You are currently viewing বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট || কামরুল ফারুকী

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট || কামরুল ফারুকী

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট

কামরুল ফারুকী

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র।আয়তনে ছোট হয়েও ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থানের জন্য কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।ভারতীয় উপমহাদেশের এক জটিল ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম।সাতচল্লিশের দেশভাগের মধ্য দিয়ে হাজার মাইল দূরের একটি দেশের সাথে এই ভূখ-কে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে জুড়ে দিয়ে যে ভুল করা হয়েছিল,বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেই ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন।সেই হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দুটি।প্রথমটি সাতচল্লিশে ব্রিটিশদের কাছে অর্জিত, দ্বিতীয়টি একাত্তরে রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে নেওয়া।তাই বাংলাদেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য,সমকাল ও ভবিষ্যত আলোচনায় শুধু একাত্তর পরবর্তী উপাদান নিয়ে আলোচনা করলে তার ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে আর্যদের আগমন ঘটলেও বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে।সেজন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অ লকে অনার্যদের দেশ বলা হত,তাকানো হত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে।এমনকি এদেশে ভ্রমণ করলে মানুষের আত্মিক পবিত্রতা নষ্ট হয় এমনও বলা হত।মূলত প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা ও নদীবিধৌত ভূমি হওয়ার জন্য ভারতীয় মূল ভূখ- থেকে এটি ছিল কিছুটা বিচ্ছিন্ন।তাই খ্রীষ্টপূর্ব সময় থেকে নানা সাম্রাজ্যের ভেতর থেকেও বাংলা নিজস্ব রাজশক্তি দ্বারা আ লিকভাবে শাসিত হতে থাকে।সুযোগ পেলে প্রায়ই এখানকার রাজাগণ কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন।সেই হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মুঘল আমল পর্যন্ত বিশেষ করে পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অংশ মাত্র এক তৃতীয়াংশ সময় কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ছিল।তাই বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাঙালীর মজ্জাগত।

তবে ঐতিহাসিক নানা বিবর্তন ঘটলেও বাংলার সামাজিক বিবর্তন খুব অগ্রগামী নয়।এক রাজা চলে গিয়ে আরেক রাজা এসেছে কিন্তু সামাজিক মানুষের জীবনযাত্রার কোন পরিবর্তন হয়নি।মূলত উর্বর ভূমি ও নদ-নদী,খাল বিলের প্রাচুর্য থাকায় প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের সমাজ ছিল আত্মনির্ভর।তাই বৃহৎ সামাজিক শক্তির বিকাশ এখানে সম্ভব হয়নি।একই কারণে বাঙালীর ঐতিহাসিক বিবর্তন সাময়িকতা দ্বারা আক্রান্ত,ইতিহাসের সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার আবির্ভাব নয়।সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এই টলটলায়মান অবস্থা আরও গাঢ় হয় যখন তা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একরাষ্ট্র হিসেবে যোগ দেয়।দেশভাগের মাত্র এক দশক আগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা জন্ম নেয়ায় যেমন পাকিস্তান নিজেই ছিল দূরকল্পনাহীন তেমনি স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর আগে ছয় দফা দাবির মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ ধারণাও এত অল্প সময়ের মধ্যেই যে পরিণতি লাভ করবে এটাও ছিল ঐতিহাসিকভাবে অপ্রত্যাশিত।বাঙালী যখন ভারত থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান চেয়েছিল তখন সে মূলত তার অধিকারই চেয়েছিল।ভারতের কোন কোন অ ল নিয়ে কীভাবে পাকিস্তান হবে তার স্পষ্ট ধারণা সাধারণ বাঙালীর ছিল না।একই বাঙালী পাকিস্তান পাওয়ার পর নিজের অধিকার পাওয়ার পরিবর্তে যখন আরও বেশি করে বি ত ও শোষিত হচ্ছিল তখন সে এ থেকে মুক্তির জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।বাংলাদেশ হলে কী হবে,রাষ্ট্রগতভাবে তা কতটা শক্তিশালী বা দুর্বল হবে,বিশাল ভারতের উদরের ভেতর তার অবস্থান কতটা সদৃঢ় হবে–এতকিছু ভাবার অবকাশ সে পায়নি।মূলত বাঙালী চিরকাল লড়েছে তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারের জন্য।তাই অল্পেই সে অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছে,বৃহৎ রূপরেখা তার সামনে উপস্থাপন করতে হয়নি।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে,স্বাধীন দেশেও সে বাঙালী আজও তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বি ত।বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস যেমন স্থবিরতা,ব নার ইতিহাস;স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসও তেমনি এক সূক্ষè প্রতারণা,উৎপীড়ন ও দমনের ইতিহাস।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮ এ জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে কথা বলা হয়েছে তা থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে।বাংলাদেশ মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে সে তার সংবিধান রচনা করেছে তা বলা যায় না।সমাজতন্ত্র বিষয়টির উল্লেখ তৎকালীন পরাশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে সাহায্যকারী সোভিয়েত ইউনিয়নকে সন্তুষ্ট করার মানসেই যদি রাখা না হত তবে অন্তত তার কিছু আদর্শ বাস্তবায়নের সামান্য চেষ্টা দেখা যেত।বর্তমানে সমাজে সম্পদের সুষম বন্টন তো দূরের কথা দেশের বেশিরভাগ সম্পদ অল্প সংখ্যাক পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে।বাংলাদেশে আসলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে কিছু নেই।এখানে আছে হয় একেবারে উচ্চবিত্ত নয় একদমই নিম্নবিত্ত।এদেশে তার চারপাশ থেকে শিক্ষা বা মূল্যবোধে সামান্য অগ্রগামী নিম্নবিত্ত কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে প্রচার করতে প্রেরণা পায় অথবা কোথাও মধ্যবিত্ত হিসেবে নিজেদের উল্লেখ দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়।এটাই বাঙালীর মধ্যবিত্তের ইতিহাস।স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ও আশির দশকে প্রচুর রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টদের নিয়ম নীতিহীনভাবে শিল্পঋণ দেওয়া হয়।তাদের বেশির ভাগই সে ঋণ সুদসমেত ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়।একটি দরিদ্র দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখে তাই আমাদের বিষ্মিত হতে হয়।যেখানে একজন সাধারণ মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে বি ত হচ্ছে,একটি শিশু স্বাভাবিক খাদ্য পাচ্ছে না–সেদেশে এইসব খেলাপী ঋণকারীরা দামী দামী গাড়ি হাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে,বিদেশে বাড়ি কিনছে। উপহার হিসেবে হয়তো ঋণ পরিশোধের উপায় হিসেবে আবার নতুন একটি ঋণের সুযোগ পাচ্ছে।এভাবে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আমরা রাঘব বোয়ালদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছি।সেদিক থেকে দেখলে বাঙালীর পাকিস্তান আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির সুফল ভোগ করছে সমাজের এই ক্ষুদ্র অংশ।বিপ্লব জনগণের জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তনই আনেনি।এজন্য বুদ্ধিজীবীগণ এ ধরণের বিপ্লবকে বেহাত বিপ্লব বলে থাকেন অর্থ্যাৎ যে বিপ্লব বেহাত হয়ে গেছে।শুধু তাই নয় চিরকালের বিদ্রোহী বাঙালীর সমাজ কাঠামো এমন ফ্রেমবন্দী করে ফেলা হয়েছে যে তার পক্ষে এখন আর নতুন কোন বিপ্লব করা সম্ভব নয়,নীরবে সব সয়ে যাওয়াই এখন তার নিয়তি।কেউ কেউ বলবেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কী কোন পরিবর্তনই হয়নি?হ্যা হয়েছে তো অবশ্যই।অর্থনৈতিক ও মানবিক সূচকে নানা অগ্রগতি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।বিশ্বের প্রতিটি দেশই অগ্রসরমান।তার সাথে তাল রেখে সামাজিক অগ্রগতি হবেই,সমাজ তো একজায়গায় পড়ে থাকবে না।দেখতে হবে তার সক্ষমতার তুলনায় এসব অগ্রগতি কতদূর হয়েছে।সময়ের ব্যবধানে খড়গোশ যদি কচ্ছপের সমান দূরত্ব অতিক্রম করে বা একদিকে এগিয়ে দশদিকে পিছিয়ে যায় তবে সেটাকে শুধু দূরত্বের পরিবর্তন দিয়ে হিসেব করলে যথার্থ চিত্র বোঝা যায় না।

রাজনৈতিক সহিংসতা ও আস্থাহীনতা বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের মূল অন্তরায়।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ব্রিটিশ আমলের চেয়েও বেড়েছে।এদেশের বড় দলগুলো একে অপরকে চুল পরিমাণও বিশ্বাস করে না।বরং ক্ষমতায় গেলে একে অপরের বিরুদ্ধে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে যে তার পক্ষে আর ক্ষমতা থেকে সরে আসার পথ থাকে না।কেননা সে জানে ক্ষমতা পেয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সে যা করেছে ক্ষমতা হারানোর পর তার সাথে প্রতিহিংসাবশত আরও খারাপ কিছু হবে।তাই বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়াকে বাঘের পীঠে চড়ার সাথে তুলনা করেছেন।একবার বাঘের পীঠে চড়লে যে আধিপত্য এবং নেমে গেলে স্বয়ং বাঘের জন্যই যে সমূহ বিপদ–এটাই তার প্রধান কারণ।রাজনৈতিক এই আস্থাহীনতার জন্যই এদেশ তার ঐতিহাসিক বীরদের নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি।যুদ্ধে পরাজিত হয়েও পাকিস্তান সরকার যে বঙ্গবন্ধুর শরীরে আচর কাটার সাহস দেখায়নি সেই বাঙালীই স্বাধীন দেশে তাকে সপরিবারে হত্যা করে স্বশরীরের রক্তখেকো হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে জাতীয় চারনেতা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন,স্বাধীনতার পর নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করতেও আমাদের হাত কাঁপেনি।শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধে যথেষ্ট স্বাক্ষর রাখা আরেক সমর নায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেও বিশ্বদরবারে আমরা নিজেদের রক্তপিপাসু হিসেবে প্রমাণ করেছি।এরপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে সাময়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সংবিধান সংশোধন,প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি আমরা দেখেছি। জাতিসংঘ কর্তৃক দূত প্রেরণ করেও এ বিষয়ে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায়নি।সকল দলের অংশগ্রহণে পারস্পরিক আস্থাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট।এই আস্থাহীনতা আমাদের ঠেলে দিতে পারে আরও বড় কোন ষড়যন্ত্রে এবং এই সংকটের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব ব্যবহার করতে পারে তাদের কলকাঠি নাড়ার কাজে।তাই দোষারোপ ও দমনমূলক নীতি বাদ দিয়ে পারস্পরিক আস্থা অর্জন এখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

একথা সবাই জানেন যে,জনসংখ্যা সমস্যা বাংলাদেশের একটি বিরাট সমস্যা।এত ক্ষুদ্রায়তনের ভেতর এত অধিক জনসংখ্যা পৃথিবীতে বিরল।বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বড় রাশিয়ার জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ১৪ কোটি ৫০ লাখ বাংলাদেশের জনসংখ্যা সেখানে ২০২২ এর সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৫১ লাখ।বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।সীমিত সম্পদ নিয়ে এত অধিক সংখ্যক মানুষের খাদ্য,শিক্ষা,চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেওয়া যে কোন সরকারের পক্ষেই কঠিন।ফলে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উপায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।কিন্তু আমরা জানি আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দেশের বাইরে গিয়ে খুব নিম্নমানের কাজ করে।বিদেশে যাওয়ার আগে তারা যদি প্রয়োজনীয় কারিগরী শিক্ষা নিয়ে যেতে পারতো তবে তারা ক্যারিয়ার জগতে আরও ভাল অবস্থানে থাকতে পারতো এবং বাংলাদেশের রেমিট্যান্স থেকে আয় আরও বেড়ে যেত।আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে।মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের দেশসমূহে প্রকৌশল,ব্যবস্থাপনা,স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের প্রচুর উচ্চপদস্থ ও দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছে।একই সাথে যা বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে এবং আর্থিকভাবেও ভারতকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।দেশের অভ্যন্তরে জনসংখ্যার বাড়তি চাপ ও কৃষিতে প্রযুক্তিগত ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অসংখ্য লোক পাড়ি জমিয়েছে শহরে,বিশেষ করে ঢাকার চারপাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানা গুলোতে।এখানে তারা পরিবেশগতভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।দেশের নাগরিক সুবিধা,জীবিকা সমস্তকিছু একজায়গায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ঢাকা শহরে জনস্রোত একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার।এ শহরের প্রতি ইি তে ইি তে মানুষের লোভ তাই জঘন্যভাবে দানা বেঁধেছে।উপরন্তু যানজট,খাদ্যে বিষক্রিয়া,শব্দ দূষণ,বায়ু দূষণ,নিরাপদ পানির অভাব ইত্যাদি বিষয় ঢাকা শহরকে এক আধুনিক বস্তিতে রূপ দিয়েছে।মানুষ তো দূরের কথা একটা কুকুরেরও এ শহরে আর স্বাভাবিক জীবন-যাপনের উপায় নেই।বাঙালীর রাষ্ট্র গঠনের অভিজ্ঞতা অল্প দিনের,তাই কিছুই সে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারেনি।নগর গঠনের অপরিকল্পনা,নাগরিক সুবিধার বিকেন্দ্রিকরণে ব্যর্থতা ইত্যাদি তার শহর ও নগরগুলোকে দিনে দিনে আরও বেশি কোণঠাসা করে ফেলছে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ইতিহাসে যে নজির স্থাপন করেছিল খতিয়ে দেখতে হবে তার ধারাবাহিক অর্জন কতটুকু।বাংলাকে আমরা মূলত রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলাম,শুধুমাত্র মাতৃভাষা নয়।বাংলা এমনিতেই সকল কালে আমাদের মাতৃভাষা ছিল।আমাদের সংগ্রাম ছিল মূলত শিক্ষা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা।আজ বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষার বাহনকে আমরা বাংলা করতে পারিনি।এখনও উচ্চ আদালতে রায় দেওয়া হয় ইংরেজিতে।ফলে গ্রামের একজন আব্দুল গফুরের যখন আদালতে গুরুতরো সাজা হয় তখন সে বিষয়ে পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণ বের হলেও তার মর্ম উদ্ধার তার পক্ষে সম্ভব হয় না।বাংলায় রায় দিতে গিয়ে বিচারকগণের প্রধান সমস্যা হল যে বেশিরভাগ আইনের বই রচিত ইংরেজি ভাষায়।তাই আইনের রেফারেন্স দিতে গিয়ে তাদের ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হয়।একটি স্বাধীন দেশে আমরা যদি সকল বিষয়ের প্রয়োজনীয় বইসমূহ বাংলায় অনুবাদ করতে না পারি–এ ব্যর্থতা ঢাকবো কী দিয়ে?একই কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে কিন্তু একমাত্র ইংরেজিই যদি আমাদের উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হয়,সেটা যদি আবার বাংলায় যথাযথ বই না থাকার কারণে হয় তবে তা আমাদের জাতীয় লজ্জার বিষয়।প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত ১০০ বছরে মাত্র ৬১ টি মৌলিক বই প্রকাশ করেছে।অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ভাষ্যমতে যার ২৬ টিই এখন বিলুপ্ত।এই যদি হয় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যাপীঠের অবস্থা তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কত করুণ তা সহজেই অনুমেয়।বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বিভিন্ন ডিগ্রীর জন্য গবেষকগণ যে থিসিস করে থাকেন দুঃখের বিষয় যে তার কোন বাংলা অনুবাদও আমরা পাই না।বেশির ভাগ সময় এসব থিসিসে ইউরোপীয় প-িতদের এত প্রভাব থাকে যে তা অনুবাদের সাহস হয়তো আমাদের নেই।ফলে থিসিসকারী ব্যক্তি জনগণের টাকায় বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে পদোন্নতি লাভ করলেও তাতে সমাজ ও জাতির কোন উপকার হয় না।এ কারণে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বে আমাদের অবদান শূন্যের কোঠায়।যেখানে আন্তর্জাতিক নানা বই ও গবেষণা বাংলায় অনুবাদের ইচ্ছে বা ক্ষমতাই আমাদের নেই সেখানে নতুন নতুন বিষয়ে গবেষণা আশা করা আত্মপ্রব নার সামিল।দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ।বলাই বাহুল্য প্রকৌশল বিদ্যার টার্মগুলো শুধু মুখস্তের বিষয় নয়,তার চিত্রটি সম্যকভাবে উপলব্ধির জন্য প্রতিটি বিষয়কে আমাদের বুঝতে হবে।যেহেতু এ বিষয়ের সমস্ত বই ইংরেজির অপ্রচলিত প্রতিশব্দে লেখা,তাই পূর্ব শিক্ষার অভিজ্ঞতাপ্রসূত আমাদের শিক্ষকগণ যেমন তা পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝাতে অক্ষম আমাদের ছাত্রগণও তা পূর্ণাঙ্গ বুঝতে অনাগ্রহী।দেশে ডাক্তারি শিক্ষারও একই অবস্থা।বলতে গেলে একজন ইঞ্জিনিয়ার কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যেমন নতুন করে ইঞ্জিনিয়ার হয় একজন ডাক্তারও কর্মজীবনে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা,পর্যবেক্ষণ,ট্রেনিং ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃত ডাক্তার হন।এক্ষেত্রে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের জন্য বিএসসি বা এমবিবিএস কোর্সটি শুধুমাত্র তার পূর্বস্মৃতির কারণ হয় যার জন্য সে তার পরবর্তী বাস্তব ধাপগুলোকে কিছুটা বুঝতে পারে।এজন্য সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যেমন আমরা সামান্য ফ্লোর লেভেলের কিছু কাজ ছাড়া বড় দায়িত্ব দিতে সাহস পাই না তেমনি সদ্য এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারের কাছেও সামান্য সর্দি-কাশি ও পেটের অসুখের চিকিৎসা ছাড়া যাই না।একই কারণে দেশের বাইরে গিয়ে আমাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা যথার্থ মূল্যায়ন পান না।প্রশ্ন হল দেশে প্রকৌশল ও মেডিকেলবিদ্যার এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান থাকার পরও অন্তত বোঝার সুবিধার জন্য হলেও কেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যাচর্চার নিতান্ত প্রয়োজনীয় বইকে আমরা বাংলায় অনুবাদ করতে পারছি না?বলা বাহুল্য উপযুক্ত শিক্ষার জন্য ব্যবহারিক বিষয়াদিরও যথেষ্ট অভাব আছে আমাদের।উপযুক্ত গবেষণা না থাকার কারণে প্রযুক্তিগত বিশ্বে আমাদের অবদান সত্যিই লজ্জাজনক।আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে না পারি অন্তত নতুন কিছুর ধারণাও যদি বিশ্বকে দিতে পারি তবু বাঙালী,বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ তার নয়া ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি পায়।দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর পরিবর্তে বরং একদম নিম্নস্তর পর্যন্ত ইংরেজিকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো এককালে আমাদের দেশের শিল্পপতিদের বাতিক ছিল,এখন উচ্চ মধ্যবিত্ত,মধ্যবিত্তের মাঝেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।ইংরেজি শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন আছে কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকেই যে ভালভাবে আত্মস্থ করেনি একটি বিদেশি সভ্যতাকে কল্পনায় লালন করলেও বাস্তবে সে তার সমকক্ষ হতে পারে না।ফলে এধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শারীরিকভাবে দেশীয় কিন্তু মানসিকভাবে পাশ্চাত্যে বসবাসকারী একদল সংকর বুদ্ধিমত্তাই আমরা কেবল তৈরি করছি।আশঙ্কার কথা এই যে, এধরণের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এখন মফস্বল শহরেও ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং অচিরেই ব্যাঙের ছাতার মতো রূপ পরিগ্রহণ করবে বলে মনে হচ্ছে।দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া গেলেও মফস্বল শহরগুলোতে ইংরেজি মিডিয়ামের জন্য যে মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া যাবে না তা বলাই বাহুল্য।সুতরাং মেধার নামে তা কথায় কথায় টিয়েপাখি সর্বস্ব সামান্য ইংরেজি শব্দ উচ্চারণকারী কিছু প্রজন্ম সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের পশ্চাদপদতার আরেকটি লক্ষণ।আশির দশকের পর বাংলাদেশে যে পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে তার বিস্তৃতির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সক্ষমতা।পোশাকশিল্পের একচ্ছত্র বিকাশ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি ভাল দিক।তবে এর সাথে সাথে অন্যান্য শিল্পের বিকাশেও যে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ তা দেয়নি।ফলে আরও বিপুল সম্ভাবনা থেকে আমরা বি ত হয়েছি।বাংলাদেশে পোশাকশিল্প এখনও পরনির্ভর বাণিজ্য।যেহেতু আমরা বিশ্ববাজারে নিজেদের কোন বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি তাই ক্রেতারা চাইলে যেকোন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারেন।যেহেতু পোশাকশিল্পের উপরই বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের ৮৫ শতাংশ নির্ভর করে সেহেতু এর উপর অতি নির্ভরশীলতার জন্য বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও জিম্মি হয়ে যেতে পারে।বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ।তাই ইলেকট্রনিক নানা আইটেম ও তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবশ্যই বাংলাদেশকে বিনিয়োগ করতে হবে।প্রযুক্তিগত সকল শাখায় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র না থাকায় দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জনগণের টাকায় পড়ালেখা করা প্রচুর মেধাবী ছাত্র বাইরের দেশে চলে যাচ্ছে।এভাবে মেধা পাচারের ফলে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে।একইভাবে প্রাইভেট সেক্টরের কোন উন্নয়ন না করে গত কয়েকবছর যাবত সরকারী চাকরির অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছে তাদের সাবজেক্টিভ কর্মক্ষেত্র ছেড়ে সরকারী নানা প্রশাসনিক চাকরির প্রতি আগ্রহী হতে।মানুষের ব্যক্তিত্ব ও রুচি অনুযায়ী কিছু পরিমানে এটা হতে পারে কিন্তু সমাজের বিপুল অংশ যদি নিজেদের বিশেষায়িত অ ল ছেড়ে এভাবে একদিকে ঝুঁকে পড়ে তখন বুঝতে হবে কোথাও গভীর কোন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।এটাও একধরনের মেধার অপচয়।বাংলাদেশের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি কারণ ছাত্ররাজনীতি।রাজনীতির যে ধনাত্মক দিকটির দিকে খেয়াল রেখে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় সেটা হয়তো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব।কিন্তু আমাদের মত মৌখিক গণতান্ত্রিক দেশে ছাত্ররাজনীতি শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে জিম্মি করে দেশকে পিছিয়েই দিচ্ছে না,একইসাথে ছাত্রাবস্থায়ই নানা প্রলোভনে পড়ে ছাত্ররা চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি,ভোটডাকাতি ইত্যাদি গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়ছে।ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটা চর্চা এখান থেকেই শুরু হচ্ছে।কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সামান্য অংশ ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বাকি ছাত্রদের তারা জিম্মি করে রাখছে।ছাত্ররাজনীতির এই অবক্ষয়ের কাছে শিক্ষকরাও অসহায়।নানা সময় ক্ষমতার ছায়ায় আশ্রয়পুষ্ট শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।দুর্নীতি বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে আরেকটি শত্রু।এ নিয়ে আর নতুন কিছু বলার নেই।দেশের উন্নয়নে সরকারীভাবে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে বিভিন্ন নেতা ও আমলাতান্ত্রিক কর্মচারীদের হাতে।ফলে রাস্তাঘাট,স্কুল-কলেজ,ব্রীজ নির্মাণ,প্রযুক্তিগত যন্ত্রাংশ আমদানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথার্থ উপযোগিতা জনগণ পাচ্ছে না।দেশের প্রতিটি স্তরে এভাবে দুর্নীতি প্রবেশ করায় শুধু শিক্ষায়তন বা বইপত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলে,আইন করে কোন লাভ হচ্ছে না।কেননা সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্নীতির শিক্ষা ও প্রেরণা পাচ্ছে।

উপমহাদেশের গণতাত্রিক প্রক্রিয়া মূলত গণতন্ত্রের নামে পারিবারিক রাজতন্ত্রের এক নতুন ভার্সন।
ভারত,পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী।এভাবে পারিবারিক গণতন্ত্র যে কোন দেশের রাজনৈতিক আদর্শকে কুক্ষিগত করে ফেলে।এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নেও পারিবারিক ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।ফলে যোগ্য নেতৃত্ব থেকে দেশ ও জাতি বি ত হয়।সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চায় অবশ্যই পরিবারতন্ত্র থেকে বের হয়ে এসে যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে।নয়তো গণতন্ত্রের মোড়কে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র,রাজতন্ত্র ইত্যাদি ব্যবস্থা দেশ ও জাতিকে অবিরতভাবে প্রহসনের নিয়ামক করতেই থাকবে।নানা কারণে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি।অথচ সমভাষী ও সমসংস্কৃতির মানুষের এত আধিক্য পৃথিবীর আর খুব বেশি দেশে নেই।আমাদের সমাজে মানুষের মন ও মস্তিষ্ক কোন একটি সাধারণ বিষয়ে এখনও সমতা লাভ করতে পারেনি।ফলে যে কোন ঘটনাকেই আমরা যার যার ব্যক্তিগত আদর্শ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসি।তাই যে বিষয়টি দলমত নির্বিশেষে সবার জন্যই জরুরি সে বিষয়েও আমরা একমত হতে পারিনা।নাগরিক সমাজের ঐক্যহীনতার এই সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।সমাজে যেকোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে তারা দ্বিধা করছে না।সমাজের বিচ্ছিন্ন কয়েকজন শুধু নাগরিক হিসেবে কোন বিষয়ে দ্বিমত করতে এলেও তার গায়ে রাজনৈতিক সিল লাগিয়ে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে।ফলে উপযুক্ত কারণ ছাড়াই কোন একটি দেশীয় দ্রব্যের মূল্য একলাফে তিনগুন হয়ে গেলেও নিশ্চুপ নাগরিক সামান্য প্রতিবাদ করতে পারছেন না,তার ব্যাখ্যা চাইতে পারছেন না।এমনকি দলীয় স্বার্থে এক বা একাধিক দলের কোন্দলে দেশ অচল হয়ে গেলেও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কারও কিছু করার থাকছে না।আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক দলই এই নাগরিক সমাজের উত্থানকে ভয়ের চোখে দেখে।তার কারণ আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি এটা একটা সত্য,তার সাথে আরেকটা ভয়াবহ সত্য এই যে, বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক অনাস্থা।শহুরে দেয়ালবদ্ধ জীবনে শুধু নয় এদেশের গ্রামের মানুষের মাঝেও আস্থা কম।কিছুদিন আগেও গ্রামে একজনের ইটের বাড়ি হলে আশেপাশের মানুষের তা সহ্য হত না।এখনও বিষ ছিটিয়ে পুকুরের সমস্ত মাছ মেরে ফেলা,বাগানের কচি গাছ কেটে ফেলা ইত্যাদি পত্রিকায় নিত্য দেখা যায়।এর মূলে রয়েছে অত্যন্ত নীচু মানসিকতা ও প্রতিহিংসা।পৃথিবীর অসভ্যতম দেশেও এরকম নজির আছে কিনা জানিনা।এককালে গ্রামে গ্রামে যে গৃহস্থের ধানের গোলা ও পালের পশু পোড়ে উজার হয়ে যেত তার পেছনেও এই প্রতিহিংসা কতটা দায়ী ছিল তা গবেষণার বিষয়।১৯৮০ এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, গ্রামে ৪.৫ শতাংশ এবং শহরে ২.৫ শতাংশ মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করে।১৯৯৯-২০০১ সালে তা বেড়ে ২৩.৫ হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে তা যে আবার নিম্নমুখী হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

বর্তমানে বিশ্বায়নের চাপে সকল দেশের স্বাধীনতাই পরোক্ষভাবে খর্ব হয়েছে।বলতে গেলে গুটি কয়েকটি দেশ বৈশ্বিক নানা প্রতিষ্ঠানের জালে ফেলে অন্যান্য দেশকে কব্জা করে রেখেছে।বিশ্বের মানচিত্রে একটি ছোট ও অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা সেখানে খুবই নাজুক।তবে বাংলাদেশ চাইছে ভারত,আমেরিকা ও চীনের সাথে একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে।সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে তাই তাকে চলতে হচ্ছে অত্যন্ত সাবধানে।ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও একটি বড় রাষ্ট্র তাই ভারতের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি তার আধিপত্যও আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।বাংলাদেশের দলগুলো যেভাবে ভারত বিষয়ে হয় ভারতপ্রীতি নয়তো অন্ধভাবে ভারত বিদ্বেষের একমুখী নীতি গ্রহণ করেছে তার উভয়টিই ক্ষতিকর।যে কোন একটি নীতিকে আদর্শ হিসেবে না নিয়ে পারিপার্শ্বিক বিবেচনার ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নীতি গ্রহণ করা উচিত।ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টনে অসাম্য,সীমান্তহত্যা,পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়া এসবের প্রতিবাদ বাংলাদেশকে বলিষ্ঠভাবে করতে হবে।
ভারতকে ইতোমধ্যেই সেভেন সিস্টারে যাওয়ার জন্য আমরা ট্রানজিট দিয়েছি কিন্তু তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার এখনও আদায় করতে পারিনি।এভাবে বিভিন্ন বিষয়কে কুক্ষিগত করে ভারত আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়কেই প্রভাবিত করছে যা তার কূটনীতির এক বিশেষ অংশ।সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ আরেক ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে।বলতে গেলে বাংলাদেশ এখানে একটি বন্ধুহীন অবস্থানে রয়েছে।চীন,ভারত,আমেরিকা,ওআইসি ইত্যাদি দেশ ও প্রতিষ্ঠান মৌখিক সাহায্যের কথা বললেও কার্যত তাদের বাস্তবসম্মত কোন পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অ লে নানা সংস্কৃতির উপজাতি বাস করায় সেখানে পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের একটি পটভূমি বিরাজ করছিল।এখন রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত হওয়ায় তা নতুন মাত্রা পেয়েছে।সম্প্রতি মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরু হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া একটি ঘোলাটে ও অনিশ্চিত দিকে মোড় নিয়েছে।রোহিঙ্গা ইস্যুকে কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক উত্তোরোত্তর খারাপ অবস্থানে যাবে এবং অভ্যন্তরীনভাবেও বাংলাদেশ নানা জটিলতায় পড়বে।এসবের পাশাপাশি বিশ্বে একদিকে চীন-রাশিয়া অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার আধিপত্যবাদী বিরোধে সৃষ্ট রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সমস্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সংকটের সম্মুখীন।করোনা মহামারি থেকে আপাত মুক্তি দেখা গেলেও বৈশ্বিক এই অচলাবস্থা মোকাবেলা করা বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ ও দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ।সম্প্রতি রিজার্ভ সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলছে।রিজার্ভ সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় আমরা যে অরাজকতা লক্ষ করেছি যেকোন উপায়ে সেরকম পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।তার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি নাগরিকের যথাযথ নাগরিক দায়িত্বপালন,রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট নিরসন এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের সব ধরণের প্রতিবন্ধকতা দূর করে তার যথাযথ বিকাশ।বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ তরুণ সমাজ।এদেশে নারীরাও এখন সর্বক্ষেত্রে অগ্রগামী।সর্বোপরি বাংলাদেশের মানুষ সহনশীল এবং যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেদের সঠিক পথকে চিহ্নিত করতে সক্ষম।তাই নানা সংকট ও আবর্তনের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে উদ্ভূত যেকোন পরিস্থিতিতে স্বকীয়তা বজায় রাখবে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে তার অবস্থান দিনে দিনে আরও সুদৃঢ় করবে।এটা এখন আর শুধু আশাবাদ নয়,এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপরই তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

কামরুল ফারুকী
প্রাবন্ধিক

*************************