বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ এইচ বি রিতা
প্রথমবারের মতো মন-মানচিত্র আয়োজন করেছে ‘বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন’ শীর্ষক কবি–সাহিত্যিকদের সিরিজ সাক্ষাৎকার। এই আয়োজনের একটাই মৌলিক উদ্দেশ্য– কবি–সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়েদেয়া। এবারের কথোপকথনে আছেন কবি, লেখক ও সাংবাদিক এইচ বি রিতা।
ইতিমধ্যে আমরা বাংলাদেশে অবস্থানরত কবি–সাহিত্যিকদের বেশকিছু সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছি এবং পাঠকদের প্রভূত সাড়া পেয়েছি। পাশাপাশি বিদেশে অবস্থানরত কবি–সাহিত্যিক যাঁদের বই প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু দেশের বইমেলায় অংশগ্রহন করতে পারেন নি তাঁদের অনুভূতি পাঠকদের সামনে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে উদ্দেশ্যে সাজানো নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করছি:
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার কয়টিগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি এবং বইটির ব্যাপারে জানতে চাই।
এইচ বি রিতা: একটি গ্রন্থ বের করা অবশয়ই একটা সাধনার ফসল। যখন যা ভাবনায় এলো তাই লিখে জমা করে রাখলাম, তারপর বছর শেষে সেগুলো মিলিয়ে একটা বই বের করে ফেললাম, বিষয়টা এমন নয়। একটা বই প্রকাশের আগে, ‘পাঠক কেন আমার বইটি অর্থ ব্যয় করে কিনে পড়বেন‘, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে।
এবছর আমার দুটো কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। ৯৮টি কবিতা নিয়ে প্রিয়বাংলা প্রকাশনী থেকে ‘আকাশের বুকে অগ্নিস্রোত‘। প্রচ্ছদ করেছেন তন্দ্রা তাবাস্ছুম। ৬৯টি ইংরেজি কবিতা নিয়ে “Diagonal Perspectives-Poetry Tied to the Ribbon of Time” প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাককিনলি পাবলিশিং হাব‘ থেকে। প্রচ্ছদ ও চিত্রকল্প করেছেন ডন লুম্যান অ্যাগ। ফ্ল্যাপ করেছেন লেখক, সাংবাদিক, কবি কাকন রেজা।
দেখুন, কবিতা–জগৎ সাধারণত গল্প–উপন্যাস, প্রবন্ধ থেকে একটি ভিন্ন স্থান যেখানে সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের নিয়মগুলি একটু ভিন্নভাবে কাজ করে। আর তাই, এই ভিন্ন কাজটা করতে সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত এবং অভিজ্ঞতাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরীক্ষা করেছি এবং তারপরেই লেখনীতে নিজ অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি যা আমার ভাষার কমনীয়তার সাথে পাঠককে মুগ্ধ করবে বলে বিশ্বাস রাখি। বই দুটো মূলত একাধিক মুক্ত চিন্তার কবিতার বই। এই কবিতাগুলি বিশ্বজুড়ে পাঠকদের কাছে তীব্র ক্ষোভ, অভিযোগ, শোক, প্রতিবাদ, দুঃখ, সবশেষে একটি সাহসী লড়াই এবং একটি উজ্জ্বল পথের সন্ধান দিবে। বই দুটোর বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে শব্দ, সুর ও ভাব বিন্যাসের কারুকার্যের মাধ্যমে সময়কে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
মন-মানচিত্র: বই প্রকাশিত হলো কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে অংশগ্রহন করতে পারলেন না। এ ক্ষেত্রে আপনার অনুভূতি কি জানাবেন?
এইচ বি রিতা: ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর বইবেলাতে আমি ১ সপ্তাহের জন্য যেতাম নিউইয়র্ক ছেড়ে। বেশ ভালো লাগতো। তবে গত ২ বছর যাবত বই প্রকাশ হলেও বিশেষ কোন কারণে আমার যাওয়া হচ্ছে না। এতে আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমি খুব বাস্তবিক একজন মানুষ, সময়ের প্রয়েজনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি।
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
এইচ বি রিতা: প্রিয়বাংলা প্রকাশনী থেকে পূর্ব প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘জোনাকির ডাকবাক্স‘ সংগ্রহ করতে পারবেন। অন্যধারাতেও আমার একটি উপন্যাস ‘বিনু‘ এবং ৪টি কাব্যগ্রন্থ থাকার কথা। আমি নিশ্চিত নই কেননা তাদের সাথে সম্প্রতি কোন যোগাযোগ করা হয়নি। আমার পূর্ব প্রকাশিত অন্যন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হল- মৌনতা, কবিতা তুমি ভবিতব্য কষ্টের প্রতিচ্ছবি, দুঃখ জলের লহরী, রক্তাক্ত নীল।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক–পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময়গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাকে অর্থবহ করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
এইচ বি রিতা: বইমেলা নিশ্চয়ই বই প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে সেতুবন্ধনের ব্যাপারটি আসলে একদিন বা ১ মাসের বইমেলায় ঘুরাঘুরি বা আদান–প্রদানের ব্যাপার নয়। এখানে লেখক ও পাঠকদের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপনের বিষয়ও রয়েছে। লেখকদের কেবল বইমেলাতেই হাসি মুখে অটোগ্রাফ দিতে দেখা যায়। অনেকে স্টলেই আসেন না নানান অভিযোগে। এক্ষেত্রে কবি, লেখক–পাঠকদের মধ্যে একটা বই পাঠ আলোচনা–সমালোচনার ব্যবস্থা রাখলে সম্ভবত একে অন্যের ভাবনা, লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত বিনিময় করতে পারতেন, যার মাধ্যমে একটি বইয়ের প্রকাশনাও সার্থক হয়ে ওঠতে পারে।
বর্তমানে প্রকাশিত বইগুলোর কনটেন্ট ও মাপকাঠি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। অনেকেই কোন লক্ষ্যবস্তু না রেখে বই বের করছেন, কেউ কেউ সনেট, পরবাস্তববাদ, উত্তরাধুনিকতা ইত্যাদি নামে বই প্রকাশ করছেন যাতে মূলত প্রচুর বিভ্রান্তি ও রুটি থাকে। বাণিজ্যিক ব্যবসা থেকে বের হয়ে এই বিষয়গুলোর উপর প্রকাশকদের নজর দেয়া দরকার। অনুবাদমূলক বইগুলোর বেলাও তাদেরকে দোভাষী দক্ষ কাউকে দিয়ে ‘মূল লেখা ও পরিবর্তিত অনুবাদ‘ এই দুইয়ে সামঞ্জস্য রয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করিয়ে নেয়া দরকার।
‘পুশ সেলিং‘ শব্দটা আজকাল ব্যাপকভাবে শোনা যায়। অনেককেই মেলায় যাওয়া মাত্রই জোরজবরদস্তির কারণে বই কিনতে হয়, এবং পকেটের রিকশাভাড়ার খরচটাও ব্যয় করে ফেলতে হয়। এই কারণে অনেকেই বইমেলা এড়িয়ে চলেন। লেখক–পাঠক কাউকেই এইধরণের আতঙ্ক ফেলা উচিৎ নয়। অনেকেই বিভিন্ন জেলা, বিভাগ থেকে ঢাকা বইমেলায় উপস্থিত হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগে, জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়নে, প্রতিটি গ্রামে বইমেলার আয়োজন করা দরকার।
২১শে বইমেলা থেকে পৃথকভাবে ‘ইসলামি বইমেলা‘টি কেন প্রতিবছর বায়তুল মোকাররাম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়, তা বোধগম্য নয়। সামগ্রীকভাবে শ্রণিবিভাজন, ধর্ম, রাজনীতির বাইরে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে হবে। বইমেলায় ধূলোবালি প্রতিরোধে আরো কিছুটা যত্নবান হলে বয়স্ক ও শিশুরা নিরাপদে মেলায় যেতে আরো উৎসাহিত হবে। আমি নিজেও দেশে গেলে এলার্জির কারণে বইমেলাতে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা। শিশুদের জন্য বইমেলায় ভিন্ন আঙ্গিকে একটা বিনেদনমূলক বইপাঠের ব্যবস্থা করা যায়, এতে করে শিশুদের বই পড়ার আগ্রহ বাড়বে এবং যাদের ঘরে বাচ্চা দেখার মতো কেউ নেই, তারাও বাচ্চাদের নিয়ে বইমেলায় স্বাচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাছাড়া, যে কোন শিল্প-সাহিত্য বা গঠণমূলক কর্মকান্ডে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা শিশুর মেধা বিকাশের পথকে সুগম করে তুলে।
মন-মানচিত্র: একুশে বইমেলাকেন্দ্রিক বইপ্রকাশনা এখন একটি প্রথা হয়ে গেছে। বিদেশে অবস্থানরত স্বভাষী লেখক হিসেবে আপনি বইমেলাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এইচ বি রিতা: ধর্মীয় প্রথা খণ্ডানো বিপদজনক ও অসম্ভব হলেও একুশে বইমেলা মূলত সাধারণ জনগণ বা সমাজ কর্তৃক বছরের পর বছর ধরে পালিত একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। এই বইমেলায় সারাদেশ থেকে কিছু লিটলম্যাগের উপস্থিতি থাকলেও মফস্বলের প্রকাশকদের তেমন দেখা মিলে না বইমেলায়। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোগের একটা দায়ভার অবশ্যয়ই আছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা প্রবাসে বসেও এখন আয়োজন করছে প্রাণের একুশের বইমেলা। অথচ, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো বা গ্রামে–গঞ্জে সম্প্রসারিত হয়নি এই বইমেলার উৎসব। তবে কি বইমেলা শুধু শহরের মানুষের জন্য?
সাম্প্রতিককালে বাংলা একাডেমীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও নানান অভিযোগ লক্ষ্যণীয়, বিশেষ করে গ্রুপলগ্নতা–পার্টিপ্রিয়তা। বইমেলাকে ঘিরে প্রকাশকদের দলবাজির অভিযোগও রয়েছে। রাজনীতি–ব্যবসার বাইরে গিয়ে একুশে বইমেলা দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ুক এমন প্রত্যাশা করি।
মন-মানচিত্র: বিদেশে থেকে দেশে বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আপনি কি কি ধরণের জটিলতায় পড়েন? এ ব্যাপারে আপনার বিস্তারিত মতামত জানতে চাই।
এইচ বি রিতা: বিদেশে বসে দেশে বই প্রকাশ করার ব্যাপারটা বেশ জটিল। অনেকটা বিরক্তিকর। আমরা অনেকেই দেশের প্রকাশক ও প্রকাশনীর নাম শুনে থাকি, কিন্তু বিস্তারিত জানা থাকে না। প্রকাশকদের সাথে লেখকদের আন্তরিকতার একটা ব্যাপার আছে, যা দূর থেকে হয় না। খুব সুপরিচিত প্রকাশনীগুলি বাদে মোটামোটি বা নতুন শুরু করা প্রকাশনীগুলো দেশের লেখকদের বই যতটা যত্নের সাথে প্রকাশ করেন, প্রবাসের সাধারণ লেখকদের বইতে সম্ভবত ততটা মনোযোগ দেন না। কারণ, ছাপানোর পর বানান, প্রচ্ছদ, বাইনডিংয়ে বেশ ভালোই ত্রুটি থাকে।
বই প্রকাশ হবার পরের অবস্থা আরো শোচনীয়। ২০০/৩০০ কপি বই বিক্রি করা বা ঘরে জমা রাখা বেশ ঝামেলার ব্যাপার। বিশেষ করে, আমি নিজে বিক্রির ব্যাপারটাতে একেবারেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি না। বিক্রির করতে প্রি–বুকিং, প্রচার, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে, যেহেতু আমার বইগুলো বিক্রির অর্থ আমার নন–প্রফিট সংগঠন ‘থিংকিং দ্য হিউমানিটি‘তে জমা ও ব্যয় হয়, তাই আত্বীয় বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীরা নিজেরাই বইগুলো মোটামোটি কিনে নেন।
মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর বিশেষ খোঁজ থাকে না। বই বাজারজাত করার বিষয়ে আপনার পরামর্শজানতে চাই।
এইচ বি রিতা: আমরা আসলে হুজুগে বাঙালি। শৈলীর চাইতে কায়দা বেশি ভালোবাসি। নিজের বুদ্ধিজ্ঞানে নয় বরং অন্যরা যা করছে তা যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক, আমাকেও করতেই হবে। এটাই হলো হুজুগের বৈশিষ্ট্য। বইমেলায় অনেক লেখক–পাঠকদের অবস্থাও এমন। তারা বইপ্রেমী হোক বা না হোক, জীবনে একটা সম্পূর্ণ বই পড়ে থাকুক আর নাই পড়ুক, বইমেলা আসলে সবার সাথে তাল মিলিয়ে বই কিনতেই হবে। ক’জন সবগুলো বই পড়ে?
একজন লেখক হিসাবে বই বাজারজাত করণের বিষয়টাতে আমি নিজেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি না। এটা প্রকাশকের কাজ হতে পারে। লেখকদের প্রকাশিত বইয়ের রিভিউ করিয়ে আলোচনা প্রকাশ করা, বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন–ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েবে প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে বই প্রমোট করা। তবে, অবশ্যই বইয়ের গুণগত মান বিচারে।
মন-মানচিত্র: বিদেশে অবস্থানরত বাংলাভাষী কবি–সাহিত্যিকদের বাংলাদেশ সরকার “প্রবাসী” অ্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ভাষার যদি কোন সীমান্ত না থেকে থাকে, তাহলে এই অ্যাখ্যা দেয়া কি যৌক্তিক মনে করেন?
এইচ বি রিতা: যে রাস্তায় দিনযাপন করে, তাকে সাধারণত ভিখারি বা গৃহহীন বলা হয়। যিনি চুল কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাকে নাপিত বলা হয়। যিনি দেশের বাহিরে থাকেন, তাকে ‘প্রবাসী বাঙালি’ বলা হবে, এটাই স্বাভাবিক। আসলে সবকিছুরই একটা নাম থাকে, দিতে হয়। যুক্তি-তর্ক থেকে বাহির হয়ে বলবো, এই ‘প্রবাসী’ বা ‘প্রবাসী বাঙালি’ শব্দটা আমাকে আহত করে। এই শব্দটার সাথে নিজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে দেখি। আসল সমস্যাটা হলো, যখন দেশের আর্থিক উন্নয়নে আমাদের দেশের বাইরে থাকা বাঙালিদের দুর্দান্ত ভূমিকা রাখার পরও সরকার এবং দেশের জনগণের কাছে মূল্যায়িত না হই। বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। আমাদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে সরকারের মাথা ব্যাথা নেই, তার দরকার রেমিট্যান্স। শুধুমাত্র এই রেমিট্যান্স এর প্রয়োজনেই আমাদের এখনো ‘প্রবাসী বাঙালি’ নামে অন্তত অস্তিত্বটুকু রয়ে গেছে, তা না হলে কবেই আমাদের মূল শেকড় থেকে টেনে উপড়ে দিতো।
আমারা এখন দেশীয় মূলস্রোতের বাইরের আজব কোন বাঙালি জাতি। শিল্প–সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত আমরা যতই মেধাবী হই না কেন, বিদেশে বসবাসের কারণে আমাদের সৃষ্টিশীল সত্তাটি আজ বাক্সবন্দী, মূলধারার বাংলা সাহিত্যে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। দেশের লেখক, পাঠক, পত্রিকার সম্পাদক, আপামর জনতার কাছে প্রবাসী কবি–লেখকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান। তাদের ভাবটা এমন যেনো- ‘ইয়ো ব্রো হুয়াটস আপ!” দেশের মূলধারার পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সম্পাদকদের কথা যদি বলি, তারা বলা যায় দেশের বাইরে থাকা বাঙালিদের গণনায় নিতেই রাজি নন। সহজ-কঠিন, উন্নত- অনুন্নত, বিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ সব ধরণের লেখকই দেশ-বিদেশে রয়েছে। কারো লেখার মান উন্নত, কারো সহজ। কষ্টদায়ক বিষয় হলো যে, দেশীয় লেখকদের অতি সহজ, সস্তা লেখাটাও তারা সাদরে গ্রহণ করেন, কিন্তু হাতে গোণা কিছু কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের ছাড়া, বিদেশী অন্যন্য বাঙালিদের মানসম্মত লেখাও তারা মাসের পর বছর ঝুলিয়ে রাখেন। এখানে অবশ্য মেধা যাচাইয়ে সখ্য ও পরিচিতির একটা ব্যাপারও আছে। দেশের বাইরে থাকায় সাহিত্যাঙ্গনে নিজেদের পরিচিতি বা প্রচারের সুযোগটা সব বাঙালিরা পান না।
আর তাদের কথাই কী বলবো? দেশের বাইরে থাকা সুপরিচিত লেখকরাই বা কে কার পাশে অনুরূপ প্রতিকৃতিটি দেখতে চান? এবং আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার হলো যে, বাইরের দেশে থাকা আমাদের বাঙালি লেখকরাও নিজের অবস্থান, ঠিকানা, অস্তিত্ব ধরে রাখতে প্রতিবাদের পরিবর্তে বরং, তারাও কীভাবে নিজেদের দেশের সাহিত্যাঙ্গনে ঢুকানো যায়, তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। এতে করে বরং আমরা, আমাদের প্রতি তাদের ‘মূলস্রোতের বাইরের লেখক’ ভাবনাকেই সমর্থন করছি।