You are currently viewing বাংলাদেশের শিল্পসমালোচনায় চিহ্নিত আধুনিকতার খোঁজে পুনর্পাঠ/ শাহমান মৈশান

বাংলাদেশের শিল্পসমালোচনায় চিহ্নিত আধুনিকতার খোঁজে পুনর্পাঠ/ শাহমান মৈশান

বাংলাদেশের শিল্পসমালোচনায় চিহ্নিত আধুনিকতার খোঁজে পুনর্পাঠ

শাহমান মৈশান

“The task of the critic is then to wrench the mask from its face” 1

–Terry Eagleton

বাংলাদেশের শিল্পকলায় আধুনিকতা কী এবং কিভাবে তা চিহ্নিত হয়েছে সেটি তলিয়ে খুঁজে দেখতে এদেশের শিল্প-সমালোচনার ডিসকোর্সে বিচরণ প্রয়োজন। এবং সেই লক্ষ্য নিয়ে প্রথমেই আমরা বুঝতে চাইবো আধুনিকতার মর্মার্থ কী?  ‘the new’ প্রধান প্রত্যয় ধরে নিয়ে বাল্টার বেনজামিন বোদলেয়ারের Flaneure-কে সামনে নিয়ে এসেছেন, যে একই সাথে পর্যবেক্ষক ও ভোক্তা হিসেবে বিরাট শহর ঘুরে বেড়িয়ে পরিবর্তন ও পণ্যায়ণ মোকাবিলা করে হয়ে উঠেছে ‘the painter of modern life’। যদিও আধুনিকতার ইমেজ গভীরভাবেই দ্ব্যর্থবোধক। আর বিশেষত বেনজামিনের আলোচনার সূত্রেই আমরা আধুনিকতার লক্ষণ বুঝে উঠতে পারছি যখন শুনতে পাই বোদলেয়ার  Les Fleurs du mal কবিতায় ব্যক্ত করছেন সেই নান্দনিক প্রয়োজনীয়তা যাতে দেখা যায় “plunge into the depths of the unknown in order to find something new”.এমনকি শিল্পী Manet  ও বিভিন্ন আভাঁগার্দ শিল্পান্দোলনে উদ্বোধিত হয়েছে আধুনিকতার মূল সূত্র “tradition of the new”.২ বাংলাদেশের শিল্পে আধুনিকতা স্বরূপ এই নতুনত্ব কিভাবে চিহ্নিত হয়েছে সেই বিচারের প্রণালী অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে আমরা প্রথমেই কনটেক্সচুয়ালাইজড করতে চাইবো দক্ষিণ এশিয়ার দর্শনগত বিচার-প্রণালীর সাথে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মারফতে জানা যায় “[সম্রাট] অশোকের সময় কথাবস্তু নামে একখানি বৌদ্ধদের বিচারগ্রন্থ লেখা হয়। উহাতে বিচার করিয়া বৌদ্ধদের সমস্ত মত স্থাপন করা হয়। […] উহার বিচার-প্রণালী বিচিত্র। […] একটা কথা উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে অনেক ফেকড়ি উঠিল, সব ফেকড়ি উদ্ধার করিয়া তবে মূলকথার বিচার হইল। মীমাংসকদের বিচার-প্রণালী আর একরকম। ১. সন্দেহ। ২. বিষয়। তাহার পর পূর্বপক্ষ, তাহার পর উত্তর। তাহার পর নির্ণয়। এই পাঁচটির নাম অধিকরণ। কিন্তু মহাযানীরা ঠিক ইংরাজি সিলজিসম() মতো কথা কহিত, উহাতে বিচারটা বেশ পরিষ্কার হইয়া যাইত।”৩ আবার, নাগার্জুনের প্রায় দুইশ বছর পর, বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের যথার্থ প্রবর্তক খ্রিস্টীয় প ম শতাব্দীর শেষ দিকে জন্মগ্রহণকারী ‘তর্ক-পুঙ্গব’ নামে খ্যাত আরেক বিশিষ্ট নৈয়ায়িক দিঙ্নাগ৪ পূর্ববর্তী বিচার-প্রণালীর রূপান্তর সাধন করেন এবং সংক্ষিপ্ততার প্রণালীতে বিচারের ধারা গঠন করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানান, দিঙ্নাগ বিচার-প্রণালীর লক্ষ্যস্বরূপ প্রমাণকে দুইভাগে ভাগ করেন-প্রত্যক্ষ আর অনুমান। শাস্ত্রী মহাশয় দিঙ্নাগের বিচার-পদ্ধতির সাথে বর্তমানের ইউরোপীয় লজিক পারসেপশন ও ইনফারেন্স-এর মতন বলে অভিমত দিয়েছেন।৫ প্রমাণিত অনুমান সম্পর্কে ভাষার প্রয়োগকে ‘অবয়ব’ বলা হয়। দিঙ্নাগ তিনটি অবয়বের কথা বলেন-প্রতিজ্ঞা (প্রেমিস), হেতু ও উদাহরণ। প্রথমটিতে পক্ষ ও সাধ্য নির্দেশ, দ্বিতীয়টিতে হেতু নির্দেশ ও তৃতীয়টিতে  সাধ্য ও হেতুর মধ্যে ব্যাপ্তি দেখানো।৬

বাংলাদেশে শিল্পের আধুনিকতার বিচারে সাঈদ আহমদ দিঙ্নাগ প্রবর্তিত তিনটি অবয়বের মধ্যে প্রতিজ্ঞা পেশ করেছেন ও প্রয়োজনীয় উদাহরণ দিয়েছেন। সবসময় হেতু নির্দেশ করেননি। এই প্রণালীতেই সাঈদ নান্দনিকতার নীতিমালা প্রয়োগ করেছেন সমালোচনায়। আধুনিকতার খোঁজ সন্তোষ গুপ্তের সমালোচনায় মীমাংসকদের বিচার-প্রণালীর সাযুজ্য দেখা যায়। তিনি প্রথমে সন্দেহ পোষণ করেন। তারপর মূল বিষয় উত্থাপন করেন। এরপর আলোচনা বিস্তারের মাধ্যমে উত্তর নির্ণয় করেন। এই প্রণালীতে বিষয়ের পর্যালোচনার ভাবাদর্শ হিসেবে মার্কসবাদী পদ্ধতির স্থানীয়করণের আশ্রয় নেন। কথাবস্তুর অন্তর্গত বিচার-প্রণালী অনুযায়ী একটা ‘কথা’ তুলে, এর সঙ্গে অনেক ‘ফেকড়ি’ জুড়ে সব ফেকড়ি উদ্ধারের পর তবে মূলকথার বিচারে ব্রতী হন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। অনেকটা মহাযানী ও ইংরেজি সিলজিসম প্রণালীর মিশ্রণে জাহাঙ্গীর সমাজতাত্ত্বিক শ্রেণী ও উত্তর-উপনিবেশিক চৈতন্যে শিল্প-সমালোচনা হাজির করেন।

এই লেখায় আধুনিকতার খোঁজ করতে উপরোক্ত তিনজন সমালোচককে আশ্রয়ের কারণ হলো বিরাজমান ধারায় নানারকম অপব্যাখ্যা ও ভুলপাঠ এড়িয়ে শিল্পালোচনার ডিসকার্সিভ ধারায় অংশ নিয়ে জ্ঞানযোগচর্চা জারি রাখা। পাশাপাশি প্রতিজ্ঞা প্রমাণের জন্য অন্যন্য অনেক সমালোচককে উপ্ক্ষো করা হয়েছে বিচার-প্রণালীগত সন্দেহ করার নৈয়ায়িক শর্তে। এক্ষেত্রে যেমন উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত সৈয়দ আলী আহসানের শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য বইয়ের কথা বলা যায়। এতে যেমন তিনি শিল্পী এস এম সুলতান সম্পর্কে লিখেছেন যে, “তাঁর [সুলতানের] লক্ষ্য হচ্ছে অমাদের গ্রামের সমাজজীবনকে উপস্থাপন করা। অত্যন্ত বলিষ্ঠ-দেহী কৃষককুল অথবা কৃষকরমণী, কৃষিকর্মে নিযুক্ত প্রাণী, ঊর্বরা ভূমি এবং  বলিষ্ঠ ধানের মঞ্জরী সব কিছুকে একাকার করে তিনি একটি সজীবতার উত্তরণ খুঁজেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে এ সজীবতা হচ্ছে আমাদের কাম্য সুতরাং তিনি কাম্যের প্রসাদকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। অবশ্য এখানে মনে রাখতে হবে বাস্তবদৃশ্য আমাদের গ্রামা লে এ সজীবতাকে উদ্ঘাটন করে না।”৭ বাস্তবকে আলী আহসান কেবল চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা উপরিতলের কান্ডকীর্তি হিসেবেই গণ্য করেছেন। এক্ষেত্রে সমালোচনার নামে শিল্পীর ভিশন, শিল্পের কনটেক্সট এবং ব্যক্তি ও সমাজের ইতিহাস, বাস্তব ও সত্য অবধারণের বহুমাত্রিক সম্ভাবনাসহ নান্দনিকতার বিচিত্র শর্তের সাথে সম্পর্করহিত কায়দায় উদ্ভট মন্তব্যধর্মিতা সহজেই লক্ষ্য করা যায়। অলী আহসান বিভ্রান্তিকরভাবে হঠাৎ হঠাৎ এমন এক একাডেমিক রিয়ালিজমের নিক্তিতে শিল্পের আলোচনা করেন যার মাধ্যমে শিল্পার্থের বদলে মরীচিকাই উৎপাদিত হয়। আবার এই বইয়েই তিনি বহুক্ষেত্রে শিল্পীদের নির্বিচার স্তুতিরও দৃষ্টান্ত রেখেছেন, অ্যাফরিজম বা সুভাষিতকরণের ফলে বিষয়বস্তুরও কোনো তল পাওয়া যায় না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাহিত সৈয়দ আলী আহসানদের এমন ধারা সমালোচনার কারণে এদেশের শিল্পের অন্দরে প্রবেশের বদলে ভুল হাতিয়ার ব্যবহারের দায়ে আত্মঘাতী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সেজন্য, আধুনিকতার খোঁেজ মূল্যবিচারী শিল্প-সমালোচনার আলোকিত ক্ষেত্রে বিচরণের লক্ষ্যে সাঈদ আহমদ, সন্তোষ গুপ্ত ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ডিসকোর্সকে এই লেখার অভিমুখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

নান্দনিকতার নীতিমালা ও আধুনিকতা

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের আলোচনা যাকে আমরা তিনটি বিদ্যমান ধারার ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম বর্গে দেখতে পাওয়া যায় নান্দনিকতার বিধিমালাকে পদ্ধতির কেন্দ্রীয় বিষয় রূপে গ্রহণ করে শিল্পের মূল্য বিচারের প্রচেষ্টা। নান্দনিকতার শাস্ত্রীয় অবস্থান থেকে আধুনিকতা চিহ্নিত করতে সচেষ্ট এমন পথিকৃত সমালোচক হলেন সাঈদ আহমদ। ফিগারেশন ও অ্যাবস্ট্রাকশন-এই দুই ধরনের ভিত্তিতে সাঈদ চল্লিশের দশক থেকে সূচিত বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের আধুনিকতার দুটো মূল স্রোতকে চিহ্নিত করেছেন। এই দুই স্রোতধারার দুটো বিভেদমূলক প্রবণতা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি অস্বীকার।

সাঈদ আহমদ তাঁর Heritage: Contemporary Art of Bangladeshনামের লেখায় তা তুলে ধরেছেন:

East Pakistani artists showed two distinct trends, namely art inspired by the folk tradition and the other a complete contrast to it [art inspired by the folk tradition] that is abstract art. The traditionalists were utilizing colours and symbols to embellish their naturalistic works and the non-traditionalists were breaking through the accepted geographical boundary […] 8 তাহলে আামরা দেখছি সাঈদ বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতা চিহ্নিত করেছেন ন্যাশনালিস্টিক স্পিরিট ও ফোক আর্টের রিচ হেরিটেজের একটি লিংক সন্ধানরত শিল্পীদের কাজের ধরন বিশ্লেষণের মাধ্যমে। তাঁরা ছিলেন ফিগারেটিভ আর্টিস্ট। এই বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীদের সম্পর্কে তারঁ বিশ্লেষণ ”The training they (elderly painters) had, the surroundings in which they grew up and the changing socio-political situation which they faced (Second world War and partition of India) shape their mind to delve deep in that particular line. […]They were basically inward-looking”.9 শিক্ষণপ্রণালী, পরিপার্শ¦ ও বেড়ে ওঠার বাস্তবতার বিভিন্ন শর্তাবলী তাদের কাজে আধুনিকতার মাত্রা যোগ করেছে এবং সাঈদ অন্তিম বিচারে তাদেরকে “ইনওয়ার্ড লুকিং” শিল্পী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা আধুনিক কিন্তু দেশমুখী। সেইজন্য তাঁদের কাজে দেশাত্মবোধক চেতনা অতি সক্রিয় থেকে ঐতিহ্যের মধ্যে সমকালীনতার ভাষ্য খুঁজে ফিরেছে। অন্যদিকে, অ্যাবস্ট্রাকশনে নিবেদিত সেই সময়কার “তরুণ অভিযাত্রিক” শিল্পীদের আধুনিক মনোভঙ্গি চিহ্নিত করতে সাঈদ তাঁদেরকে “আউটওয়ার্ড লুকিং” শিল্পী আখ্যা দিয়ে জানাচ্ছেন: These artists [Hamidur Rahman, Aminul Islam, Mohammad Ciboria, Murtaza Baseer, Abdur Razzaque, Rashid Chowdhury, Qayyum Chowdhury, Syed Jahangir, Abdul Baset, Debdas Chakroborty, Nitun Kundu, Abu Taher Majumder] who had gained training in the different art capitals of the world brought new knowledge to Dhaka. They were ready to absorb new ideas, cast away conservatism and see new perspectives. This group, which was young and dynamic created quite a tremor in the art scene.”10   

রক্ষণশীলতা পরিহার করে তাঁরা এমন সব আইডিয়া নিয়েছেন যেগুলো চিন্তা-উদ্দীপক নিরীক্ষাধর্মী কাজের উদ্ভব ঘটিয়েছে। অতএব, সাঈদের বিশ্লেষণের সূত্রে, আমরা বাংলাদেশের শিল্পের আধুনিকতার দ্বিতীয় মাত্রার উদ্ভবের হেতু হিসেবে, নির্বস্তুকতা-ভিত্তিক নিরীক্ষাধর্মিতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারি।

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের দুই মাত্রার শিল্পীদের কাজের পদ্ধতি ও ধ্যান-ধারণাকে বিচার করতে সাঈদ শিল্পীদের শিক্ষা ও বিষয়বস্তুর ডিলিং ও ট্রিটমেন্টকে মাপকাঠি ধরে “Young Artists-77” প্রদর্শনীর ব্রোশিয়রে লিখেছেন: “the elderly painters who emerged in the art world during the late forties (before the partition of Indian subcontinent), experimented with form and colour, drawing inspiration mainly from the folk tradition of the country. They learnt in their classrooms, much about the Bengal School of Painting and the contribution of the British painters. But in the fifties, a group of young and out-ward looking painters swung violently out of that orbit in order to understand  and to appreciate the new spirit of the mid-fifties, of Europe and America.”11

তাঁর চিহ্নায়নে আমরা দেখতে পাই প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা রঙ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য-আশ্রয়ী, যে-ঐতিহ্য আউটার সেল্ফ বা সমাজের বহির্বাস্তবতার সাথে ব্যক্তিসত্তার চিরাচরিত সামষ্টিক সম্পর্কের বাইরের রূপ অন্বেষণকে বিধিবদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রজন্মের আধুনিক শিল্পীরা শিল্পাদর্শে কলকাতা আর্ট স্কুল কেন্দ্রিক বঙ্গীয় ঘরানা ও রেপ্রিজেন্টেশনের ব্রিটিশ আদর্শের বিরোধিতার মাধ্যমে ইউরো-আমেরিকান বড়ো অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিত ও মধ্য-পঞ্চাশের বিদ্রোহী চেতনার সংশ্লেষ ঘটানোর ফলে বাংলাদেশের শিল্প  আধুনিকতার এমন এক চারিত্র-বৈশিষ্ট অর্জন করে, সাঈদ আহমদের ভাষায়, যেখানে ব্যক্তির “অন্তর্গত সত্ত্বার ঘনিষ্ট পরিদর্শন” (closer inspection of “inner-self”) নিরীক্ষিত হয়। আধুনিকতার এই বিশেষ নিরীক্ষা-পর্বটিকে সাঈদ আখ্যা দিচ্ছেন এই বলে যে, it was a period of intense activity, of mass media, jet travel, and trying out new ideas.”12 সাঈদ বাংলাদেশের শিল্পের আধুনিকতার তৃতীয় মাত্রার উদ্ভব হিসেবে মুক্তিযুদ্ধোত্তর শিল্পীদের কাজের বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন: The next chapter of the art movement began soon after 1971 when East Pakistan became Bangladesh .[…] All these painters (Shahid Kabir, Hashi Chakraborty, Mansur Karim, Mahamudul Haque, Biren Some, Abdus Sattar, K.M.A. Quayyum, Shahbuddin, Swapan Chowdhury, Kalidas Karmakar and others) shared one remarkable experience—the pain and horrors of the liberation war. They had to concentrate on getting over the scars and ravages of the recent past by experimenting with colour and forms. The outcome is visible sometimes in well laid out recognizable faces and sometimes in a few blotches of vibrant colour or an area pulsating with rough texture. They have utilized new methods and materials to depict the complex nature of reality.13

সাঈদের সমালোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্বাধীনতাযুদ্ধের অভিঘাত বাংলাদেশের শিল্পে নতুনতর আধুনিকতার বোধ জাগিয়েছে, যেখানে অবয়ব ও নিরবয়ব দুটোই সহাবস্থান করে। ফলে বাংলাদেশের আধুনিকতার তৃতীয় মাত্রাকে বলা যায় ফিগারেশন ও অ্যাবস্ট্রাকশনের সংশ্লেষ। সাঈদের ভাষায়, “with a wide range of canvases, graphics and sculptures”14 এই পর্বের শিল্পীরা “নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার ব্যক্তিক রূপকল্প” (“personalized vision of objective reality”)  সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিকতার তৃতীয় অভিক্ষেপ ঘটিয়েছেন।

মার্কসবাদী সমালোচনার স্থানীয় পদ্ধতি

মার্কসবাদী সমালোচনার পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা যায় সন্তোষ গুপ্তকে। এই পদ্ধতির আশ্রয় অবলম্বী সন্তোষকে দেখা যায় অতি বাম ঝোঁকের সমালোচনা করে তিনি নিজে মার্কসবাদী ঘরানার সমালোচনারই বিস্তার ঘটিয়েছেন। শিল্পসমালোচনার পদ্ধতি, মনোভঙ্গি ও ভাবাদর্শ বিষয়ে আলোচনার প্রসার ঘটিয়ে সন্তোষ গুপ্ত ব্যতিক্রমী সমালোচক হিসেবে পরিগণ্য হবার দাবি রাখেন। বাংলাদেশের শিল্পের আধুনিকতার বিচারে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান জানার মাধ্যমে এদেশের শিল্পের ডিমিস্টিফিকেশনের অন্য তাৎপর্য বোঝা সম্ভব। কিন্তু সেই ঘরানার প্রণালী কিভাবে গড়ে ওঠেছে এই বিষয়ক ভাবনা-চিন্তার হদিস নেয়ার মাধ্যমে মার্কসবাদী সমালোচনা-পদ্ধতির প্রয়োগে আধুনিকতার পাঠ গ্রহণও বিশেষভাবে সম্ভবপর হবে।

শিল্পের কথা বইয়ের অন্তর্ভুক্ত “শিল্প সাহিত্য বিচারে আতিবাম ঝোঁকের স্বরূপ” নামের নিবন্ধে সন্তোষ গুপ্ত সতর্ক করে বলেছেন, “মনে রাখতে হবে মানুষ চিরকালই শিল্পী। সামাজিক অবস্থান বণিকসভ্যতার পণ্যবাহী যুগে তাকে ক্রমেই মানবিকতা-বিযুক্ত করে চিত্রিত করতে আগ্রহী। মার্কসবাদের নামে ভাঁড়ামির পোশাকে আবৃত করে […] তামাশা দেখানোর প্রচেষ্টা চলছে। এভাবে উন্মার্গগামিতাকে বিপ্লবী চরিত্র হিসাবে উপস্থিত করার চেষ্টা চলছে। শিল্পের তত্ত¡ হিসাবে কলাকৈবল্যবাদের সে কাপালিক সহচর।”১৫ মার্কসবাদের ছদ্মবেশে থাকা কলাকৈবল্যবাদী একধরনের সমালোচনামূলক ধারার সমালোচনার মাধ্যমে তার বিষয় প্রসারিত হয়েছে। এমনকি, শিল্পের ভাষায় কৃত্রিম কায়দায় শ্রেণীসংগ্রামের চিহ্ন খোঁজার সমালোচকীয় ধরনের তীব্র সমালোচনা করে তিনি শিল্পের সত্যমূল্যের বিচারে শ্রেণীসংগ্রামবাদী সমালোচকদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন-“শ্রেণীসংগ্রামের কথা না বললে তিনি জনগণের বিপক্ষ শিবিরে থেকে জনস্বার্থের বিরুদ্ধতা করেছেন, শিল্প সাহিত্যের এ ধরনের বিচার শুধু অমার্কসীয় নয়, সাধারণ মানদন্ডে এ যাবৎ সমালোচনার যে ধারার সাথে পরিচিত, তারও সত্যমূল্য অনুধাবনে এরা কতটুকু সক্ষম সে প্রশ্ন দেখা দেয়।”১৬

“শিল্পসাহিত্যের বিচারে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রয়োগে ইদানীংকালে বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ঝুঁকে পড়েছেন” বলে সন্তোষ তার সমালোচনার মধ্যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেনি-এই অভিমত রেখে তিনি তাঁদের সমালোচনার দুর্বলতা কোথায় তা চিহ্নিত করেন-“কিন্তু এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা কী সে কথাটা তারা বলেন না”।১৭ ফলে, একটি সচেতন প্রয়াস থেকে সন্তোষ গুপ্ত এমন এক মার্কসীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন যা একাডেমিক মার্কসীয় সমালোচনা-পদ্ধতির অনুসারী নয়, বরং সন্তোষের সমালোচনার মধ্যে তাঁর অন্বিষ্ট “নিজস্ব ধ্যান-ধারণা” সম্বলিত মূল্যায়ন খুঁজে পাওয়া যায়, যার মূল ভিত্তি আবার মার্কসীয় সমালোচনার নমনীয় ভাবাদর্শ, শিল্পের বিচারের প্রয়োজনে এর মধ্যে স্থানীয় বাস্তবতা ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, কারণ আর্ট মাত্রই কনটেক্সটযুক্ত।

“আমাদের সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতির ধারা ও রূপান্তর প্রসঙ্গ” নামের এক নিবন্ধের উপসংহারে তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেন যার মধ্যে সন্তোষের সমালোচনার অভিলক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে:“আমাদের দেশের সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির রূপান্তর শুধু লেখনী বা তুলিতে আসবে না, আসবে এদেশের অর্থনীতির কাঠামো কোন ধারায় বিন্যস্ত হবে তার পটভূমিতে।”১৮ এর মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি যে, কোনো শিল্পের মূল্য বিচারের জন্য প্রয়োজন সেই শিল্প কোন অর্থনেতিক কাঠামোর মধ্যে উৎপাদিত হচ্ছে তা জানা। ফলে, অধিকাঠামোর চেয়ে ভিত্তিকাঠামোর রূপান্তরের মাধ্যমে শিল্পের রূপান্তর যদি সম্ভব হয় তাহলে সেই কাঠামোর বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট উৎপাদন-ব্যবস্থার অন্তর্গত শিল্পেরও বিচার সম্ভব। সন্তোষ গুপ্তের এই ভাবাদর্শিক অবস্থানকে, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শিল্প-সমালোচনার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি বলতে পারি। যদিও তা মার্কসবাদী সমালোচনা-পদ্ধতিরই অন্তর্ভুক্ত। এই পদ্ধতির ভিত্তিতে সন্তোষ গুপ্ত এদেশের শিল্পের আধুনিকতা চিহ্নিত করতে প্রয়াস নেন:  “আমাদের শিল্প সৃষ্টির ধারা মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা চলে। একটা আধুনিক অপরটি বহিরঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক হওয়া সত্তে¡ও আধেয়টি একান্ত দেশজ।” সাঈদ আহমদ যেমন দেশভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ের শিল্পকলাকে দু ধরনের আধুনিকতার মাত্রায় চিহ্নিত করেছেন, সন্তোষ গুপ্তও দুটি ধারা চিহ্নিত করছেন। কিন্তু সাঈদের মতন তিনি আধুনিকতার দুই মাত্রা নিয়ে নিঃসংশয় নন। বরং আধার ও আধেয়কে আলাদা করেছেন বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ-এই মাপকাঠিতে। তিনি আধার অর্থাৎ বহিরঙ্গ বা ফরমকে আধুনিক আখ্যা দিচ্ছেন, তার বিষয়বস্তু আধুনিক নয় বলে তাকে দেশজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে থাকা বিশেষ এক ধরনের দ্বান্দ্বিক আধুনিকতাও চিহ্নিত করেছেন সন্তোষ গুপ্ত। “প্রকৃত” আধুনিকতা এবং “দ্বান্দ্বিক” আধুনিকতার এই বিরোধের মনোভঙ্গিগত পার্থক্য হিসেবে লোকশিল্পকলার বা ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন ও ঐতিহ্যের প্রতি নিস্পৃহতাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে সন্তোষ যদিও বলেছেন, “আমাদের দেশে উপরোক্ত ধারা দুটির মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্র আজও প্রশস্ত নয়। তার কারণ রয়েছে যে, আমাদের শিল্পীদের জীবন-দর্শন মূলত বিপরীতধর্মী নয়। একটা অদৃশ্য ফল্গুধারার মতো সাদৃশ্য রয়েছে কোথাও। আর পূর্ববাংলার শিল্প আন্দোলনের জনক জয়নুল আবেদীনের শিল্পকলা যা আজও উচ্চকিত রেখেছে আমাদের চেতনার আয়োজন তা ছিল প্রথমাবধিই মাটির কাছাকাছি। তার সৌন্দর্য সৃষ্টির মূলে কাজ করেছে এদেশের কর্মরত মানুষের প্রতি ভালবাসা। স্বভাবতই রঙ ও আলোছায়া পরীক্ষা-নিরীক্ষারত তাঁর উত্তরসাধকদের মধ্যে তা অলক্ষে প্রবাহিত।”১৯ এমনকি, তিনি ইউরোপিয় আধুনিকতাবাদী বিভিন্ন শিল্পান্দোলনের সাথে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পধারার পার্থক্য চিহ্নিত করে পর্যটনবাদী পুনরাবৃত্তির চক্রে আপতিত বলে এর সমালোচনাও করেছেন- “ইউরোপে বিভিন্ন রীতিবাদের পিছনে সামাজিক শক্তি অলক্ষ্যে হলেও সক্রিয় ছিল। আর আমাদের দেশের দ্বন্দ্বটা ছিল এবং এখনও রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গোঁড়ামি আর মুক্তবুদ্ধির মধ্যে। সামাজিক ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবাদ কিংবা জনজীবনের বিভিন্ন ধারাকে সাধারণভাবে দেখা হচ্ছে পর্যটকের মনোভাব নিয়ে। সুতরাং শিল্পীর নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষাই আসল হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষেত্রে কিংবা বাস্তবচিত্র হিসাবে যা উপস্থিত করা হচ্ছ-যথা শ্রমজীবী, মানুষ, ভিক্ষুক কিংবা নকশিকাঁথার, এসব পুনরাবৃত্তির চক্র।”২০

তিনি শিল্পের আধুনিকতাকে প্রাচীনতার অনুকরণ থেকে মুক্তির আকাঙ্খারূপে বিচার করে বাংলাদেশের আধুনিকতার একটি ভিশনারি সমালোচনা হাজির করেছেন: “প্রাচীন শিল্পরীতির অনুকরণ থেকে মুক্তির তাগিদ আধুনিক চিত্রকলার জনক এখানে সেই অনুকরণ কি [বাংলাদেশের] আধুনিকতাকে সীমাবদ্ধ করছে না?”২১ এমনকি তিনি বাংলাদেশে আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ঠ্যসূচক বিমূর্ত শিল্পের উদ্ভবের সমস্যার দিকটিও বিচার করেন: “সুতরাং এখানকার শিল্পীদের বিমূর্ত রীতিতে আঁকা ছবির পশ্চাতে কোনো আন্দোলন, কোনো দর্শন প্রত্যক্ষ প্রেরণা যোগায়নি।”২২ তবে এদেশের আধুনিক শিল্পের একটি পরিণত রূপ রয়েছে বলে মতামত দিয়ে সন্তোষ গুপ্ত এর নিবিড় বিশ্লেষণেও মনোনিবেশ করেন: “আমাদের দেশে চিত্রশিল্পের পরিণতরূপ, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঝোঁকে প্রধানত আন্তর্জাতিকতামুখী। শিল্পরীতি আঙ্গিক, বিন্যাসের পরিকাঠামো ও উপকরণগত আয়োজন এবং মাধ্যম একদিকে লালন করেছে এই প্রবণতা। আবার অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবধারার সাথে সম্পৃক্তি ও সংঘাতে তা দেশের মানসিকতার সম্পূর্ণ না হলেও একাংশকে অবারিত করেছে অর্থাৎ তাকে প্রকাশের সীমানায় টেনে এনেছে।”২৩

সন্তোষ গুপ্তের মতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে সামাজিক আলোড়নের অন্তর্গত প্রাণশক্তি আপন ভুবনের খোঁজে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সাঈদ যেমন এ পর্বের আধুনিকতার বিচারে কেবল নান্দনিক প্রকৃতি ও প্রবণতার দিকে নিবিষ্ট, সেখানে সন্তোষ এর একটি সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনেতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে আধুনিকতার অন্তর্গত লক্ষণ বিচারে তৎপর হয়েছেন। সন্তোষের ভাষ্যে, “[মুক্তিযুদ্ধের] ফলে আধুনিক শিল্পীমানস বহির্মুখী থেকে অন্তর্মুখী হয়। অপর দিকে যুদ্ধশেষে বহু শিল্পী দেখলেন যে তাদের গুটিয়ে নেয়ার কালপর্বের প্রতি সমাজমানস উদাসীন। ফলে খুব দ্রুত শিল্পীদের একাংশ আত্মমগ্নতার মধ্যে চৈতন্যের মুক্তির সন্ধানে ব্যাপৃত হলেন। ঐতিহ্য সন্ধানী ধারার পাশাপাশি বিমূর্ত শিল্পরীতির বিভিন্ন অঙ্গিকের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। […] স্বাধীনতার পর ইউরোপীয় চিত্রকলার বিভিন্ন রীতি পদ্ধতি ও আঙ্গিক আরও ব্যাপকভাবে আমাদের শিল্পীদের শিল্পকর্মে লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে। ইউরোপ দুটি মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী ও পরবর্তীকালে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের বিপর্যয়ে শিল্পীচিত্ত ছিল উন্মোচিত, তেমনি একটা পরিস্থিতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শিল্পীচিত্তে আশার উত্তুঙ্গতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা শিল্পীর মনোভুবনকে আন্দোলিত করে। এসময় দেখা গেল ঝাঁটা, ছেড়াকাঁথা, উপেক্ষিত ও বর্জিত বস্তুনিচয় শিল্পীরা ব্যবহার করেছেন। কোলাজ রীতির এই আরোপিত ধারা অনেক বেশি শিল্পের অঙ্গনে এল। সম্মিলন ঘটানো হল ফটোগ্রাফির সঙ্গে। ফর্মের ভাঙচুর ও নতুন বিন্যাস সামাজিক অস্থিরতার প্রকাশ ঘটাল।”২৪ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী শিল্পের আধুনিকতার আার্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যার মধ্যদিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিল্পে নব্যধারার প্রবেশ ও বিকাশ প্রসঙ্গে বলেন: “[…] এভাবে আমাদের চিত্রকলায় আভাগার্ড অথবা নব্যধারা প্রতিবাদ ও উল্লাসের সাথে স্থান করে নেয়।”২৫

সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতি: শ্রেণী, উত্তর-উপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা

জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা অবলম্বনে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যে সমালোচনার জাল বুনেছেন তাতে দেখা যায় শিল্পের আধুনিকতার উন্মোচনে তিনি দেখাচ্ছেন কী করে এদেশের শিল্পে “শ্রেণী ও সমাজের বোধ”২৬ জেগে ওঠেছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের প্রথম পর্বের শিল্পী জয়নুলের কাজ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কী করে এদেশের শিল্প “শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীলতার সমস্যা” প্রতিফলিত করার মাধ্যমে “রিয়ালিস্টিক ও ইম্প্রেশনিস্টিক চিত্রের ক্ষেত্রে একসার প্রশ্নের” উত্থাপন ঘটিয়েছে। এই সব প্রশ্নের জবাবও জয়নুলের কাজে রয়েছে বলে জাহাঙ্গীর আমাদের জানান। প্রশ্নের উত্থাপন ও এর জবাবই যে, আধুনিক জয়নুলের চোখ ও মানস তৈরি করেছে, সেটাও আমরা অবগত হই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে। অধুনিকতার পরিগঠনে ক্রিয়াশীল এই প্রশ্ন ও জবাবকে জাহাঙ্গীর চিহ্নিত করছেন এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে-“কৃষক শ্রেণী থেকে মধ্য শ্রেণীতে তাঁর [জয়নুলের] উত্তরণের মধ্যে ধরা দিয়েছে কলোনী কালের ধনতান্ত্রিক বিবর্তন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রের ফ্রেমে কৃষকশ্রেণীর জীবন যাপন, পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকোত্তর ধনতান্ত্রিক ফ্রেমে কৃষক শ্রেণী উদ্ভূত মুসলমান মধ্য শ্রেণীর সংস্কৃতি রচনার প্রয়াস এবং ঔপনিবেশিকোত্তর বাংলাদেশের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক শ্রেণী থেকে বিযুক্ত মধ্য শ্রেণীর অবস্থান”২৭ কী এবং এর উত্তর নির্ণয় কীভাবে ঘটেছে সেটাই জয়নুলের কাজ বহন করে।

ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনের দটো মূল শ্রেণী  যথা জমিদার-বুর্জোয়া এবং কৃষকশ্রেণীর জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক প্রোগ্রাম বনাম মধ্যযুগীয় পন্থানুসারী অসংগঠিত বিদ্রোহের নানানামাত্রিক বিরোধের প্রেক্ষাপটে২৮ অগ্রসর সামাজিক বাস্তবতায় কী করে শিল্পের র‌্যাডিকেল সম্ভাবনা২৯ এসেছে সেই প্রশ্নের মারফতে জাহাঙ্গীর চিহ্নিত করেছেন যে, আবেদিনের কাজে, একটি শৈল্পিক ফর্মের উদ্ভাবন ঘটেছে। শিল্পী “লোকজ ফর্ম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এই ফর্ম গ্রামীণ অভ্যাসজাত নয়, এই ফর্ম দেখে বাঙালি ঐতিহ্যের বোধ মনে তৈরি হয়, কিন্তু সে-ঐতিহ্যের মধ্যে বর্তমানের কৃষক জীবনের দুই ঔপনিবেশিক যন্ত্রণা তিনি প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়েছেন”।৩০ সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতির অনুসরণের ফলে শ্রেণী ও উত্তর-উপনিবেশিকতাবাদী চৈতন্য বিকে জাহাঙ্গীরের সমালোচনাকে সাঈদ ও সন্তোষ থেকে আলাদা করেছে। সাঈদ ঐতিহ্য স্রেফ চিহ্নিত করেছেন, সন্তোষও সেটা মেনেছেন সেই সঙ্গে পুনরাবৃত্তি বলে একে সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এই দুই সমালোচক থেকে জাহাঙ্গীরের পার্থক্য হলো তিনি আধুনিক শিল্পের প্রথম পর্বে কেবল ঐতিহ্যই দেখেননি, কোনো অবস্থান থেকে ঐতিহ্যের সমালোচনাও করেননি, ঐতিহ্যের আধুনিক রূপায়ণের মধ্যে যে-ঔপনিবেশিক যন্ত্রণা রয়েছে তা ব্যতিক্রমীভাবে আবিস্কার করেছেন। দ্বিতীয়ত, মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিকে জাহাঙ্গীর যখন বলছেন জয়নুলের কাজ “সুন্দর ছবির বিপরীতে ‘বাস্তব’ জীবন তুলে ধরে” “ভাবালুতা অতিক্রম” করে ক্রমান্বয়ে তিনি ‘বাস্তব’কে আদর্শায়িত করেছেন,৩১ তখন অমরা বিশেষভাবে সচেতন হতে পারি যে, জাহাঙ্গীর প্রথম পর্বের শিল্পে এমন এক আধুনিকতার খোঁজ দিচ্ছেন যার মধ্যে নৈতিকতার বোধ সক্রিয়। অন্যদিকে, জয়নুলের কাজের, বিশেষত তাঁর নারীদেহের রূপায়ণ বিচারে জাহাঙ্গীরের বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পের প্রথমপর্বের আধুনিকতায় জেন্ডার-সংবেদনশীলতা নেই। জাহাঙ্গীর এর কারণ হিসেবে পিতৃতান্ত্রিকতার বশীভূত শিল্পীর চৈতন্যকে চিহ্নিত করেছেন। এবং সেই চৈতন্য-প্রসূত রূপায়ণেই নারী তাঁর সমুদয় সংগ্রামের কনটেক্সট থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছে। সে কারণে প্রায়ই নারী হয়ে উঠেছে পুরুষতান্ত্রিক চোখে নির্মিত সৌন্দর্যের পাত্রী। অতএব, বাংলাদেশের শিল্পের সূচনাকালীন আধুনিকতা পিতৃতন্ত্র অতিক্রম করতে পারেনি।

জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসার সূত্রে  জাহাঙ্গীর বিশেষভাবে জানান দিচ্ছেন, “সমাজই যে শরীরকে লাশ করে তোলে এই বোধ বাংলাদেশের শিল্পে ছিল না। […] শরীর ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে লাশ হচ্ছে বারবার। এই কদর্যতা, কদর্যতা উৎসারিত পাশবতা কি করে চোখে মেনে নেয়া যায়? এই প্রশ্ন চিত্র শিল্পের মৌলিক প্রশ্ন, এর সূত্রপাত রেনেশাঁ থেকে? […] রেনেশাঁশিল্প শরীরকে আদর্শায়িত করেছে এবং পাশবতাকে ভঙ্গিতে পর্যবসিত করেছে।”৩২ সমাজ ও শরীরের সম্পর্ক উন্মোচনের মাধ্যমে, বিশেষ করে গয়ার ছবির উদাহরণের সূত্রে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতার বোধ কী ভাবে বাংলাদেশের প্রথম পর্বের আধুনিক শিল্পে সমীকৃত হয়েছেÑজাহাঙ্গীরের সমালোচনা অমাদেরকে সেই পাঠ দেয়।

বাংলাদেশের শিল্পে আধুনিকতার বিচারের ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের একটি প্যারাডক্সিক্যাল অবস্থানও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ বইয়ে। সুলতানের কাজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর দু’ ধরনের আধুনিকতা চিহ্নিত করেন। একটি হলো “আন্তর্জাতিক আধুনিকতা” ও অপরটি হলো “দেশজ আধুনিকতা”।৩৩ যদিও তাঁর সমালোচনায় আধুনিকতার নামকরণে একটি দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যায়। দেশজ আধুনিকতাকে তিনি “বিকল্প অধুনিকতা” হিসেবেও বলতে চেয়েছেন। তিনি সুলতানের শিল্পে আন্তর্জাতিক আধুনিকতার প্রত্যাখ্যান ও দেশজ আধুনিকতার সৃজন আবিষ্কার করেছেন। দেশজ আধুনিকতায় শিল্পী আপন ইতিহাসে ফেরার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর ফলে, জাহাঙ্গীরের বর্গীকরণে দেশজ আধুনিকতার প্রধান গঠনমূলক উপাদান হয়ে ওঠে স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিয়ার বোধ।

সুলতানের কাজের সূত্রে, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর দেখিয়েছেন জমি হলো এমন এক বাস্তবতা যা একই সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। এর সাথে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, খাজনা, মালিকানা, ভাগচাষ, উৎপাদন, বীজ, সেচ ও শ্রমের সম্পর্ক অত্যন্ত জাজ্বল্যমান। অথচ শহুরে শিল্প-সাহিত্যে জমি যে প্রক্রিয়ায় নিসর্গ বা নৈসর্গিক সৌন্দর্যে (সিনিক বিউটি) পরিণত হয়েছে একে জাহাঙ্গীর “ঔপনিবেশিক আধুনিকতা” হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।৩৪ সর্বোপরি, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমালোচনায় বাংলাদেশের শিল্পের অন্তর্গত পরস্পর-বিরোধী “ঔপনিবেশিক আধুনিকতা” ও “দেশজ আধুনিকতা”-এই দুই ধরনের আধুনিকতার খোঁজ মেলে।

 

তথ্যসূত্র:

১। Terry Eagleton, “Towards A Science of the Text”, K.M. Newton (edt.), Twentieth Century Literary Theory A reader,  Macmillan Press LTD, London, 1988, p. 172

২। David Macey, The Penguin Dictionary of Critical Theory, Penguin Books, London, 2000, p. 260-261

৩. উদ্ধৃত, সত্যজিৎ চৌধুরী ও বিজলি সরকার (সম্পাদক), নির্বাচিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সাহিত্য ও সংস্কৃতি-চিন্তা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০০, পৃ.৩৪২
৪. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৫৬
৫. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৪২
৬. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৪২-৩৪৩
৭. সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৪, পৃ.২৩৪
৮. Le Faeuve, Cultural Newspaper of the French Embassy No.9, October 1999, পুনর্মুদ্রিত হয়েছে হাসনাত আবদুল হাই (সম্পা.), সাঈদ আহমদ রচনাবলি (২য় খÐ: ইংরেজি), বাংলা একাডেমি ঢাকা, ২০১২, ঢ়.৩৪২৯. পূর্বোক্ত, ঢ়.৩৪২
১০. পূর্বোক্ত, ঢ়.৩৪৩
১১. পূর্বোক্ত, ঢ়.৩৪৫
১২. পূর্বোক্ত
১৩. পূর্বোক্ত, ঢ়.৩৪৩
১৪. পূর্বোক্ত, ঢ়. ৩৪৬
১৫. সন্তোষ গুপ্ত, শিল্পের কথা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স ঢাকা, ২০১১, পৃ.৬২
১৬. পূর্বোক্ত, পৃ.৬১
১৭. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৯
১৮. পূর্বোক্ত, পৃ.৮৬
১৯. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৩
২০. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৪
২১. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪২
২২. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪১
২৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১
২৪. পূর্বোক্ত, পৃ.১৩২-১৩৩
২৫. পূর্বোক্ত, পৃ.১৩৩
২৬. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, মুক্তধারা ঢাকা ১৯৯০, পৃ. ৩০
২৭. পূর্বোক্ত
২৮. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৩
২৯. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৫
৩০. পূর্বোক্ত
৩১. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪
৩২. পূর্বোক্ত, পৃ.৮১
৩৩. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ.১৪
৩৪. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৭