বারুদ মানুষ কবি নবারুণ ভট্টাচার্যকে প্রয়াণ দিবসের স্যালুট
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে ভোজসভায়
অরণ্য গেছে বনানীর খোঁজে
গরীব জুটেছে শোকসভায়।
গয়নারা গেছে নীরব লকারে
বন্যপ্রাণীরা অভয়ারণ্যে
বিমান উড়েছে আকাশের খোঁজে
গরীবরা শুধু হচ্ছে হন্যে।
পুরুষেরা গেছে নিভৃত মিনারে
গর্ভবতীরা প্রসূতিসদনে
কুমিরেরা গেছে নদীর কিনারে
গরীব জমছে নানা কোণে কোণে।
বিপ্লব গেছে নেতাদের খোঁজে
যুবকেরা গেছে উৎসবে
যুবতীরা গেছে বিশিষ্ট ভোজে
গরীবের হায় কী হবে?
(কালবেলা/নবারুণ ভট্টাচার্য)
নবারুণ ভট্টাচার্য (২৩ জুন ১৯৪৮-৩১ জুলাই ২০১৪) পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ২৩ জুন ১৯৪৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য এবং বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র পুত্র।
স্কুল জীবনে তিনি বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ভূতত্ত্ব ও পরবর্তীতে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর কিছুদিন বিষ্ণু দের ‘সাহিত্যপত্র’ সম্পাদনা নবারুণ ভট্টাচার্যের কর্মজীবন বলতে তাঁর আজীবন সাহিত্য সাধনার কথা বলতে হয়৷ কলেজের পড়া শেষ হওয়ার পর তিনি ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং দীর্ঘদিন তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে কাজ করেছেন। এবং ২০০৩ থেকে ‘ভাষাবন্ধন’ নামের একটি পত্রিকা পরিচালনা করেন। একসময় দীর্ঘদিন তিনি ‘নবান্ন’ নাট্যগোষ্ঠী পরিচালনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হারবার্ট, কাঙ্গাল মালসাট।
১৯৬৮-তে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রথম ছোটগল্প ‘ভাসান’। ১৯৭২ সালে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ নামে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়৷ তিনি এই কবিতার বই এর মধ্য দিয়ে শাসকের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী সত্তা ব্যক্ত করেছেন৷
তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল৷ উপন্যাসটির পটভূমি ছিল সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলন। গল্প ও উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটি ধারা তৈরী করে ফেলেছিলেন৷ বিজন ভট্টাচার্যের পুত্র হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিজন ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ শিষ্য৷ নবারুণ ভট্টাচার্য খুব কাছ থেকে যেন লক্ষ্য করেছিলেন একজন শিল্পীর সংগ্রামকে৷
প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ (পত্রিকায় প্রকাশ: ১৯৯২)। প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ এর জন্য নবারুন নরসিংহ দাস (১৯৯৪), বঙ্কিম (১৯৯৬) ও সাহিত্য আকাদেমি (১৯৯৭) পুরস্কার পেয়েছেন। কাঙাল মালসাট, অটো ও ভোগী, হালাল ঝান্ডা ও অন্যান্য, মহাজানের অন্য, ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচক, মসোলিয়ম, রাতের সার্কাস, খেলনানগর, ইত্যাদি।
নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক প্রথাবিরোধী লেখক। তাঁর বাস্তববাদী লেখা বাঙালী পাঠকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল৷ তিনি ‘ফ্যাতাড়ু’ নামে একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র তৈরী করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ফ্যাতাড়ুরা উড়তে পারে এবং তাদের মন্ত্র হল “ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই”। এই মন্ত্রবলে ফ্যাতাড়ুরা উড়ে গিয়ে হানা দিত, কখনও কালোবাজারিদের ভয় দেখাতে, কখনও বা ভন্ড সাহিত্যিকের মুখোশ খুলতে। এই ফ্যাতাড়ু আসলে হতভাগ্য মানুষদের প্রতিনিধি। বরাবরই সাহিত্যের চিরাচরিত নিয়ম ভাঙ্গা নবারুন ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ুরা ভাষা ব্যবহারে সাহসী, আচরনে নির্ভীক। ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে দুটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’ এবং ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক’।
নবারুণ ভট্টাচার্য কাজ করতেন ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকায়। নাটক করেছেন কলকাতার মঞ্চে। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’-র মতো কবিতা, ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’-র মতো গল্প, ‘খেলনানগর’, ‘হারবার্ট’ বা ‘কাঙাল মালসাটে’র মতো উপন্যাস এক ধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী পরিচিতি তৈরি করেছিল নবারুণের। জীবনযাপনেও ছিলেন অনাড়ম্বর। ঘোরতর রাজনৈতিক লেখা লিখেও বাম বা ডান, কোনও সরকারেরই কাছের মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি কোনও দিন। যদিও চিন্তার দিক থেকে বরাবরই বামপন্থী ছিলেন। এবং মূলস্রোতের বাইরে থেকেও তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘ফ্যাতাড়ু’-স্রষ্টা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন। ‘ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই’-এর মতো শব্দবন্ধ, পুরন্দর ভাটের লেখা কবিতার লাইন তাদের অনেকেরই মুখে মুখে ঘোরে
নবারুণের লেখা থেকে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-সুমন মুখোপাধ্যায়রা মঞ্চসফল নাটক করেছেন। সুমনের তিনটি ছবি ‘হারবার্ট’, ‘মহানগর@কলকাতা’ এবং ‘কাঙাল মালসাট’ও নবারুণের রচনা অবলম্বনে। সুমন বলছিলেন, “যে তির্যক রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত নবারুণের লেখায় আসত, তাঁর যে অনন্য রচনাশৈলী, সমকালে তার জোড়া ছিল না। নবারুণ নিজেই একটা ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুতেই সম্ভবত তার শেষ হল।”
তার লেখা গ্রন্থগুলোর নাম করতে হয়। তিনি কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, রচনা করেন ব্যতিক্রমী ধারায়।
তার কাব্যগুলোর মধ্যে, “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (১৯৭২)”, “পুলিশ করে মানুষ শিকার (১৯৮৭)”, রাতের সার্কাস” ইত্যাদি। ছোটগল্পের মধ্যে “হালাল ঝাণ্ডা (১৯৮৭)”, নবারুন ভট্টাচার্যের ছোটগল্প (১৯৯৬), নবারুন ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ গল্প, ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক, ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক, ফ্যাতাড়ু বিংশতি, ইত্যাদি। তার উপন্যাসগুলোর উল্লেখযোগ্য, হারবার্ট (১৯৯৩), যুদ্ধ পরিস্থিতি (১৯৯৬), অটো ও ভোগী, ফ্যাতাড়ু ও চোক্তার, কাঙাল মালসাট, মবলগে নভেল, খেলনা নগর, লুব্ধক (২০০৬) ও সম্পাদনা জোড়াতালি (২০১৭)।
নবারুণ কোনদিনই নামী সংবাদপত্র এবং জার্নালের জন্য লেখেননি অথচ তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী তাঁকে পরিচিতি এনে দিয়েছিল৷ লেখালেখির পাশাপাশি তিনি নাটকের সঙ্গেও যুক্ত হন। মঞ্চে নাট্য অভিনয়ের মাধ্যেমে মানুষ তাঁকে ধীরে ধীরে চিনতে থাকেন৷ বিশ্বায়ন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্ছেদ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল যথেষ্ট৷ তিনি কঠোর বাস্তবের কথাই নিজস্ব আঙ্গিকে লিখেছেন। তাঁর মনে হয়েছিল গদ্যের ইস্পাত কঠিন ভাষা দিয়ে সবটা ব্যক্ত করা সম্ভব যা কবিতায় বোঝা যায় না৷ যদিও তাঁর কবিতার ভাষা ছিল যথেষ্ট বলিষ্ঠ। নবারুণের লেখনীই ছিল তাঁর অস্ত্র৷ নবারুণের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে অন্যধারার লেখা জন্ম নেয়। তিনি একের পর এক গল্প উপন্যাস লিখতে থাকেন। ২০১৪ সালের ৩১ জুলাই অগ্নাশ্যয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নবারুণ ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়।
একজন ঋজু শিরদাঁড়া সম্পন্ন কবি আমৃত্যু লড়ে গেছেন। আজ প্রয়াণ দিবসে জানাই তাঁকে জানাই স্যালুট!
==================