You are currently viewing ফাউজুল কবিরের পাঁচটি কবিতা

ফাউজুল কবিরের পাঁচটি কবিতা

ফাউজুল কবির-এর পাঁচটি কবিতা

সৃষ্টি

 

হাতের রুমাল দিয়ে অকস্মাৎ গোলাপ বানাতে জানি

যাদুকর আমি

গতকাল ভোরে রাস্না ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিয়েছি মন্ত্রে

শিরিষের দেহ

এই যে হঠাৎ বৃষ্টি নামলো শুভ্র গাছের পাতারা হাসলো

এবং আকাশ

বদলালো সুন্দরে লালে -নীলে -সাদা আর হলুদিয়া মুখ

সমুদ্রের জলে মাছের সাঁতার দেখে দেখে চোখে ভালোবাসা হলো সোনা

হাওয়ার নাচন

এ সব আমার মনেরই খেলা — ইচ্ছা হলে বলি বুকের ভেতরে জাগো

অমনি জেগে ওঠে

বিদ্যুৎ ঝলকে সৃষ্টির চমকে

সবুজ নক্ষত্র বেগুনি সারস অন্ধকারে আলো সফেদ আসমানি পরি

ইচ্ছে যদি হয়

কখনো বা হই কবিতা উজ্জ্বল জোছনার গদ্য কখনো নীরব গান

যদি মন জাগে

বনে বনে ঘুরি গাছের শাখায় সারারাত ঘুম দিয়ে

দিনের সুর্যকে হৃদয়ের চুমু দিয়ে হয়ে উঠি পাখি :

পৃথিবীর সব রঙ এসে বলে তোমাকে কোথায় রাখি

আমি শুধু হাসি — বলি , সারাক্ষণ তোমাদের বুকে থাকি ।

 

হিরণ্যপ্রতীতি

 

ধাবমান জলের বিরুদ্ধে একা একা দাঁড়িয়েই বলছি

কে যায় কে যায় ?

উত্তরের অপেক্ষায় থাকি কোনো শব্দ কোনো ধ্বনিসূত্র

কানেতে বাজে না

দুপুরের ফকফকে আলোর ভেতরেই একটি অজগর

অন্ধকার খাচ্ছে

চেয়ে চেয়ে আমি শুধু দেখছি কীভাবে শিকার করতে হয়

অথবা নিশ্চিত

হতে হয় খাদ্য —

অহিংসা পরমধর্ম আর জীবে প্রেম কে যে বলেছিলো

কখন কোথায়

মনে পড়ে নাতো :

আমার দয়াল পিতা কিন্তু একদিন কৈশোরে কয়েছিলো

ও পুত্র আমার ! প্রিয় বংশধর এ কথাটি মনে রেখো

মানুষের ধর্ম আছে শধু এ সংসারে — সাপেদের নেই

চতুর্দিকে ঈগলের চোখে হুশিয়ারে চলিও-ফিরিও

দেখিও সাবধানে

কোথায় লুকিয়ে আছে ফণা তুলে দুর্দান্ত – ফাণক

কোন পথে বসে আছে চুপ হায়েনার হিংস্র-দন্তমুখ

কোথায় বটগাছে তক্কে আছে ফোকলা দাঁত দারূণ শয়তান —

পিতৃবাক্য রেখেছি স্মরণে

মাতৃমন্ত্র মনে নাই কিছু

দুহাতে মশাল নিয়ে একা — তাই মানুষে বিশ্বাস রাখি

আগুনেরা ভাঙ্গে না বিশ্বাস মানুষেরা ভাঙ্গে পদেপদে :

ধাবমান জলের বিরুদ্ধে একা একা দাঁড়িয়েই বলছি

কে যায় কে যায় ?

আমি আছি ভাই আছি আমি ধাবমান মানুষের পিছে

যে যাই বলুক দিবারাত্রি আছি আমি হাওয়ার বিপক্ষে

ক্ষতি নেই যদি ডাকে কেউ বিশ্বস্ত প্রসিদ্ধ কাকতাড়ুয়া ।

 

রাসমোহন শুক্লদাস

 

সমগ্রতা টেনে নিয়ে যায় আকাশের দিকে

বহু দূরের আকাশ

অনেক দূরের নীল

তারকা নদীর ঝিলে প্রাচীনের ধূসরের জলে

সমগ্রতা সুশীলের বোন – রক্তে নিকট আত্মীয়

অখণ্ডতা আত্মকৃতি পুষ্পেঘ্রাণে আত্মপরিচয় ।

উচ্ছল হাওয়ার বুকে ভাসে হলুদ রাজহাঁস

বহুরূপী মুখ আছে বহুমুখি রহস্যের ভঙ্গি

সুন্দর সত্যের ঢং হাসে নিত্য রূপার কলসে

ভাসতে দাও পৃথিবীর অফুরন্ত শস্যের সংসার

সব বাণী সোনাদানা গভীরের নিস্তব্ধ তরঙ্গ

আশার জীবনে বাসা নৃত্যে বাঁচনের অনুষঙ্গ

অঙ্গের শরীর আছে সঙ্গের হৃদয়ে বাজে রঙ্গ ।

শুভ্রতার স্বপ্নে ছিলে তুমি রাসমোহন শুক্লদাস

জীবনের কেচেকেচে

নন্দন- সন্ধানী ছিলে মৃত্তিকা ও আকাশের চিত্তে

তোমার বাউল কথা

তোমার আউল স্মৃতি

তোমারই গল্পগুচ্ছ আজীবন দিগন্ত ভ্রমণ

তোমার মুখাবয়ব চারণের কথোপকথন

দৃষ্টিতে মানুষ খোঁজা ভাবনের সোনালি বিন্যাস

সময়ের ঢেউ গুণেগুণে মনে রেখেছে বিশ্বাস :

জীবনেরা চিত্রময় বিচিত্রের জানে যে অঙ্কন

রাসমোহন শুক্লদাস

প্রকৃত বিশ্বাস আছে

তুমি জেনেছিলে একা শুভ্রতারা বাস করে বুকে

ফুলেরা ফোটার আগে ঘ্রাণেরা পাতায় ও শিকড়ে

অবিশ্রাম ঘুরেঘুরে – গান করে শিরায় শিরায়

মানবেরা মরে যায় কিন্তু সুর বাঁচে এ সংসারে

মরে না মরমী ধ্বনি

বীজেরা বিপ্লব জানে

আনন্দেরা কিছু নয় –বিশ্বাসের ধবল চেতনা :

রাসমোহন শুক্লদাস শুধেছিলো জীবনের দেনা

জেনেছিলো সমগ্রের অর্থগুলি চেনা ও অচেনা ।

 

মানুষ পুরাণ

 

বর্ণন ন-জানি : তুলন ন-জানি

ন-জানি কথন চারু রাজসিক

তবু নাগরিক

লোকে ভাবে জ্ঞানী পারের সন্ধানী

আমি হাসি সুখে ভাসি

বাজি — অহমের বাঁশি —

দীর্ঘ সরোবর অনেক প্রাচীন কালের বৃত্তান্ত

জলের কিনারে বসে আছে একা

এক-ঠ্যাঙ্গাবক

দারুণ সাধক

জানে ধর্ম সত্য যে যার মতন সংসারে অপত্য

যে যত শিকারি সে তত নিপুণ তীরন্দাজধ্যানী :

অকস্মাৎ বন থেকে ভেসে আসে নীলসাদাশব্দ

বিস্ময়ের ঋষি বাণী

আশ্চর্যের মন্ত্র — কি জানি কি জানি —

প্রতিটি সড়কে ওঁৎ পেতে আছে কালান্তক সাপ

লুব্ধকের পাপ

চোখ চোখ চোখ মানুষের চোখ

পাশাপাশি শোক

বিষ বিষ বিষ লাফাঙ্গার শিস

লালসার লাভা আদিম দানব :

লালা ঝরে লালা জ্বালা জ্বলে জ্বালা

লালা কালো– লালা শ্বেত আর রক্ত লালা

ঘৃণা আর ঘৃণা

বমি করা ঘৃণা খুন চাটা ঘৃণা– মানুষ পুরাণ

একটি বক খুঁজে যাচ্ছে সময় নিদান ।

 

জার্নাল– এক

 

সমস্ত মন্তব্য থেকে চুপিচুপি সরে আসি

এ আমার চরিত্রের দুর্বলতা বোধ হয় :

পাতারা যখন ঝরে

যখন কথারা ঝরে

মেঘেরা যখন ঝরে

হাসিরা যখন রোদ হয়

রোদেরা যখন পুষ্প হয়

যখন বৃষ্টিরা স্নান হয়

ক্রন্দন যখন চোখ হয়

সব ক্রিয়াপদ বুকে নিয়ে সরে আসি আমি

নিজস্ব আকাশ তলে হাওয়াদের ছায়াবন্ধু ।

মন্তব্যের স্বর থেকে দূরে থাকা মনে হয়

বুদ্ধিমান কাজ — অনেকেই বলে সে রকম :

মন্তব্য পেঁচিয়ে দেয় সমস্ত গন্তব্যগ্রন্থি

মানুষ অসভ্য-প্রিয় টক-শো বাচাল বড়

সর্বক্ষণ খুঁজে গেরো অতিচর্চিত আশয়

এবং বিখ্যাত ভাবে

ভাবতেই হয় – কারণ

মূর্খ বড় বুদ্ধিজীবী বাচালতা জনপ্রিয়

সর্বত্র টেলিভিশনমুখ কথা-বটবৃক্ষ ——

হাঁটুভাঙ্গা সময়েরা নিয়েছে আশ্রয় আজ

অর্ধনগ্ন চেতনার

চলমান সামাজিক মণ্ডলীর সামিয়ানা

সমস্ত গ্যালারি জুড়ে গিরগিটির প্রদর্শনী

মানুষ ত্রিভুজ অন্ধ জীবনের চার -চোখে ।

 

জার্নাল — দুই

 

মানুষেরা কেন লেখে ? লিপিবদ্ধ করে উদ্ভট অস্তিত্ব ?
জীবনের রেখাবলি সুদর্শন কিছু শকুনের ডানা
হাওয়ার দৈহিক শুধু ভাসে আর নীলে ক্রন্দনের রোল
ও মনুষ্য তোমাদের যাত্রাপথে বমি করছে নিস্তব্ধতা :
বহুতল ব্যঞ্জনার বারান্দায় নামে ও বেনামে থাকে
থকথকে অভাব আর স্বভাবের কাদা –অপর বাস্তব
কর্কটসময়গুলি  সময়ের কুশ্রী– -বিশ্রী কণ্ঠগুলি
দীর্ণতায় জীর্ণতায় কোরাস -করুণ স্বর বার্তা তোলে—
অন্ধকার থেকে ভালো সর্বাঙ্গসুন্দর কোনো বাণী নেই :
সবকিছুকে অস্বীকার করা যেতে পারে যদি কেউ চায়
কিন্তু কৃষ্ণচূড়াদের অথবা শিমুল রক্তকরবীর
চেতনার এসরাজ এবং দ্রোহের অবিনীত সুর
উদ্ধত উদ্ভাসকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না কখনো।

 

কবি ফাউজুল কবির

ফাউজুল কবিরের জন্ম ০৭ আগস্ট ১৯৫৫ সাল। জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার উত্তর ইছাখালী গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক(সম্মান) সহ এম. এ ডিগ্রি অর্জন করে কলেজ শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন ১৯৮০ সালের ০৩ ডিসেম্বর। সংবাদপত্র জগতেও তিনি কাজ করেছেন। দক্ষিন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ছালেহ-নূর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। অবসর গ্রহণের পর হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজেও শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি-বাকশিস চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

২০১০ সালে কবিতা কর্মের জন্য পেয়েছেন ‘মিরসরাই এসোসিয়েশন সম্মাননা’। ২০১২ সালে লাভ করে ‘মনন সাহিত্য সম্মাননা’। সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে মননশীল চিন্তায় তিনি তৈরি করেছেন এক বিশিষ্ট সম্মানের আসন।

ফাউজুল কবির একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।মুক্তিযুদ্ধখ্যাত চট্টগ্রামের মিরসরাই অঞ্চলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা ও সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। ২০১৬ সালে হুলাইয়ুন ছালেহ-নূর ডিগ্রি কলেজের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা জানানো হয়। ২০১৬ সালে তাকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি-বাকশিস চট্টগ্রাম শাখা।

কবিতাকর্মের জন্য কবি ফাউজুল কবির ২০১৬ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।

ফাউজুল কবিরের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ 

আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস [১৯৯৬]

একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল [১৯৯৭]

কবির বাড়ি মেঘের নীলে[২০০৯]

প্রতিন জন্মচক্র প্রতিদিন জাদুমন্ত্র [২০০৯]

মেডুসার খেলা [২০১৫]

রহস্যের চাবিকাঠি [২০১৫]

সময়ের মায়াবী রাখাল [২০১৭]

জেগে ওঠো পাখির প্রমায় [২০১৯]

শিল্প মাতালের ধন [২০২১]