You are currently viewing পিপুফিশু -৭ ||   আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু -৭ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

কিস্তি

আফসারের ভেতর-বাইরের আলোছায়া

ছোট্ট টাউনশিপের মধ্যখানে এক চিলতে পার্ক, হোয়াইটস পার্ক  । অসংখ্য গাছগাছালি সুচারুভাবে বিন্যস্ত। একটা সুইমিং পুল, বাচ্চাদের কিছু রাইডার, ওপেন কনসার্টের জন্যে একটা কাঠের স্টেজ, ছোট ক্রীকের ওপর সরু ব্রীজ আর এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটানো কিছু বেঞ্চ। পরিবেশটা বেশ প্রশান্ত। কাজ, ঘর আর বাজার ছাড়া তো প্রবাসে একটু একা হবার কোন ফুরসত মেলে না। নিজেকে নিয়ে ভাববার মতো সময়ই হয়ে ওঠে না। দম দেয়া পুতুলের মতো ছুটতে ছুটতে অনেক সময় হাঁফ ধরে যায়। তাই একটু ফাঁক পেলে কিছুক্ষণের জন্যে চলে আসি এখানে। এখন যেমন এলাম। বিশাখার দেয়া বাজারের ফর্দ মোতাবেক সওদাগুলোর অর্ডার দিয়ে চলে এসেছি এখানে। ওগুলো রেডি হতে কমপক্ষে এক ঘন্টা। এই ফাঁকটুকুতে নিজেকে একটু ঝালাই করে নেয়া যাক ভেবে চলে এসেছি।
পার্কে এ সময়টাতে মানুষের তেমন আনাগোনা থাকে না। এখনো নেই। জনা কয়েক বয়স্ক পুরুষ মহিলা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। কয়েকটা ভারতীয় পরিবার বাচ্চাদের রাইডারে চড়াচ্ছে। বাচ্চারা হইচই করছে আনন্দে । আমি ন্যূনতম কোলাহল এড়িয়ে ক্রীক পেরিয়ে একটু ভেতরের দিকে চলে এলাম। একটা মোটামুটি বড়ো আকারের বৃত্তকে ঘিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো গাছ। বৃত্তের চতুর্দিকে রাখা হয়েছে অনেকগুলো বেঞ্চ। এ জায়গাটায় একধরনের গা ছমছমে নীরবতা বিরাজ করছে। কয়েকটা পাখি গাছের শাখায় শাখায় হুড়োহুড়ি করছে। নতুন পাতায় রোদ করছে ঝিলিমিলি। আমি একটা বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরালাম। পুরো সপ্তাহের খাটুনির অবসাদে শরীরটা বুঝি অবসন্ন হয়ে উঠলো এই নির্জনে। আমি আকাশমুখো হয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। এভাবে শোয়ায় একটা অন্যরকম অনুভূতি চলে আসে। যৌবনকালে খেলার মাঠে, বাড়ীর ছাদে – চাঁদনী রাতে কিংবা ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে কখনো দল বেঁধে, কখনো বা একলা কতো শুয়েছি। শুয়ে শুয়ে তারা দেখেছি, চাঁদের মিহিন আলোর বন্যা দেখেছি। কখনো দুঃখের জলে ভেসেছি, কখনো সুখের উচ্ছ্বাসে গেয়ে উঠেছি। আজ সে সব শুধু সময়ের ধুসরতায় আবৃত স্মৃতি। এখন আমি সেই সময় থেকে বয়েসের পাল্কী চড়ে অনেক দূর চলে এসেছি। ফেলে এসেছি উদ্দাম সময়ের সেই অনাবিল আনন্দময় পরিবেশ, বন্ধু বান্ধব। এখন আমি কয়েক হাজার মাইল দূরে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন বলয়ে, ভিন্ন জীবনে নিজেকে ধরে রেখেছি। বদলে গেছে সবকিছু, জীবনের প্রেক্ষাপট। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, বদলায়নি শুধু আমার ভেতর সদাজাগ্রত আরেক আমি। আমার সাবলীলতাকে অনুক্ষণ সতেজ রাখে আমার অন্তর্গত সেই আমি। সে সারাক্ষণ কথা বলে আমার সাথে, আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ফেলে আসা সময়ের বাঁকে বাঁকে। আমার স্পর্শ পাওয়া সবকিছুকে সে মেলে মেলে ধরে, পুনঃপরিচয় করিয়ে দেয়। এক কথায় আমাকে জাগিয়ে রাখে। আত্মমগ্ন করে। আমাকে যেনো ফিরিয়ে দেয় আমার কাছে। অন্তরতম সুহৃদ যদি কেউ থেকে থাকে, সে হচ্ছে আমার ভেতরের এই আমি।
এই এখন যেমন সে আমার মুখোমুখী হলো। খোলা নীল আকাশের নীচে তন্ময় হয়ে থাকা আমাকে নাড়া দিলো সে।
: কি, এখানে কি করছো ?
: এ্যাই -একটু নিরিবিলিতে নিজেকে নিয়ে ভাবছি -।
: আমি সেটা বলছি না -।
: কি বলছো ?
: বলছি, এখানে- মানে এদেশে কি করছো ?
: সবাই যা করে – কাজ করছি, সংসার সামলাচ্ছি, ছেলে মেয়েদের টেক কেয়ার করছি, এই আর কি !
: সে তো দেশে থাকলেই করতে পারতে –
: কি আর পেরেছি ? ঠিক মতো কাজই জোটেনি। অর্থকষ্ট কখনো আমার পিছু ছাড়া হয়নি। তাছাড়া সামাজিকতায় এমন জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে, ছেলে মেয়েদের দিকে তাকাবার সময়ও হতো না।
: এখন কি অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে গেছো ?
: সম্পূর্ণ না পেলেও আগের মতো খরচ না করতে পারার কষ্টটুকু তো নেই।
: এটুকু প্রাপ্তিতেই তাহলে তুমি সšত্তষ্ট হয়ে গেছো ?
: কি আর করি ? জীবন যখন যেমন, তেমন -।
: অর্থাৎ তুমি সেই চিরায়ত বৃত্তের মধ্যেই আটকে গেলে । কি হলো তোমার বৃত্ত ভাঙার স্বপ্নের , স্রোতের বিপরীতে ঝড় তোলার ?
: কি আর করতে পারি বলো ? সংসারের দায় দায়িত্ব মানুষের সামর্থ্যকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। বৃহত্তর কিছু করার আগে ক্ষুদ্রতর পরিবারটাকে সামলানো আমার প্রধান দায়িত্ব। আমারো বা কতটুকু আর সামর্থ্য আছে ? পৈত্রিকসূত্রে কিছু না পেলে নিজে অর্জন করে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই সময় পার হয়ে যায়।
: বুঝেছি। তুমি এখন আত্মরক্ষার্থে সাফাই গেয়ে যাচ্ছো। ভালো, বেশ ভালো। স্বাধীনচেতা থেকে তুমি পরাধীন চেতনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছো। তুমি যে হেরে গেছো তা কি তুমি বুঝতে পারছো ?
: না, আমি হারিনি। শুধু যুদ্ধের রূপ বদলে গেছে।
: এ যুদ্ধ শুধু একার জন্যে, যা সকল গড়পরতা মানুষই করে থাকে। এতে কোন মহিমা নেই। আছে আত্মকেন্দ্রিকতা। তুমি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছো। আর এই আত্মকেন্দ্রিকতা তোমার সকল সৃষ্টিশীলতাকে হত্যা করেছে। তুমি বাতিল হয়ে গেছো। বলতে পারো তুমি এখন মৃত।
: না, আমি মৃত নই, আমি বাতিল হয়ে যাই নি।

আমি কি চিৎকার করে উঠেছি ? তা না হলে আমার কাঁধ ধরে এই লোকটা কেন ঝাঁকি দিয়ে বলছে, হেই আফসার, আর ইউ ওকে ? আর লোকটা আমার নামই বা জানলো কি করে ? আমি আলুথালু চোখে তাকালাম লোকটা দিকে।
কি হয়েছে ?
তুমি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলে, লোকটা বললো, আমি যাচ্ছিলাম কাছ দিয়ে, দেখি তুমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছো। ইজ এনিথিং রং ?
কি হয়েছে জানি না। আবছা মনে পড়ছে আমি বুঝি ভেতরের আমার সাথে কথোপকথন করছিলাম। গভীর আত্মমগ্ন হয়ে, পারিপার্শ্বিকতা ভুলে। হয়তো নিজের অজান্তে কথা বলে কিংবা চিৎকার করে উঠেছি। কিšত্তু লোকটা কে ? এদেশে খুন হতে দেখলেও কেউ এগিয়ে আসে না বরং পুলিশে কল করে দেয়। পরিচিত না হলে কেউ কাউকে স্পর্শ করার প্রশ্নই আসে না। তাহলে লোকটা আমার পরিচিত কেউ ? তীক্ষè চোখে তাকালাম তার দিকে। নন্দনকান্ত এক যুবক। ঈষৎ লম্বাটে মুখে সুন্দর ফ্রেঞ্চ কাট। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাসিমুখে।
আরে এ যে পিটার ! গ্রীকদেবতার দেশের দেবদূত। এই পার্কেই তার ছেলে জসূয়া আর সাইমনের সাথে দেখা হয়েছিলো কিছুদিন আগে। আমার ছেলে আদিব আর আবির অতি অল্পক্ষণে ওদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলো, যেমন আমি আর পিটার। এরপরেও বিভিন্ন সুপারমার্কেট আর কনভিনিয়েন্স স্টোরে ওর সাথে বার কয়েক দেখা হয়েছিলো। আমরা দেখা হলেই জাগতিক অনেক বিষয়েই আলোচনা করে ফেলি অল্পসময়ে। আর আমি কি না তাকে চিনতে পারছি না। মনে মনে লজ্জা পেলাম।
সরি পিটার, আমি দুঃখিত গলায় বললাম, আমি বোধহয় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম।
দ্যাটস্ ওকে, আমার হাতে চাপ দিলো সে, তবে মনে হচ্ছে তুমি খুব স্ট্রেসড, এ্যানি ট্রাবল ?
না, আমার গলায় দ্বিধা, তেমন কিছু না পিটার, তবে অনেকদিন হয়ে গেলো এদেশে, এখনো সুবিধে করে উঠতে পারছি না। এসব ভাবছিলাম আর কি !
ভেবে কোন লাভ নেই, পিটার মার্লবরো বের করে আমাকে একটা এগিয়ে দিলো, আমার বাবাও অপরচুনিটির দেশ ভেবে এদেশে এসেছিলো, এখন রিটায়ারমেন্টের বয়স পেরিয়ে গেছে কিন্তু কাজ বন্ধ করতে পারছে না। প্রথম জেনারেশনকে বলি না দিলে পরবর্তী জেনারেশন হারিয়ে যায় এদেশে। তোমাকেও তাই করতে হবে।
সে তো জানি, আমি অনুচ্চকন্ঠে বললাম।
শোন , সিগারেটে একটা কষে টান দেয় পিটার, আজকের দিনটায় বেঁচে থাকাটাই জীবন। এরিকা চলে যাবার পর আমার জীবনটা মরে গিয়েছিলো। সারাক্ষণ ভাবতাম আমি বুঝি শেষ হয়ে গেছি। সে যেমন আরেক ঘাটে নাও ভিড়িয়েছে, আমিও তাই। এভাবেই বেঁচে উঠেছি। তুমি ফেলে আসা জীবন নিয়ে হা পিত্যেস করছো। এখনকার জীবনটাকে উপভোগ করো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
তোমাকে আগেই বলেছি, আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম, আমি বর্তমানটাকে খুবই উপভোগ করি। এত খুবই সাধারণ ব্যাপার, সবাই তা করে। কিন্তু কথা হলো, এই গতানুগতিক গড্ডালিকার বাইরে দুনিয়া কাঁপানো কিছু একটা করাই ছিলো আমার স্বপ্ন। আর তা হয়ে উঠছে না কিংবা হবার কোন সম্ভাবনা দেখছি না বলেই স্ট্রেসড বলতে পারো।
তুমি খুব শক্ত কথা বলেছো আফসার, পিটার উঠে দাঁড়ায়, জসূয়াদের দেখতে পাচ্ছি না, আমি এখন আসি। এ ব্যাপারে তোমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে রইলো। তবে তুমি একটু রেস্ট নিলে ভালো লাগবে। এখন আসি।
একপ্রকার ছুটে ছেলেদের খোঁজে চলে গেলো পিটার। ভাবলাম ওদের জীবনবোধ আমাদের থেকে কতো ভিন্ন। বয়ফ্রেন্ড- গার্লফ্রেন্ড হিসেবে দীর্ঘদিন একসাথে বসবাস করে, আবার বনিবনা না হলে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আবার কখনো সন্তান নেয়, বিয়েও করে। কিন্তু বনিবনা না হলে সহজেই আলাদা হয়ে যায়। আজকের বেঁচে থাকাটাই ওদের নগদ পাওয়া, কালকের জন্যে হা পিত্যেস করে না। আর হৃদয়ের বাঁধন ? আমার কাছে মনে হয়, আমাদের চেয়ে হাজার গুণ ঠুনকো। আমাদের এক পুরুষ কিংবা এক নারীতে সারাজীবন অতিবাহিত করার কথা শুনে অনেককে অবাক হতে দেখেছি। আবার প্রশংসাও করে। এদেশেও অনেক দম্পতি আছে যারা সারাজীবন একসাথে কাটায়। তবে সংখ্যায় অতি অল্প। এই পিটার যে এরিকা অন্ত প্রাণ ছিলো, এরিকার ঘরে যার দু’টি ফুটফুটে ছেলে আছে, তাকে কতো সহজে ভুলে গিয়ে নতুন সাগরে পাল তুলেছে। উদ্দাম হয়ে উঠেছে। তবে ছেলেদের জন্যে তার রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। ছেলে দু’টো একেবারে বাবা বলতে পাগল।
পিটারের ছুটে যাওয়া দেখে আমারও ছেলেদের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো বিশাখার ফর্দ অনুযায়ী দোকানে অর্ডার দিয়ে এসেছি। এক ঘন্টার মধ্যে যাবার কথা। এখন অলরেডি এক ঘন্টা হতে চললো। ওদিকে রান্নার আয়োজনের অপেক্ষায় বিশাখা পথ চেয়ে আছে। সপ্তাহান্তেই আমাদের সংসারের যাবতীয় কাজ – লন্ড্রী থেকে সওদাপাতি – সব করে নিতে হয়। তাই সপ্তাহের সাতদিনই কাটাতে হয় ব্যস্ততার মধ্যে। আর আমাদের দু’জনেরও যা-ও কথাবার্তা হয় তা সপ্তাহান্তেই। সত্যি এদেশে আসার পর থেকে পুরো জীবনের গতিধারাই বদলে গেছে। আমরাও ক্রমশঃ হয়ে উঠছি যান্ত্রিক। এখানকার সিস্টেমে পড়লে সবাইকে তা-ই হতে হবে। কোন উপায় নেই। ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে, এই জীবনটাই কি চেয়েছি আমি ?
ভাবতে ভাবতে উঠে গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম। এ সময় এক চিলতে মেঘ এসে সূর্যকে আড়াল করে দাঁড়ালো।

=======================