You are currently viewing বায়োস্কোপ || ইসরাত জাহান

বায়োস্কোপ || ইসরাত জাহান

বায়োস্কোপ

ইসরাত জাহান

আমি কালপুরুষ সে অরুন্ধতী। আমাদের গল্পটা শুরু হয় এই বায়োস্কোপ নগরে। ‘আতুরি সিদ্ধচার অষ্টক’ দে লিভ অ্যাপাট ইচ আদার। 

সিঙ্গল মল্টের সবটুকু তরল ঠক করে গিলে, রাতুল হাতের গ্লাসটা বাঁধানো ছবির পাশের রেখে একটু মুচকি হেসে রবিবাবুকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করে ‘খবর কি’? রবিবাবুও অনুরূপ হাসি উপহার দিয়ে চোখের ভাষায় বলেন, ‘খবর মোটামুটি’। ছবিটার পাশে গ্লাসটা রাখায়, সাজিয়ে রাখা সৌন্দর্যের উপকরণ / পাত্রগুলোর কাছে কিছুটা উপহাসের পাত্র হয়ে যায় রাতুল। গোঁফদাড়ির ফাঁকে ক্ষমাশীল কবি তাই হয়তো ভুরু কুঁচকায়। চারদিকের কুঞ্চিত চাহনি উপেক্ষা করে, রাতুল গ্লাসটা হতে নিয়ে শোবার ঘর লাগোয়া প্রশস্ত বারান্দাটায় এসে দাড়ায়। তারপর লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ফুসফুসের ভেতরে বাতাস নেয়। দূরের  রাস্তায় কয়জন পথচারী। তাদের কথা বলার টুকরো টুকরো শব্দ ভেসে কানে আসে।রাত সবে সাড়ে দশটা, বায়োস্কোপ শহরটা কিছুসময় পরে মহাসমারোহে জেগে উঠবে। শুক্রবার রাতে এখানে সবাই হয়ে উঠে পার্টিপ্রেমী। হ্যাপি আওয়ারে ভরে যাবে কিছুসময় পরে। হাওয়ায় ভাসবে মিউজিক, ডান্স, ওয়াইন,পিৎজা আর তুমুল মিলনের শব্দে। 

দুইবছর আগ, এমন কোন চিত্রপটের দেখা পাওয়া যেত না। রাত সাড়ে দশটায় বায়োস্কোপ  নগরীটা নিরবতায় কাবু হয়ে যেত। রাস্তায় হেঁটে বেড়াতো দুই চারটা কুকুর। নগরের মানুষগুলোর দিন কাটতে অচেনা আতংকে। প্রিয়জনের আলিঙ্গন ছাড়াই অনেক মানুষ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন অন্য জগতে। 

ইদানিং লোডশেডিং এড়ানোর জন্য রাত আটাটায় মার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কাজের দিনগুলোতে মৌন্যতা এসে ভর করে বেশ তাড়াতাড়ি। ইতিমধ্যে শহরবাসীও সেটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু  সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় শহুরের রাতের মেজাজটা ছটফটে কিশোরীর মতো হয়ে যায়। গাড়ি হর্ন, ছুটে চলার শব্দ চারদিকটা কিছুটা এলোমেলো। এই বোকা বাক্সের শহরে সবকিছুই একটু অদ্ভুত। এখানে চুল হয় কারো সবুজ না হয় কমলা। চোখের মনির রং তো মুহূর্তে বদলানো যায়। জঞ্জালে ভরা শহরের কোনাকাঞ্চিতে লুকানো হতাশগুলো উড়িয়ে দেয় নিকোটিনের  ধোঁয়ায় ।  ভুলে যায় হতাশাগুলো । তাছাড়া  আগামীকাল ছুটি। তাই  রাতটাকে সঙ্গ দিয়ে সকালটাকে নিরবতা উপহার দেবে ওরা। রাতুলের বাস শহরের অভিজ্যাত রাজ্যে।  তাছাড়া ওর প্রাসাদ একদম বড় রাস্তার পাশে হওয়ায়  ভারী গাড়ি ভারে বাড়ি কেঁপে উঠে। সেই কম্পনের মৃদু আভাস পায় । রাতের নিরবতায় স্পষ্ট বোঝা যায়, বিছানাটা থরথর করে কেঁপে উঠে। ঘুম ভেঙে যায়। কাল যেমনটা গিয়েছিলো। আর ফেরত আসেনি ঘুমটা। রাতুলের চোখের কোলে কালচে ক্লান্তিটা চোখে আরো জাঁকিয়ে বসেছে । যদিও স্রেফ এক রাতের ঘুমের ঘাটতিতে এমনটা হওয়া অসম্ভব, অনেক রাতের আপেক্ষা। সেজন্য দুরত্বটা অনেকাংশে দায়ী। রাতুল ভেবে পায়না, প্রতারণাটা কি সবসময় ওর সাথেই হবে! ভাবে  সম্পর্ক এমন তলানিতে এসে কেন  ঠেকলো । তিন পেগ নির্জলা স্কচ পেটে ঢেলে সেকথা চিন্তা করার চেষ্টা করতে গিয়ে রাতুলের মাথার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। বিছানায় এলিয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি, চোখের পাতায় আসন পেতে বসে। অনেকটা সময় পরে জহির ভাইয়ের ডাকে রাতুলের তন্দ্রা কাটে। 

কি হে রাতুল, হোস্ট হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে। গেস্টদের সামলাবে কে?

রাতুল কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সিনিয়ার বড় ভাইয়ের কথায়। বুঝতে পারে না কথার পিঠে কি বলবে। তাইতো চুপচাপ উঠো বসে। মুচকি লাজুক হাসি দিয়ে বাথরুমে চলে যায়, নিজেকে সতেজ করতে। চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখে ২৫ বছরের এক যুবক ওর রুমে দাড়িয়ে চলন্ত ফ্যানের পাখায় গুপ্তধন খোঁজার চেষ্টা করছে। চাহনী স্থির ও নিদিষ্ট। রাতুল আসার সাথে সাথে চোখ দুটো উপর থেকে নামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে রাতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। রাতুলের কন্ঠস্বরে হয়তো ছেলেটার  ঘোর কাটে। তাড়াহুড়ো করে পেন সমেত একটি কাগজ গিয়ে দিতে গিয়ে পেনটা অযথাই হাত থেকে খসে পড়ে। দ্রুত পেনটা তুলতে তুলতে পাঁচ ছয় বার সরি  বলে কম্পিত হাতে পেনটা এগিয়ে দেয়। একটু সরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করে সিগনেচারের। সিগনেচার করে কাগজটি এগিয়ে দিতে দিতে রাতুল খেয়াল করে যুবকটিকে। বয়স বড়জোর ২৫ হবে। লম্বায় ছয় ফিট থেকে একচুলও কম হবে না। আধুনিক এই শহরে অন্য যুবকদের তুলনায় ছেলেটার গায়ের রংটা একটু বেশি মাত্রায় গাঢ়, অনুজ্জ্বলতার দিক থেকে। দক্ষিনের সিনেমার নায়কদের সাথে বেশ মিল। চোখ দুটো মায়া কাড়া, ঠোঁট দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী পুরু,সেটাই ছেলেটার চেহারাটাকে ভিন্ন করছে অন্যদের থেকে। রাতুলের ভালো লাগে। 

 

কি নাম আপনার? 

স্যার, মিলন।

মিলন আপনি খেয়েছেন? 

কথা বলে রাতুল একবার ভাবে, হোটেল বয়কে এই কথাটা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হলো? ওরা সার্ভিস দিতে এসেছে, ওদের সাথে এতোটা আন্তরিক হবার কি দরকার। বাসায় গেস্টদের খাবার সার্ভ করবে, গেস্ট চলে গেলে নিজেদের বাক্স পাটরা গুছিয়ে চলে যাবে।  

জি না, স্যার। অনেক ধন্যবাদ স্যার।

এই ভাবনার মাঝে, ওই কথাটা কানে এসে পৌঁছায় রাতুলের। তাকিয়ে দেখে না মিলনের মুখের দিকে কেননা রাতুল তখন টাকিলার পেগ তৈরীতে ব্যস্ত। 

ছোট গ্লাসে এক পেগ টাকিলা। বাম হাতে গ্লাসটা ধরে হাতের পিঠে লবন মাখিয়ে দেয়,তারপরে লেবুটা, একটু লবন জিহবায় ছোঁয়াও, এবার এক চুমুকে পুরো গ্লাস খালি করে ফেলে। একটু লেবু চিপে দেয় মুখের ভেতরে তাড়াতাড়ি। মিলন মুগ্ধ হয়ে রাতুলের টাকিলা সাবাড় করা দেখে। আর ভাবে, লোকটা তো এই বিষয়টাকে শিল্পের রূপ দিয়েছেন। 

এরই মাঝে গাঢ় স্বরে রাতুল বলতে থাকে…

‘ঠিক আছে খেয়ে যাবেন। আর এখানে আপনাদের সিনিয়র কে? আমার সাথে দেখা করতে বলবেন। ‘

‘স্যার আমি সিনিয়র, আমাকে বলতে পারেন। ‘

‘আপনি সিনিয়র,  আপনাকে তো দেখে বেশ ছোট মনে হচ্ছে।’ কথাটা বলে আবারও রাতুল নিজেকে নিজে বকে। পুরু ঠোঁটের ছেলেটা  কিছু না বলে মুচকি হাসি দিয়ে বলে, স্যার বলুন।

আমি চেকে পেমেন্ট করবো।

ঠিক আছে স্যার।

এইকথাটি বলার সময় ছেলেটির হাসি হাসি মুখ দেখে রাতুলের মনে হয় ওর নেশা জড়ানো কন্ঠ শুনে উপহাস করছে। অস্বস্তি হয়। তবে কন্ঠে আন্তরিকতা টোনটা টের পায়। হয়তো হ্যাংওভারের কারনে। বাসার সব গেস্ট চলে যাবার পরে রাতুল আর রুম পর্যন্ত যেতে পারেনা, সোফায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ে। অনুভব করে কেউ ওর পা দুটো ফ্লোর থেকে তুলে সোফায় রাখছে।  নির্জলা পান, বুকের ভেতরে লুকানো শূন্যতার হাহাকার । প্রলাপ বকে নিজের মতো। 

মিলনের  ‘স্পেশাল সার্ভিস’ দিয়ে ঘরে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ওকে সহ কয়েকজনকে এমন সার্ভিস দিতে যেতে হয় বিভিন্ন জায়গায় । আজকাল অনেক রেস্টুরেন্ট বিত্তশালীদের বাড়িতে খাবার পরিবেশনের সাথে সাথে এমন স্পেশাল সার্ভিসও দিয়ে থাকে। অনেকটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মতো।  যারা যায় তারাও লাভবান হয়। অল্পসময়ে বেশ কিছু টাকা আসে হাতে। মিলন এমন সুযোগগুলো সবসময় লুফে নিতে চায়। অনেকেগুলো মুখে খাবার তুলে দিতে হয় । নিজের পড়াশোনা ইতি টেনেছে বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে। এখন ছোট ভাই, মা ও বোনের দায়িত্ব ওর কাঁধে। কেননা ওর গাড়ি মেকানিক বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগের আগে তেমন কোন সঞ্চয় রেখে যায়নি।  

গভীর রাতে রাস্তায় নেমে মিলন চমৎকার এই ঝলমলে নগরীর নিরবতাটুকু উপভোগ করে কোনরকম কৃপণ ছাড়া। সারাদিনের উষ্ণতাকে শুষে নিয়ে শীতল হয়ে আসা নিরব রাস্তায় কোন তিন চাকার বাহনের  দেখা পায় না। অনেকটা সময় অপেক্ষা করার পরে কোন বাহন না পেয়ে দু’পায়ের উপর আস্থা রেখে বাড়িমুখো হয়। শান্ত প্রকৃতি, কোলাহলবিহীন শহরে হাঁটাতে হাঁটতে  মন অশান্ত হয়। প্রতিচ্ছায়া হয়ে স্মৃতিরগুলোর আগমনে ঘটে। অন্য এক ঘোরের মাঝে হাবুডুবু খায়।

‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এ সুর আর ছন্দে  বায়োস্কোপওয়ালা কি চমৎকার বিবরনী দিতে এই নগরের। সুন্দর মিলে যায় আজকের ঢাকা সাথে ।  মনে পড়ে হাওয়াই মিঠাই খাবার দিনগুলো। 

একটা সময় বেশ ভালো স্পিনার খেলত। নানান ক্লাবে খেলার ডাক পেত। স্বভাবটা মিলনের অন্তর্মুখী স্পিনারের মতো। বল ডেলিভারির আগে যেমন ব্যাটসম্যানের সামনে নিজের সবকিছু লুকিয়ে রাখত। এখন কাছের মানুষগুলো কাছে লুকিয়ে রাখে নিজের অস্তিত্ব, নিজের চাহিদা নিজের গোপন কথাগুলো। মিলনের মনে পড়ে ফেলে আসা ছোট শহরে বেড়ে ওঠা বিকেল ও ব্যর্থতা কথা। মায়ের কাছে করা ছোট আবদার। বাবার হাতে খাওয়া শেষ চড়টা।  তার ফিরিয়ে দেওয়া চিঠিটা। খেলার মাঠে বন্ধুদের টিপ্পনী। প্রথম ম্যাচ থেকে বসিয়ে দেওয়া, বাড়িতে রোজগারের খোঁটা আর মায়ের ভার হয়ে থাকা মুখটা। যৌবনের প্রতিটি প্রত্যাখ্যান ও উপহাস। ওর পিচে পড়ে জীবন নামক লাল বলটার আশ্চর্য বাঁক নেয়া।  সেই বল থেকে ছক্কা, দর্শকদের উল্লাসের মাঝে ওর স্তব্ধতা। 

হঠাৎ দ্রুত ছুটে চলা গাড়ি হর্নে ঘোর কাটে মিলনের।  কিছুটা ভয় পেয়ে এক ঝটকায় ফুটপাতে উঠে দাঁড়ায়।  তারপরে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাটা শুরু করে আবারও। মিলন যখন বাড়িতে পৌঁছায় তখন চারদিকটায় নিস্তব্ধতার শব্দগুলোকে অদ্ভুত একটি বলয়ের তান সৃষ্টি করেছে। সেই তান ছিঁড়ে যায় মিলনের মায়ের খনখনে কাশির আওয়াজে। বিদীর্ণ নিস্তব্ধতা মাঝে মায়ের কথাগুলো মিলনকে প্রশান্তি দেয়। 

মিলন গোসলডা কইরা’ল। খাওন দিতাছি।

মিলন অনেকটা রোবটের মতো মায়ের নির্দেশ অনুসারে চলতে শুরু করে। মাথায় ঘুরপাক খায় অন্য আর একটি দুরভিসন্ধি। 

বেশ সকালে ঘুম ভাঙার পরে রাতুল নিজেকে আবিষ্কার করে সোফায়। গায়ে একটা চাদর। পায়ে জুতা নেই। কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে রাতুল। প্রায় রাতে এমনই এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কখনো এতোটা যত্নের ছোঁয়া পায় না। আজ যা পেলো। মনে পড়ে সেই পুরু ঠোঁটের ছেলেটার কথা। রাতুল  এই শহরের অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি। বাবার অটেল টাকায় গা ভাসিয়ে চলে। সেই ভেসে চলার মাঝে বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিছু ফিসফিসে কথা। রাতুল জানে, তাই এখন আর এই বিষয়টা  গায়ে মাখে না। জীবনটা ওর ইচ্ছেটা ওর। এই মন্ত্রটা ভেতরে গেঁথে ফেলেছে। তাই তো এখন ওর সবকিছু খোলামেলা। সবাই জানে ওর এই স্বত্বা সম্পর্কে। 

রাতুল ওর অপ্রচলিত স্বত্তা সম্পর্কে প্রথম বুঝতে পারে আবিরের সাথে একদিন রিকশায় বাসা ফেরার সময়। আবিরদের সরু গলিতে ওদের গাড়িটা ঢুকতো না। তাই তো রিকশায় করে বাড়ি ফেরার পথে  কেমন যেন একটা শিহরণ  অনুভূতি করে । আবিরের হাতটা মুঠোবন্দি করতে ইচ্ছে করে। এক দুইবার আবিরের থাইয়ের উপরে হাত রাখে। আবিরের ভেতরে কোন পরিবর্তন না দেখে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। জাহিদের মাচো শরীরটা ছুঁয়ে দেখতে মন চাইলেও ভাসিটিতে মেয়েদের বুকের প্রতি অনাসক্তিটা সবসময় ছিলো। নিজেকে বুঝত। তারপরও সবার জোড়াজুড়িতে বিয়ে করার পরে ফারিয়াকে মুক্তি দেয়। কোন রকম আপত্তি ছাড়াই। ফারিয়ার সাথে রাতুলের বিয়েটা হয়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে। রাতুল চেয়েছিলো লোকজনের ফিসফিসে কথাগুলো যেন প্রমানিত না হয়। কিন্ত বিয়ের পরবর্তী দিনগুলো ছিলো ওর জন্য  দুঃসহ। নিজের অপারগতার লজ্জা, উত্তেজিত করার চেষ্টা,  স্ত্রীকে নানাউপায় এড়িয়ে চলা। সবমিলিয়ে দুঃসহ ছিলো। 

তারপরে রাতুল অনেকটা নিরবে এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করে। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করে। ও আসলে জীবনে কি চায়? সবাই কি চায় সেটা না জানলেও জানতে পারে, প্রতিটি পুরুষের ভেতরে নারী থাকে, আর প্রতিটি নারীর মাঝে পুরুষ । কারো কারো মাঝে দুটো স্বত্ব একই সাথে বিচরন করে। আর সেকক্সুযালিটি একটা চয়েজ। তখন ওর পরিচয় হয় বর্ষনের সাথে। তাছাড়া বর্ষণকে সঙ্গী পেয়ে রাতুল সাহসী হয়ে ওঠে। সেই সাহসের কারনে অকপটে সবাইকে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দেয়। কথায় আছে, গুলি ও কথার কোন ইউটার্ন হয় না, একবার বের হলে ফিরে আসে না। রাতুলও নিজের অপারগতার কথা বলার সাথে সাথে পরিবারের সবার চক্ষুশূল হয়ে যায়। সবার বক্তব্য ছিলো যাই হও না কেন, সমাজের কাছে পর্দা রেখে দিলে কি আর  এমন হতো । কিন্তু রাতুলের ছলচাতুরী করতে ইচ্ছে করে না। হয়তো ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠছিলো। সাথে ছিলো বর্ষনের মৃদু ইন্দ্রন। 

সোফায় বসে অনেকটা সময় মাথার দুইপাশে হাত দুটো চেপে রাতুল পুরনো দিনের কথাগুলো ভাবে।স্মৃতির নিউরনে অনুরণন তোলে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ঘর থেকে বেড়ান সময় হয়ে এসেছে। কফি মেশিনের বাটনে আঙুল রেখে কফি বানিয়ে নেয় বেশ দ্রুত। নিজের হাতে কফি বানিয়ে খেতে বেশী পছন্দ করে । যেটাতে দুধের ফ্রথটা হয় পরিমান মতো, বেশী দুধ বা কফি বা ক্রিম ওর ভালো লাগেনা। চুমুক দেয়া মাঝে বুঝতে পারে দরজায় কেউ দাড়িয়ে আছে। হেলেদুলে দরজাটা খুলে দেখে পুরু ঠোঁটের সেই ছেলেটা উদ্ভান্তের মতো দাড়িয়ে আছে৷ রাতুল কিছুটা অবাক হয় ছেলেটাকে দেখে, চোখ দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এতো সকাল সকাল এই দরজায় কড়া নাড়ার কারনটা… 

এর ভেতরে কান্নার মৃদু ফসফস শব্দে রাতুল অপ্রস্তুত হয়ে যায়। 

‘স্যার আপনার দেয়ার চেকটা আমি গতকাল পথে হারিয়ে ফেলেছি, স্যার আপনি আমাকে বাঁচান’

এরমাঝে চোখ দুটো থেকে গড়িয়ে পরে অনেকটুকু জল। তারপরে আবার বলতে শুরু করে…

আমার তো চাকরি থাকবে না স্যার, আমার মায়ের কি হবে? 

হড়বড় করে আরো কিছু কথা বলে ফেলে ছেলেটা। রাতুল বুঝতে পারে না কি বলবে এই মুহূর্তে, তাছাড়া চেকটা আসলেই হারিয়েছে কিনা সেটাও বোঝার উপায় নেই। যদি কথা মিথ্যা হয়। কিন্তু ছেলেটার কান্নাটা ওর মেকি মনে হয় না। দুই চারটা চিন্তার মাঝে প্রথমেই মনে আসে ব্যাংকে ফোন করতে হবে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয়।  অফিসের একাউন্সে ফোন করে জানায় ওর স্বাক্ষর করা সকল  চেক পেমেন্ট যেন অফ থাকে। 

কৃতজ্ঞতায়  করতল করা হাত দুটোতে সান্তনাসূচক কথা বলতে বলতে রাতুল মিলন হাতটা মুঠোবন্দি করে অনুভব করে অন্য এক শিহরণ। অনুভূতির অদলবদল চিনে নেয় দুজন দুজনকে। মিলনের চোখে সরাসরি তাকিয়ে রাতুল বিষয়টা আরো পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করে। মিলনের বাঁকা ঠোঁটের মৃদু হাসি সবকিছু আরো পরিষ্কার করে দেয়। রাতুল কাছে টেনে নেয়। মিলনের কাঁচা ঘামের গন্ধটা ওকে আরো মাতাল করে দেয়। রাতুলের আগ্রাসী  আচরনে মিলন কিছুটা অপ্রস্তুত হয় ঠিকই কিন্তু কোনরূপ বাধা দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা স্বত্বা ওর রক্তে নতুন এক আনন্দে জন্ম দেয়। মিলনের পশ্চাৎদেশে শক্ত দন্ডের ঘর্ষনে শীতল স্নায়ুযুদ্ধ চলে শরীরের রন্দ্রে রন্দ্রে। অস্তিত্ব বিসর্জনের দুঃখময়তা ধীরে ধীরে সুখময় স্বস্তিতে পরিনত হয়।

তারপরে দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যায় এই বায়োস্কোপ নগরীর এই বাড়িতে । এই শহরে প্রতিদিনই কোনো না কোন সম্পর্কের সমাপ্তি  হয় আবার সেই ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলোর নতুন সুচনা হয় অন্যকোন কুঠুরিতে। একদম বোকা বাক্সোর মতো।  পরিবর্তীত দৃশ্যায়নে দেখা যায়  মিলন ওদের ছোট দুই কামরার বাড়ি বদলে রাতুলের বাড়িতে এসে ওঠে। বিষয়টা কারো কাছে একেবারে তুচ্ছ বিষয় মনে হয়, কারো কাছে ভয়ংকর। জাত গেলো জাত গেলো…

যেমনটা মিলনের মায়ের চোখে। ছেলের এমন আচরণ তিনি কোনভাবে মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না। মনে মনে হাজারবার নানান অভিশাপে অভিশপ্ত হতে হয় রাতুলকে।  কিন্তু নিজের ছেলেকে কিছু বলতে পারেন না । সেহেতু ছেলে ভালো টাকা ইনকাম করে। নতুন চাকরি হয়েছে। মাকে নতুন বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছে। সম্বলহীন মিলন সঙ্গীবিহীন রাতুল নিজেদের ভেতরকার বোঝপড়াটার দারুণ হয়। সেকারনে যে তাদের জীবনযাত্রার এতো পরিবর্তন সেটা তিনি বেঝেন ও উপভোগ করেন। কিন্তু কথায় আছে, পৃথিবীতে কোন সুখ বেশীদিন স্থায়ী হয় না। কেউটেসাপ বের হবেই। সেই কেউটে সাপটা হলো মিলনের অহংকার। ছোট পুকুরের মাছ বড় নদীতে আসলে বেশী যেমন ফাল দেয়। মিলনও তেমনি আচরন করে। বিষয়টা রাতুলকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ওর ভ্রু’র ওপর কপালে তিনটে ভাঁজ পড়ে। চিন্তার। এরমাঝে ঘাঁয়ের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আসে লাবনী। 

লাবনীর সাথে মিলনের পরিচয় রাতুলের সূত্র ধরে।  রাতুলের ফ্যাশন হাউসের ডিজাইনার হলো লাবনী।  পুরনো ডিজাইনারের কাজ নতুনত্ব না থাকার কারনে রাতুল সেই ডিজাইনার চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বলেন। সেখানে যুক্ত করেন লাবনীকে। চারুকলা থেকে সদ্য পাশ করা মেয়েটি নতুন কাজের সুযোগ পেয়ে পুরোপুরি নিজেকে ডুবিয়ে দেয়।  তাছাড়া এই বায়োস্কোপ নগরের গোলাপী আকাশ, হলুদ পাতা, কমলা বাড়িগুলো সবাই জানে রাতুল ও মিলনে ফিসফিসে সম্পর্কের কথা।  তাইতো লাবনী নিজেকে অনেকটা নিরাপদ মনে করেন ওদের কাছে। যতটা না মনে করেন রাস্তায়, পথে, চারপাশে ভদ্র কাপড় পরা লোকজনকে। কিশোরী বয়সে গৃহশিক্ষকের  কাছে নিজের সর্বসটুকু হারিয়ে লাবনী মানসিকভাবে পুরুষের আলিঙ্গন সহ্য করতে পারে না। ছোট বয়সে ভয়ে ও লজ্জায়  কাউকে সেই কথাটুকু বলতে পারে না কখনো।  কাজের সূত্রে মিলন ও লাবনী এখন বেশ ভালো বন্ধু, তাছাড়া  সমসয়সী হবার কারনে দুষ্টমি ফাজলামি ওদের ভেতরে চলে অবিরত। বিষয়টা রাতুলের ভালো লাগেনা । তবে সম্বলহীন মিলন সঙ্গীবিহীন রাতুল নিজেদের ভেতরকার বোঝপড়াটা ছিলো রাজযোটকের মতো। দিনগুলো নিজেদের ভেতরে বোঝাপড়ায় দারুণ কাটছিলো।  

হঠাৎ একদিন হারিয়ে যাওয়া চেকটির কারনে রাতুল কিছুটা চিন্তাত হয়ে পড়েন। মেয়াদোত্তীর্ণ চেকটির তারিখের ঘরে ঘষামাজা ও কাটাছেঁড়ার কারনে চেকটি অর্নার হয় না।  কিন্তু বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওকে জানায়। অস্বস্তি ও চিন্তা দুটোই এসে ভর করে।  রাতুলের সেই চিন্তার বলিরেখা হারিয়ে যায় মিলনের স্যান্নিধ্যে। সময় এগিয়ে যায়, সম্পর্ক আরো পোক্ত হয়ে ওঠে। 

তারপরে আরো  কিছুদিন পরে ব্যাংক থেকে ফোন আসে ওর সাক্ষরিত একটি চেকের ব্যাপারে জানতে চাওয়ার কারনে । দুইমাস আগে পাশ করা চেকের ব্যাপারে অডিট আপত্তির কারনে। কারনটা স্বাক্ষরে কিছুটা অমিল। অডিট আপত্তির কারনে বিষয়টা  সবার নজরে আসে। আবার চেকের পেছনে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে’ পেমেন্টের ব্যাপারে গ্রাহকের সম্মত্তি আছে’, তারপরেও বিষয়টা  নিশ্চিত হবার জন্য কর্তৃপক্ষ রাতুলকে জিজ্ঞেসাবাদ করেন। পরিমান কম হবার কারণে রাতুল বিষয়টাকে এড়িয়ে যায়। সেহেতু ১ লক্ষ টাকা রাতুলের কাছে তেমন কোন বড় বিষয় না। 

বোকাবাক্সের শহরে কিছু মানুষের কাছে টাকা  হাতার ময়লা আবার কিছু মানুষের কাছে সোনার হরিণ। রাতুলের কাছে প্রথমটা, তারপরেও সতেচন ব্যবসায়ীর মতো রাতুল  বিষয়টা নিয়ে ভাবে। সেই ভাবনার মাঝে ঘি ঢেলে দেয় পাঁচিশ লাখ টাকার একটি চেক। ব্যাংক জানায় গ্রাহকের সম্মতির কারনে টাকা তারা দিয়ে দিয়েছেন অনামী একটি কোম্পানীর একাউন্টে । রাতুল কিছুটা অপ্রস্তুত ও দ্বিধায় পড়ে যায়। শুরু হয় তদন্ত। চেক জালিয়াতির সময় রাতুল দেশের বাহিরে থাকায় প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় গড়মিল আছে।শুরু হয় তদন্ত। কথায় আছে কোঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসে। এখানেও তেমনি হয়। যে সাপ বের হয়ে আসে সেজন রাতুলের খুবই প্রিয়জন। সাথে জট খোলে আরো অনেক রহস্যের। 

মিলন নিজেকে বাঁচানো আর কোন উপায় না পেয়ে সবকিছু খুলে বলে। হয়তো রাতুলের প্রতি সহমর্মিতা। তবে ওটা যে ভালোবাসা নয় সেটা বুঝতে পারে একপেশে লোকটা। রাতুলের জীবনযাপন ও উদাসীনতার বিষয়ে অনেকে জানত। সেটাকেই কাজে লাগায় মিলন ও ওদের চক্র। পুরু ঠোঁটের ছেলেটাকে ইস্কাপনের টেক্যা হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেহেতু সে সকল লিঙ্গের প্রতি সমান আগ্রহী। নিজের গুরুত্ব বুঝে মিলনও নিজেকে বিকিয়ে দেয়। পরবর্তীতে প্রমানিত হয়, চেকটি মিলনের স্বাক্ষরিত ও ফোন রিসিভারও সে। সবকিছু প্রমানিত হবার পরে রাতুল কিছু টাকা উদ্ধার করতে পারে তবে পুরোটা না। তবে মিলনের প্রতারণা, প্রিয়মানুষটার  বিরুদ্ধে  কিছু বলেনা রাতুল। নির্লিপ্ত রাতুল ভাবে,যেখানে সৃষ্টিকর্তাই ওর সাথে প্রতারণা করেছে সেখানে তার সৃষ্ট মানুষ তো প্রতারণা করবেই। অবয়ব ও কামনার অমিলের কারণে যে জন্ম নিয়েছে ওর মতো সমাজের এই অপ্রচলিত স্বত্তা।

সকল জটের অবসান শেষে আরো একটি জটে লেগে যায়…

লাবনী রাতুলকে ভালবাসার কথা জানায়। রাতুলের অপারগতা কথা জানার পরেও ভালোবাসে। রাতুল লাবনীকে প্রত্যাখ্যান করে।  অনেক অপমান ও প্রতারণা ওর ভেতরের কোমল রূপটিকে কয়লা করে ফেলে। তাছাড়া রাতুল বিশ্বাস করে পৃথিবীতে এখন  শরীর বিহীন কোন প্রেম নেই। সবাই শরীরের মাঝে প্রেম খোঁজো। লাবনী যে তা সেটা খোঁজে না রাতুল সেটা বোঝে না।  লাবনী বন্ধুর মতো পাশে থাকতে চায় , রাতুল প্রত্যাখ্যান করে। লাবণী অপেক্ষা করে রাতুলের। 

প্রত্যাখানের বিকেলটা বিষন্ন ধুসর হয়ে ধীরে ধীরে গাঢ় কালো হয়ে যায়। রাতুল সেই বিষন্ন বিকেলে গায়ে চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকে পৃথিবীর মায়া কাটানোর অপেক্ষায়

(চেক জালিয়াতির পুরো বিষয়টি পুরোপুরিভাবে লেখা হলো না অন্যায়কে দমন করার স্বার্থে।) 

******************************