‘পুণ্যাহ’ যেভাবে দাঁড়ায় আমাদের মুখোমুখি
কাহিনির ঋজুতা, সংলাপ ও গীতিময়তায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক দমে দেখে ফেলার মতো নাটক ‘পুণ্যাহ’। নাটকটি রচনা করেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর। নাট্যকেন্দ্রের পরিবেশনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক।
পাপী কে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই নাটকের গল্প শুরু। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যে পাপ-পূণ্য লুকায়িত তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখি, একটি জনপদ যার নাম কাকরগাছি। এই জনপদ হঠাৎ ঝড়ের কবলে পরিণত হয় একটি মৃত্যুপুরীতে। সংস্কারাচ্ছন্ন জনপদের মানুষেরা জড়ো হয়। দাঁড়ায় একে অন্যের মুখোমুখি। মূলত এই পরিণতির জন্য তারা নিজেরাই কী দায়ী? রূপক নয় বাস্তবেই আমরা যদি আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াই তাহলে আমরা কী দেখতে পাবো? আজকে প্রকৃতির যে বিপর্যয় এর জন্য দায়ী কে?
আমরা গাছ কেটে নগর বানাই। আমাদের দেশে ছিলো লাখ লাখ নদীর মোকাম ছিলো পশু পাখির অভরায়ণ্য। আজ কোথায় সব? চারপাশে শুধু ছড়িয়ে আছে বিষ আর বিষ। নাটকটিতে রূপকভাবে এই বার্তাগুলোই আমাদের দেয়। প্রতি পরতে পরতে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় নিজের মুখোমুখি। আর বলে, ‘চোখ দিয়ে, নিজের চোখ দেখুন’।
যা হোক, নাটকটিতে আবার ‘পাপী কে?’ এই অনুসন্ধান তৎপরতায় নিজেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঠিক তখন মনে হয়েছে, কাকরগাছি শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম নয় এতো পুরো বিশ্বগ্রাম। যার সরল প্রতিনিধি আমরা নিজেরাই। এই বিশ্বগ্রাম আজ আমাদের জন্য ভালো নেই। ভালো নেই বাংলাদেশ। আজ যখন লেখাটি লিখছি, পত্রিকায় নিউজ পড়লাম ‘’ ঢাকায় কম ওজনের শিশু জন্মের কারণ বায়ুদূষণ’ শিরোনামে। বিষয়টি কী ভাবায় না?
ঝড়, খরা, বন্যা, মহামারি এতসবের পেছনে আমরা কী দায়ী নই? গতবছর সিলেটের বন্যা আমাদের কাঁদিয়েছে, উত্তরবঙ্গের বন্যার চিত্র তো সর্বজনবিদিত। কিছুদিন আগেও তুরষ্কের ভূমিকম্প পুরো বিশ্বকে কাঁদিয়েছে। এগুলো কী রুপক?
আসুন, আবার নাটকে ফিরি। আমরা দেখি, নারীই যেন সমাজের সব ধ্বংসের অন্যতম কারণ। যেমন, আম্বিয়া যার অষ্টম শ্রেণিতে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিশোরী অবস্থায় বিয়ে দেওয়া হয় ৫০ বছর বয়সী জমিদারের সাথে। কিন্তু বছর দু’য়েক পরেই সেই জমিদারের মৃত্যু তাকে বিধবা করে। ফিরে আসে কাকরগাছি। জড়িয়ে যায় বিবাহ বহির্ভূত তৈয়ব আলীর প্রেমে। সেই প্রেমের ফসল হলো তার গর্ভের সন্তান। অপরদিকে দেখি, মসজিদের মৌলভি সারা জনপদে পাপের কারণ খুঁজে পেতে হয়রান হয়ে পড়েন। সরলপ্রাণ মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের দেখা মেলে। মৌলভি নিজের মনের কথা মানুষের কাছে বলতে গিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন, জনপদের মানুষগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তখনই তারা খোঁজে পাপী কে? তাকে বিনাশ করলে জনপদে শান্তি ফিরে আসবে।
আমরা দেখি আম্বিয়ার গর্ভে তৈয়ব আলীর যে ভ্রুণ প্রাণ পেতে শুরু করেছে, তৈয়ব আলী সেই ভ্রূণ হত্যার জন্য চাপ তৈরি করে। সমাজের প্রতিটি মানুষ পাপ আর পাপীকে অনুসন্ধান করে করে একতরফা সিদ্ধান্ত আরোপ করে আম্বিয়াকে। আমরা যদিও দেখি, পতিতা মূর্তজা, খুনী জঙ্ঘু ডাকাতদের পাপও যেখানে ম্রিয়মাণ হয়ে যায় আম্বিয়ার পাপের কাছে। আম্বিয়ার ভালোবাসা তখন পাপ হয়ে যায়, টিকে যায় তৈয়ব আলীর সম্মানবোধ। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কলুষিত সমাজের গতানুগতিক বৈচারিক ঘোষণা জারি হয়, পাথর মেরে আম্বিয়াকে শাস্তি দেওয়ার। তখন জনমনে নিজের অপরাধবোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করার অতিতৎপরতায় তৈয়ব আলী এগিয়ে যায়। স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত থেকে বের হয়ে আম্বিয়ার প্রেমিক পুরুষ তৈয়ব আলী ক্ষিপ্রগতিতে ঢিল ছুঁড়ে মারে আম্বিয়ার কপালে।
এভাবেই আমরা দেখি, এই সমাজে এখনো ভালোবাসা পাপ। দেখি প্রবমান ধরে নিজের দোষ অন্যের উপর চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতার চিত্রপট। যে শোষক সেই হয়ে যায় শাসক। সবমিলিয়ে ‘পুণ্যাহ’ তাই প্রতিষ্ঠিত ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য, সত্য-মিথ্যার ভিত্তিমূলে আঘাত করে যায়। ভাবায়, আমাদের সকল পরিণতির জন্য দায়ী আমরাই।
শামীম সৈকত
স্নাতকোত্তর, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।