার, যন্ত্রণার, বিরহের ও বিচ্ছেদের কবি। দুঃখ তাঁর কবিতার প্রধান উপকরণ হয়ে উঠে আসে। তিনি বিষন্ন, বিপন্ন কিন্তু বিষাক্ত নন। তাঁর জীবনের যে অপচয়, ক্ষতি, হতাশার নিত্য আগুনে দগ্ধ হৃদয় তার জন্যে তিনি একজন নারীকে দায়ী করেন। প্রকৃতির প্রতিও বিনয়ের তেমন আস্থা নেই, নারীর মতো প্রকৃতিকেও নিষ্ঠুর মনে করতেন। আমরা জানি যে, কবি যখন কলকাতার পেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তখন এক মেধাবী, মানবী শিক্ষার্থীর সন্ধান পেয়েছিলেন, কার্যত দেখা পেয়েছিলেন তাঁর কাব্যের নায়িকাকে, তাঁর ঈশ্বরীকে। আর সেই নায়িকাই তাঁর জীবনের, কবিতার দুঃখ। কিন্তু সেই নারী বা নায়িকার বিরুদ্ধেও তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। বিনয় নারীকে মনে করেছেন শিল্প, অথবা সেই নিষ্ঠুর আদিমাতা যিনি তাঁর মানবসন্তানদের পরিত্যাগ করেছেন, কিংবা প্রকৃতির মতোই হৃদয়হীন। যে-কথা পরিশেষে বলবার আর গভীর পরিতাপের বিষয় তাহলো, বিশ্বপ্রকৃতি মহৎ এই প্রতিভাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবার সুযোগ দেয়নি। যদিও বিনয় মজুমদারের মতো প্রতিভার আবির্ভাব যে-কোনো সাহিত্যেই কদাচিৎ ঘটে থাকে। একজন সমালোচক উল্লেখ সে-কারণে উল্লেখ করেছেন :

ফিরে এসো, চাকা’র প্রতিটি কবিতাই খুব আটো সাটো, দৃঢ়গ্রন্থিবদ্ধ। শুধু তাই নয়, এই গ্রন্থের কবিতায় কবি তাঁর ভাবনাম-লকে যুক্তিক্রমের সাহয্যে বিস্তৃত করতে চেয়েছেন- এবং কে হিসেবে কবিতাগুলি প্রতিটি কবিতাই একটি চিন্তার সূত্রকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে, কিন্তু কবিতাগুলি শুধুই চিন্তানির্ভর নয়। কবিতার ক্ষেত্রে প্রতিটি চিন্তার সঙ্গেই যে একটি   সংযুক্ত থাকে, তা না হলে মহত্তম-ভাবনা-আশ্রিত কবিতাও যে কবিতা হয় না, একথা মিডলটন মারে আমাদের দীর্ঘকাল আগেই জানিয়েছেন। মারে-র সিদ্ধান্ত বিনয়ের কবিতা বিষয়েও প্রযোজ্য।১৫

 

সহায়ক সূত্র :

১.  বিনয় মজুমদার, কবিতাসমগ্র, [অখ-], (ঢাকা : কবি প্রকাশনী, গ্রন্থমেলা ২০১৭), পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২২

২.  মুহিত হাসান সম্পাদিত,  শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথাবার্তা, (ঢাকা : বাতিঘর, দ্বিতীয় মুদ্রণ, মে ২০১৯), পৃ. ৬৭

৩.  মীনাক্ষী দত্ত, ‘দীর্ঘদিন বিনয়ের সঙ্গে’। জ্যোতির্ময় দত্ত, বিনয় মজুমদার কবিতার শহীদ ও অন্যান্য, [ শ্রী তরুণ

বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাঃ,]  (কলকাতা : প্রতিভাস, প্রথম প্রকাশ, আগস্ট ২০১৭), পৃ. ১৩১

৪.  জ্যোতির্ময় দত্ত, বিনয় মজুমদার কবিতার শহীদ ও অন্যান্য, [ শ্রী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাঃ.], পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৪-

১৫৫

৫.  সমর তালুকদার, ‘কোনো গোপনতা নেই’ [বিনয় মজুমদারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার]’। উৎপল ভট্টাচার্য সম্পাদিত,

কবিতীর্থ  বিনয় মজুমদার  সংখ্যা, (কলকাতা : জুন ২০১৭), পৃ. ১৭২

৬.  জ্যোতির্ময় দত্ত, বিনয় মজুমদার কবিতার শহীদ ও অন্যান্য, [ শ্রী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাঃ.], পূর্বোক্ত, পৃ. ১২২

৭.  বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, ‘ফিরে এসো, বিনয়’। উৎপল ভট্টাচার্য, কবিতীর্থ বিনয় মজুমদার সংখ্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.২০৮

৮.  বিনয় মজুমদার, কবিতাসমগ্র [অখ-], (ঢাকা : কবি প্রকাশনী, গ্রন্থমেলা ২০১৭), পৃ. ৫৩-৫৪

৯.  জ্যোতির্ময় দত্ত, বিনয় মজুমদার : কবিতার শহিদ ও অন্যান্য, [ শ্রী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা.], পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৩

১০.শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ‘কবিতা বিষয়ক প্রস্তাব’। অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত, একজন উজ্জ্বল মাছ : বিনয় মজুমদার,

(ঢাকা : বেহুলা বাংলা,   প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৯), পৃ. ৩৪

১১. জ্যোতির্ময় দত্ত, বিনয় মজুমদার : কবিতার শহিদ ও অন্যান্য, [ শ্রী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা.], পূর্বোক্ত, পৃ. ২২

১২. জ্যোতির্ময় দত্ত, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৩

১৩. পূর্বোক্ত, পৃ.১৯

১৪. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, ‘ফিরে এসো, বিনয়’। উৎপল ভট্টাচার্য, কবিতীর্থ বিনয় মজুমদার সংখ্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০৮

১৫. প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, ‘ফিরে এসো, চাকা’ : দু-একটি সূত্র’। অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত, একজন উজ্জ্বল মাছ :

বিনয় মজুমদার,  পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৫