ফ্রানৎস কাফকা : এখনো অবিশ্লেষিত
মনিজা রহমান
লেখক ও শিল্পীদের বলা হয় স্রষ্টা ও দ্রষ্টা। হাজার হাজার বছর ধরে তারা মানুষের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করতে চেষ্টা করছেন। মানুষের চিন্তা ও চৈতন্যের স্বরূপ উদ্ধারে তারা সব সময় সচেষ্ট।
বিংশ শতকে শিল্পসাহিত্যের নানা পর্যায়ের কীর্তিমানরা অনেক সাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যেমন কয়েকটি উদহারণ দেয়া যায়-
১. অন্তরালকে প্রকাশ্য করলেন পিকাসো এবং ব্রাক কিউবিজম নামক জ্যামিতিক আর্ট ফর্ম আবিস্কার করে (১৯০৭-০৮)।
২. সিগমন্ড ফ্রয়েড মানুষের চিন্তার গতিবিধি, মনস্তাত্ত্বিক মানচিত্র জানান দিলেন এবং যৌন আচরণ ও যৌন চিন্তাকে সংজ্ঞায়িত করে ঝড় তুললেন।
৩. ডিএইচ লরেন্স লিখে ফেললেন- সানস এ্যান্ড লাভার্স।
৪. ফ্রেডরিখ নিৎসে নিহিলিজম দর্শন প্রচার করে আলোচিত হন। (All values are baseless)
৫. Absurdist রা নড়াচড়া শুরু করেছেন। (Humans are always looking for meaning, but are completely unable to find meaning because no such meaning exists).
৬. বোহেমিয়ানিজম ছড়িয়ে পড়েছে।
৭. কয়েক বছর পরে জেমস জয়েস লিখবেন ইউলিসিস (১৯১৮) ও টিএস এলিয়ট লিখবেন ওয়েস্টল্যান্ড (১৯২২)।
এমন একটি জটিল, কঠিন, নির্মম সময়ে ফ্রান্ৎস কাফকা এলেন। তিনি এসে আরো অনেক তীক্ষ্ম, তীব্র ও অসম্ভব প্রশ্ন তুলে মানুষের জীবনের অপ্রিয় সত্য উচ্চারণের চেষ্টা করলেন।
এতো অপ্রিয় উচ্চারণের পরেও বিশ্ব সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর পর যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে, তিনি হলেন জার্মান ভাষার প্রভাবশালী লেখক কাফকা। ১৯৯০ এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে গড়ে প্রতি দশ দিনে একটি করে বই প্রকাশিত হয়েছে কাফকা সম্পর্কে। এখন পর্যন্ত ৩৪ জন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাঁদের লেখায় কাফকার প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। যে তালিকায় আছেন- কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসও।
কাফকার সাহিত্যের মূল বিষয় ছিল- Absurdity, Reality, Existentialism, Surrealism. তিনি মনের সঙ্গে শরীরের এবং শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন।
কাফকাকে বলা হয়েছে দ্যা পোয়েট অব ডিজঅর্ডার। তাঁর লেখায় কষ্টভোগ, ভীতি, আতংক, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, হতাশা, পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়, একাকীত্ব, মানুষের প্রতি ও সমাজের প্রতি অবিশ্বাস বারবার এসেছে। মানুষের চরিত্রের এমন সব অপ্রিয় সত্যকে কাফকা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, যা তার আগে কেউ প্রকাশ করেননি।
সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময় উদ্ভট রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে, ছোট গল্পে। তাঁর বিখ্যাত ‘দ্যা মেটামরফোসিস’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এক ভ্রাম্যমান বিক্রেতা গ্রেগর সামসা। একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দেখে সে একটি কিম্ভুতকিমাকার বিরাট পোকা হয়ে গেছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি ছিলেন তিনি। কিন্তু পোকা হবার কারণে চাকরীটি হারান। ধীরে ধীরে গোটা পরিবারের লজ্জ্বার ও ঘৃণার বস্তু হয়ে ওঠেন। এক সময় মারা গেলে গৃহপরিচারিকা ময়লার সঙ্গে পোকাটাকে গার্বেজে ফেলে আসে।
কাফকার উপন্যাসের প্রায় চরিত্রকে লজ্জ্বা, পক্ষপাতিত্ব ও অপরাধবোধের মধ্যে চলতে দেখা যায়। ‘দ্যা ট্রায়াল’ গল্পে ব্যাঙ্ক কর্মচারী ইয়োসেফকে গ্রেফতার করা হয় কোন অপরাধ না করা সত্ত্বেও। এমনকি তিনি গল্পের শেষ পর্যন্ত জানতেই পারেন না তাঁর বিরুদ্ধে আসল অভিযোগ কি!
নিজের জীবনের বহু অভিজ্ঞতার কথা প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর লেখায়। বড় হয়েছেন প্রাগে, যেখানে তারা ছিলেন সংখ্যালঘু জার্মানভাষী ইহুদি পরিবার। ব্যবসায়ী বাবা কাফকার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। বাবার কারণে কাফকা সারাজীবন আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতেন, আবার তিনি বাবার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন।
কাফকা লেখক হতেই চেয়েছিলেন। ল পড়ে ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে লইয়ারের চাকরীও করেছেন। কিন্তু সেই কাজ তাঁর ভালো লাগেনি। তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষ মিলেনাকে লিখেছিলেন- My happiness, my talents, my every possibility I have of some use in the world have always been in the literary field.
কিন্তু তাঁর সাহিত্য সমালোচকরা বিশেষ করে জেরেমি এডনার বলেছেন, Kafka is less dazzling than Proust, less innovative than Joyce.
কাফকার সমালোচকরা স্বীকার করেছেন, অন্য লেখকদের লেখা যেভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, কাফকাকে সেভাবে বিশ্লেষণ করা যাবেনা, বিচারও করা সম্ভব নয়। কারণ কাফকার সত্য ও বাস্তবতার মধ্যে ঢোকা সহজ নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে সেই সত্য ও বাস্তবতার কোনো অস্তিত্বই নেই।
টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্টের রিভিউতে বলা হয়েছে, ১০০ বছর পরেও আমরা বলতে পারিনা, কাফকাকে আমরা বুঝতে পেরেছি বা বোঝার কাছাকাছি যেতে পেরেছি। আমাদের সেই প্রত্যাশা করাও ঠিক না। যারা ফ্রয়েড পড়েননি তারা কাফকার যে সাইকোএনালিসিস তার ধারে কাছেও যেতে পারবেন না।
কিন্তু প্রশ্ন হল- কেন?
এ্যারন মিশারা তার গবেষণার শিরোনাম করেছেন
`Kafka, paranoiac doubles and the brain; hypnagogic vs. hyper reflective models of disrupted self in neuropsychiatric disorders and anomalous conscious states.
এ্যারন বলেছেন, কাফকা ইচ্ছাকৃতভাবে লিখতে শুরু করতেন মধ্যরাতে যখন ঘুম তাকে তাড়া করতো। সেই ঘুমঘোরে কিংবা আধো ঘুমে আধো জাগরনে তিনি লিখতেন, ‘না স্বপ্ন, না বাস্তব’। তিনি তাঁর ডাইরিতে লিখে গেছেন এই চেতন-অবচেতনের অবস্থা তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেত, যা সম্পূর্ণ জেগে থেকে যাওয়া যেত না। কাফকা তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন- All I possess and certain powers which, at a depth almost inaccessible at normal condition. Again it was the power of my dreams, shining forth into wakefulness ever before I fall asleep.
কাফকা ছিলেন আগাগোড়া স্ববিরোধী একজন মানুষ। তার চরিত্রের দ্বৈততা ছিল প্রচুর। এই নিয়ে বহু বিতর্ক আছে, যেমন-
১, তিনি স্বঘোষিত নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও ইহুদীবাদের প্রতি তাঁর দুর্বলতা দেখা গেছে।
২. তিনি যুদ্ধবিরোধী ছিলেন। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যক্ষ্মার কারণে সামরিক বাহিনী তাঁকে গ্রহণ করেনি।
৩. কাফকা সারাজীবন চেষ্টা করেছেন একজন পুরোদস্তুর লেখক হবার। কিন্তু সেই তিনি মৃত্যুর পূর্বে প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে সব লেখা পুড়িয়ে ফেলার জন্য বলে গিয়েছিলেন।
৪. কাফকার জীবনের প্রতি ভালোবাসা ছিল তীব্র। আবার তিনি আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন।
৫. কাফকা যৌন সম্পর্কের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত ছিলেন। কিন্তু বিয়ে নামক প্রথাকে তিনি পছন্দ করতেন না।
৬. তিনি একাধারে হেট্রোসেক্সুয়াল ও হোমোসেক্সুয়াল ছিলেন।
৭. কাফকা একইসাথে Existentialist এবং Surrealist
৮. তিনি একইসাথে বোহেমিয়ান ও গৃহী।
ফ্রানৎস কাফকাকে বিশ্লেষণ করা দুরূহ বটে। এই যে বিশ্লেষণ করতে না পারা এটাই তাঁকে অমর করে রাখবে আরো হাজার বছর। যেমন তাঁর অমর চরিত্র গ্রেগর সামসা, দ্যা মেটামরফেসিস উপন্যাসের প্রথম লাইনেই ছিল- ‘এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল- সে পোকা হয়ে গেছে।’
উপন্যাসের এই প্রথম লাইনটাকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এমন একটি বাক্যের যিনি স্রষ্টা্, তাঁর জন্মদিন ৩ জুলাই। ১৮৮৩ সালের এই দিনে তিনি তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাগ শহরে (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) জন্ম নেন।
কাফকা সারাজীবন স্রোতের বিপরীতে চলতে ভালোবাসতেন। তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন বন্ধু ম্যাক্স ব্রড। মাত্র ৪০ বছর বয়সে যক্ষ্মায় মৃত্যুবরণের আগে বন্ধুকে কাফকা বলে গিয়েছিলেন, সমস্ত লেখা পুড়িয়ে দিতে। পুড়িয়ে দেবার আগে কেউ যেন না পড়ে সেই দিকে খেয়াল রাখতে। তবে একমাত্র বন্ধু নিজে চাইলে পড়তে পারে। বলাবাহুল্য কাফকার এই একটা কথাই রাখেননি বন্ধু ম্যাক্স ব্রড। তিনি যত্ন করে সেই লেখা প্রকাশ করলেন। আর এভাবেই কাফকা বেঁচে রইলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
====================================
মনিজা রহমান: কথাসাহিত্যিক, নিউইয়র্ক।
===================================