বাংলাদেশ
আকিমুন রহমান
আউজকা বাসে ওটোনের সোম একটা আচানক বিত্তান্ত ঘটছে। আমি- এই যে রিয়াজুল- আমি এই- নাক চোখ খোলা রিয়াজুলে তক- ট্যাপ খাইয়া গেছি- বিত্তান্তের গুণে! বিত্তান্তটা বিরাট কিছু না। কিন্তুক আমারে টাসকি খাওয়াইয়া দিছে। আতকা ঘটছে কিনা! টাসকি না খাইয়া যাই কই! নাইলে, এই ত্রিয়েস্তে আমি আছি আউজকা ধরতাছি পাঁছ বচ্চর যাইতাছে গা, নিয়ম-সিয়ম ভালাবুরা- এই দেশের চলাচলতি- বালামতন বোজার আমার বাদ নাই। সে কয়জন দেশি পোলা আমরা আছি এই ত্রিয়েস্তায়, সবটি সবটিরে চিনি! ঠায়-ঠেকায় সগলতে লগে লগে থাকি, নাইলে যে যার মোতন থাকি ছাড়া ছাড়া! কেউঅইর খোঁজ কেউঅই রাখি না। খইয়া-লইয়া তো কাম আর নাই, যে, খালি এর-তার পোন্দের পিছে এয়-তায় থাকতে থাকমু!
তয়, আমাগো সবটির লগেই সবটির দেখাসাক্ষাৎ হয়, কিন্তুক দিইন-রাইত একলগে গলাগলি নাই! যেরা যেরা এক বাসাত থাকে, তারা তারা এক গুরুপ নিজেরা নিজেরা। এই যেমুন আমি থাকি সুবার বাসায়। ফেলাটটা অয় কিনছে। তার একটা ঘর আমি ভাড়া লইছি। আরেক ঘর ভাড়া লইছে ইলিয়াছে। অন্যটাতে সুবা হালার পুতে নিজে থাকে। অয়ে এই দেশে আছে-নয় বছর দইরা। কয় বোলে, উয়ে এইনেই থাইক্কা যাইবো পুরা জিন্দিগি। তয় উয়ে থাকতে পারে! অরা তো আমাগো মোতন না। অগো দ্যাশ-খেশের লেইগা টান কম। আমাগো যেমুন বাড়ির লেইগা কইলজা ফাইট্টা যাইতে থাকে সব সোম, উয়ে তো দেখতাছি হেমুন না!
উয়ে কয়, এইনেই উয়ে বাদবাকি জিন্দিগির লেইগা থাম্বা গাইড়া বইবো! আর হেইটাই তো করছে অয়ে! ফেলাট কিইন্না বাড়িঅলা অইয়া গেছে গা, একদমে। তয় অরা পারেও শালার! দেশবাড়ির লেইগা কান্দাকান্দি করতে থাকা পরান নিয়া- অর তো দেহি কোনো ঝামেলা অয় না। আমি অরে হেইটাই খালি জিগাই! টাইমে টাইমে জিগাই, ‘আরে সুব্রইত্তা, তুই পারস কেমনে?’
সুব্রত পারে। উয়ে পারে পারুক, কিন্তুক আমি এমুন পারতে চাই না। আমি এই দেশে পইড়া থাকোনের লেইগা আহি নাই। ট্যাকা কামানের লেইগা আইছি। কামাইতাছি। বাইত পাটাইতাছি দুই হাতে। বাবায় জায়গা জমি কিনতাছে। বিল্ডিং তোলছে বাইত। সুদিতে ট্যাকা লাগাইছে। দেখতে দেখতে চাইর বচ্ছর গেছে গা। আমার তো ইচ্ছা, যাউক গা আরো চাইর পাঁচ বচ্ছর। হাতে বালামোতন ক্যাশ টাকা বাইন্দা, আল্লা আল্লা কইরা দ্যাশো ফিরা যামু। ব্যবসা করুম হেইর পর! দ্যাশে থাইক্কা ব্যবসা করমু।
ট্যাকা খেপে খেপে বাইতও পাটাইতাছি, নিজের কাছেও ব্যাংকে রাখতাছি এইনে। খায়-খরচ আর বাড়িভাড়া বাদে বেহুদা খরচার মইদ্দে আমি নাই। ট্যাকা অইলো জমানের লেইগা! এই ট্যাকা কামাইয়ের লেইগাই তো এইনে আওন, নাকি? কিন্তুক, কথাটা কি পুরা হাছা হইলো! এই যে কইলাম- ট্যাকা কামাইয়ের লেইগাই আইছি। পুরা হাছা না এইটা ! আরো কথা আছে- এইর পিছে। তয়, অহন কতা কিন্তু হেইটা না। কতা অইলো- এতো চোখকান খোলা থাকোনের পরেও- এই যে বাসে ধরাটা খাইলাম আমি! যেমুন তেমুন ধরা খাওয়া না কিন্তু!
হইছিলো কি, কামের তেনে ফিরতি কালে, আমি খাড়াইয়া রইছি বাস ইস্টপে। কুড়ি মিনিট পরে বাস। এহন, আমার ইস্টপে যাইতে গেলে ৬ নং বাসে গেলেও চলে, ৩৬-এ গেলেও অয়। আমি খাড়াইয়া রইছি, এহন যে কোনো একটা আইলেই উটমু। দেহি যে ৩৬ জন আইতাছে। আহুক। যাওন দা হইছে কথা। অমা, বাসে উইট্টা সারি নাই, কে জানি হুড়ামুড়াইয়া উইট্টা- আমারে এই বিরাট এক ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দিতে দিতে, ঝুপ্পুস কইরা ধইরা ফালাইলো; আর নিজের পড়োন ঠেকানের লেইগা, ঝপঝপন্তি সিটের একটা হাতল ধইরা লইলো!
কালা আন্ধাইরা এক- কালা বাউশ হালার পুতে! আবার কয়, ছরি ছরি ছরি- ইস্কটিমি ছরি। তর ছরির খ্যাতা পুড়ি। আরে, বাসের অই শেষ টাইমে, দরজা বন্ধ হয় হয় টাইমে, দৌঁড় পাইড়া তর ওটোনের কাম কি রে ব্যাটা! ধাক্কা খাইয়া আমি যেই দুঃক্ষুটা পাইলাম- ছরি দিয়া হেইটা উশুল হইবো! মনে মনে গাইল দিয়া তো অখন আমার কোরোধ কমবো না! মুখ দিয়া গাইল দিতে হইবো। বাংলা এইনে কেটায় বুঝতাছে! আমি অন্যদিকে চাইয়া-গাইল দেওয়া ধরলাম। ‘শালার পুতেরা! শ্রীলংকা থুইয়া এইনে কোন মরা মরতে আইছস রে বেটা! শালার পুত। হালার ঘরের হালা!’
“আপনি গালিটা বেশি দিয়ে ফেলছেন না ভাই? আমি ইচ্ছে করে করিনি কাজটা। ব্যালান্স রাখতে পারি নাই যে!”
‘হায় হায়- শ্রীলঙ্কাইন্নাটায় দি বাংলা কয়! আমার দেশি ভাই নি? ইয়া আল্লা!’ হুড়ুত কইরা মনের ভিতরে আফশোস আইসা ধাক্কা দিলো। শরম পাইলাম। দেশি পোলা না? নতুন আইছে লাগে। আমরা পুরানরা এমুন করলে- অগো উপায় কি! চলতি বাসেই শেষে অর লগে কোলাকুলি করোন খালি বাকি রাখি। কেমনে আইলো – কোন রাস্তা দিয়া আইলো – কয়দিন ধইরা আসছে- আমাগো দেশিগো কার বাড়িত আছে- এমুন কতো কতাই না হেরে জিগাই আমি! হেয় খালি চক্ষু বড়ো বড়ো কইরা আমার কতা শোনে। কিন্তু কোনো জব দেয় না! ঘটনা কি? পোলাটায় এমুন ক্যান! নাকি দুই নম্বর! দুরঅ- কি কই- আমরা সকলতে- দুই নম্বর না অইয়া- এইনে আইতে পারতাম নি? আমরা বেবাকটিই হইতাছি দুই নম্বর। তয়, অয়ে কি? কতা খালি হোনে, জব দেয় না। আমার ইস্টপ অইয়া পড়তাছে না! আমি আবার জিগাই, বিত্তান্ত কি? শেষে সেয় মোক খোলে। কয়, আমি স্টুডেন।
আরে আল্লা! দেশে অখন স্টুডেন ভিসা দিয়া বিদেশ পাঠানোর সুবিধা হইছে নাকি! নামে স্টুডেন কামে ট্যাকা কামাইয়েরর ধান্দা- সেই কেইস নাকি! হইলে, খুইল্লা কইতে দোষটা কোনখানে! এইনে, এই বিদেশে, দেশি ভাইগো মইদ্যে আবার লুকাছাপা কি?
আমি তারে কই, ‘আরে মিয়া! খোলাসা কইরা কন। কতো লাগলো আইতে- আওয়া হইলো কোন রাস্তা দিয়া, এহন কি করোনের ধান্দা-’
আমার কথা শুইন্না সে- করকরা চক্ষে আমারে দেখতে থাকে তো দেখতেই থাকে, কোনো কথা নাই! অনেক খোন কোনো কথা নাই। শেষে মুখ খোলে।
“আমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছি এখানে।”
‘বাড়িত তেনে কত ট্যাকা পয়সা নিয়া আসতে হইছে?’
“নিয়ে আসতে হয় নি তো তেমন কিছু! ক্যান?”
‘তাইলে চলেন ক্যামনে? খরচাপাতি চলে ক্যামনে?’
“ইউনিভার্সিটি দেয়- বললাম না? এসব কেন জিজ্ঞেস করেন?”
‘না জিগাইলে জানমু ক্যামনে?’ আমি তারে বুঝ দিয়া বলি। বলি বটে, তবে আমার কইলজাটা চিনচিনায়। পোলাটা ল্যাখাপড়া করতে আসছে- কলারশিপ বোলে পায়- দেশি পোলা। কিন্তু ব্যবহারের তাছির দ্যাখো! কথা বাইর করতে হইতাছে- ঠেইল্লা! গুতা দিয়া দিয়া! ফুটানি করতাছে নি! করলে করুক গা! শিক্ষিত কিনা- ফুটানি দেহায়! দুইদিন পর কই যাইবো গা, গুড়–ম গাড়–ম। তহন দেশি ভাইগো বিছারাইয়া- বেদিশা হইয়া কুল পাইতো না!
“আপনি ধারে কাছেই থাকেন?” পোলাটায় আমারে জিগায়। এইত্তো বোল ফুটতাছে- আমি মনে মনে এই কথা বইল্লা মুখে কই, ‘এই যে আর দুই ইস্টপ পরেÑ রাইয়ানো। সেইখানে আমার বাসা।’ এইটা তো ধইরাই নেওয়া যায় যে, এইর পর সেয় নিজেই- তার থাকানোর জায়গার কথা বলবো! আমার তো তেমুনই মনে হইছিলো। কিন্তুক শেষে দেখি, সে সে আর কোনো কথাই তোলে না! না-পাইরা আমিই জিগাই; ‘আপনে কই থাকেন?’
“ এই-একটু দূরে- বারকোলায়! সালিতা কনতোভেল্লিতে আমার ফ্ল্যাট।”
অ! সেইটা খুব বেশি দূরে না। আমার ইস্টপের পরে তিনটা ইস্টপ। তার বাদেই বারকোলা। আমি ঝুম ধইরা বইসা থাকি, দেখি সে আর কোনো কথা কিনা! রাইয়ানো- আমি ইস্টপ আসতে তো আর বাকি নাই।
কিন্তুক পোলাটার মুখে কোনো কথা নাই। আরে! ঠায়-ঠিকানা না নিলে, চলতে-ফিরতে ঠেকায় পড়লে যাবি কই! কিন্তুক ঠায়-ঠিকানা নেওনের লেইগা- তার কোনো লড়াচড়ি দেখা যায় না! তাইলে আমার দিক দিয়া আমি কিলিন হইয়া থাকি। দেশিভাই যখন, আমার বাসার নম্বরটা অন্তত- দিয়া থুইয়া যাই। বাস আইসা আমার ইস্টপে থামতে থামতে, আমি তারে আমার বাসার নাম্বার বলি। রাস্তা পার হইয়া- হাতের ডাইনে গিয়া- হাতের ডাইনের চাইরতলা বিল্ডিংয়ের তিনতলা। কি মনে কইরা- সে আমারে তার নাম বলে। তারপর আমার নাম জিগায়। আমার নাম তো রিয়াজুল। অর নাম বোলে রকিব।
বাস থেকে রিয়াজুলের, নাকি রেজাউল- ওই, আই অ্যাম কনফিউজড- নামা দেখতে দেখতে মনে হলো- আরে! এর সঙ্গে তো আরেকটু কথা বলা যেতো! কিন্তু, ও থাকতে থাকতে এ-কথাটা আমার মনেই আসে নি! বা আমিই মনে আসতে দেই নি যে, আরেকটু কথা বলা যেতে পারে! বাঙালির সঙ্গ খোঁজার জন্য কি এখানে এসেছি আমি? তাইলে বাংলাদেশ আছে- কোন প্রয়োজনে! ওইসব দেশি ভাইবন্ধু খুঁজে বের করে- একটা কর্ণার বানিয়ে- মিনি বাংলাদেশ দাঁড় করানোর ইমোশন- আমি ফিল করি নাকি? নাহ্, করি না তো! তাই রিয়াজুলের সঙ্গে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না। ত্রিয়েস্ত আর এমন কী বড়ো শহর! ডাউন-টাউন কী পিয়েৎসা ওবেরদানে- কোনো না কোনো উইকঅ্যান্ডে দেখা হয়ে যাবেই। এই সাতদিনে দেখা গেছে- যখুনই ডাউন-টাউনের দিকে আসা গেছে- ঘুরে-ফিরে অনেকবার- একটা-দুটো মুখের সঙ্গে দেখা হয়েছে! আর একই রুট ধরে যখন আসা-যাওয়া চালাতে হবে- দেখা হয়ে যাবেই। ওফ! এই ব্যাপারটা- এখনই মনে করে-আমার অশান্তি লাগছে! আমার কোনো বঙ্গদেশী দরকার নেই! একজনও দরকার নেই! আমি কমপ্লিটলি বঙ্গভাষা ব্যবহার না-করার পরিস্থিতি পেতে চাই! অনেক হয়েছে বঙ্গভাষা ব্যবহার। অনেক হয়েছে বাঙালির মুখ দেখা, বাঙালি দিয়ে ঘিরে থাকা। বাট লুক রকিব- হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ দ্যাট ইয়ু কুডন্ট ফরগেট অ্যানি থিং। সাতদিন হলো তো। হাজার মাইল দূরে আসা হলো তো- ঘোর মনোযোগ দিয়া পড়া শুরু করে দেওয়া তো হলো! এই সাতদিনে মনে হলো- বাসার সকলের কাছ থেকে-সাত আলোকবর্ষ দূরে চলে আসা হলো! মনে মনে চলে আসা হলো! কিন্তু যেগুলো থেকে দূরে চলে আসার জন্য অ্যাডামেন্ট হয়ে উঠেছিলাম, সেগুলো আমার মধ্যেই আমার সঙ্গেই পায়ে পায়ে চলছে। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার তো! বিষয়টা মনে রাখতেই চাই না। বাট নাউ মাই রিয়ালাইজেশন এমন যে, ওগুলো আমার রক্তকণা হয়ে গিয়েছিলো! এখন, ওই রক্তকণা ঝরিয়ে ফেলে নতুন রক্তকণা বানাতে কতোদিন লাগবে? কতোদিন! হেই অ্যাড্রিয়াটিকÑ ডু ইয়ু হ্যাভ এনি আইডিয়া হাউ লং ইট উইল টেক? অ্যাড্রিয়াটিক কি আমার কথা শোনে, শুনতে পায়?
অ্যাড্রিয়াটিক- এই তো আমার বাঁয়ে! ওকে বাঁয়ে রেখে চলতে চলতে শেষে মিরামারে- লাস্ট স্টপ! অ্যাড্রিয়াটিকের একদম পাশে- আমার য়্যুনিভার্সিটি। ডাউন-টাউন থেকে অনেকখানি দূরে। ওই যে রিয়াজুল ছেলেটা নেমে গেলো- রাইয়ানোতে- ওখান থেকেও বেশ দূরে। ডাউন-টাউনে আজকে আসাটা-একেবারে অকারণেই ছিলো। ক্লাস শেষে মনে হলো, যাই! একটু চেনাশোনা হয়ে আসি ডাউন টাউনের সঙ্গে! জাস্ট একটু হ্যালো বলা আর কী মনে মনে, পথ-ঘাটগুলোকে! শহরের গন্ধটার সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার হয়ে ওঠা! এই আর কী! ঘুরতে ঘুরতে বাসস্টপের কাছে যেতে যেতে দেখি, বাস ছেড়ে দেয় দেয়! বাস থার্টিসিক্স। ওহ! ওটাকে মিস করলে ফের বিশ মিনিটের ধাক্কা! দৌঁড়ে উঠে যাওয়া ছাড়া- দেয়ার ওয়াজ নো আদার ওয়ে! কিন্তু উঠে – তাল সামলাতে না পেরেই তো- ওই ঝক্কিটা বাঁধলো!
তো স্যরি বলো আর অ্যাপোলজি যতো করো- সে লোকের বিড়বিড়ানো বকা দেওয়া থামে না। আরে! দুষছে কাকে! শ্রীলঙ্কানদের। ফানি। আই নো, মাই কমপ্লেকশান এই ধারণা মনে আনতে পারে, খ্বুই পারে যে, আমি শ্রীলঙ্কান। ইট ইজ ডার্ক – ভেরি ডার্ক! দেশে থাকতে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি! কিন্তু যেই দুবাই থেকে রওয়ানা দিলাম ত্রিয়েস্তের দিকে; আমি জিজ্ঞাসিত হওয়া শুরু করলাম- শ্রীলঙ্কান? আচ্ছা! এরকম বাংলা বানানো শুরু করেছি আমি? জিজ্ঞাসিত হওয়া শুরু করলাম! হা হা হা! আমরা এভাবে বলি? নয় কেন! আম্মাকে ফোনে বলবো এই কথা। আর বলবো- পার হয়ে এসেছি তো! তুমি এখন নির্বিঘ্ন মনে করো আম্মা- নির্ভাবনা হও। উহু! হলো না! এখানে বলতে হবে, ভাবনামুক্ত হও। কিন্তু কেনো বলা যাবে না- নির্ভাবনা হও! নির্ভাবনা হও- বলাটা অনেক বেশি জোরালো শোনায় না, ভাবনামুক্ত হও বলার চেয়ে? যা খুশি তা হোক গে। তো, বাসের ভাইজান আমাকে ঠেসে বকা দিচ্ছিলো শ্রীলঙ্কান বলে। ফানি। দেন ইট মেড মি ইগার টু মেক হিম সারপ্রাইজড। সে কারণেই বাংলা বলা! দেখি না কী করে! কী করে আবার! হতভম্ব হয়ে যায়! হা হা হা। পার হয়ে আসার পরে, আবার, বঙ্গভাষীর বেষ্টন আমাকে নিতে হবে কেনো! আই হেইট আই হেইট আই হেইট য়্যু বাংলাদেশ- মাই লাভÑ মাই লাভ- মাই লাভ-
আম্মা খালি বলতেন- তোকে আল্লা আল্লা করে- পার করতে হবে এইখান থেকে। আল্লা! আমার বাচ্চাটাকে নিরাপদে পার করতে দিয়ো। আমি কি ঘোর ঝঞ্ঝার কালে অথৈ নদীতে পড়েছিলাম নাকি? কোথায় ছিলাম! কোথায়! আমার দেশে। বাংলাদেশে।
বাস তেনে নামোনের এক সেকেন আগে পর্যন্ত মনে অয় নাই যে, আমার এহন বাইত যাইতে মোন চাইবো না। পুরাটা দিন কাম করতে হইছে- কম্পানি পাঠাইছে ডাউন-টাউনের শেষ মাথার একটা বাড়ির কামে। আমি করি ওয়েল্ডিংয়ের কাম। সারাটা দিন খাড়ার উপরে! ঝালাই দেও জোড়া দেও। কাহিলের উপরে দিয়া কাহিল হইয়া গেছি গা! অন্যদিন হইলে তো রুমে গিয়া ধুপ্পুস। এহন মনে অইতাছে, একটা রেস্টুরেনে বইয়া এট্টু কাফি খাই! নাকি হাঁটমু! পোলাটার বেবহার আমার মিজাজটা গা›ন্ধা কইরা দিছে! উয়ে ফুটানি করলো না? ল্যাখাপড়া জানোনের ফুটানি? আরে! আমরা কমলা মানুষ আছি- একেকজোনে কত্তা ট্যাকা কামাই করি- দেশের হিসাবে! খেয়াল করবি তো! ল্যাখাপড়া আমাগোও হইতো না, বাও মোতন চললে? বাও মোতন চলোনের উফায় আছিলো- সম্বন্ধীর পুতের দেশে !
চৈত মাসের বিয়ানবেলা- আমি খাড়াইয়া রইছি গোলাপ জাবুন গাছের সামনে। হায়রে ফুলের ফুল, গাছে! ফুলের গন্ধ কী! কালা কালা ভোমরার ভোনভোনানি কী ! ফুলে ফুলে! আমি মায়রে ডাক পারতাছি; ‘অ মা! মা গো! এদিক আহ । দেইক্কা যাও। এইবার দুনিয়ার গোলাপ জাবুন অইবো গাছে!’ এইর মইদ্যে বাবায় কামে যাওনের লেইগা মেলা দিয়া- আমারে কয় কী, ‘অই রিয়াজুইল্লা! এট্টু পর দশটার সোমে নয়াপাড়া যাবি।’ নয়াপাড়া ভইরা হুসিয়ারি আর ডাইংয়ের দোকান! আমি অইনে গিয়া কী করমু? বাবায় কয়, ‘ অইনে গিয়া হোসেন মিয়ার ডাইংয়ের দোকানে কামে লাগবি তুই!’
আমার ইস্কুল আছে না?
‘আউজকার তেনে তর পড়া বন।’ কইয়া বাবায় কামে মেলা দেয়। বাবায়ই যুদি কামে লাগাইয়া দেয়, তাইলে আমার আর করোনের উফায় থাকে কী! আমার দশ ভাই। সব এমা-ডেমা- পাই -সিকি! একটার পিঠে আরেকটা। মাইয়া মাইয়া করতে করতে বাবায় বোলে বেচইন হইয়া গেছিলো! কিন্তুক বারে বারে খালি পোলা। মায় কয় যে, এই কইরা কইরা দশ জোন হইয়া গেলো, কিন্তুক মইয়ার নামগন্ধ নাই। মাইয়া নাই দেইক্ষা – বাড়ির আলিক্ষিও ছোটন নাই। আমি পাঁচ নম্বরে। সবার বড়ো যে- মিয়া ভাইয়ে- ভাদাইম্মা! কামে-কাইজে হের বোলতে মোন নাই! মেজু ভাইয়ে খালি দরগাত দরগাত ঘোরে। তাগো পরের দুইজনে – দর্জির দোকানে সিলির কাম শিখে। আমার ছোটোটি খালি ঘুরাঘুরি করে। তার মইদ্দে একলা আমারে- মায় ইস্কুলে দিছে। ফাইবে উইট্টা সারি নাই- হেইর মিদে বাবায় কয়- ডাইংয়ের কামে গিয়া লাগতে। লাগলাম। দিন-রাইত ডাইংয়ের ফ্যাট্টরিতে কাম। ল্যাখাপড়া কতোদিন হইলো ছাড়ছি? আরে ছোবান্নালা! বহুত বহুত দিন। পোলাটা- রকিব কইলো না নামটা- পোলাটা মনে লয় আমার বয়সী হইবো! অর লগে আর কোনো দেশি পোলা আইছে নাকি পড়তে!
এই ত্রিয়েস্তে – আইসিটিপিতে- পড়তে আসাটা কী রকম জটিল-ঘোরালো-অসম্ভব একটা ব্যাপার হয়ে উঠতে যাচ্ছিলো! আমার ইচ্ছেটা ছিলো ইউএসএ- তে যাওয়ার। জনস হপকিন্স আমাকে যেতে ডাকছে, গ্রান্ট দিচ্ছে- মন ভরে যাওয়ার মতো- যাই ওখানেই? আম্মা খালি বলে, ‘না! আগে ইউরোপ ঘুরে যা। আইসিটিপি ঘুরে যা!’ আচ্ছা। জনস হপকিন্স তবে এ-বছর বাদ। আমি আইসিপিটিতে যাওয়ার জন্য- কাজ করা শুরু করি। আশ্চর্য কান্ড! তাই নিয়ে কথা কথা কথা! কতো রকম কথা! আমার ক্লাসমেটদের- স্যারদের- কী অন্য ডিপার্টমেন্টের কতোজনের! কি রকম কথা সেইসব? হা হা হা! মনে পড়ে, সব মনে পড়ে!
আরে রকিব তো চাল মারছে। ইউএসএ হইলে কেউ আবার ইতালি যায়?
অই রকিব অই! সত্যি যদি জনস হপকিন্স অফার দিয়া থাকে- সেইটা ছাইড়া তুমি ইতালি যাইতাছো? এট্টু বেশি চাপা দিয়া দিছ না?
হয় নাই, হয় নাই- মিছা ফুটাইছে! একটা চাল ঝারছে-
ওয়াল্ডের বেস্ট জায়গাটা রাইক্ষা- আইসিটিপি পাড়াইতে যাবে- এইটাতে কী বুঝায়-সেইটা তো গাধায়ও বুঝে! হি হি হি।
“আম্মা আম্মা দ্যাখো, এইগুলি আমাকে শুনতে হচ্ছে- ক্যাম্পাসে ঢুকলেই- শুনতে হচ্ছে! তোমার জন্য তোমার কথা শুনে!” আমি গোঙাই, রাগ ঝারি। ‘এসব কানে তুলতে হয় না! আগে পার হও- পার হয়ে নাও- তারপর পেছনে ফিরে দেখো।’
স্যারদের রিকমেন্ডশন নেওয়া তো লাগে! আমি টেবিল টেনিস বলের মতো ঝটকা খেতে থাকি- নানান রকম মতের ঝটকা! স্যারদের মত। সিনিয়র মোস্ট স্যার ড. আজাহার আলী। আমাকে স্যার কথা শেষ করতে দেন না। হাউ হাউ করে ওঠেন। নো নো- আইসিটিপি ইজ নট অ্যা ম্যাটার অফ জোক। তুমি সেখানে সারভাইভ করতে পারবা না।
জ্বী স্যার, কোনো?
ওদের সিস্টেমটা উন্নত। পড়াশোনার লোড আনইমাজিনেবল। ইয়ু কান্ট সারভাইভ হিয়ার।
ড. শামসুল আলম কী সহজে দেবেন, না পরিস্থিতি কঠিন করে তুলবেন? আমি অনুমান করতে পারি না। তাঁর কাছে যাই।
ওয়েল রকিব! এখন বাইরে যেতে চাইতেছো ক্যান?
পড়ে আসি স্যার।
বোঝলা,ইটস অ্যা রং স্টেপ! হোয়াট ইয়ু আর গোয়িং টু ডু- আমি তো বলব রং ডিসিশান। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইছ। এখন দেশে মাস্টার্সটা করো। পরে ফিরে আসলে ডিপার্টমেন্টে হোল্ড থাকবে না- জয়েন করতে পারবে না। চাকরি পাওয়া কঠিন হবে। রিসার্চ করতে চাইলে জয়েন করেও যাওয়া যাবে। চাকরিটা আগে। রিচার্স কিছু লাফায়ে চলে যাচ্ছে না। খেতে তো হবে, নাকি?
ঠিক! আমি তো না-খেতে পাওয়া জাতি। আমার আবার হায়ার স্টাডিজের স্বপ্ন দেখা কী! আম্মা, আমার ছিঁড়ে- ফেঁড়ে যেতে ইচ্ছে করে! আমি যে ছেলে – সেটা আমার মনে থাকে না। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই, না? আমার চোখ দিয়ে ঝপঝপিয়ে পানি ঝরতে থাকে। জ্ঞানে আমাদের কোনো দরকার নেই- কিচ্ছুর দরকার নেই- শুধু খাওয়া দরকার।
‘দাঁড়া দাঁড়া- একটুখানি। পার হয়ে নে! তারপর- তারপর দেখিস!’ আম্মাও আমার সঙ্গে কাঁদতে থাকে।
ডায়িং ফ্যাট্টরিতে কামে তো লাগলাম! সারাদিন অইনে খালি -শাটে গেঞ্জিতে ছাপ্পা দেও- সাইজ করো- মাল সাপ্লাই লও আর দেও। কামে কামে দিন যায়। সন্ধ্যাকালে বাইত আসলে পরে, দোস্ত-বন্ধুগো লগে, এট্টু টাইম পাস তো করোন লাগে! অগো লগে কথাবার্তা, রং-তামাসা করতে করতে একেকদিন- রাইত বাইজ্জা যায় দশটা এগারোটা। মায় ভাত লইয়া বইয়া বইয়া ঝিমায়, আর আমার লেইগা রাস্তা চায়।
‘এত্তা রাইত করোনের কাম কি তর, রাস্তায়?’ মায় আমারে ঝামটা মারে।
“দোস্তগো লগে এট্টু চলাচলতি করোন লাগবো না নি আমার?” আমিও লগে লগে মায়েরে খেঁজি দেই।
বিত্তান্ত শেষ অয়, কিন্তুুক য্যান শেষও অয় না। সেজু ভাইয়ে টেইলারিং কাম – এই কয় বছরে যা শিখোনের শিইক্ষা -নিজেই অখন এক দোকানে মাস্টারের কাম করে। সেয় যা পায়- হেইটা দিয়া কোনোমতে দিন চলে! কিন্তুক আমি দেখি যে, সেয় বাইত খাওন-দাওন আনোনের ধুম ফালাইয়া দিছে। একদম বহুত ঘনঘন সেয় অইটা করতাছে! এই না শবেবরাত আসছে! হেয় ধুম কইরা নিয়া আসলো তেরোটা মুরগি- ছয় সের পোলাওর চাইল- হাবিজাবি -বহুত কিছু! কতা নাই বার্তা নাই -ঘরের সবটিরে সেয় সিনেমা দেখতে লইয়া যাইতাছে! যহন-তহন লইয়া যাইতাছে! শাটের উপরে শাটের- কী বাহার হের! খালি হেয় ট্যাকা লাড়ে-চাড়ে! ট্যাকার উপরে ট্যাকা। দরজি কামে এত্তা ট্যাকা কুনদিক দিয়া আহে! রাস্তাঘাটে বাইর হইলে- দোস্তবন্ধুরা কেমুন জানি আওয়াজ দেয় আমারে, ‘কিরে? ফুইল্লা তো তরা হাত্তি হইয়া যাইতাছস গা!’
কিয়ের হাত্তি!
অরা যে কী কয় – অরাই বোঝে! আমারে তারা সবকতা ভাইঙ্গা কওনের আগেই- এক সন্ধ্যা রাইতে পুলিশ আইসা- খেও দিয়া আমাগো বেবাকাটিরে ধইরা – ভ্যানে তোললো। আমরা দোস্তবন্ধুরা হগলটি খালি গিয়া তহন রাস্তার মোড়ে খাড়াইছি, পুলিশ আইয়া দমাদম মাইর দিয়া, গাড়িত ঠেইল্লা দিলো। ক্যান আমরা আরেস্ট হইলাম? পুলিশের কাছে বোলে খবর গেছে- কোন এক ডাকাতি মামলার আসামি বোলে হইতাছে- এই পাড়ার চ্যাংড়া পোলাপাইনটি! হাজতে পইড়া পইড়া আমাগো দিন যায়; আর তারিখের দিন আমরা কোমরে দড়িবান্ধা হইয়া কোর্টে যাইতে থাকি। মোটা মোটা শিকের ঘের দেওয়া একখান খাঁচার মোতন খুপড়ির ভিতরে ঢুইক্যা- জজ হুজুরের দিকে দুই হাত জোড়া কইরা খাড়াইয়া থাকি, কিন্তু বিছার আর আগ্গায় না! খালি টাইম পড়ে খালি টাইম পড়ে। এমনে সেমনে একবছর যায়- কোনো বিছার নাই, খালি টাইম পড়া ছাড়া-আর কোনো কারবার নাই! আমাগো সবটির বাবায় মিল্লা- আমাগো সবগিলির লেইগা – একজোন উকিল রাখছে! য্যান হেই মিয়ায় আমাগো জাবিন লইয়া হেয়! কিন্তুক হেই উকিলে কই যায়,কী করে, কী কয়,কী বোলে! আমাগো জাবিনের কোনো খবর নাই! আমরা হগলটিয়ে খালি হাজত খাইট্টা যাইতাছি তো যাইতাছি! হাজতে কুকড়ি-মুকড়ি খাইয়া হুইয়া থাকতে থাকতে কাইন্দা জারেজার হই। আরে! এইটা কী বিষয়- আমারে ক্যান হাজত খাটতে হইতাছে!
আমি ফিজিক্স পড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলাম। যেতে হবে তাত্তি¡ক জ্ঞানের পথে! মেঘরাজ্য না-ছোঁয়া পর্যন্ত থামবো না- এই হচ্ছে আমার জন্য আমার পণ। আমি যে একটা মারাত্মক অন্যায় করে ফেলতে যাচ্ছি- সেটা ভর্তি পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে ঢুকেই – বুঝতে পেরেছিলাম। আমার অপরাধ বা অন্যায় এই যে, আমি ইউনিভার্সিটিতে আমার একমাত্র পছন্দের বিষয় হিশেবে নিতে চাচ্ছি – ফিজিক্স। পিওর ফিজিক্স। ভাইবা বোর্ড টুকরা-টাকরা হাসি দিয়ে দিয়ে- আমার পাগলামির তল মাপা শুরু করে। দুই দুইবার স্ট্যান্ড করা ছেলে- ফিজিক্স পড়তে আসবে কেনো! তার জন্যে তো পশ সব সাবজেক্ট অপেক্ষা করে আছে! সে কম্পিউটার সায়েন্স পড়বে, নয় পড়বে ফার্মেসি, নয় অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স। নয় মাইক্রোবায়োলজি। ফিজিক্স! হোয়াই ফিজিক্স!
হ্যালো! হ্যাভ ইউ গন ক্রেজি ! ফিজিক্স নিতে চাও!
দ্যাখো ছেলে- হ্যাভ ইউ কাম ফ্রম আ রিমোট ভিলেজ? ঢাকায় তোমার কেউ নাই – পরামর্শ দেওয়ার? ভালো সাবজেক্ট কোনটা, সেইটা বলার কেউ নাই তোমার?
ফিজিক্স কেন নিবা তুমি? এর চাকরির ভবিষ্যৎ কি?
ডাবল স্ট্যান্ড একটা ছেলে ফিজিক্স নিয়া ভবিষ্যৎ মাটি করতে চায়!!!
রকিব নিরুত্তর থাকে। ফিজিক্স পড়লে ভবিষ্যৎ মাটি হয়! রকিবের তো ফিজিক্স ছাড়া নো আদার চয়েস। রকিব ফিজিক্স চায়- হি ওয়ান্টস টু বি স্পয়েল্ড ইন দিস ওয়ে। রকিব ফিজিক্স চায়! ভাইভা বোর্ড ওর অই বেকুবি দেখে বিদ্রূপে হেসে ওঠে আবার! জনা দুই আফসোস করে! দু-একজন শেষবারের মতো- ওর মত ফেরাতে চায়! তারা একটু কেমন ভীতি প্রদর্শনের পথ ধরে আগায়!
‘এখন তো বুঝতাছো না। পরে কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও সাবজেক্ট বদলাতে দিবো না তোমাকে। তোমার নাম রোল নাম্বার-সব মার্ক করে রাখলাম।
পরে কিন্তু ভালো বিষয়ে যাবার আর চান্স পাবা না।
এই শেষবার সুযোগ দেওয়া হলো- নিবে কম্পিউটার সায়েন্স?
রকিব ফিজিক্স চায়। হেই ফিজিক্স! হেই! হ্যাভ ইউ হার্ড হোয়াট দে সে- তোমার সম্পর্কে! তুমি রাগ কোরো না শুদ্ধতম জ্ঞান! রকিব তোমাকে চায়। কিন্তু রকিবকে কী বিড়ম্বনা ঘিরে ফেলে দ্যাখো! ক্লাস শুরু হবার পর- সকলে তাকে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ডিপার্টমেন্টের মামুরা দেখে, ক্যান্টিনের ক্যাশিয়ার দেখে, বয়-বাবুর্চি দেখে। দেখে, আর চোখ ছানাবড়া করে। মাথা গরম নাকি ছেলেটার! ভালো ভালো সাবজেক্ট রেখে কিনা- সে আসছে রদ্দি-মদ্দি ফিজিক্স ঘাঁটতে। ওহ! আমি পারছিলাম না- পারছিলাম না – ওইসব চাউনির বিদ্রূপ সহ্য করতে! ফিজিক্স পড়তে চাওয়ার অপরাধের কারণে যে দন্ড আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিলো- আমি পারছিলাম না সেটা সহ্য করতে। ওহ! আম্মা! এটা আমি কোথায়! কোথায়! আমি বাংলাদেশে।
জিয়োগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট থেকে দলেবলে পোলাপান আসতে থাকে! নব্য আঁতেলের খোঁজ করতে আসে তারা! কেমিস্ট্রির দঙ্গল হি হি করে ওঠে! ইন্টেলেকচুয়াল অফ নিউ এরা! ওই যে যায়। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি গলায় অদ্ভুত আওয়াজ তোলে! মাইক্রোবায়োলজি হাঁক দেয়; আঁতলামি আঁতলামি…।
“আম্মা- আম্মা! এরা এমন করে কেনো! আমি কীভাবে পড়বো এখানে!”
‘একটু সহ্য কর- একটু পুরু কর চামড়াটা, কালো! একটু!’ নিবিড় দুঃক্ষের দিনে আম্মা আমাকে এই নামে ডাকে। আম্মা- তোমার কালো- তার চামড়াটা পুরু করে নেবে- গন্ডারের মতো পুরু!
‘তোকে আগে পার করি -এই আন্ধার সুড়ঙ্গ! তারপর রাগ করা যাবে- কালো।’
টিটকারিগুলো আমার ওপর আছড়ে পড়তে থাকে! এদিক থেকে ওদিক থেকে- পড়তেই থাকে ননস্টপ। ওহ! অ্যাম আই গোয়িং টু বি সামথিং লাইক জড় প্রস্তর! টিটকারি সহ্য হয়ে যায় আমার! সহ্য হয়ে যায়! হাউ কাম!
জামিনের লেইগা রাস্তা গোণতে গোণতে, শেষে, হাজতের মোশার কামড়ও সহ্য হইয়া যায় আমার। না-ফুরাইতে চাওয়া দিনগুলাও সইজ্জ হইয়া যায়! এমুন সোমে আঁতকা খবর আসে- মামলা বোলে খারিজ হইয়া গেছে। কিসের মামলা ক্যান খারিজ হইলো ক্যামনে খারিজ হইলো- কিছুই বোঝার উপায় নাই। খালি এক বচ্ছর সাত মাস বাদে বাইত আইলাম আমি- হাড্ডিকাটা সার হইয়া। হাজতখাটা দাগী এক ঢ্যাঙা বেটা হইয়া।
আমি কিনা হালার জেলে দিন পার করি কাইন্দা-কাইট্টা,ওদিগে বাড়িত আইয়া দেহি যে, বাড়িত বহুত চমচমি চলতাছে! বেশুমার খাওন-লওন হইতাছে! দুনিয়ার নয়া নয়া কাপড়চোপড় কিনা হইতাছে- অহন তহন! সব সেজু ভাইয়ে করতাছে। হেয় বোলে- কিয়ের ব্যবসা ধরছে। দর্জি কাম থুইয়া সেয় কিসের ব্যবসা করে! হেয় বোলে- কিয়ের ব্যবসা ধরছে। দর্জি কাম থুইয়া- সেয় কিসের ব্যবসা করে! আমি তারে জিগাই! সে কয়, ‘আছে। তর হোননের কাম কি?’ তাইলে আমি আর জিগাই ক্যান! অন্য সকলতের লগে লগে তাইলে- আমিও খালি খাইয়্যা যাই।
বাড়িত কী রান্ধার ধুম রে বাবা! এই দুই ডজন ডিমের কোরমা রানতাছে মায়! এই ছয় সের গরুর গোশত। গোশতের লগে খাওনের লেইগা- দুনিয়ার পারটা বানানী হইতাছে। আমি খাই-লই, আর টাউনে গিয়া কাম বিছরাই। আগের ডায়িং ফ্যাট্টরি আমারে কয় যে, হেরা আর আমারে নিবো না! তাও আমি রোজই গিয়া-তাগোই ধরাধরি করতে থাকি। বেহুদা কতখোন তাগো ধরাধরি কইরা – আমি সিনেমা হলের ভিতরে যাই। হেইনের পুস্টারটি ভালামতন দেইখ্যা- আমি হেইরপর দোফরের টাইমে বাইত আহি! আইয়া, ধুম-ধাড়াক্কা খাওন খাই! আরে আল্লারে! দুনিয়ার খাওন!
আমারে খাওন বাইড়া দিতে দিতে মায় কয়, ‘অইবো নে কাম! আউজকা না অয় কাউলকা অইবো। তুই বেজার অইয়া থাকিস না!’ হেই দিন দোফরেও কামের লেইগা বেহুদা ধরাধরি কইরা, সিনেমা হলে ঘোরান দিয়া,আমি বাড়িত পাও দিয়া দেখি-বাড়ি ভইরা কুদাকুদি চলতাছে! ঘরের জিনিসপাতি সব ছন্নভন্ন! হাড়ি পাতিল উল্টাইন্যা! আর উঠান ভইরা পুলিশ।
সেজু ভাইয়েরর দোস্ত জালাইল্লার কোমরে দেহো- দড়ি বান্ধা। সেয় কতোক্ষণ পরপর পুলিশের রুলের বাড়ি খাইতাছে, আর চিক্কার দিয়া উঠতাছে। কি হইছে কি- বিষয়টা? আমাগো বাইত পুলিশ ক্যান! জালাইল্লায় আমারে দেইক্ষাই কয় কী, ‘পুলিশ ছার- কইতাছি-কইতাছি- এই হইলো আমার ফেনছি ব্যবসার পাটনার!’
আয় হায়! আমি কবের থেইক্যা ফেনছিডিলের কারবার করা ধরলাম! জালাইল্লায় এটি কয় কী! আমি কই, “অই শালার পুত, এইটা কি কলি? আমি তর লগে ফেনছির ব্যবসা করি!” কিন্তুক তহন কে কারে কথা কইতে দেয়!
আমার কোমরে আবার দড়ি পড়ে! ঠেইল্লা লাত্থি দিয়া- পুলিশে আমারে গাড়ির ভিতরে ফিক্কা দেয়! শালার পুতের দেশ! কার মাইর- কার উপরে দেও তুমি! সেজু ভাইয়ের এত ট্যাকার চমচমির পিছে তাইলে এই বিত্তান্ত! পুলিশে আমাগো পুষ্কুনীতে খেও দিয়া- গাট্টি বান্ধা ফেনছিডিলের বোতল তুইল্লা আনে। মামলা পাকতে কতোক্ষণ! তয় হাতে- নাতে ধরতে পারে নাই তো! সেই কারোনেই এই-সেই কইরা কইরা- ছয়মাসের মাথায়-জাবিন পাওন গেলো। অখন তারিখে তারিখে গিয়া কোর্টে হাজিরা দেও। কিসের মইধ্যে যে পড়লাম- এই শালার পুতের দেশে!
জাবিন লইয়া আহোনের পর -আরেক মুসিবত আইয়া খাড়া হয়। আমাগো মইল্লার যেই পোলাপাইনটি- এই হেইদিনও গুঁড়াগাড়া আছিলো; আতকা কেমনে জানি অরা ডাঙর হইয়া উইট্টা আমারে কয়; ‘মালপানি ছাড়!’
কিয়ের মালপানি?
‘ফেনছি দিয়া কামাইতাছো না? তুমি একলাই লাল অইবা নি- পুঙ্গির পুত?’
রাস্তা দিয়া হাঁটতাছি- হাঁটতাছি- আতকা কথা নাই বার্তা নাই, কোন মহল্লার জানি- কত্তটি ড্যাকরা ছেড়ায় কুঁদাইয়া আইসা খাড়ায় আমার সামনে! কয়, ‘আমাগো দশ বতল ডাইল দেওন লাগবো।’
“কিয়ের ডাইল?” আমি বেবুদ্ধি মোখে জিগাই!
‘আমাগো আতে টাইম কম!’ ড্যাকরাটিয়ে আমারে ধামকি দেয়; ‘ কইতাছি দিতে, এক্ষণ দেওন লাগবো!’
“‘অই তরা কি কস? কইতাছস কি? শালার পুতেরা, আমি ডাইল পামু কইনে?”
‘ডাইল পাইবা কইনে? গুষ্টি সুদ্ধা ডাইলের ব্যবসা কইরা- দুনিয়া ভাসাইয়া দিতাছ, আবার জিগাও ডাইল কই পাইবা? ভালা চাইলে এক্ষণ দেও- দশ বতল।’
“শালার পুতেরা!” আমার ত দেহি আর সহ্য হয় না! “‘অই শালার পুতেরা, দিতাম না তগো ডাইল। দেহি তো কী করস তরা!”
অরা সবটিয়ে মিল্লা -হুড়–ত কইরা- আমার উপরে ঝাইপ্পা পড়ে। ঘুষি কিল গুঁতা লাথ্থি- দিতাছে তো দিতাছেই। আমি একলা কয়টারে খেদামু- কয়টারে কাবু করমু- মানইষেরা দ্যাহো খাড়াইয়া খাড়াইয়া – আমার মাইর খাওন দেখতাছে! একজোনেও নি আমারে বাঁচানের লেইগা আগাইয়া আহে! এইটা শালার কেমুন চুতমারানির দেশ হইয়া গেছে!
ফয়সাল আমাকে বলে যে, দোস্ত তোর ফার্স্ট ইয়ারের নোটগুলা আমারে দে।
“হোয়াই? হোয়াট ইজ দ্যা ইউজ অফ ইট?”
‘আমারে তো দোস্ত – ফার্স্ট ইয়ারের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষাটা দেওন লাগবে! নম্বর দ্যাখ- থার্ড ক্লাসের নম্বরও আসে নাই এইবার!’
“ওহ্। এতো খারাপ করলি কেমনে!” আমি বেদম দিশাহারা বোধ করি। আঁতেল আঁতেল বলে চিৎকার দিতে থাকা সকলের মধ্যে- ফয়সালই একজন- যে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে! ক্লাশে আমার পাশে বসে। আমার সঙ্গে চা খেতে যায়, একসঙ্গে ল্যাবওয়ার্ক করে। উফ! আই অ্যাম গ্রেটফুল টু হিম! ফয়সাল এত্তো খারাপ করলো ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট!
‘কাম অন রকিব! সকলেই কি তুই হবে নাকি? আমরা সকলেই কি তোর মতো? রেকর্ড মার্কসের চেয়ে দশ নম্বর বেশি পেয়ে বসে থাকবো!’ ফয়সাল খুব রাগ করে -আমার সঙ্গে!
আচ্ছা-ঠিক আছে- অই নোটগুলো তো আমার আর দরকার নেই! ওকে দিয়ে দিই তবে অইগুলো! “ কিছু বোঝানোর দরকার হলে বলিস- একসঙ্গে বসবো নে!” আমি ওকে বলি! কিন্তু ফয়সাল কতোটা পড়তে থাকে, আমি খোঁজ নেবার সময় পাই না। ও সামলাতে যাচ্ছে ওর ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা- আমার তো সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল। ওফ, কোনো যে পরীক্ষা দিতে হয় ছাত্রকে! সিস্টেমটা বদলানো যায় না? আই ডিসলাইক ইট। তবুও তো মাথাগরম না-করে,সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল শেষ করতে হলো! রেজাল্ট এখন যবে আসেÑ আসুক! থার্ড ইয়ার ক্লাশ যে দৌড়ুনো শুরু করেছে, গড!
এদিকে সে-এক কান্ড! ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো আমার। যে মুখের স্বপ্ন আমি দেখি- ফিজিক্সের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে- সেই মুখ! আম্মা য-মুখকে বলে পানপাতা মুখ- সেই মুখ-এইখানে আমার ডিপার্টমেন্টে! তার নাম লাবনী। ক্লাশে যাওয়া, ল্যাবে ঢোকা, লাইব্রেরিতে কাজ করা-সবকিছু ঢের বেশি ভালো লাগার হয়ে ওঠে! ওইখানে লাবণী আছে যে! কিন্তু আমি কি করে ওই মেয়েটিকে- এই কথা বলি? কেমনে করে বলি! কেমন করে বলতে হয়! শিট! আই ডোন্ট নো দ্যা ওয়ে! শিট। হোয়াট অ্যা অপদার্থ আই অ্যাম! আমি আমার ভেতরে গোমড়াই। কিভাবে কাছে যেতে হয়? কীভাবে!
আহ্ ন্যাচার! আই অ্যাম থ্যাংকফুল টু ইয়ু! দূরকে তুমি কীভাবে নিকট করো! ইন্টারেস্টিং! লাবণী নিজে নিজেই আমাকে এসে বলে, ‘ভাইয়া, ফিজিক্স পড়তে আসছি। কিন্তু অনেক কঠিন লাগতেছে! আপনার হেল্প না হইলে আগাইতে পারবো বলে মনে হইতাছে না।’ দূর এসে পৌঁছায় কাছে! কিন্তু লাবণী কেমন ভাষায় কথা বলে। এটা কেমন বাংলা! এটা কেমন বাংলা! আমার কানে সহ্য হতে চায় না! ওকে! সব ঠিক করে নেওয়া যাবে। কিন্তু লাবনীকে কখন সময়টা দেই! আমার পড়া আছে না! থার্ড ইয়ার ফাইনাল ঘনাচ্ছে না? কিন্তু সময় তো দিতে হবে। ওয়েল! সপ্তাহে তিনদিন লাইব্রেরি ওয়ার্ক বাদ। আমি পুরো বিকেল ভরে লাবনীকে পড়াই। পুরো ক্যাম্পাস জেনে যায়, রকিব লাবনীর জন্য উতলা! লাবনী জানে না ক্যানো! সারা ক্যাম্পাস আরো কতো কী জানে রকিবের বিষয়ে! রকিব সে-সব জানে না ক্যানো!
ক্যাম্পাস জানে, ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের কাছে- রকিব তার ফার্স্ট ইয়ারের নোটগুলা বিক্রি করছে- খুব ভালো রেটে বিক্রি করছে! অলমোস্ট সব স্টুডেন্টই খাচ্ছে অই নোট! লাস্ট দুবছর ধরেই খাচ্ছে! এবার যে ফার্স্ট ইয়ার এসেছে- তারা একেবারে শুরু থেকেই অই নোটগুলা- হন্যে হয়ে খুঁজছে। তবে রকিবের চক্ষুলজ্জা আছে। সে নিজে নোট বেচাবিক্রির কাজে নাই! রকিবের হয়ে ওগুলো সেল করছে ফয়সাল। বন্ধুর জন্য কাজ করে দেওয়া আর কী! আঁতেল হলে কী হয়, ধান্দাটা ভালো জানে রকিব! টাকা আর্ন করার যেই ফন্দিটা বের করেছে সে! তার বুদ্ধির তুলনা নাই!
ফয়সাল রকিবের নোটগুলা বিক্রি করে, পকেটে টাকা তুলতে তুলতে, সবকথা শোনে। শুনে ঠা ঠা হাসে। শালা আঁতেল! দ্যাখছো ধরা খাওয়া কারে বলে? তুই শালা এখন-ফয়সালের হাতে ধরা খাওয়া! তুই কারে বিশ্বাস করাবি যে- এইটা আমার চাল!
“আম্মা- এটা আমি কোথায় আছি! কোথায়? ফয়সাল আমার নোটগুলো – পড়ার জন্য নিয়েছিলো! এসব কী হচ্ছে আম্মা! আমি কী করবো- কী করবো!” আমি লাবনীর কাছে যাই। আমার চলতে ইচ্ছে করে না, তবু চলি। আমার মনের কথাটা-আজ ওকে বলা দরকারই ! আজই স্পষ্ট করে বলা দরকার! ও আজ আমার মুখেই সেই কথাটা শুনুক! এতোদিন কথা দিয়ে -যা প্রকাশ করা হয় নি; আজ তার প্রকাশ হোক! এতোদিন আমার চোখ,ওর দিকে আমার ছুটে যাওয়া, আমার ভঙ্গি আমার কণ্ঠস্বর – বারেবারে মিনিটে মিনিটে ওকে যা বলেছে; আজ তার স্পষ্ট উত্তর আমাকে শুনতেই হবে। আমি বলি,“লাবনী! আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
‘এসব আপনি কী বলতেছেন, ভাইয়া? আমার শুনতে খারাপ লাগতাছে।’ লাবনী চেহারা কালো করে- রুক্ষ কণ্ঠে বলে।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি! তুমি বোঝো না?”
‘আমি ক্যান এইসব বুঝবো? আমি আপনারে বড়ো ভাইয়ের মতো দেখি! ভালোবাসার কথা এইখানে আসতাছে ক্যান!’
লাবনী আমাকে বড়ো ভাইয়ের মতো দেখে! ও গড, ও গড ওহ্ গড! বেশ তোÑ দেখতেই পারে! দুজন কী একই সঙ্গে প্রেমে পড়তে পারে? কেনো পড়লো না! কেনো। হোয়াই। হোয়াটস দ্যা প্রবলেম উইথ মি! কেনো! আই লাভ ইয়ু লাবনী! প্রিয়তমা সুন্দরীতমা- হে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার- আমাকে তোমার ভালোবাসা দাও! ‘ওই কালাকুষ্টির সঙ্গে প্রেম! ছেঃ! কথা বলতে গিয়া- তোতলাতে তোতলাতে আমার কানের মাথা নষ্ট কইরা দেয়! ওইটার সঙ্গে কী প্রেম! লাবনী এতো সস্তা না! আরে, হাবাটারে তো খালি পড়া বোঝানের কাজে ইউজ করা যায়! ওইটার বেশী আর কিছু করা যায় নাকি! ওর সঙ্গে প্রেম করতে হবে। ছাগল নাকি!’ অন্যদের মুখে মুখে – লাবণীর মনের কথাগুলো-উড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে! সেই কথারা আমার কাছেও এসে পৌঁছায়! আম্মা বলে, ‘ এই ঘোর সুড়ঙ্গ অন্ধকার তোকে পেরুতে হবে! কালো!’
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, আম্মা! পেরুতে হবে।”
‘টলিস না-টলিস না! খবরদার টলবি না!’
রকিব যদি কষ্টে কষ্টে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে শেষও হয়ে যায় – সেই ছেঁড়াখোঁড়া রকিবকে রকিবেরই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেরোনোর আর কতো বাকি- কতো বাকি!
আফিয়ায় আমারে রোজ দুপুরের টাইমে, অগো বাড়ির, ওর-বরই গাছতলায় যাইতে কয়। এত্তবার হাজতখাটা জেলখানা ফিরত আমি, তাও দেহি উয়ে আমারে দেখলে মুখ মটকায় না! আমারে এট্টুও য্যান ঘিন করে না! উল্টা আমারে দেখলে সেয় হাসি দেয়, আর ডাক পারে। আমি হেষে না-পাইরা একদিন দোপোরের টাইমে, আফিয়াগো, ওর-বরই গাছতলায় যাই! অয়ে আমার লগে কতো বাহারের কথা কয়, হাসি মশকরা করে! আমার খারাপ লাগবো ক্যান! উয়ে কয়, আমি য্যান অরে একদিন রুবেলের- ওই যে হিরু রুবেল- হের একটা পিকচার দেহাইতে লইয়া যাই!
আচ্ছা নিমু। এইটা কোনো ব্যাপার!
উয়ে আমার লগে পিকচার দেহে, এক রিকশায় গাও ঘেঁষাঘেঁষি কইরা- আমরা সিনেমা হলে যাই-আসি, বাদামভাজা খাই- চেনাচুর! আমি বুজতে থাকি যে, এইনে,আমাগো দোনোজোনের ভিতরে, ভাব- ভালোবাসা ঘইট্টা যাইতাছে! হউক না! প্রেম- মোহব্বত না থাকলে কী জুয়ানকি জমে! ঈদে-চান্দে আমি অরে জরজিটের থিরি পিচ কিন্না দেই! এক ঈদে দিলাম পাঁচশ ট্যাকা! এই যে দেওয়া-দেওয়ি! এটি দিয়াই প্রেম- মোহব্বত জমে। আমরা চুমাচুমি খাই, জাবড়া-জাবড়িও বাদ নাই! অম্মা- কিয়ের মইদ্যে কী! একদিন শোনা যায়, আফিয়ার বোলে কার লগে পলাইয়া গেছে গা!
আরে, পলাইলে তো আমার লগে পলাইবো! অর লগে তো আমার প্রেম- মোহব্বত! কিন্তুক আফিয়ায় পলাইলো কার লগে? না! মহল্লার মিদে যেই ছেড়ার বেশি ট্যাকা আছে- অই যে মোহসীন- আফিয়ায় ওইটার লগে পলাইছে! মোহসীনে কয়দিন জানি -কই গিয়া- নাই হইয়া থাকলো! তার বাদে আবার সেয় মহল্লায় আইয়া ঘোরে- খায় লয়! য্যান কিছু অয় নাই! য্যান আফিয়া কেটায় – উয়ে তার কিচ্ছু জানে না!
মোহসীনে তো ফিরা আসলো, তাইলে আফিয়ায় কই আছে? আফিয়ার সন্ধান কেউ জানে না। আর তামশাটা দ্যাখো! আফিয়ার মায়-বাবায় গিয়া কিনা – আমার নামে-নাবালক মাইয়া অপহরণের মামলা দেয়! হায়রে মজা! চুতমারানির দেশের তামশা দ্যাখছো! পুলিশ আমারে বিছরাইয়া – বাড়িঘর ফাতাফাতা করে! আরে- আমি এর কী জানি! আমি কেমনে আসামি হই! কিন্তুক আমি আসামি। তবে এইবার আর আমারে ধরোন খায় না! বহুত ধরা খাইছি! ভালামানষীর কারণে বহুত জোতা খাইছি! অহন আমি কী আর চোখ-নাক-কান খোলা হই নাই! হইছি! শালার পুতের দেশÑ গাদ্দারের গুষ্টির দেশ! মার পিছা! অর নাক মুখ বরাবর-পিছা মার! যামু গা শালার এই দেশ ছাইড়া। হাঁটোন পার্টির লগে ম্যালা দিলে- দেশ ছাড়তে কতোক্ষণ!
আমার কিন্তুক পাসপোটও আছিলো না। এক কাপড়ে এক জোতায়- ছাড়লাম শালার দেশ! এই ইন্ডিয়া দিয়া যাই পাঞ্জাবের দিগে! ধরা খাইয়া জেল খাটি ছয় মাস। পাকিস্তান দিয়া ইরান গেলাম- ইরান ছাইড়া টার্কি। টার্কি থুইয়া রুমানিয়া, রুমানিয়ার বাদে হাঙ্গেরি। বাউন্না বাতাসের মোতন জানপরান হাতে লইয়া লৌড় পারলাম। মার সোনার গয়নাটি যা আনছিলাম- কোন্দিনে হেটি দালালেরা লইয়া গেছে গা! আর আনছিলাম- সেজু ভাইয়ের ফেনছি বেচোনের এক বোন্দা ট্যাকা! হেইগিলিও দালালে – চক্ষের পলকে তুইল্লা লইয়া গেছে। জায়গায় জায়গায়, বাগানে ক্ষেতে, যেইনে পারে দালালে আমাগো কাম করায়! মাসের পর মাস-কাম করাইয়া যাইতে থাকে! এক মাইল আগাইলে- তিন মাস থোম ধইরা বইয়া থাকোনের হুকুম দেয়! থাকলাম। খাটলাম। মনে মনে এই কিরা কাটলাম যে, এই জীবনে ওই শালার পুতের দেশে আর ফিরুন্তি নাই! দেহি এমনে কদ্দুর যাওন যায়! যদ্দুর যাওন যায়, যামু।
রুমানিয়ার আইসা দালাল আমাগোরে কয় যে, যাইতে হইলে- এইর পর – বন্ধ ভ্যানের ভিতরে, লেটকি খাইয়া বইয়া, যাইতে হইবো। এই ছাড়া অন্য রাস্তা নাই। কী সব গোশত-মোশত নেওনের আজদাহা এক ভ্যান। হেইটার চাইর দিগ- ঠাসা বন্ধ! খালি উপরে এক কোণায় একটা এট্টুক গর্ত! কোনোমতে বাতাস ঢোকে কী ঢোকে না- এমুন অবস্থা। তয় যাওন তো লাগবো! সেইটা নিয়া আবার কথা কী! যাওন লাগবো, যামু!
হায়রে ঘুটঘুট্টি আন্ধার! ভ্যানের ভিতরে- হায়রে আন্ধার! মনে হয়, কব্বরের তেনে বেশি আন্ধার। কোণার ছিদ্রি দিয়া, হাছা- মিছা এট্টু বাতাস আহে কী আহে না! সেইটুকই হড়হড়াইয়্যা শইল্লের ভিতরে নেই! চাইর চাক্কার আন্ধার কব্বর যায় যায় যায়! কতোবার দিন গেলো রাইত আসলো, কে জানে! ঘুরঘুট্টি কব্বর যাইতাছে তো যাইতেছে! কই গেছে খাওন- কই গেছে গোছল- কিসের বোলে ঘুম- কিসের বোলে জাগনা থাকা! সব জাবড়া- জাবড়ি কইরা- হইয়া উঠছে নিঃসাড় আন্ধার! এই হুঁশ আছে, এই হুঁশ নাই হইয়া যায়। আহ্হারে! এট্টু পানি যুদি পাইতাম! কব্বর চলে চলে চলে! কোনোখানে থামোন নাই! হায়রে! পানির লেইগা কইলজা ফাইট্টা যাইতে চায়! পানি খামু। পানি খাওন লাগবো। পানি কই পামু। পানি কেমনে পামু! শেষে সগলতে মিল্লা- একদমে পানির বন্দোবস্ত – কইরা ফালায়। চড়চড়াইয়া মোতা ধইরা-একেকজোনে আঁজলায় আঁজলায়- সেই মুত নেয়। মুত খাওন যায় না- কেটায় কয়? খাওন যায় তো! খাওন যায়। পানির মতোনই তো লাগে। মুত মোনে অয় না! পানি পানি লাগে! শেষে একদিন কব্বরের দরজা ফাঁক হয়। আমাগো সামনে অইটা কী দেহা যায়? একখান সীমাছাড়া ধু ধু ময়দান দেহা যায়!
ফয়সাল আমার নোটগুলা বছরের পর বছর ধরে বিক্রি করে চলছিলো! আমার নাম করে করে বিক্রি করে চলছিলো! সকলেই জেনেছে সেই কথা, শুধু আমি জানি নি! আমার জানতে দেরি হলো কেনো! আমি ফেরি হচ্ছি- আমি বিক্রি হচ্ছি- আমি কেনো জানবো না! তাহলে আমি সারভাইভ করার যোগ্যতা রাখি না? আমি তো প্রেম পাবারও যোগ্যতা রাখি না। আমি তবে কি? কি? কোনো আমি! কোথায়- কোথায় আমি!
কারা নাকি আমাকে খুঁজছে খুব করে, কিন্তু একটুর জন্য ধরতে পারছে না! হয় আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছি, ল্যাবে গিয়ে তারা আমার খোঁজ করছে! আমি নেই। ক্লাশ শেষে আমি দৌঁড়ে গেছি বাস ধরতে, তারা ক্লাশের সকলের কাছে- আমার সন্ধান করছে। কারা তারা? তারা পার্টির লোক। শেষে একদিন তারা আমাকে ধরে ওঠে। আমার তখন খুব তাড়া ছিলো। সকালের ক্লাশ আটটায়, আমি ওদিকে আটটা পাঁচ করে ফেলেছি। তখন সিঁড়ি ডিঙোচ্ছি দু’তিনটা করে করে, তেমন সময়ে তারা আমাকে ঘিরে ফেলে! তারা ওপর থেকে নেমে এসে, আমাকে ঘিরে নিয়ে, হ্যান্ডশেকের ওপরে হ্যান্ডশেক করা শুরু করে।
‘আরে ভাই- আসেন চা খাই!’ তাদের প্রধানজন বলে।
“না ভাই, স্যরি! আমার ক্লাশ।”
‘কিন্তু কিছু ইম্পরট্যান্ট আলাপ ছিলো!’ তারা চা খেতে চাওয়ার কারণটা জানায়।
‘চিনছেন তো আমাগো? আমরা দলের নেতা-কর্মী!’ একজন আরো স্পষ্ট হয়।
‘এখন আপনেরে আমাদের পার্টিতে জয়েন করতে হইবো!’
‘একজন ভালো ছাত্র পার্টিতে আসলে – আমাদের ইজ্জত বাড়বে!’
‘কী কী সুবিধা আপনি পাবেন, বলতেছি!’
‘হলে একটা পুরা রুম আপনেরে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। আজকা থেকে।’
‘আপনার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব পার্টির।’
‘এইটা তো একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। ভার্সিটিতে আপনার ঢোকার জন্য- পার্টি সবকিছু করবে!’
‘আপনার টাকা-পয়সার বিষয়টা পার্টি দেখবে। আমরা শুধু আপনারা ফেসভ্যালুটা চাইতেছি!’
‘একটা বাইক আপনার জন্য থাকবে- ফুয়েল কোনো ব্যাপার না!’
‘যদি আমাদের সঙ্গে না এসে, ওদেরটাকে যান! পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে! আমরা আগে আসছি!’
‘হয় আমাদের পার্টিতে, নাইলে কোনোখানে না!’
তাহলে ওরা একটা অপশন রেখেছে – আমার জন্য! হয়তো ভুল করে, নাকি দয়া করে! আমি-আমি – পড়াটা শেষ করতে চাই! আমার ক্লাশ এখন! আমি কি যেতে পারি? তারা শেষ কথা বলে দিয়ে- চলে যায়। তারপর অন্য গ্রুপ আসে। তাদের মুখেও আমার জন্য-একই রকম নিরাপত্তা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশ্বাস- বাজতে থাকে! আমার ফেসভ্যালু এতো! এতো! আমি কোন পথ দিয়ে বের হবো এই ঘের থেকে? এই ঘিরে থাকা থেকে- কেমন করে বের হবো!। ‘ওদের সঙ্গে গলা চড়াস নে কালো! খবরদার রে!’- আম্মা কাঁপতে থাকে, ‘বল- ওদের বলে দে, তুই রাজনীতি বুঝিস না! বল যে, তুই শুধু পড়াটা করতে চাস! আর কিছু চাস না।’
আর কি চাইব আমি? আর কিছু কি চাওয়ার থাকতে পারে!
আমার আগে যারা অনার্স করে গেলো- তারা সব তিন বছরের কোর্স করা গ্রাজুয়েট। আমাদের সেশন থেকে অনার্স কোর্স চার বছরের। আমরা প্রথম ব্যাচ-চার বছরের গ্রাজুয়েশন কোর্সের প্রথম ব্যাচ! ওয়েল! পৃথিবীর অন্য সকলের মতো তাহলে হতে চলেছি আমরা!
স্যারদের অনেকে আমাকে তাদের রুমে যেতে বলতে থাকেন। কেনো? কেনো কে জানে! জুলফিকার হায়দার স্যার কথা বলেন সোজাসাপ্টা! স্যারদের কতো দল, রঙের নামে নাম সব দল। জুলফিকার স্যার খয়েরি -না যেনো কালো দল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান।
‘শোনো রকিব, তুমি ফোর্থ ইয়ারে লেজার ফিজিক্স নিবা। আমার সাবজেক্ট।’ স্যার আমাকে জানায়ে দেন।
“আমি-আমি তো মডার্ণ ফিল্ড থিয়োরি পড়বো স্যার!”
‘দেখো। এইটা আমার প্রেস্টিজ ইস্যু। ওরা আমার সাবজেক্টের পাশে কিনা দাঁড় করায় মডার্ন ফিল্ড থিয়োরি! এই সাবজেক্টের কোনো বাজার আছে? এইটা পড়লে ভাত পাবা না!’
“ আমি স্যার-”
‘ফার্স্ট ক্লাস নম্বরের উপরে আরো কতো বেশি চাও তুমি? সমস্যা হবে না। তাছাড়া ভবিষ্যতে চাকরির ব্যাপারটা তো আছে। আমার দল ক্ষমতায় আসবেই!’
“স্যার-”
‘মর্ডান ফিল্ড থিয়োরির মতো পদার্থবিদ্যা – আমাদের জন্য না! ওইটা ওইসব ডেভেলপড কান্ট্রির পিপলদের জন্য। আমার সাবজেক্টে অনেক কাজ হয়ে গেছে। এইটা আমাদের স্টুডেন্টেদের জন্য অনেক হেল্পফুল সাবজেক্ট। ওই ফিল্ড থিয়োরি- এইটার ভাত নাই!’
“স্যার, আমি থিয়োরিটিক্যাল হাই এনার্জি ফিজিক্স পড়বো। ওটার জন্য ফিল্ড থিয়োরি না নিলে হবে না স্যার! এই জন্যই আমার ফিজিক্স পড়া!”
‘কি? তুমি নিজের মত ফলাও? কি বোঝো তুমি ফিজিক্সের? মডার্ন ফিল্ড থিয়োরি পড়বা ? আমার বিষয় বাদ দিয়া? যাও, মর গিয়া। দেখবো ক্যামনে তুমি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করো!’
পদার্থবিদ্যার অই নবীন শাখাটায় – কাজ করার ভীষণ ইগারনেস যে আমার ভেতরে! কেনো সেটা আমার জন্য হবে না? আমি কেমন করে থাকবো এখানে – এমন বিরূপ ক্রুদ্ধ চোখের নিচে-কেমন করে থাকবো! আরো কতো কতো ধমকা-ধামকি আছে আমার জন্য? আর কতো পেতে হবে?
ড. কবির হোসেন স্যার বলেন যে, বিষয়টা তো নতুন- এই যে ফোর্থ ইয়ারের জন্য যে-কোর্সটা চালু হয়েছে- তাই তোমরা নিজেরা নিজেরা আগে বইপত্র পড়ে নাও । আর রকিব, তুমি সিলেবাস ধরে ধরে নোট তৈরি করো তো? অমুখ তারিখের মধ্যে নোট তুমি – আমার কাছে সাবমিট করবে। তারপর আমি দেখবো- কীভাবে আমি পড়াবো।
স্যার যখনই যেভাবেই পড়ান গে না- আমার তাতে সমস্যা কী! আমার এদিকে খুব মজা লাগতে থাকে! একেবারে নতুন একটা বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-খুব থ্রিলড লাগতে থাকে আমার! নোট করতে করতে-অই নতুন সাবজেক্টটাকে- বেশ ভালো লাগতে থাকে। স্যারের কাছে নোটটা নিয়ে যাবার পরে,স্যার বলেন; ‘এটা আমার কাছে থাকুক!’ ইইস! আমার একটু মনখারাপ লাগতে থাকে! নোটটার একটা ফটোকপি করে রাখলে তো হতো! ব্যাপারটা খেয়াল আসে নি!
রকিবের নোট ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে পড়ানো হতে থাকে, রকিবের ক্লাসে! পরের ইয়ারে হুবহু পড়ানো হতে থাকে! আর কতোক্ষণ লাগবে- এই সুড়ঙ্গটা পার হতে? অতোটা সময় – মাথাটা খাড়া রাখা যাবে তো! আমি পার হতে পারবো নাকি! নাকি পারবো না! চোখের সামনে ধু-ধু হলুদ- খালি লাফ-ঝাঁপ দেয়- আমার চোখের সামনে! রকিবের কান্না পেতে থাকা চোখ- রকিব কাঁদে- পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদে- হুঁ হুঁ! কেমনে পার হতে হয়- পার হয়ে কোথায় যাওয়া…
ভ্যান কব্বর থেইক্কা নাইম্মা দেখি, ধা-ধা মাঠ! মদ্যিখানে কতো কতো তারের বেড়া! লগে কাঁটাতারও আছে। দালালে কয়,ঐ তারগিলি পার হইয়া ঐপারে যাইতে হইবো। আমরা আছি অহন শ্লোভেনিয়ায়! হরেক রকম তারের বেড়ার এই পারে আছি! ওই পারে ইটালিয়া। আমার যাওনের শেষ জায়গা। এই তারগিলির ভিতরে দিয়া যাইতাছে কারেন্ট। কাজেই অই তারেরে কাইট্টা যে কেউ যাইবো- সেইটার সাধ্য নাই। অই তারগিলিরে ডিঙ্গাইয়াও যে- কেউ যাইবো- সেইটারও উপায় নাই!
দুইদেশের দুইপাশ থেইক্যা তারগিলি আইসা- একটা পাইপের ভিতরে-ঢুইক্যা গেছে ! আরে বাপ্পুস রে- বাপ্পুইস! কী বিরাটের বিরাট অই পাইপ! আর অই পাইপটা গিয়া যে কোনখানে ঠেকছে- শ্লোভেনিয়ার এই মুড়া থেইক্যা- সেইটার কিছুই বোঝোন যায় না! কোন আসমানের কাছে জানি গিয়া – শেষ হইছে এইটার আরেক মাথাটায়! দেইক্ষা আমি টাসকি খাইয়া যাই! দালালে কয়, এই পাইপ তিন কিলোমিটার লাম্বা। আমি বুঝি মাইলের হিসাব! কিলুমিটারের আমি কী বুঝি!
পাইপের ভিতরটা বহুত চওড়া, কিন্তুক বোলে এইটার ভিতরে দিয়া গেছে- পাঁচ হাজার ভোল্ট কারেন্ট! ওই যে তারগুলা! সেইগুলার মধ্য দিয়া নি গেছে -পাঁচ হাজার ভোল্ট কারেন! আয় হায়! আমাগো বোলে এই পাইপের ভিতরে দিয়া যাইতে হইবো! হামা দিয়া দিয়া বোলে- যাইতে অইবো সেই তিন কিলোমিটার। তবেই বোলে পামু ঐ ইটালিয়ারে! আমরা বিশজনে, মোনে মোনে, ঝলৎ কইরা চিক্কুর দিয়া উঠি! ডরে, আগামাথা ছাড়া ডরে, আমাগো শইল থরথরাইতে থাকে! কেমনে যামু ! কারেন্টের তারে ঠাসা পাইপের ভিতর দিয়া-কেমনে যামু!
অন্য উনিশ জনে যেমুন পিন্দে, আমিও তেমুন প্লাস্টিকের টুকরাটিরে পিন্দি। পিন্দন তো না- দালালে কেমনে জানি তেনার মোতন কইরা সেই প্লাস্টিকরে-আমার শইলে পেঁচাইয়া দেয়! শইল্লের এক তিল অংশ, এক চিমটি জায়গা য্যান খোলা না থাকে! একদম মোড়ানো রাখোন লাগবো শইল! একদম। এইটা তো আর শুইয়া করল্ করোন না! প্লাস্টিক মোড়া হইয়া, বইসা বইসা, পা টিপ্পা টিপ্পা আগানো! কোনো বেহুদা নড়নচড়ন নাই! শইল থেইক্যা খবরদার যানি প্লাস্টিক- এট্টুও কোনো দিক দিয়া না সরে! পাঁচ হাজার ভোল্টের কারেন চলতাছে কইলাম! রিয়াজুলে দ্যাহো গো মা, বইয়া বইয়া পাও ফেলতাছে- টিইপ্যা টিইপ্যা পাও ফেলতাছে সেয়! প্লাস্টিক য্যান একচুল না লড়ে রে রিয়াজুল! ইয়া আল্লা! কতো কুটি বছর লাগবো- এই পাইপ পার হইতে! ইয়া আল্লা- পেলাস্টিক সইরা গেলো নাকি- মাথার তেনে! কান্দিস না, কান্দিস না রিয়াজুল! আরে সম্বন্ধীয় পুতের দেশ রে! তুই আমার তর কাছে ঠাঁই দিলি না!
আমি দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি করছিলাম শুধু ওইখানে- ওই দেশে- আমার দেশে! আসলে আমি থুবড়ে পড়ে গেছিলাম- ক্রল করছিলাম আমি- কোনোমতে ক্রল করা! ভাতের ব্যবস্থা করার জন্য যেখানে, জীবনের সব আয়োজন! সেই পশুস্তরের জীবনে- আমি চাই থিয়োরিটিক্যাল হাই এনার্জি ফিজিক্স পড়তে! পাগল না আমি? চতুষ্পদ! আইসিটিপির সব কাগজপত্র হাতে পাওয়া মাত্র- আম্মা আমাকে প্লেনে তুলে দিলো। আম্মা, তুমি কাঁদবা নাকি আম্মা! একা হয়ে যাচ্ছো যে! একদম একা!
‘আহ্! আমার বাচ্চাটা এবার বাঁচবে। এবার স্কলার হবার রাস্তা ধরে মাথা তুলে হাঁটতে পারবে! আমার বাচ্চাটাকে আামি পার করতে পেরেছি- ভয়াল অন্ধকার সুড়ঙ্গ পার করে দিতে পেরেছি! আমি ওকে উন্মূল উদ্বাস্তু করে অথৈ বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দিয়ে পেরেছি। ও বাঁচবে! ও বাঁচবে- ও বাঁচবে-’
ওহ বাংলাদেশ- ও আমার দেশ- এটা কেমন বেঁচে থাকা। অ্যাই রকিব অ্যাই! কাঁদবে না! এটা বিভুঁই! চোখে পানি আসা চলবে না! রকিব! কাঁদে না ধুর-