বাঙালির পয়লা বৈশাখের সেকাল ও একাল
অমিতা মজুমদার
পহেলা বৈশাখ এর পার্বণ দিয়ে বছরের শুরু । কেমন ছিল আমাদের ছোটোবেলায় গ্রামের পহেলা বৈশাখ ? সূর্য ওঠার সাথে সাথে গ্রামের ছেলে বুড়ো একসঙ্গে মিলে নগর কীর্তন দিয়ে গ্রাম পরিক্রমা শুরু করত ।আর বাড়ির মেয়ে বউরা সকাল সকাল স্নান সেরে ভোগের আয়োজন করতে লেগে যেত । চৈত্র সংক্রান্তিতে শুরু হওয়া গ্রামের স্কুল মাঠের মেলা তিনদিন ধরে চলত। গ্রামের এই মেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকত সবাই। বিশেষ করে গ্রামের মা,বোনেরা,বউ মেয়েরা। ষাট সত্তর দশকে মহিলাদের শহরতো দূর গ্রামের বাইরে যাওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না। সকল বাড়ির পুরুষেরা মেয়েদের শখের আলতা, সাবান, স্নো, পাউডার কিনেও দিতো না।সারা বছর ধরে নানা উৎস থেকে টাকা জমিয়ে মেলায় হাত খুলে খরচ করত মেয়েরা।নিজের সখি,বোন সহ শুভানুধ্যায়ীদের সামর্থ্যের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান করত। মোটের উপর এ দিনটি অন্তঃপুরবাসিনীদের যেন মুক্তির দিন। আজকের গ্রামের মেয়েরাও সেই মুক্তির আনন্দ অনুভব করতে পারবে না। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে নাগরিক সুবিধা এখন হাতের মুঠোয়। পয়লা বৈশাখের আনন্দ এক আলাদা মাত্রা পেত নারী পুরুষের সম্মিলিত আনন্দ যাত্রায়।এই মেলায় মিষ্টির দোকান মানে বর্তমানের ভাষায় লাইভ চলত।জিলিপি ভাজা হচ্ছে,রসগোল্লা,রাজভোগ,কালোজাম সহ সব মিষ্টিই শখের ময়রাগণ সততার সাথে বানাতেন। ব্যাবসা কতটা হলো সে চিন্তার চেয়ে আনন্দটাই ছিল বিবেচ্য। কাঠের বাক্সে আইসক্রিমওয়ালার সামনে ছোটোদের ভিড় লেগেই থাকত। বায়োস্কোপের বাক্সের ফুটোতে চোখ রেখে বিশ্বজয়ের আনন্দে মেতে উঠত বড়ো ছোটো সবাই। কোনো কোনো মেলায় নাগরদোলাও থাকত।মাটির ও প্লাস্টিকের পুতুল,খেলনার দোকানের সামনে শিশুদের সামলাতে বেগ পেতে হতো বাবা-মাকে।বাঁশের বাঁশি,হাড়ের বাঁশি,বেলুন,কাগজের রঙিন ফুল কী না পাওয়া যেত এই মেলায়। একটা দিনের এই মুক্তির আনন্দ সারা বছরের দখিনা হাওয়া বয়ে নিয়ে আসত গ্রামীণ জীবনে। এখন প্রয়োজনীয় জিনিসের সহজলভ্যতা প্রাপ্তির আনন্দ অনেকটাই ফিকে কওরে দেয়।
সবচেয়ে আনন্দ আর স্বস্তির বিষয় ছিল অসাম্প্রদায়িক আবহে সেই মেলা যেন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির মিলনমেলা হয়ে উঠত। সত্যি বলতে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক এই শব্দগুলো আমরা স্বাধীনতা-পূর্বকালে শুনিনি। যাইহোক সেই মেলা থেকে ফুট, তরমুজ, বাতাসা কেনা হতো ভোগের জন্য। এছাড়া নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সব বাড়িতে দই চিড়া, কলা, খই, নারিকেল এসব দেওয়া হতো। যারা কীর্তন নিয়ে আসতেন তারাই সবকিছু মিলিয়ে মেখে খেয়ে নিতো। কলাপাতা কিংবা হাতে করে সেই নৈবেদ্য সবাই কত আনন্দ করে খেতো ।বিকেলে জগন্নাথের মন্দিরে কীর্তন শেষ করা হতো । রান্না হতো খিচুড়ি । যা সবাই মিলে আনন্দ করে খেতো।
কর্মসূত্রে বা পড়ালেখার জন্য যারা বাড়ির বাইরে থাকত তারাও এসময় নিজের আত্মজনের সাথে বছরের প্রথম দিন কাটানোর জন্য বাড়িতে আসত।
আমাদের ছোটদের কাজ ছিল বড়দের প্রণাম করা । এছাড়া ওই দিনটা বেশ স্বাধীন ভাবেই চলতে পারতাম। আমরা আবার নানারকম প্রতিজ্ঞা করতাম,যেমন কথা না বলা,যাতে সারা বছর কম কথা বলি। যার সাথে দুদিন আগে হয়তো খেলতে গিয়ে ঝগড়া হয়েছে তার সাথে ভাব করা ,সারা বছর ভালো হয়ে থাকা এই সব আর কী। কোনো কোনো বাড়িতে পহেলা বৈশাখ থেকে সারা মাস নিরামিষ খাওয়া হতো। তখন তো বুঝতাম না এখন বুঝি এই নিয়মগুলির বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে । কারণ এই সময় সকল মা মাছের পেটে ডিম থাকে। তাই মাছ খেলে পরবর্তী সময়ে মাছের বিস্তার ব্যাহত হবে । সারা বছর যেন সকলের জন্য শুভ হয় এই প্রার্থনা করত সবাই । এখন গ্রামের পহেলা বৈশাখ কেমন হয় জানি না।
মহা নগরের বাঙালির পহেলা বৈশাখ তো আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। সারা দেশে এখন পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। তার সাথে পান্তা ইলিশ সহ নানাবিধ উপকরণ মিশে এর গ্রহণ যোগ্যতা যেমন বাড়িয়েছে, আবার নতুন প্রজন্ম এই উছিলায় পহেলা বৈশাখ যে বাঙালির অস্তিত্বের উৎসব তাও জানতে পারছে এ কথা যেমন ঠিক,তারপরেও বাঙালির উৎসব পয়লা বৈশাখের আমেজ বা আবহ কেমন যেন ম্লান হয়ে গেছে। তাল কেটে যাওয়া সঙ্গীতের মতো আড়ম্বর আছে উচ্ছ্বাস আছে প্রাণের স্পন্দন বড়ো দুর্বল। নববর্ষের ভাতা পায় বাঙালি কিন্তু খেতে যায় পাঁচতারা তিনতারা হোটেলে কন্টিনেন্টাল খাবার শুধু নিজের পরিবার বা বন্ধু বান্ধব নিয়ে। এই নিজের পরিবারে জায়গা হয় না অনেক আত্মজনের। কারণ এখন নিজের পরিবার মানে শুধুই নিজের।
তবুও বাঙালির জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে পয়লা বৈশাখ। আম, জাম, কলা, লিচু কাঁঠালের গাছ সেজে ওঠে ফলভারে। চৈত্রের খরার শেষে নতুন জলে ভরে উঠবে খাল বিল পুকুর। মাছেরা পাবে প্রাণ খুলে বিচরণের ক্ষেত্র। গাছে গাছে পাকা ফলের গন্ধে ছুটে আসবে পাখ-পাখালি। শিশুদের কন্ঠে শোনা যাবে”এসো হে বৈশাখ এসো এসো…”
এইতো আমাদের সোনার বাংলার বাংলা নববর্ষ।
শুভ নববর্ষ।