২২শে শ্রাবণে ৬টি ছায়াছোট গদ্য :
~ অমীমাংসা ~
সবচেয়ে উচ্চশিখর বাঙালির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রথম এশীয় যিনি ইউরোপীয়দের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলে আনেন, তিনি বাংলা ভাষার সাংগঠনিক সংহতি আনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন, তাঁর আগে আমরা জানতাম না- আমাদের প্রাণের অন্দরমহল যে কত সহস্র শিহরণের নগর!তিনি প্রথম বাঙালি পশ্চিমা লেখক যিনি হিন্দু ও মুসলমানকে রাখীবন্ধনে বাঁধেন, সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও সাহিত্যে শানজরের উদ্যোগ নেন, তিনি মানুষকে আগুনের কাছে বিনত করেন- আগুনকে উদ্বুদ্ধ করেন নতশির হতে, রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে দৃশ্যমানতার অয়োময় থেকে অদেখার অনুরণনের বোধির সঙ্গে মেলান, তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে কাঁটাতারের বিভেদ দিগন্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেন।এতোগুলো অর্জনের কারণেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চশিখর বাঙালি নন; তাঁকে নিঃসঙ্গ মৃত্তিকামুকুট রাজার অধিষ্ঠানে গ্রহণ করি- কেননা তিনি পথভোলা এক পথিক- নিশ্চিত করে জানেন না তাঁর আসলে গন্তব্য কী- অন্বেষা-ই তাঁর বাড়ি; সবার সর্বাংশে জানার মচ্ছবে তিনি-ই একমাত্র না-জানার সংশয়ে মহীয়ান।
~ ব্যক্তির পূর্ব-পশ্চিম ~
তার আগে প্রথমেই বাতিল করে নিই সেই পুরাতন কূটচাল : জলের উপর পানি না-কী পানির উপর জল; তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিতরমহলে আলো ফেলে আমাদের জন্য তুলে আনেন সহজ প্রণম্য সারবস্তু যে অর্থ করে এক ও অদ্বিতীয় – সত্য ঘোরনিষ্ঠা- প্রিয়তম জীবনসুষমার জয়ধ্বনি আর কলকাকলি; হীনমন্যতার সাধ্য কী মুহূর্তলাগি কালি ফেলে জীবনমাধুরী পটে; মিথ্যা আর পুরাতন গ্লানির ক্ষমতা-ই নেই পথ আটকে দাঁড়ায় আনন্দকল্যাণ অভিযাত্রার মুখে- তিনি রবীন্দ্রনাথ জাদুকরি হাতের স্পর্শে আমাদের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেন নোতুন প্রাণের উৎসার, হৃদয়ের যতকথা মেঘ ও রৌদ্রের কলহাস্যে গুঞ্জরণ করে, দুঃখ ফোটে বসন্তদিনের নিদারুণ কল্লোলে; যে-ভাষা চমকায় প্রকৃতির সহজিয়া বিস্তারে, তিনি সেই ভাষায় মন্ত্র শোনান পাশ্চাত্য অন্ধগতির কানে কানে, জাতীয়তাবাদী গণ্ডারী ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তিকে তিনি দেখতে চান সহমর্মিতা আর সংবেদের মনকড়ায় বন্দীবিলাসে মুক্ত; রবীন্দ্রনাথ চান প্রাণহীন পশ্চিমা ক্ষিপ্রতার গোঙানির জায়গায় ফুটে উঠুক মননের গৌরব, প্রাচ্যের স্থবির সংস্কারে চনমনিয়ে উঠুক গতির টঙ্কার,মর্যাদাবান ব্যক্তির বলিষ্ঠ জাগরণ তাঁর সর্বৈব সাধনা- তাই আজো কে থাকে ঘুমের ভিতরে নিষ্প্রাণ জড়, তাঁর আমূল সুরে ও প্রাণে চিত্তের মিলনযাত্রায় অর্ধব্যক্তিরা আড়মোড়া ভাঙে,নিসর্গও কাতরায় বুঝি প্রত্যুষের দিকে- একাএকা মর্মরধ্বনি জাগে মনে ও মেঘে, ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় তাহারই চিহ্ন পড়ে!
~ গৃহী ও বাণপ্রস্থ ~
এমন একটি সমীকরণ থাকুক- তা কোনভাবেই চাই না, কিন্তু এই সমীকরণটি সত্য হতে পারে বলেও মনে হয়: আমরা যতদূর ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আলোকায়ন কবুল করি, রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের ততোদূর ভালো লাগে; যখনই পশ্চিমা দর্শন, উন্নতি, অর্থনীতি আর মানুষে মানুষে সম্পর্কটি নেড়েচেড়ে দেখি- তাকে বিনা জেরায় গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ বোধ করি না- রবীন্দ্রনাথের গানও তখন আমাদেরকে আর তেমন তুমুলভাবে টানে না; একান্ত গভীর ব্যক্তির একক আকুতির উন্মীলনে রবীন্দ্রনাথের যে আয়োজন- তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেরই জয় ও বাসনা; এই ব্যক্তির মধ্যে পশ্চিমা ব্যক্তির প্রাণভোমরায় একা বেড়ে ওঠার বীজমন্ত্র যুক্ত আছে।দেখতে পাই- আমাদের এতোদিনকার আরাধ্য পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার আয়ু ও প্রকল্প করপোরেট পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে হাঁসফাঁস করে- ব্যক্তিরও নাভিশ্বাস ওঠে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এখন আর অর্গল খুলে যাওয়া বোঝায় না- বোঝায় দেয়াল, ব্যক্তির হীনমন্যতা ও স্বার্থপরতার জগদ্দল, কুয়া, কুণ্ডলির ভিতর আবদ্ধতার নাম, তা আর আগুনের ওম নয়, দাহ; নীরবতা নয়- বরফ।কিন্তু এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শিতা অনুসরণযোগ্য: তিনি সংশয়হীনভাবে বুঝতে পেরেছিলেন- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বেপরোয়া উত্থানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের পাগলা ঘোড়ার একটি প্রত্যক্ষ যোগ আছে। রবীন্দ্রনাথ লাগাতার জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত নৃশংসতার ব্যাপারে সতর্ক উদ্বেগ জারি রেখে গ্যাছেন, বারবার পশ্চিমাদের রোষানলে পড়েছেন। এভাবেই তিনি গৃহী ও বাণপ্রস্থ, অতীত আর ভবিষ্যতের মিলনবিন্দু।ব্যক্তির উন্মেষ, জাগরণ ও কাতরতার জন্য রবীন্দ্রনাথের যে পণ এতোদিন পরে এসে আজ আর তা গন্তব্য নয়, কিন্তু জাতীয়তাবাদী উত্থানের অধপতন এবং নীচতা সম্পর্কে তাঁর উৎকন্ঠা আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও দূরপ্রসারী।
~ নতুন করে হারাই বলে ~
অনেককেই জানি, যারা রবীন্দ্রনাথের আলোকধারায় জীবনে পথ চলেন, তারা রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে সম্পূর্ণ জীবন বিন্যস্ত করে তোলেন। এই কথাটির বাস্তবিক অর্থ কী- তা অবশ্য খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল।উদাহরণ হিসাবে দাখিল করি : আমি এমন একজন শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষকে জানি- যিনি জীবনের ভরা যৌবনকালে প্রেমে পড়েছিলেন। এবং তাঁর প্রেয়সী তাঁকে শ’ খানেক প্রেমপত্রও লেখেন- যার প্রতিটিই ছিল চিঠির বদলে রবীন্দ্রনাথের একেকটি গান। শেষাবধি ভদ্রলোক ওই সম্পর্ক থেকে পালিয়ে আসেন।পরে অনেকটা আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আদলে প্রেমিকপ্রবর কহেন- ওখানে লম্বা লম্বা গানের বাণী ছিল, অতি দূরবর্তী উতল হাওয়া ছিল- কিন্তু কোনভাবেই আমি ছিলাম না, না ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কী ওই দয়িতা নিজে। যা ছিল- তার নাম মহীয়ান নামতা।পলাতক শ্যামপ্রেমিকরাজ আরও বলেন- রবীন্দ্রনাথ অনেক বড়, কিন্তু আমার সামান্য জীবন থেকে বড় নন, আমার গোটা জনপদ যতোই পশ্চাৎপদ হোক- সেই জনপদ থেকে বড় নন। কেউই এভাবে বড় নন- না কার্ল মার্কস, না মাও সেতুং, আব্রাহাম লিঙ্কন, না রবীন্দ্রনাথ, না গৌতম বুদ্ধ- কেউ না।আমরা রবীন্দ্রনাথকে বাজারে তুলি, তা-কে ভাঙিয়ে বড়াই করি, কিন্তু উদযাপন করি না- সে জীবন যাপন করি না- যাতে তিনি মর্মের গোপনে থাকেন, তাঁকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফুলের বহু মনকাড়া বর্ণে উপস্থিত করি, কিন্তু আসলে তিনি ফুলের গন্ধে হাজির।আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। বাস্তব জীবনে যদি ঘনঘোর, স্পর্শকাতর বিহ্বলতা না থাকে- তাহলে ওই রোমান্টিক গান- সকল সুসমাচার, উঁচু উঁচু কোটেশন সবই কুঠারাঘাত, শিলাবৃষ্টি- তা সে যে নামেই বর্ষিত হোক।
~ মোহন সর্বনাশ ~
তিরিশি কবিদের দাপটের কাছে একসময় আধুনিক কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ খানিকটা পিছিয়ে আসেন।তিনি যে কবিতা থেকে সরে এসে গানে নোঙর করেন- তার মধ্যে একটা ঐতিহাসিক দার্শনিক ঘটনার রূপায়ণ ঘটে।রবীন্দ্রনাথের অন্তর্লোকে একটি গভীর নিজস্ব ঐতিহ্যকাতর দীক্ষা ছিল- যাকে তিনি কখনও দূরে সরিয়ে দেননি। আধুনিক কবিতার জন্য নিজের ছায়া কেটে ইউরোপীয় মাজহাব কায়েমে তিনি ঠিক ওইভাবে জঙ্গম হয়ে উঠতে রাজি হননি।ভাবগীতল গানের মাঝে বাঙলা লোককবির সারল্যের সঙ্গে পশ্চিমা ব্যক্তি মানস উন্মোচনের একটি দ্বিধা থরোথরো কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদম্য আত্মগোপনকারী সুরের শিখায় ছুঁইয়ে দেন।প্রটেস্ট্যান্ট ক্রিসটিয়ানিটি যেমন নবীকে কবির সঙ্গে মিলাতে রাজি থাকে, রবীন্দ্রনাথও উঠতি ব্যক্তি মানুষের সংবেদনশীল চৈতন্যকে তাঁর গানে বেদমন্ত্রের উপরে সমাসীন করেন।রবীন্দ্রনাথের এই সুরের ঝুঁকি আমাদের ভীষণ কাজে আসে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসের কেন্দ্রীয় বিহ্বলতা অতঃপর দু’টি আকুতি নিয়ে গড়ে ওঠে : বাতাসে দোলা বাবুই পাখির বাসা, আর রবীন্দ্রনাথের গানে মহীয়ান সর্বনাশের উদযাপন।
~ আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ ~
বোধকরি বৈজ্ঞানিক সত্যের নৈর্ব্যক্তিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটু ভয় ছিল। তিনি সত্যকে বস্তুনিরপেক্ষভাবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।১৪ জুলাই ১৯৩০ সনে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে আলাপ হয় তাতে বুঝি- রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছু বিচার করার যে রেওয়াজ তার বাইরে যাননি।আইনস্টাইন বলেন- জগৎ-সংসারে কেউ না থাকলেও অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার একইরকম সুন্দর থাকবে।রবীন্দ্রনাথ বলেন- না, তা থাকবে না। মানুষের চোখের সমর্থন ছাড়া অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার সুন্দর নয়।আইনস্টাইনের উত্তর- তা হয়তো সৌন্দর্যের ব্যাপারে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্যের বেলায় নয়। কেউ দেখুক, কী না দেখুক- সত্য একা একাও সত্যই।মানুষের অংশগ্রহণ বা আত্মিকতার বাইরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাকে টেনে নিয়ে যাননি। আইনস্টাইন সংশয়ী হয়েছিলেন বটে, তাঁর কথায় একটু দীর্ঘশ্বাসের প্রলেপ ছিল; বলেছিলেন- বৈজ্ঞানিক সত্যের দিকে যাওয়াই তাঁর ধর্ম, তাই পিছন ফিরে তাকাননি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহত্ত্ব এখানেই যে, তিনি নিঃসঙ্গ হতে চাননি- তাই বারবার মানুষের দিকে ঘুরে দেখেন; আলবার্ট আইনস্টাইনের গরিমা ওখানে যে, তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি।।