বইমেলার খোলাচত্বর: কথোপকথন/ মজিদ মাহমুদ
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে মন-মানচিত্র সাহিত্যকর্মের বার্তা সাহিত্যের পাঠকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে। আজ আমরা কথা বলেছি কবি-প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ধ্রুব সাদিক।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থ মূলত দীর্ঘ একটা সময়ের সাধনার ফসল। অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে আপনার প্রকাশিত গ্রন্থের ব্যাপারে জানতে চাই। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ায় আপনার অনুভূতি যদি শেয়ার করতেন।
মজিদ মাহমুদ: ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ নামে আমার একটি কাব্যগ্রন্থ এ বছর অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালের পরে এটিই সর্বশেষ কবিতার বই। এই বইয়ের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে মূলত বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি কালে। সময়ের অস্থিরতা, জীবন ও মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পরম সত্যোপলব্ধি মিথ প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত আমার পনেরটি কাব্যগ্রন্থের চেয়ে এটি বিষয়ের দিক থেকে, এমনকি শৈলির দিক থেকেও কিছুটা আলাদা। এই বইয়ের সকল কবিতার মধ্যে মহাবিশ্বের সময় চেতনা, মৃত্যু ও অস্তিত্বের সংকট নানা মাত্রায় ধরা পড়েছে। শৈলির দিক থেকেও কবিতাগুলো মিশ্র ছন্দে লেখা।
বই প্রকাশ হওয়া একজন লেখকের জন্য আনন্দের তো বটেই। আগে যত বই প্রকাশিত হোক না কেন, নতুন বইয়ের অনুভূতিই আলাদা। যতক্ষণ নতুন বই হাতে না আসছে ততক্ষণ এক ধরনের অস্থিরতা, অপেক্ষা কাজ করে। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঠকের কিছুটা নজর কেড়েছে। চেনা অচেনা অনেক কাব্যপাঠক নিজ থেকেই তার অনুভূতি প্রকাশ করেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।
এছাড়া এ বছর ‘পরদেশী কবিতা’ নামে আমার একটি অনুবাদ কবিতার বই বের হয়েছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী’র কবিতা নিয়ে একটি ‘নির্বাচিত কবিতা’ বের হয়েছে। এই বই দুটি পাওয়া যাবে আদর্শ প্রকাশনীতে। এ বছর ‘মাহফুজামঙ্গল- এর তিরিশ বছরের পাঠ’ বের করেছে দিব্য প্রকাশ। এটি মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের আঠারতম সংস্করণ।
মন-মানচিত্র: আপনার পূর্বে প্রকাশিত সাহিক্যকর্মও কি পাঠকরা গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন?
মজিদ মাহমুদ: আমার এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশটিরও বেশি। এর অনেকটা বইমেলা থেকে সংগ্রহ করা যাবে। তবে কিছু বই এখন পাওয়া যায় না। যে সব প্রকাশনী থেকে পাঠক নিতে পারবেন তার মধ্যে কথাপ্রকাশ, দিব্যপ্রকাশ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, আদর্শ, ভাষাপ্রকাশ, বটেশ্বর, বাংলাপ্রকাশ, মিজান পাবলিশার্স প্রভৃতি।
মন-মানচিত্র: অমর একুশে গ্রন্থমলো লেখক-পাঠকদের মধ্যে শুধু সেতুবন্ধনের কাজটিই যে করে তাই নয়, এইসময় গ্রন্থপ্রেমিকদের মধ্যে খুশির আমজেও পরিলক্ষিত হয়। গ্রন্থমেলাটিকে প্রাণবন্ত করার ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মজিদ মাহমুদ: বইমেলা নিশ্চয় বই প্রচার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক কর্মকান্ড। এতে লেখক পাঠকের মধ্যেও একটি যোগাযোগ গড়ে ওঠে। অনেকে অভিযোগ করেন, অনেকে নিয়মিত মেলায় যান, কিন্তু বই কেনেন না; আমি বলি এটিও মেলার জন্য একটি ইতিবাচক ব্যাপার। কেবল পাঠক লেখক গেলে মেলার স্বতঃস্ফূর্ততা থাকত না। অমর একুশে বইমেলার মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বড় মেলা আর কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই। কোলকাতার গ্রন্থমেলা আয়তনে কিছুটা বড় হলেও সময়ের দিক থেকে বেশ কম। ফ্রাঙ্কফুটের মেলাতে সরাসরি বই বিক্রি হয় না। আমাদের এখানে মেলার ব্যাপারে লেখক ও প্রকাশকের উভয়ের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
ধূলোবলি প্রতিরোধ আরো যত্নবান হলে বয়স্ক ও শিশুরা মেলায় যেতে আরো উৎসাহিত হবে। এবারেও পুলিশের সঙ্গে মেলায় আগত লোকজনের ঝগড়ায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। সেটার সঙ্গত কারণ উদ্ধার করে ব্যবস্থা নেয়া। পুলিশের ভূমিকা যতটা হ্রাস করা যায়।লিটল ম্যাগাজিনের স্থান আরো কিছুটা উন্নত করা যেতে পারে। খাবার দোকানগুলোর ক্ষেত্রে মেলার উপযোগী করা।
মন-মানচিত্র: গ্রন্থমলোর সাথে প্রকাশনায় জড়িত মানুষের রুটিরুজির সংস্থানের ব্যাপারটিও জড়িত। এই ব্যাপারে আপনি যদি আপনার মতামত শেয়ার করতেন।
মজিদ মাহমুদ: নিশ্চয় প্রকাশনা একটি শিল্প হিসাবে যথাযথ মান্য হওয়া উচিত। এই খাত থেকে হয়তো জিডিপি’র যোগান কম, কিন্ত একটি জাতির মননের বিকাশের সঙ্গে জড়িত লোকের কর্মসংস্থানের হিসাবে কম নয়। একটি মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি এবং প্রচ্ছন্নভাবে অনেক ধরনের লোক, দক্ষ শ্রমিক জড়িত। যে কোনো পেশার জন্য প্রথম শর্ত তার স্বচ্ছলতা। এই শিল্পের প্রতি মালিকদের পাশাপাশি সরকারের আরো দৃষ্টি দেয়া উচিত। ব্যাংকগুলো স্বল্পসুদে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দিতে পারে, মেলার সময়ে স্বল্পমেয়াদি তারল্য সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে পারে।
মন-মানচিত্র: বইমেলার পর প্রকাশিত বইয়ের আর খোঁজ বিশেষ থাকে না। আমাদের দেশে বইয়ের দোকানও স্বল্প। এই পরিস্থিতিতে বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন।
মজিদ মাহমুদ: বই তো কেবল মেলা কেন্দ্রিক পণ্য নয়। সারা বছর বই প্রকাশিত হয়, তেমন সারা বছর ধরে বই বিক্রি হয়ে থাকে। বরং মেলার চেয়ে অন্য সময়ে কেজো বই বেশি বিক্রি হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ, মেলাকে কেন্দ্র করে বই কেনা একটি সাময়িক বিষয়। তাছাড়া বর্তমানে বইয়ের নানা রকম ভার্সন তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বইয়ের খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে যেটি একেবারে হচ্ছে না, সেটি বইয়ের সম্পাদনা, এবং সঠিক বই কোনটি তার মাপকাঠি নির্ণয়। বই লেখকের নিজেরও যেমন জানা দরকার তিনি কি লিখেছেন, তেমন একজন প্রকাশকেরও জানা দরকার তিনি কি ছাপছেন। এই বিষয়টি সঠিকভাবে হলে পাঠক যেমন বিব্রত হবেন না, তেমন বইয়ের বেচাকেনাও তেমন বেড়ে যাবে। আর বই বিক্রি বেশি হলে এই শিল্পে আরো গতি ফিরবে।
মন-মানচিত্র: কোভিড পরিস্থিতিতে বইমলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে, পাঠকদের প্রতি আপনার র্বাতা যদি শেয়ার করতেন।
মজিদ মাহমুদ: কোভিদ মহামারিকালে বলা চলে লেখাপড়া জানা লোকের প্রধান আশ্রয় ছিল বই। বই যেমন তাকে এই সময়ে আনন্দ উপলব্ধি দিয়েছে, ভালো সঙ্গী হিসাবেও সঙ্গ দিয়েছে। আমরা যখন একা থাকি বই আমাদের সঙ্গে থাকে। বইয়ের সঙ্গে থাকুন, বইকে সঙ্গ দিন, আপনার সময় ভালো যাবে।