ফারহানা ইলিয়াস তুলি’র কবিতা
অভিবাসন ক্যাম্পের দিকে
সামনেই গভীর জঙ্গল। মৃত নদীর হাড়গোড়
পড়ে আছে। সীমান্তের দেয়াল নেই-
আছে ধূ ধূ মরুভূমি। বৃষ্টিপাতহীন
উত্তপ্ত দুপুর।
সন্তর্পণে কয়েকজন মানুষ নিয়ে জঙ্গল
পার হচ্ছে পথ প্রদর্শক!
এরপরে কয়েকটি দল,
তারপরে আরও কয়েকটি……
কিছু দূরেই অপেক্ষা করছে কয়েকটি
হার্ডউডের নৌকো।ইঞ্জিন চালিত।নেমপ্লেট বিহীন।
ওই বেনামী নৌকোগুলো চড়েই কিছু মানুষ
পাড়ি দিতে চাইছে ভূমধ্য সাগর অথবা
গালফ অব ম্যাক্সিকো!
এভাবেই প্রতিদিন সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
বিশ্বের কোথাও না কোথাও,
নতুন অভিবাসন খোঁজছে কিছু মানুষ!
কখনও নৌকোটি ডুবে যাচ্ছে!
কখনও সমুদ্র সাঁতরিয়ে মানুষগুলো দৌড়ুচ্ছে
অভিবাসন ক্যাম্পের দিকে ।
ইউক্রেন
অর্ধপোড়া দেশলাইটি ফেলে গিয়েছে কেউ।
চারপাশে পড়ে আছে এর কয়েকটি কাঠি।
প্রচণ্ড শীতে গৃহচুল্লিতে তা নিয়ে কেউ হয়তো
আগুন জ্বালোতো! কেউ হয়তো কড়া সিগারের
পাইপে আগুন ধরাতে ধরাতে
তাকাতো বাইরের বরফপাতের দিকে।
সেই দিনটি এখন আর নেই।ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে
যে অর্ধনগ্ন ইট, দাঁত দেখাচ্ছে-
এর নীচেই পড়ে আছে একটি শিশুর মাথার খুলি!
যে সড়কে গাড়ি চালিয়ে প্রেমিক
তার প্রেমিকাকে পৌঁছে দিত কর্মক্ষেত্রে-
সেখানে জন্ম নিয়েছে বড় বড় গর্ত।
কিয়েভ শহর কী এমন ছিল কখনও!
বাইসাইকেল চালিয়ে যে কিশোর তার মায়ের
খোঁজে বেরিয়েছে;
সে জানে না তার ভবিষ্যত কী!
সন্ধ্যা নামছে। জেগে ওঠা চাঁদের বক্ষদেশ
ভেদ করে উড়ে যাচ্ছে কয়েকটি রাশিয়ান
যুদ্ধবিমান। আর সভ্যতা মুখ লুকোচ্ছে
পৃথিবীর নর্দমায়-নালায় !
মানুষের পাঁজর
মানুষের পাঁজর বাঁচে,অন্য কোনো জলের পাঁজরে
বহুদিন প্রাণে প্রাণে থেকে যায়- এই মাতৃস্নেহ
কেউ তাকে ধরে রাখে ছবিতে,কেউ রাখে স্মৃতিঘরে
বলা যায়-,মাটিই পরম সত্য, আকাশই অগ্নিদেহ ।
এই দেহমন,অভিমান,বিষাদ- যেভাবেই বলো তুমি
সবই নির্ণয় করে স্বপ্নের অধিবাস, রোদের শিয়রে
আলোই জীবন,সাথে কিছু অন্ধকারও হয়ে চারণভূমি
এই মাঠে পাশে থাকে মানুষের,সুখ কিংবা দু’খের প্রহরে।
ছুঁয়ে দেখো,তোমার পাঁজরও বশ্য কারও-কোনোভাবে
যাপন করছে আশ্রিত সময়- হয়ে ফুলদানির ফুল
ঝরে পড়ার আগে- পরাগ উড়ে আপন স্বভাবে
হাওয়ায় হাওয়ায় চৈত্র, বসন্তে খেয়ে যায় দোল।
ভাগ্য কী তবে নিয়ন্ত্রিত হয় রক্তাক্ত হাতের মুঠোয়
যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা মানুষেরা খোঁজে না নিবাস
জীবন কী তবে সব হারিয়েই- পায় শেষ জয়
আর যে জন হারায় পাঁজর,সমুদ্রই তাকে করে গ্রাস !
বর্ণডোরের ঝলক
মায়াডোরের ঘোর না কাটতেই দেখি,দরজায়
দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বর্ণডোর,কথার ঝলক
আর মোহনীয় পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্ত!
এই প্রান্তে কী শুধুই মোহ থাকে, অথবা স্তব্ধতা!
না কী যারা মায়াবীজ বপণ করে যায়, থাকে
তাদের প্রতিচ্ছায়া! আচ্ছন্ন থাকি তা ভেবে ভেবে।
যে পাতা হলুদ হয়ে বৃক্ষ থেকে মাটিতে ঝরে-
যে মেঘ ফিরবে বলে বৃষ্টি হয়ে সমুদ্রে গড়ায়
জীবন তো তেমনই তছনছ করা ঢেউয়ের ভ্রমণ।
মানুষ ভ্রমণবিলাসী।আর সমুদ্র ভালোবাসে উত্থান-বিলাস
আমরা আমাদের চারপাশে বর্ণবৈভবের যে সমাহার দেখি,
তা ভ্রম নয়- প্রাণের প্রতি প্রাণের নৈবেদ্যের প্রকাশ।
পথে পথে প্রেক্ষাগৃহ
সমতল ভূমির কাছে মানুষ গিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে খুব
সাধারণই মনে করে। পাহাড়ের উচ্চতায় নিজের ছায়া
দেখলে,যে কেউ নিজেকে পাহাড়ের প্রতিদ্বন্ধি ভাবতেই
পারে।আর তাই-; উচ্চতায় আকাশ দর্শনের অভিলাষ
মনকে আরও শিখরে নিয়ে যায়- ভাবনায়, জাগরণে।
মানুষের জন্য জগত মূলত একটি প্রেক্ষাগৃহ।দেখে যাওয়ার
গোপন নির্বাণ। অনেকে চাইলেও এই কক্ষপথ থেকে সরে
আসতে পারে না। যারা পারে-; তারা আত্মপ্রশ্নের মাঝে
খুঁজে অন্য কোনো ভুবনের ঠিকানা। যে রাত্রিবীজ প্রেমের
নক্ষত্রকে কাছে টানার জন্য নিজস্ব পথ তৈরি করে যায়-
প্রতীক্ষা তার দুধারে হেঁটে যেতে যেতে ফুল-চন্দন ছিটায়।
***************************************************