প্রতিধ্বনির দিন
দিলশাদ চৌধুরী
যখন বৃদ্ধ তেঁতুল গাছের চিরিচিরি পাতাগুলোয় রোদ এসে লাগল, একটা বেড়াল বেরিয়ে এলো বন্ধ চায়ের দোকানের পেছন থেকে। বাসের অপেক্ষায় বন্ধ দোকানটার বেঞ্চের ওপরেই বসে আছে মাং লং। ট্রেনেও যেতে পারত , কিন্তু তাতে বড্ড সময় বেশি খরচ হয়। আর এখান থেকে বাসে যাওয়াই সুবিধা। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে অপেক্ষা করছে। বাস আসতে বোধহয় একটু দেরি হবে, অথবা হয়ত সে-ই চলে এসেছে আগে আগে। পকেটে ফোন আছে, বের করলেই সময়টা দেখা যাবে। কিন্তু এই হালকা রোদে আলসেমি তাকে বেশ ভালোভাবে পেয়ে বসেছে। ডানপাশে কলেজের মেইনগেট, অনেকেই বেরিয়ে আসছে টুকিটাকি। সবাইকে চেনা নেই, দু’একজন চেনা পড়ে গেলে হাত নাড়ে, মুখে ফুটিয়ে তোলে ঝোলাগুড়ের মত তরল হাসি। বিড়ালটা দুটো পা সামনের দিকে একটু ছড়িয়ে নিয়ে রোদের দিকে মুখ করে বসে আর একটু পর পর গোলাপি জিভটা বের করে চেটে নেয়। হঠাৎ কি যেন একটা শিহরণ বয়ে যায় সারা শরীরে! পকেটে ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, বের করে হাতে নেয়। শ্রাবণ! এত সকালে মানুষটা ঘুম থেকে উঠল কি করে ভাবতে ভাবতে সবুজ বোতামটা চাপ দিয়ে কানের কাছে নিলো।
– হ্যালো
– বাসে উঠে গেছ?
– না, বাস আসে নাই।
– আচ্ছা। বাসে উঠে একটা টেক্সট পাঠাইয়ো।
– ঘুম দিয়া এত জলদি উঠিলে?
– নাহ, এলার্ম দিয়ে শুইছি। খোঁজ নিলাম, এখন আবার ঘুমাব। সাবধানে যাইয়ো।
শ্রাবণের সাথে প্রথম যেদিন মাং লং-এর দেখা, সেদিনটা খুব গুমোট ছিল। গাছের একটা পাতাও নড়ছিল না, সুর্যের তাপটা গায়ে লাগছিল কিন্তু একটুও ঘাম হচ্ছিল না। যেন পুরো ঘামটা বিন্দু বিন্দু হয়ে শরীরের এখানে ওখানে বাতাস আটকে রেখেছে। তখন প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়ে কয়েকদিন কেটেছে মাত্র। মাং লং ক্যান্টিনে এসে গ্লাস ভরে ভরে পানি খাচ্ছিল। টয়লেটে ছোট কাজ সারার পর থেকে জ্বালাপোড়ায় দাঁড়াতে পারছিল না। ব্লটিং পেপারের মত শরীর যেন পানির প্রত্যেকটা কণা শুষে নিচ্ছিল। তারপর চেয়ারে বসে কোণার টেবিলে দু’হাত রেখে মাথাটা পেছনের দিকে হেলিয়ে চোখ বুজে থাকে সে। আশেপাশের টেবিলগুলোর শোরগোল, খাবারের লাইনের বকবক আর প্লেট গ্লাস ধোয়ার টুংটাং মিলিয়ে যে কোরাস চলছিল তাতে শারীরিক অশান্তি আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ও যেই টেবিলে বসেছিল সেই টেবিলটায় গরমের দিনে কেউ বসে না, কারণ টেবিলে মাথার ওপর ফ্যান নেই। মাংলং মাথা সোজা করে টেবিলটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল, পানিভর্তি জগ, তার পাশে টিনের দুটো গ্লাস। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো প্যান্টের চেইন খুলে জগের সমস্ত পানি ঢেলে দেয়, তারপর টিনের ঠাণ্ডা গ্লাস দুটো চেপে ধরে। প্রতিটি শিরায় যে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে তাতে যদি একটু উপশম হয়। হঠাৎ পাতারঙা জামা পরা একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল কোণাচে ভঙ্গিতে, যেন ছুঁয়ে দেবে।
– একটু বসব?
মাং লং তাকায়। মেয়েটিকে চেনে কি সে? সম্ভবত ক্লাসে দেখেছে অথবা নয়, মনে পড়ছেনা ঠিক। ক্লাসে দেড়শর কাছাকাছি ছেলেমেয়ে, সহপাঠী হলেও মাং লং একটু বিচ্ছিন্ন। শহরের এই কলেজে সে ভর্তি হয়েছে একটু ভালো পড়াশোনার আশায়। পাহাড় ঘেরা এক ছোট্ট জনপদে বড় হয়েছে সে। একটা সময়ে তাদের পূর্বপুরুষেরা জানতই না পড়াশোনার ব্যাপারে। যুগ যদিও পাল্টাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর গতিতে নয়। মনে পড়ছিল, মেয়েটা তার ক্লাসেরই, নবীনবরণে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ছোট বক্তৃতা করেছিল। তা বাদে দু’একদিন হয়ত দেখে থাকতে পারে।
বাস চলে এসেছে। ফোনটা হাতেই ছিল, দ্রুত পকেটে ভরে ছোট ব্যাগটা নিয়ে বাসের দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। হাতল ধরে শরীরটাকে পেছন দিকে নিয়ে পা দুটোয় হালকা ভর দিয়ে উঠে পড়ে। ৬ নং সারির ডি নাম্বার সিট। খুঁজতে খুঁজতে বাসের মানুষদের মধ্যে এক অদ্ভুত বিচলন লক্ষ্য করে, চোখে চোখে সবাই যেন নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করছে। মাং লংয়ের হাসি পায় ওনাদের মুখগুলো দেখে। মুখগুলো যেন চিৎকার করে বলছে, “দেখ দেখ, একটা চাকমা!”
যদিও মাংলং চাকমা নয়। কিন্তু সমতলের বাঙালিদের মধ্যে খুব কম মানুষেরই সেই বোধ আছে, একটু পাহাড়ি চেহারার কাউকে দেখলেই তারা ধরে নেয় চাকমা। এমনকি নিজেদের মধ্যেও নিন্দাবাচক বিশেষণ হিসেবে ‘চাকমা’ শব্দটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে। কারো চোখ ছোট, “তোকে তো চাকমাদের মত দেখায়”, কারও নাক বোঁচা, “এত পুরা চাকমা”। মাংলংয়ের নিজেকে একটু হলেও উঁচু মনে হয়, ভাগ্যিস সে চাকমা নয়! সেদিন শ্রাবণও চেয়ার টেনে তার সামনে বসতে বসতে বলেছিল, “তুমি কি চাকমা?”
মাংলং বিরক্ত হয়েছিল, কিন্তু বেশি নয়। কারণ তার জীবনটা ছোট হলেও এই প্রশ্নের সংখ্যাটা কখনই ছোট ছিল না। বাংলাদেশে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ রকম জাতিগোষ্ঠীর পনেরো-ষোল লাখের কাছাকাছি মানুষ বাস করলেও সবাইকে তাচ্ছিল্যভরে চাকমা ডেকে বেশিরভাগ বাঙালিই তৃপ্তি পায়। তাই সে আর নতুন করে একে ধরে কথা শোনায় না। আস্তে আস্তে ঠোঁট খুলে প্রায় না শোনার মত করেই বলে, “না”।
– তাহলে তুমি কি?
– ম্রো।
– সেটা কি?
– তুমি কি প্রয়োজনীয় কিছু বোলবা?
মেয়েটা থতমত খেয়ে বলে ওঠে, “আমি এমনিই জানতে আসছিলাম। আগে কখনো উপজাতি দেখি নাই, মানে দেখছি, কিন্তু ক্লাসে পাই নাই।” তড়িঘড়ি করে উঠে চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে মেয়েটা।
– তোমার নাম কি?
– মাংলং ম্রো।
– ওহ, আমার নাম শ্রাবণ। আমি তোমার ক্লাসেই পড়ি। আমি এমনিতেই জানতে আসছি বিশ্বাস করো। তুমি কিছু মনে কইরো না।
মাংলং অদ্ভুতভাবে ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল সে কিছু মনে করেনি। মেয়েটা আরও কয়েকবার ওর হঠকারী প্রশ্নের জন্য বিব্রতভাব প্রকাশ করে বিদায় হলো। ও চলে যাওয়ার সাথে সাথে মাংলং বুঝল যে হিসির রাস্তার জ্বলুনিটাও একটু কমে এসেছে। আবার একগ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছিল সে, আরেকবার ফ্রেশ হিসি হয়ে গেলেই যন্ত্রণাটা পুরোপুরি কমে যাবে। পৌনে বারোটায় একটা ক্লাস , তাই উঠতে হয়েছিল তাকে। ক্লাসে ঢোকার মুখে দেখেছিল মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে বান্ধবীদের গল্প শোনাচ্ছে, হয়ত একটু আগে করা তার বোকা বোকা কাণ্ডের গল্প। মেয়েটা তাকে খেয়াল করে না, সেও তাই আস্তে করে ক্লাসে ঢুকে রাকিব, সাদাফ, জিয়াদদের সাথে বসে যায়। ক্লাস ছাড়া ওদের সাথে বেশি ঘোরাঘুরি করে না মাংলং। ওরা প্রচুর খরচ করে, এদিকওদিক ঘোরে, রেস্টুরেন্ট যায়, দামী সিগারেট খায়। মাংলং এসব পছন্দ করে না। সে কখনই ভুলতে পারে না বাবার তেমন সামর্থ্য না থাকায় তার বড়ভাই পড়তে পারেনি বেশিদূর। আবার সেই বড়ভাই-ই খেটেখুটে উপার্জন করে, বাবাকে সাহায্য করে তাকে পড়তে পাঠিয়েছে। পাহাড়ের একটু একটু ঘাম, একটু একটু টাকা, একটু একটু পরিশ্রম হয়ত সমতলে কিছুই নয়, কিন্তু তাদের কাছে বড্ড দামী। ক্লাসের শেষে শ্রাবণ আসে আবার, চা খেতে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করে। মাংলং শ্রাবণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মেয়েগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে থাকে। শ্রাবণ লক্ষ্য করে। তারপর হাত ইশারায় মেয়েগুলোকে চলে যেতে বলে। “এখন যাবা?”, প্রশ্ন করে। মাংলং রাজি হয়। কেন? সেটা সে আজও অব্দি ভেবে পায় না। বাসের জানালার পাশের সিটটায় বসে বাইরের দিকে চোখ রেখে ভাবতে থাকে। চা খেতে খেতে সেদিন অনেক প্রশ্নের ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিয়েছিল শ্রাবণ।
– তোমরা কি খাও?
– কি খাই মানে?
– মানে প্রতিদিনকার খাবার…
– ভাত, ডাল খাই। তোমরা যেমন খাও…
– কাছিম খাওনা? আর বেঁজি? আর শেয়াল?
হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে মাংলংয়ের কাপ থেকে চা ছলকে পড়েছিল মাটিতে। সেদিনকার পর থেকে শ্রাবণের সাথেই তো সময়গুলো কাটতে লাগল। সন্ধ্যায় হলে ঢোকার আগ অব্দি দু’জন গল্প করত। শ্রাবণ অবশ্য হলে থাকত না, ওর বাসা কাছেই ছিল। শ্রাবণ সুন্দরী ছিল, বেশ সুন্দরী। এতটাই সুন্দরী ছিল যে “চাকমার লগে ঘুইরা বেড়ায়” মূলক আহাজারি চারিদিক থেকে দিনে দিনে বেড়ে চলল আবার কমেও গেল। কোন বিষয় নিয়েই মানুষের আগ্রহ বেশিদিন থাকে না, এ-ব্যাপারেও থাকলো না। জোড়া শালিকের মত দু’জন ঘুরে বেড়াত, ওদের দেখে অনেক মানুষ বড্ড সুখী রকমের হাসি দিত, ওটুকুই পাওয়া। প্রথম যেদিন সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে হিজলতলায় ওরা চুমু খেলো, সেদিন হাওয়াই মিঠাইয়ের মত অদ্ভুত গোলাপি হয়েছিল দু’জন। কাঁপা কাঁপা হাতে সেদিন রাতেই মাংলং লিখেছিল প্রথম কবিতা। পরেরদিন সেই কাগজটা শ্রাবণের হাতে দিতেই ও পড়া শেষ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলেছিল, “এটা নিব না, তোমার ভাষায় কিছু লিখা দাও।”
– আমার ভাষা? আমার ভাষা তো তেমন মনে নাই।
– মানে কি? তুমি বাসায় কথা বলো কোন ভাষায়?
– আমার ভাষায়ই বলি। কিন্তু লিখতে তো পারি না।
– কি আশ্চর্য! লিখতে পারোনা? অক্ষর নাই তোমাদের?
মাংলং বোঝাতে পারেনি সেদিন। অক্ষর আছে, লিপি আছে, ভাষাও আছে, কিন্তু মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ নেই। আগে অবশ্য লিপিও ছিল না। একদম ছোট ক্লাসের পড়াশোনায় একটু আধটু লিপি শেখানো হলেও পরে চর্চার অভাবে বেশিরভাগই ভুলে যায় লিপিগুলো কেমন দেখতে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, শুধু বাংলা। তাই, যার যাই মাতৃভাষা হোক, চর্চা হবে শুধু বাংলার, এটাই যেন অলিখিত নিয়ম। ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অব্দি একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ঝুলতে দেখেছে লাল, নীল রঙে রাঙানো অ, আ, ক, খ। তার ভাষার বর্ণমালা কেউ কখনো টাঙিয়ে দেয়নি ওখানে!
শ্রাবণ সেদিন হেসেছিল। মাংলং অবশ্য তাকে বলেছিল লিপি খুঁজে লিখে দেবে কবিতা, নতুন করে। তারপরে একদিন কোথা থেকে যেন শ্রাবণ একটা হিজিবিজি লেখা চাদর নিয়ে এলো উপহার। গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখো, চিনতে পারো?”
মাংলং খেয়াল করে দেখেও কিছুই বুঝতে পারে না। শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে থাকে। তারপর বলে, “অনলাইন থেকে নিছি। বলল পাহাড়ি ভাষা, ভাবলাম হয়ত তোমার ভাষার অক্ষর হইলেও হইতে পারে। ঠইকা গেলাম।” মাংলংয়ের হাসি পেয়ে যায়। এই আবার নতুন এক জিনিস শুরু হয়েছে অনলাইনে। জামা, কাপড়, বাসনকোসন থেকে ডায়রি পর্যন্ত সবখানে। কোথাও আদিবাসী লিপি, কোথাও ছবি, কোথাও আলপনা, কোথাও চিত্রকর্ম! দেখলেও হাসি পায়, গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা কেবল! এইত সেদিন শাফায়ত ফ্রিতে চা খাইয়ে প্রস্তাব দিলো ‘প্লুং’ বাঁশি এনে দিতে হবে। মাংলং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “প্লুং বাজানো শিখবা?”
– আরে নাহ। বিক্রি করমু। তুই তো জানস না, বড়লোক বা ওইযে নতুন নতুন যারা অভিজাত ভাব নিতে চাইতেছে, ঘর সাজাইতে নেয়। আবার বিভিন্ন দোকানে, রেস্টুরেন্টে ইন্টেরিয়রের কাজেও নেয়, অনেক দাম দিয়া।
– তারা নিয়া কি করে? বাজায়?
– নাহ! বাজাইবে কেন? সাজাইয়া রাখে। এস্থেটিক ভাব আসে এগুলা বসার ঘরে, রেস্টুরেন্টে সাজাইয়া রাখলে, বুঝস না?! শোন, তুই পাঁচশ’র মধ্যে পারলে আমারে আইনা দিস।
শ্রাবণ পরে বলেছিল, শাফায়াত ওগুলো তিন-চার হাজারে বিক্রি করবে। আজকাল পাহাড়িদের যেকোনো জিনিস মানুষ শখ করে কেনে, কখনো কখনো তো রীতিমতো মারামারি করে কেনে। মাংলং এগুলো জানত না। তার সবকিছু কেমন নতুন লাগে। পাহাড়ি জিনিসের এত দাম, তাহলে পাহাড়িদের পেটে ভাত নাই কেন? পাহাড়ি জমি দিনে দিনে কমে যাচ্ছে কেন? যাদের পাহাড়িদের ব্যাপারে এত আগ্রহ তারা কি জানে পাহাড়িরা কেমন আছে?
মাংলং ছুটিতে গ্রামে ফিরে লিপির খোঁজে বেরিয়ে দেখেছিল পাহাড় কেটে, জুমের জমি কেড়ে নিয়ে, সবুজের বুক নষ্ট করে আধুনিকতা আসছে। পায়ে পায়ে অভিযাত্রিকের দল নিশ্বাসের খোঁজে এসে সভ্যতার মাপকাঠি তুলে ধরছে। মাংলংয়ের বুক আরও একবার কেঁপে উঠেছিল। সেই নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাসে নয়, আশংকার মেঘ গর্জনে। সব যদি সমতল হয়, তবে আপনজনেরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বাবাকে, বড় ভাইকে প্রশ্ন করেছিল সে। তাদের নিশ্চুপ চোখ তাকে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করেছিল সেদিন।
শ্রাবণের সাথে এখন আর আগের মত সম্পর্ক নেই। শ্রাবণকে পাওয়ার মত পরিস্থিতি তার নয়, সেটা সে জানে। একদিন খোলাখুলি কথা বলে ব্যাপারগুলো পরিস্কার করে নিয়েছিল সে। শ্রাবণ বুদ্ধিমতী, সহজেই বুঝেছে। কিছু ব্যাপার অপরিবর্তনীয়, মেনে নিয়েছে তারা। বাসের জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে মাংলং ভাবে, শ্রাবণ তো তার মাতৃভাষার মতই, জনপদের মতই। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, আরও দূরে সরে যাবে, একদিন হয়ত মুছে যাবে প্রতিদিনের জীবন থেকে। ভালোবাসার লিপিগুলো খুঁজে ফিরবে ভাষাতাত্ত্বিকেরা, মাটি খুড়ে হয়ত কোন প্রস্তরে আঁকা প্রেমপত্রের ধ্বংসাবশেষ হাতে পাবে সন্ধানী প্রত্নতাত্ত্বিক। যেদিন সমতলে বৈচিত্র্য আনা পাহাড় সমতল হবে সব বৈচিত্র্য নষ্ট করে, সেদিন সবাই জানবে, ঠিক জানবে, কিছু নিয়ম বদলালেই বদলে যেতে পারত নিয়তি। শুনেছে আন্দোলন হচ্ছে, সবাই চিৎকার করে জানান দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব, বেঁচে থাকার চেষ্টা। কিন্তু কেন? জামা-কাপড়ে, বাসনে, বইয়ের পাতায়, টিভিতে, পত্রিকায়, অভিজাত ড্রইংরুমে তো মাংলংরা উপস্থিত। তবে চিৎকার করে জানাতে হবে কেন! প্রশ্নগুলো ধূসর পিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে মাংলংয়ের চোখের মণিতে ঘুরপাক খায়।