You are currently viewing প্রকৃতি ও প্রাণের কথা>  লাবণী মণ্ডল

প্রকৃতি ও প্রাণের কথা> লাবণী মণ্ডল

প্রকৃতি ও প্রাণের কথা

লাবণী মণ্ডল

পাখি ছাড়া প্রকৃতির কথা চিন্তাও করা যায় না। একইভাবে প্রকৃতি ছাড়া মানুষের কথাও ভাবা প্রায় অসম্ভব। এ যেন অবিচ্ছেদ্য এক সত্তা! নদী, পাহাড়, বন আর সমতলের বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল নিসর্গে সর্বত্রই পাখপাখালির রাজত্ব। আবার শীতে এখানকার জলাশয়গুলো ভরে ওঠে পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই বিচিত্র সব পাখি আমাদের প্রকৃতির মূল জীবনীশক্তি। সেই পাখিদের পঞ্চাশটি রূপময় জগৎ উঠে এসেছে মানজুর মুহাম্মদের পঞ্চাশ পাখির গল্প শীর্ষক গ্রন্থে। গল্পগুলো কিশোর-উপযোগী হলেও পরিণত পাঠকের ভাবাবেগ এবং মননকেও উজ্জীবিত করতে পারে। এর ভাষার সারল্যও পাঠককে আনন্দ দেবে। গল্পের মাঝেও রয়েছে বৈচিত্র্য। লেখক কল্পনাপ্রতিভার স্ফূরণে সেখানে পাখিদের জীবনযাপনের সঙ্গে যেমন মানবিক অনুভূতির সমন্বয় ঘটিয়েছেন, তেমনি দেশের প্রকৃতি, বিশেষ গ্রামীণ সমাজজীবনের একাংশ তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে কয়েকটি গল্পে পাখির রূপ ও জীবনযাপনের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালকে অঙ্কিত করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে প্রাণ-প্রকৃতির ওপর আগ্রাসন চালিয়েছিল, তা সেখানে উঠে আসে।

বাংলাদেশ পাখির দেশ। গানের দেশ। ফুল-প্রজাপতির দেশ। এখানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে। এর অর্ধেক অতিথি পাখি। তারা আমাদের দেশে আসে বছরের বিশেষ সময়ে। কিছুদিন থেকে আবার চলে যায়। বাকি অর্ধেক আবাসিক। বাংলাদেশের পাখির নামও খুব আদুরে। যেমন ফুটফুটি, বসন্তবৌরি, ফুলঝুরি, ভরত, চশমা পাখি, নীলকণ্ঠ, মুনিয়া, সহেলি, হলদেবউ, কমলাবউ, বন্ধন, নীলপরি, শ্যামা, দোয়েল, বুলবুলি, চড়ুই, মথুরা, রঙিলা বক, ডুবুরি, পাপিয়া, রাঙ্গাহালতি, হালতি ইত্যাদি। নামগুলো মন ছুঁয়ে যায়। এদের কণ্ঠ সুরেলা। তাদের গানে প্রাণ ভরে যায়। সবচেয়ে ছোট্ট পাখিটির নাম ফুলঝুরি, আর সবচেয়ে বড়টির নাম মদনটাক। পাখিরা আমাদের পরিবেশের এক বড় সম্পদ। তারা শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বনের খাদ্যশৃঙ্খলে স্বাভাবিক ধারাও বজায় রাখে। পাখিরা ফসলের যতটুকু খায়, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে উপকার করে তার চেয়ে বেশি। তারা উদ্ভিদের পরাগায়ন ও বীজের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এই পাখিদেরও আছে মন। আছে আবেগ, অনুভব ও উপলব্ধি। তারাও ভালোবেসে বন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধে। তাদের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, ক্রোধ, বিদ্রোহ এবং বীরত্বগাথা নিয়ে রচিত পঞ্চাশ পাখির গল্পস্বর্গীয় পাখি দুধরাজ গল্পে পাখির দুর্দান্ত বর্ণনা দিয়েছেন লেখক- ওর মাথায় আছে এক চমৎকার রাজকীয় কালো রঙের চুড়ো। মনে হচ্ছে ও চকচকে কালো পালকের কোনো মুকুট পরেছে। ওর ঠোঁটের রং নীল। সেই তীক্ষ্ণ কপাল কী সুন্দর কালো। ঘাড়ের উপরের কালো চুলগুলো যেন কোনো পার্লারে গিয়ে সমান করে কেটে নিয়ে ব্যাক ব্রাশ করেছে। ওর বুক আর পেট তুলোর মতো শুদ্র। গলা ও কপাল কী সুন্দর কালো। নীল রঙের চোখের মণিতে সূক্ষ্ম একটি সাদা অনন্যসুন্দর বিন্দু আছে। পায়ের রং হালকা লাল। ওর লেজের সৌন্দর্য দেখে যে কেউই মুগ্ধ হবে। ওর লম্বা লেজটি শরীরের তুলনায় তিন ভাগের দুই ভাগ। লেজের অগ্রভাগ থেকে দুটি লখ সাদা পালক ফিতার মতো নেমে গেছে। ওই সাদা পালক দুটির রূপ-মাধুর্য ও শারীরিক অপার সৌন্দর্যে ওকে স্বর্গীয় পাখি বলে মনে হয়। বাদামি কানের তুলতুলে খরগোশছানারা আর ছোট পাখিগুলো খেলা ভুলে এই অনন্যসুন্দর পাখিটির উড়ন্ত সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। পাখিটি ওদের ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছে। সে যেন উড়ে উড়ে বলছে, এই দেখো আমি কত সুন্দর। আমার লেজের পালক কত চমৎকার। ও যখন বাতাসের বিপরীতে উড়ছে তখন ওর লেজের সাদা ফিতা দুটি টানটান হয়ে যাচ্ছে। তাকে তখন আরও সুন্দর লাগছে। আর যখন বাতাসের অনুকূলে উড়ছে তখন ওই ফিতা দুটি তার মাথার উপরে উল্টে এসে পড়ছে। তখনো তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সে কিছুক্ষণ উড়ে একটি গাছের ডালে বসল। বসার পর তার লেজের পেছনের লম্বা সাদা ফিতা দুটি তরবারির মতো বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুলে থাকল। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে ওর দুধের মতো সাদা লেজের মসৃণ মোলায়েম ফিতা দুটি নাচিয়ে দিল। এমন দৃশ্য দেখে খরগোশছানা ও ছোট ছোট পাখিরা হাততালি দিল। হাততালি শুনে অনিন্দ্যসুন্দর পাখিটি হেসে দিল। পাখিটির নাম হলো দুধরাজ। পাখির সৌন্দর্য্যের এমন প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা তরুণ পাঠকদের প্রকৃতির আরও কাছে টানবে। 

মায়াবী পাখি ফুটফুটি গল্পে লেখক একইভাবে ফুটফুটি পাখির বর্ণনা তুলে ধরেছেন- ফুটফুটিরা রোজ সকালে নিজেকে আড়ালে রেখে মোলায়েম সুরে গান করে। ফটিক সেই গান খুব পছন্দ করে। তাই ফটিক ফুটফুটিদের মোলায়েম সুরে গান শুনতে কাক ডাকা ভোরে বনে আসে। চিকিক কিক্‌ চিক্‌কি…. চিকিক কিক্‌ চিক্‌কি স্বরে মিষ্টি সুরের গান ফটিকের মন-প্রাণ আকুল করে। কখনো সে হুইছো.. ছিক..ছিক..ছিক স্বরেও ডাকে। ফুটফুটিদের গায়ের রংও অনেক সুন্দর। ওরা মায়াবী পাখি। তাদের মাথা গাঢ় ধূসর। মাথা থেকে ধূসর রং ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নেমেছে। পিঠ সোনালি। সোনালি পিঠেও ধূসর রঙের আবছা ভাব আছে। গলা ও বুকের অর্ধেকটা হালকা ধূসর, তারপরে আবছা সোনালি টান আছে বুকের মাঝ বরাবর পর্যন্ত। পেটের রং কী সুন্দর উজ্জ্বল হলুদ। ঠোঁটের রং ধূসর। ঠোঁট তীক্ষ্ণ ও শক্ত। লেজ যেখানে শুরু তার উপরের কিছুটা অংশ গাঢ় হলুদ। লেজের উপরিভাগের পালক সুরমা রঙের। ডানার পালকের রং কালো। ডানার কিছু পালকের কিনারায় হলুদ রঙের দারুণ কারুকাজ আছে।

পলাশি নদীর পানি লাল সিরুর বাবা বলল, মঞ্জু ভাই এই রক্তের ওপর দিয়া কীভাবে নৌকা চালাব। এই রক্ত তো আমার তোমার বাবা, ভাই, বোনের, সন্তানের। পাকিস্তানিরা আমাদের এমন করে কচুকাটা করছে যে, নদীর পানি তো আর পানি থাকল না, সব রক্ত হয়ে গেছে। মজু মিঞা ধমক দিয়ে বলল, বেশি কথা বলিস না, নৌকায় ওঠ। সিরুর বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বলল, আমি পারব না, আমি রক্তের ওপর নৌকা বাইতে পারব না। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি পারব না। মঞ্জু মিঞা পাকিস্তানিদের কানে কানে কী যেন বলল। অমনি পাকিস্তানি সৈন্য দুইজন সিরুর বাবাকে পায়ের বুট দিয়ে একের পর এক লাথি মারতে লাগল। সিরুর বাবা মাটিতে পড়ে গেল। সিরু কড়ইগাছের ওপর থেকে সব দেখছে। সে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। সিরুর বাবার বুকের ওপর বুট দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে করে পাকিস্তানি সৈন্য দুইজন বলছে, হারামজাদা, কিশতি চালাও… কিশতি চালাও। সিরুর বাবার নাকে-মুখে রক্ত করছে। সিরুর বাবা চিৎকার করে বলতে লাগল, আমার ভাইয়ের রক্তের ওপর দিয়ে আমি নৌকা চালাতে পারব না, কোনোদিন পারব না। সিরু মধুকে বলল, এক্ষুনি গিয়ে ওই পাকিস্তানি দুইজনের চোখ তুলে নে। মধু তৎক্ষণাৎ কড়ইগাছ থেকে জেট বিমানের মতো উড়ে গিয়ে এক পাকিস্তানির চোখে তার তীক্ষ্ণ নখর গেঁথে দিল। পাকিস্তানি যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল, মর গিয়া… মর গিয়া। মধু শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বিশেষ কৌশলে অন্য সৈন্যের চোখ ও নাকে আক্রমণ করল। আক্রান্ত সৈন্য দুইজন যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। মজু মিঞা অবস্থা বেগতিক দেখে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মধুপাগল মধুরাজ গল্পে পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের বিপরীতে প্রকৃতির প্রতিরোধেরই চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে সিরুর পাখি বন্ধু মধু হানাদার বাহিনীকে আক্রমণ করে। 

এভাবে পঞ্চাশ পাখির গল্প বইটির প্রতিটি গল্পেই রয়েছে সুন্দর ও মনকাড়া বর্ণনা। পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প লিখতে হলে পাখি-প্রকৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়। গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক তার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই গল্পগুলো পড়লে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সি পাঠকই পাখি সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবেন। বইটি শিশু-কিশোরদের জন্য যেমন উপযোগী, তেমনি চমৎকার কাহিনির জন্য সব বয়সি পাঠকের কাছেই তা ভালো লাগবে। এ প্রসঙ্গে বইটির ভূমিকায় লেখক বলেছেন, শুভ্র নীল আকাশের গায়ে পাখি যেন ছুটন্ত নকশি ফুল। বন, মাঠ, জল ও আকাশে ছড়িয়ে থাকে তাদের সুখ-দুঃখের আখ্যান। বিচিত্র রঙের পাখি সবুজ প্রকৃতিকে আরও রাঙিয়ে তোলে। তাদের বিচিত্র স্বরের গানে নিসর্গের নীরবতার খাঁজে যেন সুন্দরের মণিমাণিক্য জমে ওঠে। সেই সুরে মন ভরে যায়। বাহারি পাখি চোখ জুড়িয়ে দেয়। তাদের কণ্ঠে বেজে ওঠা সুরে বোঝা যায় পাখির হাসি ও কান্না। …পাঠকের মনে গল্পগুলো পাখি সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে, দেশপ্রেম ও পাখিপ্রেম জাগরণে ভূমিকা রাখবে। পাখির জন্য পাঠকের মনে অপার ভালোবাসার জন্ম দেবে। এর মধ্য দিয়ে পাঠক বাংলাদেশে পাখি নিধন বন্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

 

পঞ্চাশ পাখির গল্প

লেখক: মানজুর মুহাম্মদ

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ

প্রচ্ছদ: সোহাগ পারভেজ

মূল্য: ১২০০টাকা

*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*