You are currently viewing বর্তমান অবর্তমানে / ইশরাত তানিয়া

বর্তমান অবর্তমানে / ইশরাত তানিয়া

বর্তমান অবর্তমানে

ইশরাত তানিয়া

আশপাশ থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসে। এলাকার লোকজন এরা। আর বাকিদের কেউ ভ্রাম্যমান সবজী বিক্রেতা, মুটে মজুর, জুতো পালিশওয়ালা, হকার, স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ। বিকেলে ছায়া দীর্ঘতর। স্থিরতা আর অস্থিরতার মাঝামাঝি ঢিমে তালে চলছে শহরতলী। সিগারেট ধরিয়েছিল কেউ। ফেলে দিয়েছে। ফ্লাস্কে করে চা ফেরি করা ছেলেটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছে- নড়বেন না। এমনও বলছে- চোখ বন্ধ করে রাখুন। নাবিলার কানের জানালা অব্দি এসে কথাগুলোর কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। মাথার ভেতর চলছে ঘটাং ঘটাং। সে আছে জাম গাছের বিষণ্ণতায়। পাশে হিজল গাছ। জাম হিজলের পাতা ছুঁয়ে বাতাস অন্য কিছু নিয়ে আসে। সবুজাভ। সে আর যাই হোক কোনো নির্দেশনা নয়। উত্তেজনা নয়।

কিছুদিন ধরেই শহরবাসী ভাবছিল এমন বাতাস আগে বয়ে যায়নি। ফি বছর ফাগুন এসেছে এত পরাগ ভাসেনি। সেদিন অফিসফেরত রাতুলের সাদা শার্ট লাল রেণুতে এতোটা উজ্জ্বল হয়ে ছিল যে দূর থেকেও নাবিলা দেখতে পেয়েছে। রাতুল অবাক গলায় বলেছে- কান্ডটা কী হলো! রাতুল যদি একটু বুঝত ওকে। একটা তাঁতের শাড়ি আর গোল টিপ। সুরুচির। সেই তো রিনরিনে প্রত্যাশার গান শুনে ঘুমিয়ে পড়া আর জেগে ওঠা। কানে রেশ লেগে রয়। শরীর ছুঁয়ে ছেনে বেরিয়ে যাওয়া প্রজাপতিরা পুষ্পরাগ মেখে দেয় না। ডানা ভাঙা প্রজাপতি ফেলতে ফেলতে কাজের লোক বিরক্ত- ‘আপা, এতো পাখনা ছিঁড়া পজ্যা কই থেইকে আসে!’

উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নাবিলা। হাত দুটো সামনে। ঠিক যেন যোগাসনের ভঙ্গী। স্থান, কাল, পাত্র পরিমাপ করে সবকিছু অনুষ্ঠিত হতে হবে সংবিধানে এমন কোনো আইন নেই। থাকতও যদি তার প্রয়োগ বাস্তবতার নিরিখে প্রশ্নবিদ্ধ। কাজ হাতে নিয়েই বেরিয়েছিল নাবিলা। ঢিমে বিকেলটা পিচ রঙা হতে হতে হয় না। থমথমে ঘোলা। সব কিছু গুছিয়ে প্রত্যাশার কাছাকাছিও না। বিষাদ জমে জমে আইসবার্গ। ম্যালানিন কমে ধূসর হলো সাদা। ধুধু বরফ ছাওয়া রাজ্যে তীক্ষ্ণ শৈত্যপ্রবাহ দাঁত বসিয়ে যায়। তাইগায় ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়ি নেই। মাথায় বরফের স্তুপ নিয়ে ওকে-পাইন দাঁড়িয়ে নেই। শুধু স্কি পরে উদয়াস্ত বরফ-ঝড় ঠেলে যাওয়া। বরফে ডুবে যায় পা। গায়ের ভারী পশমের কোট বাঁধন খুলে উড়ে যায়। একটু দূরেই চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কুঁড়ে দুলছে। চোখের সামনেই। সেখানে চুলোর ওপর চায়ের জল ফুটছে আর একোর্ডিয়ানের সুর ভাসছে। শুধু মাঝের পথটুকু আর পেরোন হয় না। শীতল ধোঁয়াটুকু রেখে ক্রমাগত দূরে সরে যায় ভ্রাম্যমান কুঁড়ে।

ঘটাং ঘটাং এখন একটু বেশিই হচ্ছে রেল স্টেশানের কাছে। লেভেল ক্রসিং এ মানুষজন দাঁড়িয়ে কিছু দেখছে। ‘ভয় পাবেন না’- এ শব্দগুলোও নাবিলার কাছে ঘেঁষতে পারে না। মালগাড়ির ফাঁকে ফুঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। নাবিলার বুকে ব্লাউজের সেফটিপিন গেঁথে যাচ্ছে। নড়বার যো নেই। সে অনুভব করতে পারে না সেফটিপিনের সুচালো আগা চামড়া ভেদ করে মাংসে পৌঁছেছে। রেল লাইনের ওপর শুয়ে  ও প্রায় অবশ হয়ে আছে। পুরোটা লাইন হিম কাঁটা। ছোটখাটো সেফটিপিনের খোঁচা গুরুত্ব পাবে এমন আশা করা অসমীচীন। যখন মাথার ওপর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে এক এক করে পঞ্চাশটি ওয়াগন। আবহমান কাল ধরে এভাবেই সে শায়িত বোধহীন একটি জীবন কাটিয়েছে। চাকার শব্দেও তার মস্তিস্ক আলোড়িত হয় না।

মন খারাপ লাগছে নাবিলার। কতটা বদলেছে সে। আজন্মের জন্য সিমেন্ট বালি খোয়ার ঢালাই পড়ে গেল। ঠিক যেন নরম ধুলোর মেঠোপথে ইটের সোলিং আরো পরে কালো পীচ ঢালা রাস্তা। কাঁচা মাটি হারিয়ে গেছে। ফিরে গেছে হাসনাহেনার ঝাড়। এখন বৃষ্টির পর রাস্তার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণ ভাপটুকু শুধু বেরিয়ে যায়। সে জানতই না প্রবল অবসাদ কালো গুহার মতো তাকে গিলে নিচ্ছে। যেন ব্ল্যাক হোল। বেরোবার পথ নেই। গুহার আঁধারে জোনাকির গায়ে রঙ ঢেলে উড়িয়ে দিয়েছিল। বেমালুম ভুলে গেছে এ কথা। উড়ন্ত আলোর পতঙ্গ হারিয়ে শূন্য গহ্বর একলা জাগে।

গুহা এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। কেউ জানত না কখন অগ্নি উদ্গিরন শুরু করবে কালো ধোঁয়া আর ধুলোয় আকাশ ছেয়ে। অথচ রেল স্টেশানের দক্ষিণ দিকে আপ লাইনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল সে পেপার বিল দেয়া হয়নি। মান্থলি ডিপোজিট স্কীমের টাকা জমা দেয়ার শেষ দিন আগামীকাল। আজকে বাজার করে ফিরতে হবে। লন্ড্রির ছেলেটাকে ফোন করবে রাতে। দরজাটা লক করেছিলো নাকি মনে করতে পারে না। দক্ষিণা বাতাসে স্পষ্টত সে কেঁপে ওঠে অনেক বছর পর। এতো ফুলের রেনু এসে হাতে মুখে মেখে যাচ্ছে। তার নিস্তরঙ্গ জীবনে এমন বিঘ্ন আগে ঘটেনি। এই রহস্যোন্মোচন করতে গিয়েই দিন দিন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে সে। এতটা আত্মভোলা হওয়া ঠিক নয়। নিজেকে বলে নাবিলা। লাইন পার হবে সে। ডাউন লাইন থেকে আসছে মালগাড়ি।

ফুলের পরাগগুলো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই গরম লাভার প্রবাহ ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে। শ্বাস রোধ হয়ে আসে। সক্রিয় লাভার গতি বাড়ছে। হিমশিম খেয়ে আপ লাইনেও যে মালগাড়ি আসছে সে লক্ষ্যই করেনি। দুটো ট্রেনের হুইসেল একই সময়ে বাজাতে সতর্ক হতে পারেনি। খেয়াল করতেই দেখে আপ লাইনের মালগাড়ি একেবারে কাছে চলে এসেছে।

পৃথিবী ভেতরের সমস্ত লাভা ঢেলে দিয়েছে। মাথাটা বিকল হলো তক্ষুনি। সময় পেল না নাবিলা আগুপিছু হবার। মালগাড়ির গতি ছিল কম। তবুও ইঞ্জিনের কাউক্যাচারে ধাক্কা খেয়ে নাবিলা দু’লাইনের মাঝে পড়ে গেল। তখনও হ্যান্ড ব্যাগ হাতে ধরা। সাদা-প্রুশিয়ান ব্লু। কালো বেল্টে বাদামি পাঞ্চ ক্লিপ আটকানো। স্যান্ডেল একটি ছিটকে পড়েছে রেল লাইনের বাইরে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পথচারীরা দাঁড়িয়ে যায়। নির্ঘাত মরে গেছে মেয়েটা। যদি দৈব ক্রমে বেঁচেও থাকে। মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দে ট্রেন চলে গেলে আতঙ্কেই একটা অন্যথা ঘটবে। আশাহীন হয়েও তারা বলে যাচ্ছে- চোখ বন্ধ করে রাখুন। ভয় পাবেন না। আরেকটু ক্ষণ। সাথে যুক্ত হয়েছে রেলকর্মী কয়েকজন। চাকার কর্কশ শব্দের সাথে পাল্লা দেয় উঁচু গলার আওয়াজ।

কেন যে আলাভোলা মানুষটার জন্য ইনবক্সে কড়া কয়েক লাইন রেখে এলো সে। বেশির ভাগ কথাই ডানে বামে বেঁকে যায় নইলে উলটো ধায়। সোজা পথে তার কথা কমই হাঁটে। কি এক ক্ষোভ নাকি অভিমান তার সোজা কথাগুলোর পথ ঘুরিয়ে দেয়। পৌষের কুয়াশায় ঠাহর করা দায়। যা সে বলতে চায় ঠিক তার বিপরীত কথাটি বলে। তারপর তীব্র কষ্ট। সেই মানুষটিও কষ্ট পায় যে থাকে অন্য জগতে। কিছুটা বিচলিত। দূরে থেকেও নাবিলার অক্ষমতা বোঝে নিশ্চিত তাই লাভা থেকে টেনে তোলে। হাত পোড়ায় গরম ছাই পাথরে। নাবিলার কালিঝুলি মাখা গায়ে রঙিন জোনাকি এসে বসে। কত দিনের চেনা বন্ধু। ভুলে যায়নি। ঘণ্টা বুড়োর ঢং ঢং শোনা যায়। ওরা বেরিয়ে যেতেই ঝুরঝুর ভেঙে পড়ে গুহা।

নাবিলার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। ‘মরে যাব’ বলে কাউকে কথা দেয়নি। তাই এপিটাফ টেনে আনেনি।  ডাউন লাইনের মালগাড়ির গার্ড হাফিজুল ওয়াকিটকি হাতে নিয়েছে মহিলা কাটা পড়ার খবর জানাতে। মালগাড়ি চলে যাবার পর সবাই নাবিলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ডালিমের স্ফটিকোজ্জ্বল লাল নাকি রক্তের লাল, কোনটি বেশি সুন্দর? ভিড়ের মধ্যে কারও মনে হতে পারে- দেখে নেয়া যাক। মৃত চোখ কি কথা বলতে পারে? সে কথাগুলো কি খানিকটা এগিয়ে পথভুলে ডানে বামে চলে যায়? এবার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হোক। রাতুল থানা-পুলিশ করবে কিংবা বেওয়ারিশ সে পড়ে থাকবে লাশ কাটা ঘরে। সেখানে নীল মাছির ভনভন নাও থাকতে পারে। অন্য জগতে যে থাকে সে এক মুঠো জোনাকি জ্বালিয়ে দিতে পারে ঘুমন্ত চোখের পাতায়।

রেল পুলিশ এগিয়ে আসার আগেই কয়েকজন ওকে ধরে ওঠায়। ঘোরের মধ্যে কিছুক্ষণ। সম্বিত ফিরে পেয়েও পায় না। বরফে লাভায় চরমভাবাপন্ন বৈপরীত্যে স্নায়ু শিথিল। নাবিলার দুহাতের কনুই আর নাকের ওপরটা ছিলে গেছে। গা ব্যথা করছে। কমের ওপর দিয়েই গেছে বলা যায়। হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন নেই। বর্তমানেই বাঁচা। তার অবর্তমানে কিছু এসে যায় না। অত্যাশ্চর্য জীবনকে ভালোবেসে যাওয়া। জাম-হিজলের বাতাসে ঘটাং ঘটাং মালগাড়ি বইছে করোটির ভেতর। ভিড়ের সব লোকজন দক্ষিণা বাতাসে একই বনজ গন্ধ পায় কিন্তু কিছুই প্রকাশ করে না। তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। অবিশ্বাস্য এই ঘটনার সাথে এমন বিরল বাতাসের কোনো সম্পর্ক আছে কি না।

কেউ স্যান্ডেল এগিয়ে দেয়। পা গলিয়ে শাড়ি সামান্য ঠিকঠাক করে নেয় নাবিলা। তাকে যেতে হবে। এক আত্মীয় অসুস্থ। মরণাপন্নকে শেষবার দেখার জন্য সে বরফ ভেঙে পা বাড়ায় খালি রিকশার দিকে। তার পাশাপাশি একটি প্রজাপতি উড়ছে।