ফ্রানৎস কাফকা: প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
ফ্রানৎস কাফকা। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য দ্যুতিময় একটি নাম। তাঁর মেটামরফোসিস উপন্যাসিকা দিয়ে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন বিশ্বসাহিত্যে। এই উপন্যাসিকার শুরুটাই ছিলো নতুন এক কম্পনের প্রারম্ভ যা যেকোনো পাঠককেই আলোড়িত করে অনায়াসে, “নানান আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে ওঠার পর গ্রেগর সামসা দেখলো যে সে এক বিশাল পতঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।”
একটা জলজ্যান্ত মানুষ আবার হঠাৎ করেই পতঙ্গে পরিণত হলো কীভাবে! কিন্তু ফ্রানৎস কাফকা এরকম অদ্ভুত একটা শুরুর পরেও যে গল্পকে নিয়ে যেতে পারেন গভীর মূল্যবোধ সম্পন্ন দিকে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই উপন্যাসিকা। গ্রেগর সামসা পতঙ্গে পরিণত হবার পর থেকেই তার জীবনে নেমে আসে বিড়ম্বনার এক কালো ছায়া। সামসা ছিলেন একজন ভ্রাম্যমান বিক্রেতা । এক কোম্পানির হয়ে কাপড় বিক্রি করতেন । গ্রেগর এর পরিবর্তন এর পরপরই তার অফিসে যেতে দেরি হওয়ায় অফিস থেকে পিওন তার বাসায় চলে আসে এবং দুর্ব্যবহার শুরু করে। তারপর গ্রেগরের বাবা, মা ও বোন তার এই পরিবর্তিত রূপ দেখে গ্রেগরকে এক ঘরে করে দেয়। গ্রেগরের রোজগারে বেঁচে থাকা পরিবারটি গ্রেগরকেই তাদের এখন বোঝা মনে হতে শুরু করে। গ্রেগর বন্দীদশাতেই শেষে মারা যায় এবং তার পরিবার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারা যেন অনেক বড় এক বিড়ম্বনা মুক্ত হলো। প্রতিবেশীরা গ্রেগরকে দেখবে কী না এই ভয় থেকেও তারা মুক্ত হলো। পুঁজিবাদী সমাজের নির্মমতার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলো মেটামরফোসিসের মূল প্রতিপাদ্য।
ফ্রানৎস কাফকা (৩ জুলাই, ১৮৮৩ – ৩ জুন, ১৯২৪) ছিলেন একজন জার্মান ভাষার উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হিসাবে বিবেচিত। তাঁর অধিকাংশ কাজগুলো যেমন- “ডি ফেরভান্ডলুঙ্গ”(রূপান্তর), “ডের প্রোজেন্স”(পথানুসরণ), “ডাস স্কোলস”(দুর্গ) ইত্যাদির বিষয়বস্তু এবং আদর্শিক অভিমুখ আধুনিক মূলত বিচ্ছিন্নতাবোধ, মানুষের ওপর ক্ষমতাধর মানুষের শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা, অভিভাবক-সন্তান সম্পর্কে সংঘর্ষ, আতঙ্কজনক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যস্ত এমন চরিত্র, মানবজীবনে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপএবং রহস্যময় রূপান্তর – এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কাফকা অস্তিত্ববাদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন।
তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরে (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) একটি মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদী জার্মানভাষী মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার সময়কালে প্রাগের অধিকাংশ মানুষ চেক ভাষায় কথা বলতো। চেক আর জার্মান ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিভাজন ছিল একটি স্পর্শকাতর বাস্তবতা, যেহেতু উভয় পক্ষই একই জাতীয় পরিচয়ের দাবিদার ছিল। ইহুদি সম্প্রদায় প্রায়ই দুই অনুভূতির মধ্যে নিজেদের খুঁজে ফিরত, যেহেতু এই জায়গাটা কোন রাজ্যের সেই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই উঠতো। কাফকা উভয় ভাষায় পারদর্শী হলেও জার্মান ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা মেনে নিয়েছিলেন।
নিজের জীবনের বহু অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে কাফকার রচনায়৷ বড় হয়েছেন জন্মস্থান প্রাগে, সংখ্যালঘু জার্মান ভাষী ইহুদি পরিবারে৷ বাবা ছিলেন ব্যাবসায়ী৷ ছেলের ওপর তাঁর ছিল কঠোর কর্তৃত্ব৷ বলা হয়ে থাকে কাফকার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তিনি কিছুটা অশ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন৷ তবুও কাফকা সারাজীবন চেষ্টা করেছেন দাম্ভিক বাবার কাছাকাছি যেতে৷ জার্মান ভাষীদের স্কুলের শিক্ষা শেষে প্রাগের চার্লস ফ্যার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেন৷ আইনজীবী হিসেবে একটি বীমা কোম্পানিতে কাজ করেছেন বহু বছর৷ এমন চাকরি উপভোগ করতেন না, তাই সবসময় বলতেন ‘রুটির জন্য এই চাকরি’৷
চাকরির পাশাপাশিই চলে সাহিত্য চর্চা৷ ১৯১২ সালে প্রথম প্রকাশ পায় ১৮টি ছোট গল্পের সংকলন ‘বেত্রাখটুং’ (কন্টেমপ্লেশন)৷ একাধিকবার প্রেমে পড়েছেন তিনি৷ কিন্তু কোনোটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বা বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি৷ ৩৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন কাফকা৷ বলা যায়, তাঁর প্রায় সারাটি জীবনই কেটেছে অসুস্থতাজনিত বিষণ্ণতা এবং সামাজিক উদ্বেগের মধ্য দিয়ে৷ মারা যান ৪১ বছর বয়সে৷ মৃত্যুর কিছুকাল আগে নিজের যাবতীয় পাণ্ডুলিপি এবং না পাঠানো চিঠি ও স্মৃতিচারণামূলক বই দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘকালের বন্ধু, সাহিত্যিক ও প্রকাশক মাক্স ব্রোডকে৷ দেয়ার সময় একটা অনুরোধও করেছিলেন – সব কিছুই যেন তাঁর মৃত্যুর পর ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ ব্রোড তা করেননি৷ কাফকা বেঁচে থাকতে তাঁর খুব কম রচনাই প্রকাশিত হয়েছিল৷ মৃত্যুর পরই সিংহভাগ প্রকাশিত হয়৷ ফ্রানৎস কাফকার সাহিত্যকর্মই তাঁর লেখক সত্তাকে চিরজীবী করেছে৷
আজ ৩ জুন কাফকা’র প্রয়াণ দিবস। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নিষ্পেষিত ও পর্যুদস্ত কাফকা আমৃত্যু অস্তিত্বের লড়াই করে মাত্র ৪১ বৎসর বয়েসে প্রয়াত হন। অতৃপ্ত জীবন যন্ত্রণায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেছেন তিনি। আমরা তাঁর প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
====================