বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ এবং শর্ট লিষ্ট
কাজী লাবণ্য
বলা হয়ে থাকে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের হারুকি মুরাকামি। হারুকি মুরাকামিকে আমি পড়েছি, তার সাক্ষাৎকারগুলোও দেখেছি, পড়েছি, তবে তাকে যতটা পড়েছি হুমায়ূন আহমেদকে তারচেয়ে অনেক বেশি পড়েছি। যতদূর জানি তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আড়াইশত’র কম বা বেশি।
আমরা ভাইবোনেরা বেড়ে উঠেছি হুমায়ূনের কালে। ফলত তার সবগুলো বই কেউ না কেউ সংগ্রহ করেছে আর হাতবদল হয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। এভাবে এই লেখকের সব বই-ই আমার পড়া হয়েছে, কিছু বই একাধিকবার পড়া হয়েছে। বিশাল না হলেও আমার নিজস্ব বইয়ের কিছু সংগ্রহ রয়েছে আর রয়েছে ছোট্ট একটি ‘হুমায়ূন কর্ণার’।
এছাড়াও হুমায়ূনকে বিভিন্নভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি তার একক, ধারাবাহিক, অসংখ্য নাটক, সিনেমা, ডকুমেন্টারি। পুনঃপুনঃ শুনেছি তার রচিত গান।
বলা হয়ে থাকে তিনি ‘জনপ্রিয়’। হ্যাঁ তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কোনো তুলনা হয় না। তার প্রতি ভক্তকুলের ভালোবাসারও কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা এবং এই ভালোবাসাকে বলা হয় ‘সস্তা’।
একবার তিনি ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সারা দেশব্যাপী প্রচারণা চালিয়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবেন। জানালেন, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রথম ইট নেওয়া হবে সিলেট থেকে। প্রথম অর্থ নেয়া হবে তিনজন ভিক্ষুকের কাছে, তাদের ছবি তুলবেন নাসির আলী মামুন, স্কেচ ও ইন্টারভিউ নেবেন মাসুক হেলাল। এরপরে যাবেন দেশের শীর্ষ তিন ধনীর কাছে। এভাবেই তিনি অভিনব একটা ছক করেছিলেন।
সেসময় আমি, আমার বোনেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের অলংকারাদি যা আছে তা ওনার হাতে তুলে দেব। এবং এ ব্যাপারে আমরা ছিলাম বদ্ধ পরিকর। এও জানি আমাদের মত অনেকেই টাকা, জমি, অলংকারাদি দেবার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। তিনি সময় আর সুযোগ পেলে দেশ একটা উন্নতমানের ক্যান্সার হাসপাতাল পেত বৈকি।
আমার তো মনে হয় না আর কোনো ব্যক্তি আহবান করলে কেউ নিজেদের অলংকারাদি দেবার কথা ভাববে। এতটাই ছিল তার অগাধ জনপ্রিয়তা। এই জনপ্রিয়তা তিনি অর্জন করেছিলেন কেবল ‘লিখে’।
পাঠকের এত ভালোবাসা এত বিশ্বাস পেয়ে আর কোনো লেখক ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’ হতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই।
বলা হয়ে থাকে তিনি মানুষের ‘আবেগ’ নিয়ে খেলেছেন। হ্যাঁ খেলেছেন। একেবারে স্কুলের মাঠে, গঞ্জের মেলায়, জোড়া বটতলায়, কিছু যাদুকর যেমন হাতের তালুতে ছোট ছোট বল নিয়ে খেলে,এই একটা বল শূন্যে ছুড়ে দিলে দুইটা হচ্ছে, চারটে হচ্ছে, শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে আবার আটটি বল হয়ে ফিরে আসছে, এমন অনায়াস লোফালুফি খেলা।
হুমায়ূন আহমেদ ঠিক এভাবেই মানুষের প্রধান অনুভূতি যে আবেগ তা নিয়ে খেলেছেন, মারাত্মকভাবে খেলেছেন। কই আর কেউ তো পারেননি এভাবে খেলতে। অন্তত আমি পাইনি।
মুরাকামিও কি ওভাবে পেরেছেন?
যেহেতু দু’জনের মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে, তাই যদি হয়, জাপানের হারুকী মুরাকামীর বই ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি নোবেল প্রাইজের শর্ট লিষ্টে কয়েকবার এসেছেন।
বাংদেশের হুয়ায়ূন কি এসেছেন? আসাটা দরকার ছিল না?
আড়াইশত বইয়ের মধ্যে একটি গল্প, একটি উপন্যাসও কি কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হওয়ার মত নেই?
আমরা কাকে কীভাবে কোন ‘দোষ’ এ খারিজ করা যায় তা নিয়ে নিরন্তর ভাবি। কেবল ভেবেই ক্ষান্ত হই না তাকে বয়কট করি নানান দোষে, নানান অভিযোগে।
অথচ কি করলে কাউকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা যায় তা কখনই ভাবি না।
এমনটাই হয়ত আমাদের চরিত্র।
জন্মদিনে এই জনপ্রিয় লেখককে জানাই গভীরতম শ্রদ্ধা।
*************************************************