বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ কিযী তাহনিন
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মন-মানচিত্র সাহিত্যকর্মের বার্তা সাহিত্যের পাঠকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য কবিসাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে। আজ আমরা কথা বলেছি কথাসাহিত্যিক কিযী তাহনিনের সাথে। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দেড় নম্বরি প্রকাশিত হয়েছে পাঠক সমাবেশ থেকে। বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ১৪ নম্বর পাঠক সমাবেশের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ধ্রুব সাদিক।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার প্রকাশিত গ্রন্থের ব্যাপারে জানতে চাই। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতিও যদি শেয়ার করতেন।
কিযী তাহনিন: দেড় নম্বরি বইটিতে নয়টি গল্প। গল্পের থিম প্রেম। তবে মোটা দাগে প্রেমের গল্পের বই একে বলা যাবে না। এ গল্পগুলো একটি ছেলে আর একটি মেয়ের সেই তথাকথিত প্রেমের গল্প নয়। জীবনের প্রতি প্রেম, বেঁচে থাকার আকাঙ্খার প্রতি প্রেম, ক্ষমতার প্রতি প্রেম, নানাভাবে প্রেম এসেছে। গল্পে প্রেম এসেছে নানা ছুতোয়, অলি-গলি ধরে। পুরানো ঢাকার স্যাঁতস্যাঁতে হলদে এক বাড়ির দেয়ালের ফাঁক দিয়ে। কখনো জড়বস্তুতে কখনো জীবের প্রতি প্রেম এসেছে গল্পের অনুসঙ্গ হয়ে। প্রেম এসেছে শত্রু হয়ে, খেলার পুতুল হয়ে, প্রেমের মতন করেও প্রেম এসেছে। গল্পে যতবার জীবন এসেছে, প্রেম এসেছে, বিষাদ হয়ে, অপেক্ষা হয়ে। আমার পাঠকরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান, ভাবতে জানে। আমি নিশ্চিত তারা সে প্রেমও খুঁজে নিবে গল্পে, যাকে আমি আড়াল করে রেখেছি।
এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রতিবার বই প্রকাশের পর ঠিক একইরকম হয়। বই আসি আসি করছে যখন, আমি খুব অপেক্ষা করি। বইয়ের প্রুফ থেকে প্রচ্ছদ পর্যন্ত প্রতিটি কাজ আমি গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করি। প্রকাশ হবার পর বই যখন প্রথম হাতে নেই, সময়টা কেমন স্থির হয়ে যায়। মনে হয় এইতো অপেক্ষা ফুরোলো। তারপর আমি সত্যিই কিন্তু বইটা অনেকদিন আর হাতে নেইনা। দূর থেকে দেখি। আমার লেখা আমার গল্প তখন সবার। উন্মুক্ত। মনে হয় আমার আর কিচ্ছু করার নাই। অনেকদিন পর আবার বইটি হাতে নেই, তখন উল্টে পাল্টে দেখি। কী হলোনা, কী হতে পারতো সেই হিসাব কষতে বসি। আর এই যে অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতা থেকে যায়, সেটাই লেখকের শক্তি। সেই অপূর্ণতা বোধ থেকে নতুন গল্প সৃষ্টি হয় আবার।
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
কিযী তাহনিন: জ্বি পারবে। আমার পূর্ব প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে, আছে এবং নাই, ইচ্ছের মানচিত্র পাঠকরা সংগ্রহ করতে পারবেন পাঠক সমাবেশের ১৪ নম্বর প্যাভিলিয়ন থেকে।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাটিকে প্রাণবন্ত করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
কিযী তাহনিন: গ্রন্থমেলা নিজ গুনেই জমজমাট। লেখক পাঠকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী হয়। লেখকদের এক হওয়ার জায়গায় এটিই। পুরো বছর জুড়ে লেখকদের এক হবার আর উপলক্ষ্য তেমন থাকেনা আসলে। বইমেলাকে আমার এমন করে দেখতে ভালো লাগে, বিশাল, জমজমাট। যে যার মতন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থমেলার সাথে প্রকাশনায় জড়িত মানুষের রুটিরুজির সংস্থানের ব্যাপারটিও জড়িত। এই ব্যাপারে আপনি যদি আপনার মতামত শেয়ার করতেন।
কিযী তাহনিন: জড়িত। খুব গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু আমার প্রতিবার আশঙ্কা হয়। কারণ, এই গ্রন্থমেলার রুটিরুজির বিষয়টা টেকসই না। আমাদের দেশে বইয়ের বাজারই তো টেকসই না। বইকে পণ্য বলতে আমরা নারাজ। প্রকাশনাকে একটা ইন্ডাস্ট্রি ফরম্যাট এখনো দেয়া যায়নি। স্ট্রাটেজি দরকার। বই তো সৃজনশীল পণ্য। এ বিষয়টা অনুধাবন করতে হবে প্রকাশকদের, নীতি নির্ধারকদের, লেখকদের এবং পাঠকদের তো বটেই। কারণ এটি যেকোন ইন্ডাস্ট্রির মতন, এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর নির্ভরশীল। প্রকাশকরা ক্ষতিগ্রস্থ হলে লেখকেরা ও ক্ষতিগ্রস্থ হবে, বইয়ের সাথে জড়িত, ছাপাখানার সাথে জড়িত সকল মানুষদের রুজি রোজগারে টান পরবে। তাই পলিসির জায়গায় কাজ করা জরুরি। নীতি নির্ধারক, প্রকাশক, লেখক সকলের সমন্বয়ে পলিসিকে কার্যকর করতে হবে। যার যা প্রাপ্য সে যেন বুঝে পায়। নাইলে এ দেশে কখনো লেখকেরা শুধু লেখাকে পেশা হিসেবে নিতে পারবেন না। গ্রন্থমেলা কিংবা লেখাকে শুধু মাত্র রোমান্টিক বলয় থেকে বের করে এনে একটা কার্যকর বাস্তবরূপ দেয়া ভীষণ জরুরি।
মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর খোঁজ বিশেষ থাকে না। আমাদের দেশে বইয়ের দোকানও স্বল্প। এই পরিস্থিতিতে বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন।
কিযী তাহনিন: ওই যে বললাম, কাঠামোর জায়গায় কাজ করতে হবে। চাহিদা যোগানের জায়গায় মিলমিশ হচ্ছেনা। কেন হচ্ছেনা সেটা ভাবতে হবে। পাঠকেরা কী আসলে বই পড়তে চাননা? নাকি তারা পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছেন না বইয়ের কাছে পৌঁছানোর, সেটাও দেখতে হবে। বই পড়বার অভ্যাস ও কিন্তু কমে যাচ্ছে। আমরা আগে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কত বই পড়তাম। সেই অভ্যাস আবার তৈরি করা কি যায়না? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ঘরে? আর আমাদের মূল আকর্ষণের জায়গা যেহেতু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তাই সে মাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে, বইয়ের খবর পৌঁছে দেবার জন্য, বই বিক্রির জন্য। বই কেন্দ্রিক মার্কেটিং স্ট্রাটেজি দরকার,পাঠকদের সাথে এনগেজমেন্ট দরকার, বাইরের দেশগুলোতে যেমন থাকে। বই পড়বার চাহিদা থাকলে, তার যোগানও বাড়বে।
মন-মানচিত্র: কোভিড পরিস্থিতিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠকদের প্রতি আপনার বার্তা যদি শেয়ার করতেন
কিযী তাহনিন: পাঠকদের প্রতি আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। পাঠকরা চায় বলে, আসে বলেই, বইমেলা হয়। এমন কি এই কোভিড পরিস্থিতিতেও। আমার বইয়ের সবচেয়ে সৃজনশীল সমালোচনা আলোচনা আমি পাঠকদের কাছ থেকেই পাই। তারা আছে বলেই বইমেলা হয়, আমরা লিখি, প্রকাশকেরা কাজ করে যান। সকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলায় আসবেন, এই প্রত্যশাই করি।