You are currently viewing বইয়ের ভিতর বাহির/ বদরুজ্জামান আলমগীর

বইয়ের ভিতর বাহির/ বদরুজ্জামান আলমগীর

বইয়ের ভিতর বাহির

বদরুজ্জামান আলমগীর

কেউ  পড়ে যান বইয়ের পাতা, তার চোখের সামনে একের পর অন্য ভেসে আসে কাহিনীর ইন্দ্রজাল। বইয়ের পাতা সারি সারি পিঁপড়ামতো অক্ষরে পরিপূর্ণ, কিন্তু তারা মেলে ধরে জগতের সমস্ত বিস্ময় ও আলোকিত সিন্দুক। অডিও ক্যাসেট যেমন মৃত ফিতামাত্র নয়, একটি ম্যাটালের স্পর্শে তার অন্তরে বেজে ওঠে বিবিধ বর্ণ আকুতির সঙ্গীত, বই তেমনি জড় এক পদার্থ যার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে জগতের সেরাসেরা বিজ্ঞানীর জটিলকঠিন সূত্রসমূহ, জীবন পরিচালনার আশীর্বাদমান বাণীগুচ্ছ, প্রকৃতির অজস্র খেয়াল, মানুষের উন্নতিকর বহুমুখী উদ্যোগ। জীব, জগৎ, ব্রহ্মাণ্ড এবং মানুষের জিজ্ঞাসা যতো দীপ্রগভীর, বইয়ের রাজ্য তেমনি বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য। রিটা ডোভ যেমন বলেন, বইয়ের আয়োজনের ভিতর জগতের সম্মিলিত পদধ্বনি ঘুমিয়ে থাকে, বইয়ের পাতায় যে গন্ধ তা গোটা সভ্যতার সুবাস।
ফলে সমগ্রে মানুষ যা- যেভাবে মানুষ ইতিহাসে ঘনবদ্ধ- বই তার নির্নিমেষ বোঝাপড়া, মোকাবেলা ও লাগাতার ধারাবর্ণনা। বই ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হবার আগের  ইন্টারনেট; অধুনাকার ভার্চুয়াল দুনিয়া তৈরি হবার আগেই ভার্চুয়াল জগৎ। এক স্বপ্নজীবী কথক বুনন করে, অদেখা পুণ্যজীবী গ্রাহক তা পাঠ করে, গ্রহণ বা অগ্রহণের দড়ি টানাটানিতে লিপ্ত হয়; যেমন কাশীরাম দাস ভনে শোনে পুণ্যবান। জোহ্যান উল্ফগ্যাঙ গ্যাটে এবং  ওয়াল্ট উইটম্যানের পারস্পরিক জবানিতে  তেমনই একটি বয়ান শোনা যাক: ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে গ্যাটে বলেন, গোটা প্রকৃতিই একটি জীবন্ত বই- যদিও তাকে বোঝার ক্ষেত্রে ভুলভাল হয়, কিন্তু তাকে সামগ্রিকভাবে বোঝের মধ্যে আনা সাধ্যের বাইরের কিছু নয়; ওয়াল্ট উইটম্যান তাঁর  মৃত্যুর আগেআগে যেন গ্যাটের কথাটিকেই একটি পরিপূর্ণ জ্যামিতিতে বাঁধেন; উইটম্যান বলেন, আসলে প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই- তা পর্বত, বৃক্ষ, নক্ষত্র- বা যা কিছুই বলি, কী হোক জীবন অথবা মৃত্যু- সবকিছুর মাঝেই নিহিত আছে একটি অর্থ, বা অর্থময়তা যা একটি মরমিয়া ইঙ্গিতের অন্তরে লুকিয়ে থাকে!

ফলে বই যাদুর দরোজা খোলে : একে একে ব্যাখ্যা করে কোথা থেকে এলো এই বস্তুমণ্ডল, রঙ, রূপ, গন্ধ, পতন ও উদ্ভব, এই অগণন জ্যোতিপুঞ্জ; সৃষ্টির আদি মুহূর্তে ছিল না কোন পরিচিত পদার্থ- অণু এবং পরমাণু কিছুই না; কতিপয় মৌলিক কণার মধ্যে চলেছিল অপরিসীম শক্তির খেলা। এক জটিল পথপরিক্রমায় ক্রমশ সৃষ্টি হয়েছে পদার্থ : নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ, এমনকী অবশেষে প্রাণ!

অন্যদিকে ধর্মগ্রন্থ কহে:

১. আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। ২. পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। ৬. পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক, ও জলকে দুই ভাগে পৃথক করুক। ৮. তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। (নির্বাচিত অংশ উদ্ধৃত। পবিত্র বাইবেল : আদি পুস্তক; জগত সৃষ্টির বিবরণ।)

ধর্ম ও বিজ্ঞানের উপর্যুক্ত বক্তব্যে আপাতত প্রযুক্ত না হয়ে এ-কথা নৈকুন্ঠ্যে বলা চলে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজে একটি মহাগ্রন্থ, তাকে অনিঃশেষ পাঠ করা চলে। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের কথাই ধরা যাক : সবুজ ও শীর্ণ পত্রালির ঘরে কোত্থেকে আসে এমন লক্ষনিযুত মোরগের ঝুঁটি; অগণন নক্ষত্র আর নীহারিকাপুঞ্জের বাড়ি কোথায়, সমুদ্র কি করে হলো এতোবড় বারিপাত্র, কীভাবে মরুভূমির বাউবাব কাণ্ডে পরিত্রাতা জল সঞ্চিত থাকে, সমুদ্রের ভিতর থেকে কীভাবেইবা সুউচ্চ হিমালয় গড়ে ওঠে!

জন্মের পর থেকেই মানব শিশু আকাশের নীল থেকে উদারতা শিক্ষা করে, সে দ্যাখে মাটি কতো ফলবতী ও সহিষ্ণু, পাহাড় বলে মৌনতা ও সংকল্পের কথা। তাই, নিসর্গ তার কাছে প্রথম পাঠ: অ আ ক খ।

প্রকৃতিতে মানুষের বিস্ময় একের পর এক নির্মাণ করে বহুবর্ণিল আশ্রয় ও বেদনা। এইজন্যে মুসা পয়গম্বর লাঠি ফেলে অবলীলায় পার হয়ে যান নদী, যিশু খ্রিস্ট করস্পর্শে মৃতকে নোতুন জীবন দান করেন; হযরত মোহাম্মদ অঙ্গুলি নির্দেশে বিভক্ত করেন সুদূর প্রতিষ্ঠিত চাঁদ। কেননা, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠলো রাঙা হয়ে।’

বই একটি দেয়াল গড়ি ও তার চলমান কাঁটা- আমাদের জানান দেয় : মানুষ এক মুহূর্তের জন্যও বসে নেই; এতোবড় তৃষ্ণা কী তার শেষ হতে পারে? অজানাকে জানার অসীম তৃষ্ণা গুমর হয়ে আছে বইয়ের আত্মায়। লালন ফকিরের বাণীর সঙ্গেই দেখি গভীর বাতেনি অর্থে বইয়ের কেমন সখ্য তৈরি হয়ে যায়: আমায় ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না- আমি গোপনে বেশ্যার ভাত খেয়েছি; কাম গোপন, প্রেম গোপন, মুর্শিদ লীলা নিত্য গোপন- দেহে তোমার মক্কা গোপন।

অজানাকে জানার নিভৃত আকাঙ্ক্ষা ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে নোতুন পৃথিবীতে নিয়ে যায়, ক্যাপ্টেন কুক যান দক্ষিণ মহাদেশে, স্কট ও এমাল্ডসেনের পায়ের আওয়াজে চমকে ওঠে কুমেরু, ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মহাশূন্যে মানুষের বিজয়ের টিপসই অঙ্কন করেন। ইহাই মানুষ : গ্রীক পুরাণে ইকারুস দাসত্ব ঘুচাতে মোমলাগানো পাখায় পাড়ি দিতে যায় অথৈ সমুদ্র সীমা। ইউলিসিস সমস্ত রাজ্যপাট ছেড়ে জ্ঞানের অন্বেষায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। শাক্য বংশীয় রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র গৌতম জরা, মৃত্যু ও দুঃখের কারণ অনুসন্ধানে তামাম বৈভব পিছনে ফেলে নিভৃতচারীব্রত গ্রহণ করেন। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি সবরকম বইয়েরই কেন্দ্রীয় আভিমুখ্য জিজ্ঞাসা: তার শেষ নাহি যে! একমাত্র ধর্মগ্রন্থের বাণী চূড়ান্ত, প্রশ্নবিহীন উত্তর।

ইতিহাস একটি চলমান বই। আদিকাল থেকে মুখে মুখে ইতিহাস, তথ্য, ঘটনারাশি বর্ণিত হতে হতে একটি সামগ্রিক অমুদ্রিত গ্রন্থরূপ লাভ করে। এমন অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ আছেন যাঁরা খাঁটি অর্থেই একেকজন কালের জন্মদাগ- তাঁরা  কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক ঘটনা, ধর্মকাহিনী কিংবা যুদ্ধবিগ্রহের এমন বর্ণনা হাজির করেন,মনে হয় এইমাত্র বুঝি ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঘটে গেল! তাই বই সম্পর্কে ‘সেতুবন্ধ’ শব্দটির একটি সুখী ব্যবহার করা চলে। পিতা-মাতা  পুত্র-কন্যার বই, পুত্রকন্যাও মা-বাবার সামনে আনকোরা বই। পুত্র-কন্যা মা-বাবাকে পাঠ করে শেখে ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ ও সম্পর্কের নিষ্ঠা, মা-বাবা বাচ্চাদের পাঠ করে জানে- নিজেদের কতোটা নোয়ালে পরে বাৎসল্যের বালামে নিজেদের নথিভুক্ত করা যায়। বই জিজ্ঞাসায় সুউচ্চ গগণশিরীষ, ফলভারে মুহ্যমান আমলকী গাছ।

বই মানুষের জীবনের অনুবাদক এবং ঘটনা প্রবাহের ডাকহরকরা। কারো একাকিত্বে বই প্রাণের পাশে দাঁড়ায়, আবার কখনো শত আত্মীয়ের ভিড়েও নিঃসঙ্গতায় রঙিন করে তোলে- যে নিঃসঙ্গতায় রবীন্দ্রনাথ রঙিন, ফ্রিদা কাহলো সারাদুনিয়ার ব্যথা, রংধনু জংশন।

বই একজনকে অন্যজনের সঙ্গে যত্নশীল পার্থক্যে একীভূত করে, বই-ই প্রত্যেককে তার নিজস্বতায় বিশিষ্ট করে তোলে। হারুকি মুরাকামি সহজ একটি বাঁকের মধ্যে এই কথাটি বলেন: সবাই সচরাচর যে বই পড়ে, তুমিও যদি একই বই পড়ো- তাহলে তুমি গড্ডালিকা প্রবাহেরই একজন; আর তুমি যদি বই পড়ো অন্যরকম, তাহলে তুমি ভাবো, এবং কথা বলো আলাদা।

সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, ছাপার হরফে কোন মিথ্যা থাকতে পারে না। তা সর্বতো সত্য নয়। যেমন গাবগাছ অশোকতরুসদৃশ হলেও তাদের মধ্যকার পার্থক্য দুর্লঙ্ঘ, তেমনি বই হলেও তা কুশ্রী এবং আপত্তিকর হওয়াও অসম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে, ঘোরতর অসুস্থ, বিকৃত, ক্ষতিকর বিষয়ের পক্ষাবলম্বন করে বই আছে অগণন।

আমরা জানি, রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রোধ করেন। কাজটি যতো মহৎ ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল কঠিন। সতীদাহ প্রথা রোধ করার অনিবার্য প্রয়োজন সম্পর্কে তিনি নিজে এবং অন্যরা অনেক যুক্তিতর্ক হাজির করেন। শেষপর্যন্ত এই প্রচেষ্টা সমাজে কার্যকর হয়। কিছুদিন আগেও দিল্লীর একটি নারী সংগঠন জোর দিয়ে বলেন, সতীদাহ প্রথা রোধ করে দেওয়া তাদের জন্য অনেক অকল্যাণ বয়ে এনেছে। কয়েক বছর আগে ভারতে রূপ কানোয়ার নাম এক মহিলা সতীদাহে আত্মাহুতি দেন। সতীদাহ প্রথা রোধ করার কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁরা জানান, মৃত স্বামীর সঙ্গে জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা নিতান্ত অমানবিক এবং সামাজিক অপরাধ। উপরন্তু স্ত্রী আগে মৃত্যুবরণ করলে স্বামীকে চিতায় ভস্ম করা হয় না। যদি হতো, তা হলে একদিক থেকে বলা যেতো যে, দাম্পত্য জীবনের নিষ্ঠা বজায় রাখার জন্য এ ব্যবস্থা জারি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এ-নিয়ম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিষ্ঠুর উদ্দীপনা ছাড়া আর কিছু নয়।

অন্যদিকে যে-সব নারী এবং পুরুষ সতীদাহ সমর্থন করেছিলেন তাঁরা প্রধানত বলেছিলেন পাপের কথা, তাঁরা ছিলেন ঈশ্বরবিরোধী গর্হিত কাজের জন্য পরকালে শাস্তির ভয়ে উদ্বিগ্ন, সর্বোপরি তাঁরা সমাজে নির্বিঘ্ন রাখতে চেয়েছিলেন পুরুষের একচ্ছত্র মোড়লিপনা। তাঁরা দাবি করেন, জীবন্ত পুড়ে আত্মাহুতি দেয়ার যে কষ্ট তার চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতন তাদের সইতে হবে পরকালে। তার ওপর আছে সামাজিক অনিশ্চয়তা এবং ‘রাক্ষসী’ হিসাবে স্বামী খেয়ে ফেলার লজ্জা।

আগে ছিল, এবং এখনো এ-ধারণা প্রচল যে, স্ত্রীর আগে স্বামী মারা যায় একমাত্র স্ত্রীর অপকর্ম বা পাপের কারণে। উপরিউক্ত দুটি পক্ষ অবলম্বন করেই বই লেখা হয়েছে। সমস্যা হলো যে, দুটি বক্তব্যকেই একসাথে সত্য বা সমর্থনযোগ্য হিসাবে ধরে নেওয়া যায় না। কেননা, সতীদাহ প্রথা সমর্থন কিংবা অসমর্থন করার মাঝামঝি কোন অবস্থান নেই। যেমন, মধ্যবর্তী কোন অবস্থান কোপারনিকাস কিংবা গ্যালিলও’র ছিল না। ধর্মগ্রন্থ বলেছে যে, পৃথিবী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সূর্য গলদঘর্ম হয়ে রাতদিন গর্দভ দেবতাদের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ান! প্রথমে কোপারনিকাস এবং পরে আরো নিদিষ্ট করে গ্যালিলিও দেখালেন যে, আসলে সূর্য স্থির, পৃথিবী তার চারিদিকে ঘোরে। এ-কথা বলার জন্য কোপারনিকাস ও গ্যালিলিওকে অনেক দণ্ড ভোগ করতে হয়। এ বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। বই আমাদের চিন্তাক্ষেত্রে ঐক্য ও অনৈক্য বলে দেয়, সমাজ সভ্যতার ধারাবর্ণনা করে।

পাঠাভ্যাস ছাড়া সময়ের সঙ্গে পা মেলানো যায় না। আগে সমাজ দেহে যে স্থবিরতা ছিল এখন তার জায়গা দখল করেছে গতি। বই মানুষের জন্য একমাথা থেকে অন্য কিনারা পর্যন্ত জাল ফেলে প্রতিদিন তুলে আনে সুপ্রভাত। কিন্তু অতিমাত্রিক গ্রন্থশীলতা থেকে চিন্তার বন্ধ্যাত্ব তৈরি হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই, মাও সেতুঙ বলেছিলেন বইকে ভালবাসার কথা, কিন্তু বিরোধিতা করেছিলেন বইপূজা।

একটি অসত্য অনেক মিথ্যার সূত্র তৈরি করে। বর্তমানে নানাক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে শঠ ও প্রতারক আছে কাড়িকাড়ি; তাই সংখ্যায় বিভ্রান্তিকর ও অপগ্রন্থই বেশি। অনেকের ধারণা, যে বই পড়তে জানে না- সে অকাট মূর্খ। কেউ নিরক্ষর হতে পারেন, কিন্তু কোনভাবেই মূর্খ কিংবা অশিক্ষিত নন।

এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা বিশেষরকম কাজে পারদর্শী। যেমন একজন অনক্ষর লোক বিষাক্ত সাপ ধরতে পারেন, অন্য একজন চমৎকার মাটির পাত্র বানাতে পাকা, অনন্য এক চাষী বিনা অক্ষরে পাঠ করতে পারেন প্রকৃতির পালাবদল, নিরক্ষর ধাত্রীমা কী অপার দক্ষতায় নবজাতকের জন্ম দিতে পারেন।

এখানে একথা স্মরণযোগ্য যে, যে-কেউ সৃষ্টিশীল কিংবা উৎপাদক তাকে অবশ্যই অভিনিবেশের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, কেবলমাত্র দেখলে চলে না। বই নিজে কোন গ্রন্থ নয়। বই বহু বিস্তারিত ও কার্যকর হয় যখন পাঠক অন্ধ পড়ুয়ামাত্র নন। শিক্ষা আলো বলে তাকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে হয়। বই শিক্ষার্থীর সুচরিত মানস গঠনের নিমিত্ত উদ্ভাসিত ও বিষন্ন পঙ্ক্তিমালা বর্ণনা করে, নিম্নের কাহিনী তেমনি একটি গল্প :

মহাভারতের একলব্য ক্ষত্রিয় ছিল না। সে সমরবিশারদ দ্রোণাচার্যের কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে গেলে দ্রোণাচার্য তাকে শিষ্য হিসাবে অগ্রহণ করেন। কিন্তু তাতেই একলব্য দমে যায়নি। গোপনে দ্রোণাচার্যের মূর্তি স্থাপন করে স্থিরসংকল্প একলব্য সমরবিদ্যা চর্চা করে। একদিন একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তার অনুশীলনের একাগ্রতা নষ্ট করে, তাতে সে তীর ছুঁড়ে কুকুরের মুখ আটকে দেয়। সেই বিদ্ধতীর সারমেয়কে অনুসরণ করে দ্রোণাচার্য একলব্যের সন্ধান পান। একলব্য দ্রোণাচার্যকে গুরু হিসাবে তার সপর্যার সাকল্য ও ভক্তি প্রদর্শন করে। দ্রোণাচার্য তার কাছে গুরু দক্ষিণা দাবি করেন যে, ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি তাঁকে কেটে দিয়ে দিতে হবে। একলব্য জানে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিলে সে কখনো তীর ছুঁড়ে মারতে পারবে না; তবুও সে নিঃসংকোচে তার গুরুকে পরম শ্রদ্ধায় বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে সমর্পন করে।

এখানে একলব্য পরাজিত শিক্ষার্থী, দ্রোণাচার্য নিরাপদ শিক্ষাগুরু, কিন্তু বসুন্ধরায় অবস্থিত বিপুলব্যাপক পাঠকের কাছে একলব্য শিক্ষক, দ্রোণাচার্য স্বার্থপর সমরকুশলী মাত্র।

বইয়ের কাছে পাঠক প্রত্যাশা করেন বিনয়, সততা এবং একনিষ্ঠার পরম বিন্যাস।

বই গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউস যে মানুষের জন্য বহ্নিশিখা হরণ করে আনে, যিশু খ্রিস্টের সত্যিকার হাত যার স্পর্শে অন্ধের দৃষ্টি ফেরে, পথচলার মাইলফলক যাতে খোদাই করা থাকে- কতদূর এগুলো মানুষ : ইহা একটি আয়না যে প্রতিবিম্বিত করে উল্লাসের বেলুন মহল, বেদনার ঝাড়বাতি এবং সংকীর্ণতার নোংরা কুয়া। বই এমনকী মহাভারতের দুঃশাসন যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে। বই একই সঙ্গে ছাত্র ও শিক্ষক, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া, রাত্রি এবং ভোরবেলার গাথা। বই হাজার কোটিবার বর্ণনা করে মানুষের বীভৎসা, এবং প্রতিপক্ষে তার নিষ্ঠুর সংগ্রামশীলতার কয়েকবিন্দু জয়ধ্বনি।

বই ছাড়া অন্য কিছুকে সমগ্র বিশ্বের প্রতিনিধি বলা সম্ভব নয়। বই মানুষের জীবনে নিদারুণ এক উচ্চতা রোপন করে।

রে ব্রেডবারি উদ্বেগজনকভাবে একটি চমৎকার কথা বলেন, কেউ যদি ভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিকভাবে সমূলে বিনাশ করে দেবার জন্য তাদের সমস্ত গ্রন্থাগার পুড়িয়ে ফেলাই যথেষ্ট, তাতে কোন ফল হবে না; ওই জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রকল্প অব্যর্থ দাওয়াইয়ের  কাজ করবে- যদি পাঠাভ্যাস থেকে পুরোপুরি তাদের মুখ ফিরিয়ে আনা যায়!

বই সকল প্রশ্নের মীমাংসা করে দেয়; সঙ্গেসঙ্গে আরো জিজ্ঞাসার মূলে গেঁথে ফেলে। বই প্রত্যেকবার তার সীমাবদ্ধতার কথা জানান দেয়, এখানেই তার মহত্ব। মানুষকে আরো দূরের অধ্যবসাঋদ্ধ নিশানা ইঙ্গিত করে, প্রতিবার ঘোঁট পাকিয়ে যায় প্রকৃতি, মানুষ ও মহাকালের গূঢ়ৈষা।

সর্বোপরি বইয়ের ভিতর আমাদের অনিঃশেষ যাত্রার ধ্বনি চিহ্নিত আছে বলেই এ-বেলায় অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কথা মনে পড়ে যায়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিনি বলেন, এই বিশ্বের সব থেকে দুর্বোধ্য ব্যাপার হচ্ছে যে, সে বোধগম্য।

কবি, নাট্যজন, অনুবাদক।