গানঃ আঁধার পথে দিলাম পাড়ি, মরন স্বপন দেখে/আঁধার শেষে আছে যে আলো,তার ছবি যাই এঁকে……………
১ম কথকঃ সুধীজন; মরন পথ পাড়ি দিয়ে যে যায় আলোর পথে, সমকাল তারে চেনে বা কতটা জানিনা। সমকাল তারে জানে বা কতটা বুঝি না কিন্তু কাল পার হয়ে আসে যে কাল, অতীত থেকে উৎসারিত তবু অতীত থেকে অগ্রসর। হয়তো সে কাল পিছন ফেরে দেখে কেউ লিখে গেছে আগাম আগমন বার্তা তার।
তবে শুরু হোক গল্প তার। গল্প কোথায়? হয়তো সংগ্রাম, হয়তো বিপ্লব। উল্টোপিঠে হয়তো নির্বোধ নিশ্চিত যাপন, হয়তো বাঁশির নান্দনিক সুর মুক্তির জন্য। বিষের নীল ছোবল সংগ্রামের জন্য, মুক্তির জন্য হয়তো বাঁশি” ও আমার, দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’’ হয়তো বিষ আঁধার পথে দিলাম পাড়ি/মরন স্বপন দেখে…………..।
২য় কথকঃ যদিও শহরের মধ্যে এই পাড়া তবু মনে হয় শান্ত সুনিবিড় পল্লীর কোলেই ওরা আছে। বড় বড় আম জাম নিম আর কাঁঠাল গাছ। বুনো আসাম পাতার ঝাড় ছোট দক্ষিন পাড়কে ঘিরে রেখেছে। আরো দক্ষিনে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির বড় নালা। বর্ষার সময় এই নালা ভরে উঠে পাশের পাহাড়ী ও উঁচু জলের ঢল নিয়ে ঠিক গ্রামের নদী আর জলের মতোই, স্রোতময়ী হয়ে সগর্বে সশব্দে ছুটে চলে।
জগদ্ধন্ধু ওয়াদ্দেদার এর বাসার সামনে যে ছোট্ট জায়গাটুকু তাতে ফুলের বাগান করেছে ছেলেমেয়ে রা। মৌসুমী ফুল নয়। জবা, গন্ধরাজ, স্থলপদ্ম, বেলি, মালতির চিরায়ত রূপ সৌরভ। আর নিকানো উঠোন ডিঙিয়ে মাটির চারদেয়াল ঘেরা গেরস্থালিতে উঠে গেলে সেখানে নিুমধ্যবিত্তের টানাপোড়েন নৈমত্তিকতার গা ছুঁয়ে। কিন্তু প্রাণময় কোলাহল তবু শোনা যায় অনটন উপহাস করে।
অনুজ্জ্বল হারিকেনের আলোয় ভাই বোন সুর করে পড়ে
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পিতাঃ কইরে তোরা? তোদের মা কই?
ছেলেঃ বাবা!
কন্যাঃ বাবা এসেছে মা।
পিতাঃ স্কুলের প্রগ্রেস রিপোর্ট পেয়েছো?
কন্যাঃ হ্যাঁ বাবা আমি এবার ও প্রথম হয়েছি।
পিতাঃ আর গর্দভ টা?
(কন্যা প্রগ্রেস রিপোর্টখানা বাড়িয়ে দেয় পিতার হাতে)
কন্যাঃ বাবা এটা স্বাক্ষর করে দিও।
পিতাঃ আহা এটা যদি আমার মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো!!
(ঘরে প্রবেশ করে মাতা প্রতিভা দেবী)
মাঃ মেয়েটা এতো ভালো রেজাল্ট করলো, আর তুমি এভাবে বলছো।
পিতাঃ যাই বলো মধুর মা! মেয়ে তো মেয়েই। যতো ভালো করুক, কতদূর আর যাবে। বছর না ঘুরতেই বর খোঁজার তাড়া শুরু হয়ে যাবে। তাতে আবার পেয়েছে একেবারে আমার বাপের গায়ের রং, কে যে ওকে নেবে। এই কালো মেয়েকে তো গুন দেখে কেউ নেবে না গো।
মাতাঃ আমার কালো মেয়ে একদিন তোমাদের সবারঘর আলো করবে দেখে নিও।
প্রীতিলতা (রানী)ঃ শুনেছি, আমার জন্মক্ষনে এয়োনারীরা প্রস্তুত ছিল ৭ বার উলুধ্বনি দেবার জন্য। পুত্র সন্তান আলোকিত করবে বংশের মুখ, পিন্ড দেবে পূর্ব পুরুষ মুখে। আমার পিতা ও ছিলেন কান পেতে উৎকন্ঠায় কিন্তু যখন পাঁচবার উলু দিয়ে থেমে গেল ধ্বনি অন্দরে, আমার পিতাসহ স্বজনরা বুঝে নিলেন কন্যার আগমন বার্তা নবজাতকের আগমনে কোন উৎসব হয় নি সেদিন। [কিন্তু এ প্রকৃতিভিন্ন মেয়ে, মায়ের আক্ষেপ, পিতার হতাশা এর কিছুই স্পর্শ করেনা তার সন্ধানী মানসে, যেখানে ঘুর্ণি তোলে অন্তহীন জ্ঞানের তৃষ্ণা কেবল।]
পিতাঃ শোন শোন কান্ড, আজ কি হয়েছে চারজন ডাকাত ঘোড়ার গাড়ী থামিয়ে পাহারাদের মেরে রেলের কর্মচারীদের বেতনের টাকা ডাকাতি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
মাঃ ও মা বলো কি!
বাবাঃ তবে আর বলছি কি? তাও বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ, একেবারে দিনে দুপুরে।
মাঃ ও মা কি দুঃসাহস গো,
বাবাঃ পাহাদারদের হাতে বন্দুক ও ছিল। আমার তো মোটেই মনে হয় না ওরা সাধারন ডাকাত ওরা স্বদেশী দলের হবে।
মাঃ বলো কি গো ক্ষুদিরামের দল?
বাবাঃ ওরা ইংরেজ তাড়াতে মরণ কেও ভয় পায় না।
গান– একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
কথকঃ ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরামের নাম আর তার আত্মত্যাগের গল্প তার ভিতরে এনেছে দেশপ্রেমের আলোড়ন। আজ নিজ শহরে যখন সে শুনে অন্য ক্ষুদিরামদের দুঃসাহসী অভিযানের কথা, তখন রক্তে তার লাগে তুফান। ভিতর থেকে কে যেন তাড়া দেয় তাকে এক অচেনা আঁধারে ঝাপ দেবার মন্ত্রে।
আঁধার পথে দিলাম পাড়ি……
কথকঃ ধীরে ধীরে নামে সন্ধ্যা, আম জাম কাঁঠাল পাতার গা ছুঁয়ে আসা শান্ত বাতাস ঢুকে পড়ে টিনের ছাউনি দেয়া ঘরে। সমস্ত দিনের ব্যস্ত গন্ধ মুছে পাখির নীড়ের মত শান্ত আশ্রয়ে কোরোসিনের শিখায় জ্বলে উঠে দিন শেষের আয়োজন, (মাটিতে বিছানা চাটাইয়ে, ভাই-বোন, রানী আর মধু, সামনে খোলা পাঠ্যপুস্তক)
মধুঃ জানিস রানী, দেয়াল বড় বড় কাগজ লাগছে আঠা দিয়ে। এগুলো নাকি পোস্টার। আমি বাসায় ফেরার সময় দেখে এসেছি।
রানীঃ কিসের পোস্টার দাদা?
মধুঃ যারা রেল ওয়েতে ডাকাতি করেছে তাদের ধরিয়ে দেবার জন্য পুরস্কার ১০,০০০/- টাকা।
রানীঃ দশ হাজার, ও বাবা দশ হাজার !! কত টাকায় দশ হাজার টাকা হয় দাদা।
মধুঃ দশ হাজার টাকা তো দশ হাজার টাকাই, আবার কত টাকায় হয়। এই না হলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি?
রানীঃ কথায় কথায় মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষ বলো নাতো দাদা
মধুঃ তুই কি মেয়ে মানুষ না? মেয়ে মানুষ কে তো মেয়ে মানুষই বলবো
রানীঃ হ্যাঁ আমি অবশ্যই মেয়ে মানুষ, তাই বলে আমার বুদ্ধি কম নাকি?
মধুঃ কম নাতো কি?
রানীঃ দেখো দাদা, আমি মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষ হয়েই আমি প্রমাণ করবো আমি মানুষ, মেয়ে বলে কম কিছু নই।
মধুঃ ইস কি পাকা কথা। কোথায় শিখলি রে? মুন দা শিখিয়েছে?
রানীঃ হুম মনু দা শিখাবে কেন ? আমি নিজেই ভাবি।
মধুঃ শোন না আমি যদি ওই ডাকাত গুলোর খবর পেতাম, তবে ঠিক জানিয়ে দিতাম। দশ হাজার টাকা পুরস্কার, ও বাবা এতো টাকা এই ঘরেই ধরবেই না।
রানীঃ কি বলছো দাদা?
মধুঃ হ্যাঁ তোকে আটআনা দিয়ে লাল ফিতে কিনে দিতাম।
রানীঃ দরকার নেই দাদা আমার লাল ফিতা। সাবধান তুমি ওদের ধরতে যেও না।
মধুঃ তোর কথা শুনতে ইস বয়েই গেছে আমার।
রানীঃ জানো দাদা আমি যদি ওদের পাই তবে ঠিক বলবো ওরা যেনো সাবধানে থাকে। আমি বড় হয়ে ওদের দলে যোগ দেব।
মধুঃ দূর মেয়েরা আবার স্বদেশী হয় নাকি? হতে পারে নাকি/
রানীঃ কেন হবে না? কেন হতে পারবে না।
মধুঃ দূর ছেলেদের কাজ ছেলেদের, মেয়েদের কাজ মেয়েদের।
রানীঃ কক্ষনো না আমি দেখিয়ে দেবো দেশের কাজে ছেলে মেয়ে বলে আলাদা করে কিছু নেই।
গানঃ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি………………..
(বালক বালিকার দল অর্থহীন আনন্দে লাফায় রাজপথের মোড়ে)
বালিকাঃ রানী রানী, ডাকাত দল ধরা পড়েছে। দেখবি নাকি? আয় তাড়াতাড়ি সম্মিলিত কন্ঠে বলতে থাকে- ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে ডাকাল দল ধরা পড়েছে। (দলে এসে দৌড়ে মিশে রানী আর মধু)
রানীঃ কোথায় রে ডাকাত, কোথায়?
পুলিশের সাথে তীব্র বন্দুকযুদ্ধে দুজন আহত স্বদেশীকে নিয়ে এগিয়ে আসা গরুর গাড়িটির দিকে চোখ যায় সম্মিলিত দলের। ভিতরে শীর্নদেহে নিরীহ মুখারবয়রের দুজন বসে আছে হাঁটুতে মাথা গুঁজে। পুলিশের হাবিলদার নির্দয় মারছে তাদের।
মধুঃ ও মা ওরা ডাকাত’’ ইয়া বড় গোঁফ নেই! ভাল মানুষের মত চেহারা।
২য় বালকঃ ও মা ও তো আমাদের মাস্টার মশাই। মাস্টার মশাই ডাকাত হবে কেন?
রানীঃ ইস, কি ভাবে মারছে দেখ। দয়া মায়া নাই
বালকঃ হুম, খুব বাহাদুরি, ধরবে ডাকাত, তা না ধরে নিয়ে এসেছে আমাদের মাস্টার মশাই কে।
রানীঃ ভাল মানুষ মাস্টার মশাইদের উপর খুব ঝাল ঝাড়া হচ্ছে। জানো দাদা আমি বড় হয়ে এর প্রতিশোধ নেবো।
বালকঃ কি ভাবে নিবি?
রানীঃ কেনো স্বদেশী দলে যোগ দিয়ে
২য় বালিকাঃ দূর, মেয়েরা স্বদেশী দলে যেতে পারে নাকি?
রানীঃ কেন পারবে না। আমি হয়ে দেখিয়ে দেবো
বালিকাঃ তাইলে একটা কাজ কর, চুল ছেটে, ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে ছেলে হয়ে যা। অবশ্য তোর যা চেহারা, ভালোই মানাবে।
রানীঃ মোটেই না, আমি ছেলে হবো কেনো? আমি মেয়ে হয়েই স্বদেশী হবো।
‘মনু’ রানীর মা প্রতিভাদেবী তাকে আদর করে ডাকেন মনু। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র এই ছেলেটি যে গোপনে বিপ্লবী দলের সদস্য তা অজ্ঞাত সবার কছে। মূলত দলের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর গোপনীয়তার তা বুঝবার ও সাধ্য নেই কারো। রানীর অর্ন্তজাত বাসনার তেলসিক্ত সলতে তে অগ্নিসংযোগ করে সে চুপি চুপি। হয়তো সচেতন কিংবা হয়তো অসচেতন ভাবেই।
মনুঃ কাকীমা, কাকীমা
রানীঃ দাদা ! দাদা! ওদের বিচার হবে? কি শাস্তি হবে?
মনুঃ তার আমি কি জানি ও সব ডাকাত ফাকাত দের খবর আমি রাখি না।
রানীঃ ওরা ডাকাত নয় দাদা। রেনুর দাদা বলছিল, এদের একজন উমা তারা স্কুলের ইংরেজির মাস্টার মশাই। সূর্য সেন। দাদা ওরা বোধ হয় স্বদেশী।
মনুঃ ওরে বাবা স্বদেশী, সর্বনাশ, ওদের নাম মুখেও নিবি না।
প্রতিভা দেবীঃ কেন রে? কি হলো?
মনুঃ ঐ কাকীমা বলছিলাম, ওসব স্বদেশীর কথা যেনো রানী মুখে না নেয়
প্রতিভাঃ সে তো আমিও বলি বাবা, ঐ মেয়ে তো স্বদেশী বলতেই অজ্ঞান। তোমার কাকাবাবুর কেরানির চাকরি। যদি ওদের কানে যায়, রক্ষে আছে বলো? পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। না খেয়ে মরতে হবে।
মনুঃ হ্যাঁ কাকীমা, ওর মাথাটা যে কে নষ্ট করছে।
প্রতিভাঃ ঐ যে স্কুল থেকে ওর দিদিমনি একটা বই দিয়েছিল ‘ক্ষুদিরামের কথা’ তারপর থেকেই এই অবস্থা। দাঁড়া বাবা যাসনে নাড়কেল মুড়ি খেয়ে যাস।
(মা চলে গেলে মনু এসে দাড়াঁয় গোমরামুখী রানীর কাছে)
মনুঃ কি রে? গাল ফুলিয়েছিস।
রানীঃ তুমি মায়ের কাছে বিচার দিয়েছো কেন আমার নামে?
মনুঃ শোন, কাকীমা চলে আসবে, তোর জন্য উপহার আছে।
রানীঃ কি?
মনুঃ এই নে, (একখানা বাঁশি দেয় রানীর হাতে)
রানীঃ ও মা ! বাঁশি।
মনুঃ হুম আমি জানি তুই খুব ভালো বাজাস।
রানীঃ কতদিন খুঁজেছি এরকম একটা বাঁশি মনে মনে।
মনুঃ তোর মনের খবর আমি জানিতো। শোন এই ব্যাগটা তোর কাছে রাখ। কাউকে দেখাবি না। খুব সাবধান।
রানীঃ এটার ভিতরে কি আছে?
মনুঃ তোর জানার দরকাই নেই। সাবধান খুলবি না, কেউ যেন না জানে।
(প্রতিভা দেবী প্রবেশ করেন হাতে কাঁসার বাটি আর জলের গ্লাস)
প্রতিভা দেবীঃ সত্যিরে মনু, ঐ নিরাপরাধ লোকগুলোর শাস্তি হয়ে যাবে।
মনুঃ জানিনা কাকিমা, যদি এ যাত্রা ছাড়া পেয়ে যায়, তবু যে আইন হচ্ছে বেঙ্গঁল অর্ডিন্যান্স, কেউ পার পাবে না।
গানঃ আঁধার পথ …………
এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, অন্য হাতে অজানা রহস্যের হাতছানি। সেই ছোট্ট বেলায় বাবা মেলা থেকে কিনে এনেছিলেন একটা বাঁশি, তাতে সুর তুলে তুলে বাঁশি তে বড়ো নিপুন নিয়ন্ত্রন তার। চাঁদনি রাতের নিচ্ছিদ্র আলোতে কিংবা অমাবস্যার নির্জন অন্ধকারে তার বাঁশি বেজে উঠে একাকী প্রহরে’’ একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি……..। কিন্তু এই ব্যাগে কি আছে? মনুদাদার ভাবগতি বড়ো রহস্যময়। আগেও এমন ব্যাগ দিয়েছে সে তাকে, আবার নিয়ে ও গেছে। বিশ্বাস ভঙ্গ করে কখনো খুলে দেখে নি রানী। কিন্তু আজ কৌতুহল তার নিয়ন্ত্রনহীন-কি আছে এতে অস্ত্র? টাকা? মনুদাদা সেই ডাকাত নয়তো?? ছি। ছি!! কি ভাবছি দেখেই নেই খুলে, ও মা!! বই!!! দেশের কথা! বাঘা যতীন!! ক্ষুদিরাম!!! কানাইলাল!!!
দাদা, তুমি স্বদেশী! তুমি স্বদেশী দাদা!! কোনদিন তো বুঝতে দাওনি! দাদা!!!
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা
কথকঃ বাসার দক্ষিনে বড় বড় আম জাম কাঁঠাল গাছ। তার ফাঁকে ফাঁকে শটির ঝোপ জংলি কচুবন, নালার উত্তর পাড়ে তাদের বাসার দিকে আসাম লতার জঙ্গঁল। কাশফুল আর ঘেটুফুল অনেক রয়েছে ফুটে। ঋতু পরিবর্তনের হাওয়ায় মৃদু শীতের কাঁপন, পরিযায়ী পাখিদের কিচির মিচিরের øিগ্ধ মনোরম কোলাহল, শহরের যান্ত্রিকতায় এক টুকরো ছোট্ট গ্রাম যেনো, সেখানে এক মাটির ঢিবি, রানী নিজেই পরিস্কার করে নিয়েছে। একান্তে পড়বে বলে। মনুদাদা জানে সে খবর, ঘরে না পেয়ে তাই সোজা বাগানে রানীর খোঁজে।
কি পড়ছিস দেখি? ( টান মেরে নেয় হাতের বইটি)
রানীঃ দাদা, দাদা, কেউ দেখেনি দাদা। আমি এই যে ইতিহাস বই এর ভিতরে এখানে নিয়ে এসেছি। বিশ্বাস কর দাদা, আমি খুব গোপনে রেখিছি। কেউ দেখে নি। কেউ জানে না।
মনুঃ যদি কাকীমা, কাকাবাবু জানতে পারেন রক্ষে থাকবে?
রানীঃ জানবে না দাদা, আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।
মনুঃ তোকে বিশ্বাস করেই তো রাখতে দেই রানী, জানিস যাদের কাছে এই নিষিদ্ধ বইগুলো পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে ওরা।
তাই তো তোকে …………………..
(মনুকে মাঝপথে থামিয়ে এগিয়ে আসে রানী)
রানীঃ দাদা! তুমি স্বদেশী?
মনুঃ বাঁশি শোনা, অনেক দিন তোর বাঁশি শুনি না।
রানীঃ এড়িয়ে যাবে না দাদা, কোনদিন তো বুঝতে পারিনি, তুমি স্বদেশী। সত্যি কথা বল দাদা।
মনুঃ শোন রানী, নেহাৎ তুই খুব ভাল। নইলে সশস্ত্র অভ্যূথান আর ইংরেজ ও দালালদের হত্যা করতে আমাদের মেয়েদের সাথে কোন সর্ম্পক রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু বিপদে পড়ে আমাকে তোর কাছে আসতে হয়। বইগুলো রাখতে হয়।
রানীঃ আমাকে দলে নেবে দাদা! তোমাদের দলে?
মনুঃ মেয়েদের দলে নেবার নিয়ম তো নেই রানী, এ বড় কঠিন পথ।
“কর্ম আর মৃত্যু চাই, প্রশ্ন করার কিছু নাই”, মেয়েরা ওসব পারবে না।
রানীঃ কেন পারবে না দাদা! তোমরা আমাকে রানী বলে ডাক।
ঝাঁসির রানী পারে নি? ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্যদের ডাক দিয়েছিলেন মেরি ঝাঁসি নেহি দেংগি’’ রাজশাহীর রানী ভবানী পারে নি? রানী লক্ষ্মী বাঈ পেয়েছে, তোমাদের রানীও পারবে। কেন পারবে না। এতো আগে তারা পারলো, এখন আমি পারবো না? মেয়েরা জাতির অর্ধেক অংশ, ওদের ঘরে বসিয়ে তোমাদের বিপ্লব সফল হবে ভেবেছো।
মনু মুগ্ধতায় শোনে যায় রানীর তোজদীপ্ত যুক্তিগুলো। দলের নীতি আদর্শ বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়ার নিয়মে, নিজের ভিতর থেকে শুনতে পায় অনিয়মের ডাক, কি অসম্ভব ভালোবাসা তার দেশের জন্য। সে এই লড়াই এ যোগ দিতে পারবে না কেবল মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে? যে জন্মের উপর,তার কোন হাত নেই।
মনুঃ শোন রানী, মেয়েরা ঐ রকমভাবে এখন যুদ্ধ করতে পারবে না। টাকাপয়সা সোনা অলংকার দিয়ে সাহায্য করতে পারবে।
রানীঃ আমি যুদ্ধ করবো দাদা, তোমাদের মত যোদ্ধা হবো। অবুঝ রানীর হাত দুটো ধরে মনু, আমি তোর কথা দলে আলাপ করবো। দেখি কি বলে।
হঠাৎ এসে প্রতিভা দেবী ক্ষেপে উঠেন এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে এসে জোরে চড় কষান রানীর গালে।
প্রতিভাঃ জানো ও তোমার ভাই হয়। রক্তের সর্ম্পকীয় ভাই।
মনুঃ কাকীমা, কাকীমা ওকে আপনি মারছেন কেন? আমি তো
প্রতিভা দেবীঃ ক্ষেপে উঠেন আরো- থাক, থাক তোমার কিছুই বলার দরকার নেই। নিয়ম-নীতি, ধর্ম-অর্ধম বলে কথা থাকে। তোমার মধ্যে কি তাও নেই?
মনুঃ কাকীমা আমি অর্ধমের কাজ তো কিছু করি নি।
প্রতিভা দেবীঃ থাক বাবা আমার অত কথা বোঝার দরকার নেই। তুমি আর কোনদিন আমাদের বাসায় আসবে না।
অশ্র“ঝাপসা চোখে প্রীতিলতার দেখে মনুদাদার অপমান বিদ্ধ চলে যাবার দৃশ্য। প্রীতিলতার আগ্রহ আর লক্ষ্য থেকে কি একই সাথে নির্বাসিত হয় স্বদেশী হবার স্বপ্ন? দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার সংগ্রামে ব্রতী হবার বাসনা? না রক্তে যার জাগে মুক্তির তুফান সে থেমে থাকে না। কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করার পর সে যায় ইডেন কলেজে পড়তে। চট্টগ্রামে তার জন্য রুদ্ধ হয়ে যায় যে স্বপ্নের দরজা, ঢাকায় সে খুজেঁ নেয় তার নতুন ঠিকানা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে গোপনে আবার ডেকে পাঠায় সে মনু দাদা কে , সেই মাটির ডিবি, সেই আম কাঁঠাল আম জাম ফলবতী বৃক্ষের মায়াবতী ছায়া……..
বাঁশি– একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি
মনুঃ কি রে রানী, জরুরী তলব! কাকীমা কই?
রানীঃ মা, রেনুদের বাসায়। শোনো আমাকে পরামর্শ দাও।
মনুঃ কিসের পরামর্শ
রানীঃ এটা দেখো
মনুঃ কি এটা?
রানীঃ দিপালী সংঘের সদস্য ফরম। লীলা দি এটা আমাকে দিয়েছেন। দাদা আমি কি এর সদস্য হতে পারি?
মনুঃ আমার একটু মাস্টার দাদা সাথে আলাপ করে নিতে হবে।
রানীঃ তাড়াতাড়ি জানি ও দাদা, ছুটি শেষে ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতে হবে।
মনুঃ আমি কালই তোকে ফেরত দিয়ে যাবো ভাবিস না। মনে হয় মাস্টারদা অমত করবেন না, আর মেয়েদের এমন আলাদা সংগঠন করে কাজ করাই ভাল।
রানীঃ প্রয়োজনে দেশের মুক্তিসংগ্রামের আমার সর্বস্ব জীবন পর্যন্ত আমি ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি।
গান- আঁধার পথ দিলাম পাড়ি
কথকঃ চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারে এখন জেলা কংগ্রেস কমিটির অফিস। বিপ্লবী সূর্য সেন জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। মনু সেখানে মুখোমুখি হয় বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন এর। উমাতারা হাইস্কুলের ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষক সূর্যসেন নিজের অদ্ভুত চরিত্রবল, সংকটকালে সিদ্ধান্ত গ্রহনের দেশপ্রেমের জন্য চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলে তিনি সর্বসম্মত সর্বাধিনায়ক, গভীর শ্রদ্ধা আগ্রহ আর আশায় তরুন তাকিয়ে থাকে।
সূর্য সেনঃ মা বোনেরা স্নেহ, মমতা ও সেবা দিয়ে আমাদের যে সাহায্য করেন, তারা কিছু দুর্বলতার বন্ধনে ও আমাদের বাধতে চান
মনুঃ মাস্টারদা আপনি অভয় দিলে, আজ আপনার সামনে আমি স্বীকার করি, দীর্ঘদিন সে আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী, মেয়েদের সাথে সংস্পর্শ না রাখার কঠোর নিয়ম থাকা সত্ত্বেও আমি নিরাপত্তা ও গ্রেফতার এড়ানোর জন্য তার কাছে বার বার আমার গোপীনয় বই পত্র, লিফলেট রেখে এসেছি, কিন্তু সে কোনদিন বিশ্বস্ততা ভঙ্গঁ করেনি আমাদের আদর্শের পরিক্ষীত সৈনিক সে।
সূর্য সেনঃ মেয়েদের সর্ম্পূন বাদ দিয়ে এদেশে বিপ্লব হবে আমরা তা ভাবি না। কিন্তু এই রক্তপাত সংঘর্ষ, কঠিন লড়াই এর পথ আমাদের মেয়েরা এখনো তার জন্য প্রস্তুত নয়।.
মনুঃ আমি আপনার কথা মানতে পারলাম না মাস্টার দা, রানীর সাথে দীর্ঘসময় কথা বলে ওর দৃঢ়তা দেখে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে আমাদের মেয়েরা মানসিক ভাবে এই ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। আমরা তাদের প্রতি অন্যায় করছি। তাদের মেয়ে পরিচয়টাকে বড় করে দেখছি।
সূর্য সেনঃ ক্ষানিক স্তদ্ধ হয়ে যান নেতা সূর্যসেন। এই তরুন বিপ্লবীর কথায় তার অর্ন্তজগতে তোলপাড় এক অতীত স্মৃতির। বড় করুন দুঃসহ স্মৃতি। বিপ্লবের বন্ধুর পথের প্রতিমুহুর্তের লড়াই এ অনুশোচনায় দগ্ধ করে তাকে। সত্যি কি এই নারীর প্রতি অন্যায় করেন নি তিনি!!!
সূর্য সেনঃ আমি তখন বোম্বাই এর রত্নাগিরি জেলে বিনাবিচারে আটকে আছি। চট্টগ্রাম থেকে বড় ভাই এর চিঠি পাই। খামখানি খুলে দেখি সেই অপরিচিতা নারীর চিঠি।
“জানি আপন ইচছায় আপনি আমাকে বিবাহ করেন নাই। আপনি দেশের জন্য উৎসর্গীত এক বিপ্লবী প্রাণ।
বিবাহের পর যখন জানিতে পারি আপনাদের বিবাহ করার অনুমতি নাই, কেবল পরিবারের চাপেই আপনি বাধ্য হইয়াছেন। তখন হইতেই আমার মনে আক্ষেপ, কেন আপনি বিবাহের রাত টি পার হইবার আগেই আমাকে ত্যাগ করিয়া গেলেন? আপনি কি একটিবার আমাকে লড়াই এর ময়দানে সহযোদ্ধা করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিতেন না। আপনি কেন পালাইয়া গেলেন’’
ইতি চির অপরিচিতা
সঙ্গেঁ বড় ভাই এর ছোট্ট একটি নোট। কদিন ধরয়িা কঠিন টাইফয়েড জ্বরে ভুগিয়া সে হইলোকের মায়া ত্যাগ করিয়াছে।
সূর্য সেনঃ এই বিপ্লব, এই সংগ্রাম, এই রক্তপাত আদর্শ দেশপ্রেম আমার নিষ্ঠায় কেবল আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই অপরিচিত নারীর শেষ কথাটি কেন আপনি পালাইয়া গেলেন’’ কেন আপনি পালাইয়া গেলেন বীর রা তো পালায় না। তুমি যাও প্রীতিলতাকে দীপালি সংঘের সদস্য হতে বলো। তাকে আমাদের সহযোদ্ধা করে তৈরি হতে সাহায্য কর। তাকে আমাদের আদর্শ পথের সাথী করে আমি আমার পূর্ববর্র্তী পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
মনুঃ আমি যাই মাস্টার দা। আমি তাকে খবরটা জানাই। সে ভারী খুশি হবে।
সূর্য সেনঃ দাড়াঁও। আপাতত এ বিষয়টি তুমি আমি আর সে ছাড়া কেউ জানবে না। তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। আমি তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।
কথকঃ বিপ্লবী দলে মধ্যে সূর্য সেন এর নেতৃত্বাধীন ‘‘যুগান্তর’’ দলটি ছিল নেতাজি সুভাষ বোস এর অনুসারি। অন্য বিল্পবী দল “অনুশীলন” থেকে যুগান্তর ছিল অধিকতর শক্তিশালী। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে স্বদেশ ভূমি মুক্ত করা অসম্ভব এমত বিশ্বাস থেকে যুগান্তর পরিকল্পনা করছিল সশস্ত্র বিল্পবের। ১৯২৯ সাল ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ১ম স্থান অধিকার করে ২০ টাকা বৃত্তি পেয়ে প্রীতিলতা যখন ভর্তি হয় কলকাতা বেথুন কলেজে তখন মাস্টারদার সকাশে তার উপর অর্পিত হয় গুরু দায়িত্ব।
সূর্য সেনঃ আমি জানি আপন যোগ্যতায় আপনি নারী হয়েও বিল্পবী চক্রের এক গুরুত্বপূর্ন সদস্য হয়ে উঠেছেন। এতোদিন অর্থ সংগ্রহ করে প্রচারপত্র বিলি করে আপনি আমাদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চাই।
প্রীতিলতাঃ দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আমি যে কোন দায়িত্ব পালন করতে সদা প্রস্তুত।
সর্যসেনঃ আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করা। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন অফিস ধ্বংস করে চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন অচল করে দেয়া।
প্রীতিলতাঃ আমাকে আদেশ দিন।
সূর্যসেনঃ আপনি আপনার চক্রের সদস্য কল্পনা সরোজিনী নলিনী ও কুমাদিনীকে সাথে নিয়ে সেই অপারে শানের জন্য সমস্ত বোমার খোল কোলকাতা থেকে নিয়ে আসবেন। মনু আপনাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দেবে। খুব সাবধানতার সাথে দায়িত্বটি পালন করতে হবে। প্রীতিলতা মনু ও সূর্যসেন একত্রে শপথ করে। আধার পথ দিলাম পাড়ি/মরন স্বপন দেখে …………………….
চেতনার যে অগ্নিস্কুলিঙ্গঁ ভিতরে ভিতরে স্তুপীকৃত হচ্ছিল প্রচন্ড বিস্কেরন আকাক্সক্ষায়, বিল্পবী বইপত্র পাঠচক্রের অনুশীলন যাতে যোগান দিচ্ছিল দাহ্য, আদর্শের আত্মত্যাগের, মাস্টার দা সূর্যসেনের সান্নিধ্যে তা যেন দাও দাও জ্বলে উঠে বাংলার এক সামান্য নারীর অসামান্য অন্তরে …………..
রোজনামচা লেখা বিপ্লীদের নিত্যকর্ম। প্রীতিলতা ডায়েরিখানা নেয় হাতে। আজ একটি গরুত্বপূর্ণ দিন তার জীবনে, দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াই এক বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার হাতে। হঠাৎ দৃষ্টি যায় বাঁশি টির দিকে। অদৃশ্য বাতাসের খেলায় কি স্বর্গীয় সুরধারা নামে এই বাঁশিতে। কি অসীম শক্তি সেই অদৃশ্য বাতাসের, (মনু এসে দাঁড়ায় পাশে মাথায় হাত রাখে প্রীতিলতার) সে সুর তাকে ডাকে বিপ্লবের পথে-
মনুঃ দায়িত্বটা বিশাল। খুব সাবধান রানী। তোর উপর নির্ভর করছে পুরো অপারেশান এর সার্থকতা।
রানীঃ দাদা, তুমি ও থাকবে সে অপারেশানে?
মনুঃ মাস্টার দা এখনো আমাকে বলেন নি। তিনি যাকে বলবেন।
রানীঃ আমি জানি তুমি থাকবে।
মনুঃ আমি ও চাই তাতে অংশগ্রহণ করতে।
রানীঃ দাদা, তুমি আমাকে এ বাঁশিটি কেন দিয়েছিলে?
মনুঃ তুই খুব ভাল বাজাস, বাজাতে ভালোবাসিস তাই। এ প্রশ্ন কেন?
রানীঃ দাদা আমি জানি, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অপারেশানে তুমি থাকবে।
মনুঃ হ্যাঁ আমি থাকবো, হয়তো এই তোর সাথে আমার শেষ দেখা, জানি না সে অপারেশানে কি ঘটবে।
রানীঃ একটাই তো জীবন পায় মানুষ বাঁচবার জন্যে। তুমি বিপ্লবী বলে বলছি না, সাধারণ ছাপোষা মানুষ ও বলো, কার জীবন নিশ্চিত যাপনে? বেচেঁ থাকা মানে প্রতিদিন লড়াই, প্রতিদিন যুদ্ধ, জীবন যুদ্ধ।
মনুঃ একটাই জীবন পায় মানুষ বাঁচবার জন্যে, সেই যুদ্ধ কেবল নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য, দেশের জন্য করে যাওয়া, সেই জীবনে এমন কিছু করে যেতে হয় যেনো পৃথিবী মনে রাখে। ভালো থাকিস রানী। কাজটা সাবধানে করিস।
রানীঃ বাঁশিটা নিয়ে যাও দাদা, আমি লড়াই এর জন্য যখন নিজেকে তীব্র দৃঢ়তায় তৈরি করি, তখন এই বাঁশি আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দেয় বার বার। আমার ভয় হয় কখন আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ি। কখন তোমাকে আদর্শচ্যূত করি। আমার মন চঞ্চল হয়ে পড়ে।
মনুঃ চঞ্চলতাকে এড়িয়ে নয়। শাসনে নিয়ন্ত্রন করাই প্রকৃত বিল্পবীর ধর্ম। (মনু চলে যায়)
প্রীতিলতাঃ (ধীর পায়ে ভারাক্রান্ত মনে মনোনিবেশ করে তার রোজ নামচায়। ডায়েরিতে লিখে)
“এ কোন পথে জীবনকে আমি ভাসিয়ে দিলাম। এই তো আমার টেবিলে রাধাকৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বগীয়। এই প্রেমকে কেন আমি তুচ্ছ ব্যক্তি জীবনে টেনে আনি? এমন ভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালোবাসতে হবে। আর কোন প্রেম ভালোবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতো আমার প্রেম আমি উজাড় করে ঢেলে দেবো দেশ কে। আমি নিজেকে নিঃশেষে দান করে যাবো।”
নতুন জীবনের অভিষেকে অক্লান্ত নিষ্ঠাবান রানী, নিজের ব্যক্তিগত মধুর ব্যবহার কলকাতা ছাত্রী নিবাসে প্রিয় হয়ে উঠে সবার। ঘনিষ্ট সহযোগী কল্পনা দত্ত সরোজিনী পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিত দের নিয়ে গড়ে তোলে পাঠচক্র। মেয়েদের উদ্দীপ্ত করতে চায় দেশপ্রেমে” অন্যদেশ থেকে এসে বনিকের মানদন্ডকে গায়ের জোরে রাজদন্ড বানিয়ে যারা আমাদের শাসন করছে, শোষন করছে আমাদের, আর তাদের দেশীয় দোসর সামন্তবাদী জমিদার, জোতদার, ধনীদের দালালীর দরুন আজ আমাদের সোনার দেশের মানুষ ভিক্ষুক, নিরক্ষর উলঙ্গ ও সহজ মৃত্যুর শিকার। আমরা এর প্রতিশোধ নিতে চাই। আমরা চাই জন্মভূমির ঋণ শোধ করতে” । বন্দে মা তরম
১৯ এপ্রিল, ১৯৩০, কলকাতার ছাত্রী নিবাসে ভীষন উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম রাত কাটে প্রতিলতার। অস্থির পায়চারি করে সে কক্ষের এ প্রান্ত ও প্রান্ত, বিশ্বস্ত সঙ্গী কল্পনা আসে দৈনিক নায়ক পত্রিকা হাতে, উৎকণ্ঠিত প্রীতিলতা ঝুঁকে পড়ে পত্রিকায় “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল- টেলিগ্রাফ ও টেলিগ্রাম অফিস ধ্বংস- রিজার্ভ পুলিশ লাইন অধিকার।” আনন্দে আবিষ্কার করে সংবাদটি। কিন্তু এ কি! শহিদদের তালিকায় এ কার নাম !! দাদা !! বুকফাটা আর্তনাদে বুক চিরে নেমে আসে যন্ত্রনা দু’চোখ বেরে অশ্র“ধারা স্মৃতিগুলো যেন হেটে যায় বায়োস্কোপের ছবির মতো। দাদা !! দাদা !!।
“আলোর পথ যাত্রী ……….. এ যে রাত্রি ………….. এখানে …….. থেমোনা। মুহুর্ত মাত্র। সহ যোদ্ধারা এগিয়ে আসে চারদিক থেকে
এ কান্নার সময় নয়
এ সময় দুর্বলতায় নয়
এ সময় ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের নয়
এ সময় লড়াই এর
এ সময় বিপ্লবের
এ সময় ত্যাগের
সময় ধ্বংসের
সময় মৃত্যুর/ আমাদের মাতৃভূমি বিপন্ন/ জন্মভূমি বন্দী সময় স্বাধীনতার।
আমরা প্রস্তুত, দেশের মুক্তিসংগ্রামে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত।
বি,এ পরীক্ষার পর যখন চট্টগ্রামে ফিরে প্রীতিলতা তখন চট্টগ্রাম জুড়ে বেড়ে গেছে পুলিশ ও মিলিটারির তৎপরতা। আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার জন্য মরিয়া ইংরেজ বাহিনী। প্রতিলতা ব্যস্ত হয়ে পড়ে মাস্টারদার সঙ্গে একটিবার দেখা করার জন্য। মাস্টারদার সাথে দেখা করতে গিয়ে ঘটে ধলঘাট আক্রমন। সহযোদ্ধা অপূর্ব, ভোলা নিহত হয় পুলিশী অ্যাকশনে, প্রীতিলতা আর সূর্যসেন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সে দিন। ফের যেদিন দেখা হয়, সেদিন রচিত হয় বাংলার ইতিহাসের এক অনির্বচনীয় গাথা। (মাস্টারদা, প্রীতিলতা ও অচেনা একটি লোক মুখোমুখি)
মাস্টারদাঃ প্রীতিলতা আপনি জানেন চট্টগ্রাম ক্লাবের বাইরে ফলকে কি লেখা আছে।
প্রীতিলতাঃ জানি, কুকুর ও বাঙালীদের প্রবেশ নিষেধ।
মাস্টারদাঃ কুকুর ও বাঙালীদের প্রবেশ নিষেধ। আমরা তাদের কাছে কুকুরের মতো।
অচেনা লোকঃ কুকুর ও বাঙালীদের প্রবেশ নিষেধ!!। থুঃ থুঃ
মাস্টারদাঃ পুলিশ লাইন আক্রমনের সময় ঐ চট্টগ্রাম ক্লাব ও আমাদের টার্গেট ছিল। কিন্তু ঐ দিন ছিল গুড ফ্রাইডে, আমরা পারি নি। কারন ক্লাব বন্ধ ছিল। শৈলেশ্বর কে তারপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সে ও সফল হয়নি। ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে।
প্রীতিলতাঃ আমি সব জানি মাস্টার দা।
মাস্টারদাঃ তারা ক্লাব সে সরিয়ে নিয়েছে পাহাড়তলী। সেই ক্লাবে আক্রমনের দায়িত্ব আমি এ বারে আপনাকে দিতে চাই। আমি আপনাকে ব্যর্থ দেখতে চাইনা। ও কাদির আলী। ইংরেজদের ক্লাবের বাবুর্চি। সে এই কাজে আমাদের সাহায্য করবে। আসুন আমরা পুরো পরিকল্পনাটি বুঝে নেই।
কথকঃ ক্লাবের দরজা/ জানালার সংখ্যা, প্রবেশ ও নিস্ক্রমন পথ, নৃত্যে ব্যস্ত পানোন্মত্ত ও ইংরেজরা কখন একটু অসতর্ক থাকবে। ক্লাব পাহারার নিযুক্ত সশস্ত্র পুলিশ বা সৈনিকের সংখ্যা কত ইত্যাদি সঠিক তথ্য যথাসময়ে জানান দেবে কাদির মিয়া, তার সঙ্গে সহোযোদ্ধা থাকবে শান্তি চক্রবর্তী, কালি দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, পরো পরিকল্পনাটি বুঝে নিয়ে প্রীতিলতা যখন ফেরে ঘরে, পিতা মাতা পরিজনরা জানেনা তাদের প্রিয় রানীর এই আপাতঃ নিরীহ অবয়বের পিছনে কি দুঃসাহসী প্রস্তুতি ……..
ছোট বোনঃ কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও বড়দি, এতোদিন পর কোলকাতা থেকে ফিরলে, একটু আমাদের কোলকাতার গল্প শুনাবে, তা নয়। সারাদিন বাইরে বাইরে
প্রীতিলতাঃ বাবা কোথায় রে?
বাবাঃ রানী ফিরলি?
প্রীতিঃ হ্যাঁ বাবা!
বাবাঃ কই কই থাকিস, দেশকাল ভালো নয়। কখন কি হয়!
প্রীতিঃ আমাকে নিয়ে ভয় পেয়োনা বাবা।
বাবাঃ হ্যাঁ তুই আমার শান্তলক্ষী মেয়ে, নইলে কি আর এতদূর পড়তে পাঠাই? শোন মা স্মৃতি, রীতা ও যোগ্য হয়েছে। তুই বড়, তোর বিয়ে না দিয়ে তো ওদেরকে দিতে পারি না। তুই শিক্ষিত মেয়ে, তোর মতামত ছাড়াতো কিছু হবে না। কয়েকটা ভালো প্রস্তাব আছে হাতে ………………..। তোদের সুপাত্রস্থ করে শান্তিতে দুচোখের পাতা বন্ধ করতে চাই মা।
বাবা স্নেহার্দ বুকে টেন কন্যা প্রতিলতাকে। আলোকিত আকাশের মতো পিতার উদার বুকে মাথা রেখে দুচোখ চেয়ে অবিরল অশ্র“ধারা নামে তার, পিতা সযত্নে মুছে দেন।
পিতৃ গৃহ ছেড়ে স্বামীর সংসারে প্রবেশের প্রস্তুতিতে এ অশ্র“জল বিসর্জন তো বাঙালী নারীর চিরন্তন।
গানঃ
খাকি পোশাকে সজ্জিত হয় প্রীতিলতা, কোমরে চামড়ার কটিবন্ধে গুলিভরা রিভলবার, চামড়ার খাপে ভরা গুর্খা ভোজালি। পাড়ে মোজা ও বাদামী বং এর ক্যানভাসের রাবার সোলের জুতা, মাথার দীর্ঘ কেশরাশিকে সু-সংসবদ্ধ করে বাধা হয়েছে উপরে সামরিক কায়দায় একে একে সবাই পা ছুঁয়ে আর্শীবাদ নেয় মাস্টারদা সূর্য সেনের। সবার শেষে প্রতিলতা এসে দাঁড়ায় মাস্টারদার মুখোমুখি। দৃষ্টি স্থির। চোয়ালে বজ্র কঠিন প্রত্যয়। পা ছুঁয়ে প্রনাম করে সে সূর্যসেনের। আর্শীবাদের হাত রাখেন তিনি প্রীতিলতার মস্তকে। সবাই বজ্রমুষ্ঠি হাত তোলে উপরে “বন্দে মা তরম” ।
গানঃ
ইংরেজ ক্লাবের চারপাশে তখন প্রস্তুত প্রীতিলতার নেতৃত্বে তার সহ যোদ্ধারা। ভিতর থেকে ভেসে আসে হালকা সুখের মূর্ছনা …………….।
১ম জনঃ আমরা পারবো তো দি দি?
২য় জনঃ এর আগে কতবার ব্যর্থ হয়েছে তারা।
৩য় জনঃ এই শেষ সুযোগ দিদি।
প্রীতিলতাঃ পারবো না মানে! পারতেই হবে। পারতে হবেই আমাদের। সবাই সতর্ক!! সাবধান সবাই উৎপেতে উৎকণ্ঠায় তারা ………….. তখন হঠাৎ জানালা দিয়ে প্রতিফলিত হয় উজ্বল টর্চের আলো, জ্বলে, নেবে। কাদির মিয়ার সংকেত। প্রীতিলতা আদেশ দেয় চার্জ ……….। এগিয়ে যায় সবাই ক্লাবের দিকে ………. গুলি, বোমা …..আঘাতে উদ্দাম বল নৃত্যের আসরে মূহুর্তে নেমে আসে মৃত্যুর বিভীষিকা হাহাকার আর ধ্বংসলীলা ………….।
শোষক শাসকের মৃত্যুশয্যায় দাঁড়িয়ে বিজয়োল্লাসে শ্লোগান দেয় তারা- বন্দে মা তরম !! বন্দে মা তরম !! প্রীতিলতা হুইসেল বাজায় প্রত্যাবর্তনের আদেশে, সহযোদ্ধাদের সবাইকে আগে দিয়ে সামরিক নিয়মে নেতা প্রীতিলতা থাকে সবার পিছনে …………….. এই সাফল্যের খবর এক্ষুনি দিতে হবে মাষ্টারদাকে। সবাই আনন্দে আত্মাহারা ছুইছে সামনে হঠাৎ প্রীতিলতা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে, একটা গুলি লাগে কাঁধে।
প্রীতিলতাঃ মা, মাগো
সহযোদ্ধারাঃ দিদি, কি হয়েছে দিদি……………….
প্রীতিলতাঃ তোমরা পালাও, তোমরা পালাও, ঐ যে দেখো একজন আহত ইংরেজ হাতে বিভলবার। ঐ যে দেখো যাচ্ছে। সবাইকে খবর দেবে। তোমরা ভাগো।
যোদ্ধাঃ তোমাকে ফেলে দিদি?
প্রীতিঃ আমি আমারটা দেখবো, আমাকে সাথে নিতে গেলে তোমারও প্রাঁণে বাচঁবে না, পালাও, মাষ্টারদাকে বলবে, তার দেয়া দায়িত্ব আমি পালন করতে পেরেছি।
(দৌড়ে পালাতে থাকে সহযোদ্ধারা)
প্রীতিলতাঃ সব রক্তে ভিজে গেছে। আমি আর দৌড়ে পালাতে পারবো না এখান থেকে। দৌড়ে যাবার ক্ষমতা নেই আমার। ঐ তো সাহেবগুলো আসছে। এক্ষুনি ধরে ফেলবে আমাকে। শুরু হবে নির্যাতন, ওদের নাম বলার জন্য, মাষ্টারদার ঠিকানা বলার জন্য, আমার নারীত্ব নিয়ে অপমানের হোলি খেলা খেলবে তারা। না তা হবেনা। তা হতে পারে না।
(কোমর থেকে সায়ানাইডের পোটলা টি বের করে ঢেলে দেয় মুখে প্রীতিলতা)
অন্যহাতে কোমর থেকে বের করে তার খুব প্রিয় বাশিঁটি মৃত্যুর আগমনকে ক্ষনিক থমকে রেখে বাঁশিটি উপরে তুলে ধরে প্রীতিলতা, তারপর বলে- বন্দে মা- তরম, দাদা আমি আসছি তোমার কাছে…………….. আধার পথ