ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা: জন্মদিনে সালাম কমরেড
১৯৩৬-এর স্পেনে একনায়ক ফ্রান্সিসকে ফ্রাঙ্কোর ‘ডেথ স্কোয়াড’-এর হাতে তাঁর মৃত্যুটুকু ঐতিহাসিক সত্য, মৃত্যু-উত্তর তাঁর কিংবদন্তিপ্রতিম উচ্চতা লাভ আরওই সত্য, কিন্তু স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত নাট্যকার-কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার মৃত্যুমুহূর্তটি ঠিক কেমন ছিল, তা জানার উপায় নেই। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের খুন-জখম-হত্যার বিশদ বিবরণী লিখে রাখা শুরু করবে লোরকা-হত্যার ক’বছরের মধ্যেই, এ দিকে লোরকার মৃতদেহটুকু পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গ্রানাদার বাইরে কোন পাহাড়ি জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়েছিল তাঁর শরীর, অজানা। প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীরা একত্রে খোঁজাখুঁজি করেছেন বিস্তর, এই সে দিনও, ২০০৯ সালেও— লাভ হয়নি।
গ্রানাদার যে খামারবাড়ি হয়ে উঠেছিল লোরকা পরিবারের নিয়মিত গ্রীষ্মাবাস, স্পেনে গণতন্ত্রী রিপাবলিকান আর দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী ফ্রাঙ্কোর দলবলের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা গৃহযুদ্ধ থেকে ‘বাঁচতে’ মাদ্রিদ ছেড়ে সেই বাড়িতেই চলে আসেন লোরকা। বাঁচতে পারেননি, এক পড়শির বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পরেও না। কারা তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছিল, লেখা আছে ইতিহাসে। কেউকেটা কেউ নয়, বরং পাড়ার চেনা লোক সব, এমনকি আত্মীয়ও কেউ কেউ। এমনই তো হয় কালবেলায়।
ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি। তিনি একাধারে একজন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রজন্ম ২৭-এর (কবিদের সম্মিলনে গড়ে ওঠা সংগঠন, যারা ইউরোপিয়ান বিপ্লব স্প্যানিশ সাহিত্যে আনার চেষ্টা করে) একজন সদস্য হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান। তার রচিত অসংখ্য রচনা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের পাঠকদের কাছে এবং ধীরে ধীরে তার কাব্য-সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বতন্ত্র এক ধারায়। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে জাতীয়বাদী কর্মীরা তাকে হত্যা করে, তার লাশ আর কখনও পাওয়া যায়নি। তাকে স্পেনে ‘জনগণের কবি’ বলে ডাকা হয়।
নিজের এক বিখ্যাত বক্তব্যে লোরকা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ কথা। মৃত্যু আসে, চিরতরে পর্দ্দা নামে কিন্তু স্পেনের বিষয়টি ভিন্ন, এখানে বরং মৃত্যু সব পর্দ্দা, সব আড়াল সরিয়ে দিয়ে সবকিছু দৃশ্যমান করে তোলে।’ তিনি স্পেনের ঐতিহ্যবাহী বুল ফাইটের সঙ্গে মৃত্যুর প্রতি মানুষের আত্মঘাতী আকর্ষণের যোগসূত্র খুঁজে বের করেছিলেন। লোরকা লিখেছিলেন, ‘স্পেন একমাত্র দেশ, যেখানে মৃত্যু বিষয়টি জাতীয়ভাবে সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।’
লোরকা ১৮৯৯ সালের ৫ জুন স্পেনের প্রাচীন ঐতিহ্যময় শহর গ্রানাডা থেকে পাঁচ মাইল দূরে আন্দালুসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা ছিলেন একজন জমিদার আর মা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মূলত পিয়ানো বাজানো শেখাতেন। তাই খুব ছোটবেলায় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় লোরকার। সেই সুবাদে জনপ্রিয় গানগুলো গাইতে পারতেন শৈশবে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই বেশিরভাগ সময় কাটত বাড়ির আঙ্গিনায় আর পড়ার টেবিলে। দৈহিক পরিশ্রমে অপারগ ছিলেন বলে লোরকার নিকট স্বপ্নের জগতটা বেশ বড় হয়ে উঠে। স্পেনের পলস্নী জীবন, ষাঁড়ের লড়াই, প্রেম, জিপসিদের রোমান্টিক জীবন, লোকসঙ্গীত, লোকনৃত্য সবকিছু সম্পর্কেই সম্যক একটি ধারণা পেয়েছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে তারা চলে আসেন বালদেরুবিয়ো শহরে। সেখান থেকে ১৯০৯ সালে গ্রানাডা শহরের উপকণ্ঠে উয়ের্তা দে সান বিসেন্তেয় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। লোরকার বয়স তখন ১১। যেসব জায়গায় লোরকা বসবাস করেছেন সর্বত্র প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছেন। পরবর্তীতে তার শিল্পচিন্তা ও লেখালেখিতে এর গভীর প্রভাব পড়েছিল।
লোরকার ১৮ বছরের কবিতা রচনার মধ্যে ৪ টি ধারায় ভাগ করা হয়:
১. প্রস্তুতির ও প্রাথমিক বছরগুলো (১৯১৮-১৯২৭)
২. জিপসি বালাদ (১৯২৬-২৮)
৩. নিউইয়র্কে লেখা কবিতা (১৯২৯-৩০)
৪. তার পরের কবিতা (১৯৩১-৩৬)
এর মধ্যে মৌলিক ও মূল্যবান হচ্ছে জিপসি বালাদ এবং নিউইয়র্কের কবিতা। মোটা দাগে জিপসি বালাদের মধ্যে লোরকা গীতলতা এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করে ঐতিহ্যগত লোকজ লোরকা নতুনত্ব ভরিয়ে দিলেন। নিউইয়র্কে লেখা কবিতাগুলোয়, যা পরে পোয়েতা এন নুয়েভা ইয়র্ক (নিউইয়র্কের কবিতা) কাব্য গ্রন্থে প্রকাশিত হয়, তিনি চিত্রকল্প এবং কোলাজ এমন ভাবে বিচ্ছিন্ন আবার একই সঙ্গে সংগ্রথিত করেছেন যে এগুলো পরাবাস্তববাদী অভিধা প্রাপ্ত হয়ে উঠেছে।
১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদে চলে যান। সেখানে কাটিয়ে দেন পরবর্তী ১৫টি বছর। তাঁর নতুন স্থান রেসিদেনসিয়া দে এস্তুদিয়ান্তে। এর সুবাদে তিনি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে থাকেন। এবার তাঁর পাঠের বিষয় আইন ও দর্শন। কিন্তু কিছুদিন পরেই হাঁপিয়ে ওঠেন। পাঠ্যক্রমভুক্ত বিধিবদ্ধ পাঠে তাঁর আর মন বসে না। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে তিনি আত্মনিয়োগ করেন শিল্পচর্চায়। মগ্ন থাকেন অভিনয়, কবিতাপাঠ ও প্রাচীন লোকগীতি সংগ্রহে। এ সময় এল মালেফিসিয়ো দে লা মারিপোসা বা প্রজাপতির দুরভিসন্ধি নামে একটি নাটক লিখে ফেলেন। ১৯২০ সালে সেটি মঞ্চস্থ হলে ঢি ঢি পড়ে যায়। কারণ, নাটকটি ছিল প্রচলিত ঘরানার বাইরে। এটি রচিত পোকামাকড়ের জীবন নিয়ে, মূলত একটি তেলাপোকা ও একটি প্রজাপতির মধ্যে ভালোবাসার কাহিনি। পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর লোককাহিনিভিত্তিক লিব্রো দে পোয়েমাস বা কবিতার বই। এতে এসেছে ধর্মীয় বিশ্বাস, একাকিত্ব ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ।
লোরকার ওপর ফ্লামেঙ্কো ও জিপসি সংস্কৃতির প্রভূত প্রভাব পড়েছিল। এ জন্য তাঁদের কথা ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। ফ্লামেঙ্কো সংস্কৃতির প্রসারে ১৯২২ সালে তিনি প্রথম ‘কান্তে হোন্দো’ বা ‘গভীর গান’ উৎসব আয়োজন করেন। স্পেনের বিখ্যাত ডিপ সং গায়ক ও পিয়ানোবাদকেরা তাতে অংশ নেন। তিনি বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুর দিকে যেসব কবিতা লিখেছেন, তাতে গভীর গানের আদল খুঁজে পাওয়া যাবে। লোরকা ‘সাতাশের প্রজন্ম’ নামে একটি আভাঁ গার্দ শিল্পীসংঘে যোগ দেন। এই সংঘে ছিলেন সালভাদর দালি ও লুইস বুনুয়েলের মতো জাঁদরেল শিল্পীরা, যাঁরা তাঁকে পরাবাস্তববাদ ও প্রতীকবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ দুই শিল্পদর্শনের আশ্রয়ে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনাময়, নান্দনিকতায় গূঢ়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কানসিয়োনেস বা গীতিমালা। ১৯২৮ সালে আলোর মুখ দেখে রোমান্সেরো হিতানো বা জিপসি গাথা। এ বই তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যায়।
১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। লোরকা তখন তার নিজগৃহ ‘কায়েহোনেস দে গারসিয়া’তে অবস্থান করছিলেন। ফ্রাঙ্কোর সৈন্যরা তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। ১৯ আগস্ট ঘাতকেরা তাকে কবরস্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তার লাশ গুম করে ফেলা হয়। তার মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
লোরকার মৃত্যু ছিল সত্যিই হৃদয়বিদারক। অতি সুদর্শন প্রগতিবাদী প্রগলভ প্রাণোচ্ছল সেই যুবকটি আর নেই, এ যেন এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা। তাঁর মৃত্যুসংবাদে পাবলো নেরুদা অশ্রুভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘স্পেনের সেরা ফুলটি ঝরে গেল।’ লোরকা কি তাঁর নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়েছিলেন? মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি একটি কবিতায় লেখেন (অমিতাভ দাশগুপ্ত ও কবিতা সিংহের লোরকার শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে):
আমি বুঝতে পারছি খুন করা
হয়েছে আমাকে।
তারা কাফে, কবরখানা আর
গির্জাগুলো তন্ন তন্ন
করে খুঁজছে।
তারা সমস্ত পিপে আর
কাবার্ডগুলো তছনছ
করছে।
তিনটে কঙ্কালকে লুট করে
খুলে নিয়ে গেছে
সোনার দাঁত।
আমাকে তারা খুঁজে পায়নি।
কখনোই কি পায়নি তারা?
লোরকার কবিতায় একদিকে পাওয়া যায় জিপসি গানের সুরসৌন্দর্য ও চিত্রল ইঙ্গিতময়তা, একদিকে আরব শৈলীর ঐতিহ্যবিধুরতা ও পরাবাস্তবের স্বপ্নকুহেলিকা। কাতালান মেজাজে তিনি প্রতীকবাদী শিল্পীর নিপুণ দক্ষতায় অঙ্কন করেন নিউইয়র্ক ও হাভানার জীবনচিত্র। একই মেজাজে আন্দালুসীয় কৃষক ও নারীজীবনকে নাট্যরূপ দেন। স্পেন ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কাব্যকীর্তি। ভ্রমরগুঞ্জনের মতো লিরিকধারা প্রবাহিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
বিরল কাব্য ও নাট্যপ্রতিভার অধিকারী লোরকা যাপন করেছেন প্রায় ৩৮ বছরের এক সৃষ্টিশীল কর্মময় জীবন। অপ্রত্যাশিত ঘাতকের বুলেট নিথর করেছে তাঁর দেহ, কিন্তু থামাতে পারেনি আগুনের পরশমণির সর্বত্রগামিতা। তাঁর কবিতা দ্বিজয়ী, আজও মানুষকে নাড়া দেয় বিপুল আনন্দবৈভবে।আজও পাঠক মুগ্ধচিত্তে আস্বাদন করে শিশিরের স্নিগ্ধতায় মাখা, কোমল চন্দ্রালোকে স্নাত, পাহাড়ের মৌনতায় সমাহিত তাঁর ছন্দিত পঙ্ক্তিমালা। কবি নিজেই লিখেছিলেন:
ঘুম দেব আমি এক মুহূর্ত
এক মুহূর্ত, একটি মিনিট,
এক শতাব্দী
কিন্তু সবাই জেনে রেখো আমি
এখনো মরিনি।
(‘কালো মৃত্যুর গজল’)
আজ তাঁর জন্মদিন। এই মহান হৃদয়বান মানবতাবাদী কবির জন্মদিনে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
=========================