বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ কাজী রাফি
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মন-মানচিত্র সাহিত্যকর্মের বার্তা সাহিত্যের পাঠকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে কবিসাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে। আমরা আজ কথা বলেছি লেখক কাজী রাফি‘র সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ধ্রুব সাদিক।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার প্রকাশিত গ্রন্থের ব্যাপারে জানতে চাই। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতিও যদি শেয়ার করতেন।
কাজী রাফি: ঠিক তাই, ভালো সৃষ্টি মূলত একটা দীর্ঘ সময়ের সাধনার ফসল। করোনা মহামারীর এই কাল তো সৃষ্টির জন্য বন্ধ্যাত্বের! মানুষ যখন জীবন নিয়েই শঙ্কিত আর উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তেমন পরিস্থিতিতে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই সৃষ্টিশীল কাজে ভিতরের তাগিদ বা অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেন। তবু, এরই মাঝে ‘অনেক বৃষ্টির একটি কদম’ একটা উপন্যাসের সৃষ্টি হলো –যা এই সময়কে ধারণ করে। নিঃসন্দেহে আমি আনন্দিত।
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিত্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
কাজী রাফি: হ্যাঁ, আমার সকল বই-ই পাঠক বইমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। এ বছর উপন্যাসটির প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ ছাড়াও পার্ল পাবলিকেশন্স, সময় প্রকাশন, অনিন্দ্যপ্রকাশ এবং অন্বেষা প্রকাশনীতে আছে আমার অন্যান্য উপন্যাস/গল্পগ্রন্থসমূহ।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমেজও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাটিকে প্রাণবন্ত করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
কাজী রাফি: দেখুন, প্রাণ থাকলেই না প্রাণবন্ততার ব্যাপারটি আসে। প্রশ্ন হলো আমাদের প্রাণ কি অবশিষ্ট আছে? প্রাণ তো তাদেরই সজীব যারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। শিশুদের কাছ থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি। দেখবেন একটা ভাঙা ঘুড়ি দেখেও শিশুরা তাদের বাবা বা আপন কাউকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তাদের প্রাণবন্ততা এত সরল যে, সবকিছুতে বিস্মিত হওয়ার মতো ব্যাপারটা থাকে বলে তারা অনবরত প্রশ্ন করে। প্রাণবন্ত তারাই যাদের কাছে উত্তর অথবা নিশ্চয়তা বড় কিছু নয় – বড় হলো প্রশ্ন, অনুসন্ধিৎসা এবং অনিশ্চিত জীবনের অনিত্যতা। কিন্তু বইমেলায় আমরা কী দেখছি? এখানে অনুসন্ধিৎসু মানুষের চেয়ে ভাইরাল হয়ে যাওয়া যা কিছু সেইসব নিশ্চিত উত্তরের দিকে পঙ্গপালের মতো একদল ছুটছে। একটা জাতীর প্রাণহীনতার বড় লক্ষণ হলো, অনুসন্ধিৎসা এবং জিজ্ঞাসার অভাব। প্রশ্ন করার ভয় যারা রপ্ত করে তারা অজান্তেই প্রাণবন্ততা হারিয়ে ফেলে। সেজেগুজে ছবি তোলা, হুল্লোড় করা, আলাপ-আড্ডায় মেতে ওঠার এইসব উচ্ছ্বলতা প্রাণবন্ততা তো নয়। প্রাণবন্ততা মানে, অনুভবের অনুরণনে ভিতরের স্বপ্নকে উসকে দেওয়া। খুব সুন্দর করে সাজা কনেও উপরে যতই হাসুক তার ভিতরের অনুরণনটুকু তার হাসি অথবা স্বপ্নের সম্পূরক অথবা সমান্তরাল না-ও হতে পারে।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থমেলার সাথে প্রকাশনায় জড়িত মানুষের রুটিরুজির সংস্থানের ব্যাপারটিও জড়িত। এই ব্যাপারে আপনি যদি আপনার মতামত শেয়ার করতেন।
কাজী রাফি:হ্যাঁ, রুটি রোজগার হোক –সে তো আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু বিশেষত প্রকাশকদের মনে রাখতে হবে, তারা একটা অদৃশ্য জগত নিয়ে খেলা করছেন। এই অদৃশ্য জগতই বস্তু জগতকে শাসন করে। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা যেভাবে বিস্তৃত হয় একটা জাতীর মনন-কাঠামো তার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সেই হিসবে আমরা বলতে পারি একটা জাতির মনন গঠনের কারিগর প্রকাশক। কেন না, কোন মানের চেতনা-রুচি তারা নির্মাণ করবেন; তা তাদের প্রকাশনার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। প্রকাশকগণের সাথে অন্য ব্যবসার পার্থক্য অথবা শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক এখানেই, এ কথা তাদের স্মরণে এবং চেতনায় রাখতেই হবে। গ্রন্থ নির্বাচন এবং প্রকাশের ব্যাপারে এজন্যই তাদের যত্নশীল এবং সংবেদনশীল দায়িত্ব প্রত্যাশিত। সেজন্যই রুটি-রোজগারের পাশাপাশি এই দায় প্রকাশকগণ এড়াতে পারেন না।
মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর খোঁজ বিশেষ থাকে না। আমাদের দেশে বইয়ের দোকানও স্বল্প। এই পরিস্থিতিতে বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন।
কাজী রাফি: ভালো মানের সৃষ্টি তথা মহৎ বই-ই সত্যিকারার্থে পাঠক বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সাধনাহীন জ্ঞান তো মননে আলো জ্বালে না। প্রতিবেদনধর্মী লেখা এমনকি পাঠকের ভাবনার চেয়েও নিম্নগামী মেধা/ভাবনায় যা কিছু সৃষ্ট তা এক সময় অগ্রহনীয় হবে। সস্তা লেখার পাঠকরা কিন্তু পরিশেষে পাঠকের খাতা থেকে খারিজ হয়ে যায়। সস্তা কিছুকে হাজার বিপনন মাধ্যম করেও টিকিয়ে রাখা যাবে না। পাঠক টিকে থাকে কারা? যারা কৈশোর-তারুণ্যে যারা ভালো সৃষ্টির স্বাদ পেয়েছে, যে সব সৃষ্টি তাদের বোধ চেতনাকে সমুন্নত করার পাশাপাশি তাদের জীবন কুহেলিকার মায়ার ছায়া হয়ে আছে তারাই আজীবন পাঠক থেকে যায়। জ্ঞানান্বষণ এবং সেই জগতে বিচরণের মননটুকু আসলে পরিবার থেকে শৈশব-কৈশোরে অর্জন করতে হয়, ভালো চর্চার মাধ্যমে। আমাদের প্রকাশকগণ বইমেলাকেন্দ্রিক হওয়ায় ব্যবসাটা একমাসের এবং পাঠকও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা সিন্ডিকেটেড হয়ে যাচ্ছে। জাতির মনন গঠনের চেয়ে সারা বছরের পোটরা একবার ভরে নিয়ে ঘরে ওঠার এই প্রবণতা ভয়ংকর। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় না খুঁজলে আগামী দিনের পরিণতি ভালো হবে বলে মনে হয় না।
মন-মানচিত্র: কোভিড পরিস্থিতিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠকদের প্রতি আপনার বার্তা যদি শেয়ার করতেন।
কাজী রাফি:পাঠকদের প্রতি স্বনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মানুন। যারা বইয়ের সংবেদশীলতার কাছে আসছেন –নিশ্চয়ই তাদের অনুভূতিপ্রবণ মন, অনুভবময় হৃদয় আছে। এমন মানুষ কি কখনো চাইবেন তার মাধ্যমে কারো ক্ষতি হোক। কক্ষনো নয়।