পিপুফিশু || আলী সিদ্দিকী
কিস্তি- ১৪
বৈপরিত্য শত্রুতার সিদ্ধতা নয়
কমিউনিটির ভেতর ব্যাপারটা ছড়াতে সময় লাগলো না। ছোট্ট কমিউনিটিতে যে ঘটনাই ঘটুক না কেন তা পলকে সবার জানাজানি হয়ে যায়। আবিরকে মারার কারনে মুকুলের এরেস্ট হবার ঘটনাটিও বেশ চাউর হয়ে গেলো। আমি বেশ ক্ষুব্ধ হলেও জানাশোনাদের কাউকে ব্যাপারটা বলিনি। আসলে সবাই এতো ব্যস্ত থাকে যে অনেকের সাথে মাস ছয়মাসেও একবার দেখা মেলে না। আর দেখা হলেই যে কাউকে নিজের পারিবারিক কোন কিছু জানাতে হবে এমন কোন কথা নেই। তাছাড়া আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা আমার স্বভাবে নেই। তবে অনেকের হাবভাবে মনে হলো, পুলিশ কল করার বিষয়টিকে কমিউনিটির লোকজন স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। দোকানপাটে লক্ষ্য করেছি, পরিচিতদের কেউ কেউ আমাকে যেন একটু এড়িয়ে চলছে। তাতেও কিছু যায় আসে না। এদেশে কেউ কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে না। আমিও কিছু না বোঝার ভান করে চলতে লাগলাম।
আপনার কি হয়েছে আফসার ভাই ? দোকানে ঢুকতেই কবির ভাই আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
আমার কি হয়েছে মানে ? আমি অবাক হয়ে ভাবলাম। আমার চেহারায় কি এমন কোন ভাব ফুটে উঠেছে যে, দেখে মনে হয় আমার কিছু একটা হয়েছে ? জানি না। দোকানে তেমন লোকজন নেই এখন। আমি তাকালাম কবির ভাইয়ের দিকে।
কেন বলছেন একথা কবির ভাই ? আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম।
না শুনলাম আপনার ছেলেকে কে যেন মেরেছে, তিনি রেজিস্টারে কাজ করতে করতে বললেন, আপনি নাকি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন।
ঠিকই শুনেছেন, আমি একটু উষ্মামাখা গলায় বললাম, একটা ছোট্ট বাচ্চাকে পঁচিশ ত্রিশ বছরের মানুষ অমানুষের মত মারবে, তাতো মেনে নেয়া যায় না।
তাতো নয়, তিনি সায় দিলেন। কিন্তু কমিউনিটির লোকজন আপনার সমালোচনা করছে।
কেন ? বিষয়টা যে আমার কানে আসেনি তা নয়। তবু না বোঝার ভান করলাম, আমি কি অন্যায় কিছু করেছি ?
অন্যায় নয়, তিনি বোঝানোর ভঙ্গীতে বললেন, অই ছেলের তো কাগজপত্র নেই, এখন হয়তো ডিপোর্ট হয়ে যাবে। ওর একটা বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো, এজন্যে অনেকে ব্যাপারটা ভালো হয়নি বলছে আর কি !
তাই বলেন ! আমি হেসে উঠলাম, ব্যাপারটা ওরই মাথা রাখা উচিত ছিলো। আমার ছেলেকে মেরেছে, আমি আমার কর্তব্য করেছি।
আমি হলেও তা করতাম, কবির ভাই রাগতঃ গলায় বললেন, দুনিয়ার মানুষের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা কি জানেন ?
কি ?
মানুষ কমনসেন্স ইউজ করে না।
সেটা ইউনিভার্সেল ট্রুথ কবির ভাই।
এ সময় জামিল ভাই ঢুকলেন দোকানে। উনি একজন সক্রিয় সমাজকর্মী বলে সবাই জানে। তাছাড়া এখানকার মসজিদকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে তিনি খুবই সোচ্চার। মসজিদকে মুষ্টিমেয় কিছুলোক তাদের ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে, কমিউনিটির চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠা মসজিদকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা না করে স্বেচ্ছাচারীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, মসজিদকে উগ্র মৌলবাদীদের আস্তানা বানানো হচ্ছে প্রভৃতি কথাগুলো একমাত্র উনার মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে প্রথমে। সেজন্যে বাঙালী কমিউনিটিতে জামিল ভাইয়ের একটা আলাদা পরিচিতি আছে। মসজিদগোষ্ঠী অবশ্য উনাকে সহ্যই করতে পারে না।
কি খবর কবির ভাই ? জামিল ভাই সরাসরি ক্যাশের পাশে চলে গেলেন, পান আছে নাকি ?
আছে, কবির ভাই ফ্রি পান খাওয়ান সবাইকে, হাত বাড়িয়ে পান এগিয়ে দিলেন, আপনার একটা খবর শুনলাম, সত্যি নাকি ভাই ?
হ্যাঁ, পান বানাতে বানাতে বললেন জামিল ভাই, মসজিদ কমিটির লোকেরা আটজনের সাথে আমার নাম জড়িয়ে এফবিআইয়ের কাছে রিপোর্ট করেছে যে, আমরা নাকি মৌলবাদী তৎপরতা চালাচ্ছি।
বলেন কি ? আমি অবাক হলাম শুনে, এটা খুবই খারাপ হয়েছে।
এসব ওরা চিন্তা করে না আফসার সাহেব, জামিল ভাই আমার দিকে তাকালেন, ওরা শুধু ভাবে নিজেদের স্বার্থের কথা।
তাই বলে এ দুঃসময়ে এমন কাজ করা কি ঠিক হয়েছে ? আমি ক্ষুন্ন হলাম, শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশকে ডিবি কোটা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে, বাংলাদেশকে আর শুল্কমুক্ত কোটায় পোষাক রপ্তানীর সুযোগ দেয়া হবে না।
তা ঠিকই শুনেছেন, মুখে পান পুরে জামিল ভাই একটু সময় নিলেন, তাছাড়া দেখছেন না, শুধু নামের কারনে এখন আমরা কাজ পেতে মহাসমস্যা হয়ে যাচ্ছে। দেখুন না, সামনের সময় আরো কত কঠিন হয়।
সত্যি কথাটি বলেছেন জামিল ভাই, কবির ভাই হাতের কাজ গুছিয়ে টেবিলে কনুইয়ের ভর দিলেন, গত কয়েক মাসে অনেক বাঙালী লে অফ হয়ে গেছে। এমনিতে অড জব করতো, এখন তাও পাচ্ছে না।
ধর্ম কি শেষমেষ আমাদের জন্যে কাল হয়ে যাবে ? আমি জানতে চাইলাম।
ধর্মের তো দোষ নেই, জামিল ভাই গলায় যেন বিষ মেশালেন, দোষ ধর্ম ব্যবসায়ীদের। ওরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করতে গিয়ে সবাইকে ঠেলে দিচ্ছে বিপদের মুখে।
সে তো ঠিকই, আমি বললাম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ভেতর লুকিয়ে থাকা উগ্রতার উপকরন ওদের এমন আত্মঘাতী হবার পথ করে দিচ্ছে।
এটা কেন বলছেন আফসার সাহেব ? জামিল ভাই ক্ষুন্ন হলেন যেন।
আমি কি ভুল বললাম ? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে নিজেই জবাব দিলাম, দেখুন না ইসলামের ইতিহাস। আমাদের ধর্মের যাত্রাটাই ছিলো যুদ্ধোম্মদনায় ভরা। যুদ্ধ ছাড়া কি ইসলাম বিকশিত হয়েছে ? ইসলামের ইতিহাস হলো অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে যুদ্ধের ইতিহাস। আর এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের মূল ভিত্তি ছিলো, ইসলামই শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্বে অহমিকার কারনে ইসলামে পরধর্ম সহিষ্ণুতা দেখা যায় না।
আপনি ধর্মবিরোধী কথা বলছেন, জামিল ভাই এবার রাগ গোপন করতে পারলেন না।
না আমি ধর্মবিরোধী কিছু বলছি না, আমি যুক্তি দেবার চেষ্টা করলাম, যা বলছি তা ঐতিহাসিক সত্য। ইসলামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় আপনি এর সত্যতা খুঁজে পাবেন।
আপনি ইসলামবিরোধীদের লেখা ইতিহাস পড়ে তা জেনেছেন, তিনি এবার উগ্রমূর্তি ধারণ করলেন, সবাই যে আপনার সম্পর্কে বলে এখন দেখছি তা মিথ্যা নয়।
সবাই কি বলে আমার সম্পর্কে ? আমার কন্ঠে বিদ্রুপ ফুটে উঠলো বুঝতে পারি, এখানকার ক’জনের সাথে আমি মিশি বা এসব নিয়ে কথা বলি বলে আপনার ধারণা জামিল ভাই ?
যা হোক না কেন, তিনি সোজা জবাব দিলেন না, আপনার এসব ধারণা ঠিক নয়।
ও, তাই বলুন, আমি হাসলাম, আমরা প্রত্যেকে যা জানি তা-ই একমাত্র সঠিক বলে জানি। আর এটাই আমাদের সীমাবদ্ধতা।
আমি গেলাম কবির ভাই, জামিল ভাই আমার দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলেন।
শুনুন জামিল ভাই, আমি পেছন থেকে বললাম, যত যাই উদার বলে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন না কেন, আখেরে আমাদের সবার ভেতরে ধর্ম নিয়ে এক ধরণের উগ্রতা আছে। সত্যকে, সময়কে, পরিবর্তনকে মেনে না নেবার উগ্রতা।
এটাই আমাদের গর্ব আফসার সাহেব, ঘাড় ঘুরিয়ে হাসেন তিনি।
তাহলে ভন্ডামী না করলেই হয়, তীব্র শ্লেষ মাখা গলায় বললাম আমি।
জামিল ভাই থমকে দাঁড়াতে গিয়ে কি মনে করে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
কবির ভাই হা করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি সওদাগুলো গুছিয়ে নিয়ে তার দিকে তাকালাম।
কি হলো কবির ভাই ?
আপনাকে দেখছি-।
সে আর নতুন কি !
জামিল সাহেবকে যে একেবারে নাকাল করে ছাড়লেন-।
আমি কি ভুল কিছু বলেছি ?
ভুল নয়, ভুল নয়রে ভাই- কবির ভাই একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পেছনের দরোজার দিকে টেনে নিয়ে এলেন, সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন, আপনার সাহসের প্রশংসা করতে হয় ভাই।
প্রশংসিত হবার মত কিছুই আমি করিনি কবির ভাই, আমি বিনীতভাবে বললাম, শুধু ভ্রান্ত ধারণাতে আঘাত করেছি।
আমিও ভাই একসময় রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে মঞ্চ কাঁপিয়েছি, ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে ছিলাম সদা সোচ্চার, কবির ভাইয়ের চোখ জোড়া নস্টালজিক হয়ে উঠলো, তিনি যেন ফেলে আসা দিনগুলোকে খুঁজে পেতে চাইছেন বলিরেখায় হারিয়ে যাওয়া আজকের সময়ে, কিন্তু আপনার মতো করে কখনো বলতে পারি নি। এজন্যে আপনার কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে। যদিও জানি আপনার এসব কথার মূল্য কেউ দেবে না। নিজেকেও পারবেন না আত্মপ্রকাশ করতে। যেমন পারেন নি তারিক আলী। তার কথা মতো আপনারা হলেন এ সমাজের চলমান মৃত মানুষ।
তা ঠিক বলেছেন কবির ভাই, আমি সায় দিলাম, ধর্মান্ধতা পুরো মানবজাতিকে কূপমন্ডুক বানিয়ে রেখেছে। আর এটাই হলো এ পৃথিবীর দুর্ভাগ্য।
চরম সত্য কথাটিই বললেন, দোকানে কাস্টমার ঢুকতেই সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ভেতরে পা বাড়ালেন কবির ভাই, আরেকদিন কথা হবে আফসার ভাই।
আচ্ছা আসি।
আমি পেছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
এসময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। দৌড়ে গাড়ীর দরোজা খুলতে না খুলতেই একপ্রকার ভিজে গেলাম। তখুনি ঝপাৎ করে দেশের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো দুর্দান্ত বৃষ্টি মাথায় সামরিক শাসনবিরোধী মিছিলের কথা, মনে পড়ে গেলো ঘরের চাল ফুটো হয়ে নেমে আসা বৃষ্টির সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত মায়ের গজ গজ করে জিনিসপত্র সামলানোর কথা, মনে পড়ে গেলো একানব্বুইয়ের ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড চট্টগ্রামের উপকূলাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বৃষ্টি মাথায় রিলিফ বিতরন করতে গিয়ে বিয়ের আংটিটা হারানোর কথা, মনে পড়ে গেলো বৃষ্টির দাপটের মতো অপ্রতিরোধ্য জামাতী হায়েনার সাথে এলাকায় সংঘর্ষের কথা।
গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ভাবতে লাগলাম, আসলে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধর্মপ্রবণতা একটা জঘন্য মনোবিকারের জন্ম দিয়েছে। দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসায় কচি কচি শিশুদের যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা তাদের সারাজীবনের আলোর পথকেই শুধু আড়াল করবে না, তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও একই গহবরে টেনে নিয়ে যাবে। এমনিতেই যুগ যুগান্তর ধরে সমাজের ব্যাপক জনগোষ্ঠী অশিক্ষা, কুশিক্ষায় পশ্চাদপদ চিন্তা চেতনা নিয়ে বেঁচে আছে। আর সেই মনমানসিকতায় বেড়ে ওঠা সন্তানেরাই তো এদেশে প্রবাসী হয়েছে। সুতরাং এদের সেসব বদ্ধমূল কূপমুন্ডকতা তো এই আধুনিক দেশে এসেও বদলাবে না। কারন এদেশে জীবন যাপন করলেও তারা তো থেকে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। নিজস্ব কমিউনিটি ছাড়া তো তারা মূলধারায় মেশে না।
ছেলে মেয়েগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে ইদানিং আমি আর বিশাখা আশঙ্কিত হয়ে উঠেছি। ওরা যতো বড়ো হচ্ছে ততোই যেন আমাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বেড়ে যাচ্ছে। বাঙালী কমিউনিটিতে মিশতে গেলে যেমন ধর্মীয় চুৎমার্গের হাতে পড়ার ভয়, তেমনি আমেরিকান সমাজের মূলধারায় মিশতে গেলে শেকড়হারা হবার ভয়। এই দুই ধরনের আশঙ্কা থেকে মুক্তির জন্যে একটি স্বতন্ত্র উদার ও আধুনিক চিন্তাচেতনা সম্পন্ন বাঙালী কমিউনিটি ছিলো মূল ভরসা। কিন্তু ক্ষুদ্র এই শহরে সেটি মেলা ভার। বড়ো শহরে গিয়ে পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে পারাটাই হলো কঠিন সমস্যা। কি যে করবো ভেবে কূল পাচ্ছি না।
এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নর্থ ওয়েলস্ রোড়ের ট্ট্যাফিকে আটকা পড়লাম। অনেকদিন ধরে বিশাখা একটা রাইস কুকারের জন্যে বলছে। কিন্তু আমেরিকান স্টোরগুলোতে যা পাওয়া যায় তা সাইজে অনেক ছোট। এখানে এ্যাসি প্লাজা নামে নতুন একটা কোরিয়ান স্টোর হয়েছে, ওরা এশিয়ানদের প্রয়োজনানুযায়ী অনেক জিনিসপত্র রাখে। শুনেছি ওদের কাছে বড়ো রাইস কুকার পাওয়া যায়। সেজন্যেই এদিকে আসা। কিন্তু দেখো ট্ট্যাফিকের কান্ড। আমার সামনে বিশ পঁচিশটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির সাথে সাথে আশপাশ হয়ে উঠেছে ধোঁয়াশা। আমি সিডিতে অনুপ ঘোষালের গজল লাগিয়ে দিলাম। একটু বুঝি তন্ময়তা এলো অনুভূতিতে।
এ সময় প্রচন্ড এক ধাক্কায় আমার গাড়ীটা হুমড়ি খেয়ে পড়লো সামনের গাড়ীটার ওপর। মাথা সজোরে ঠক্কর খেলো জানালার সাথে, দু’হাতে ধাক্কা সামলাতে গিয়ে কড়াৎ করে উঠলো ডানহাতের কব্জি । ঘাড়টা যেন অসাড় হয়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বিহব্বল হয়ে পড়লাম। মাথাটা ঝন ঝন করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, দেখছি ধোঁয়াশা, ঝাপসা। কারা যেন বলছে, আর ইউ ওকে ? আর ইউ ওকে ?
কারা যেন আমাকে টেনে বের করলো গাড়ী থেকে। আমার পা দু’টো মাটির স্পর্শে যেন কেঁপে উঠলো। দেখলাম সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ী রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। এক অফিসার আমার বাহু ধরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, আর ইউ অল রাইট মিস্টার ?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ইউর কার কমপ্লিটলি ড্যামেজড-।
মাথা কাত করে গাড়ীর দিকে তাকিয়ে বুকটা চ্যাৎ করে উঠলো। সামনে পেছনে পুরো দুমড়ে মুচড়ে গেছে আমার শখের গাড়ীটা।
ক্যান ইউ ওয়াক ? অফিসার আবার জানতে চাইলো।
আমি বুঝি মাথা নেড়ে না বললাম।
অমনি দেখি এ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির।
লোকজন এসে আমাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো। চিৎ হয়ে শুয়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাচ্ছি। কালো মেঘের চাদর বুঝি আমার চেতনাকে ঢেকে দিচ্ছে। এ সময় কার যেন গলা শুনলাম, ইটস মাই ফল্ট অফিসার, মাই ফল্ট।
লোকটার দিকে আলতো করে তাকালাম। মধ্যবয়েসী শেতাঙ্গ ভদ্রলোক অপরাধীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অমনি মনে পড়ে গেলো, আমার দেশে হলে কখনো কেউ দোষ স্বীকার করতো না। পালিয়ে যেতো। এদের সততার প্রশংসা না করে পারা যায় না।
অফিসার সিটিশান লিখে আমাকে এক কপি দিলেন।
এ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা আমাকে তাড়াতাড়ি গাড়ীতে তুলে সাইরেন বাজিয়ে হসপিটালে নিয়ে এলো। এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর আমাকে চেকআপ করতে লাগলো এক তরুণ। সে আমার প্রেসার চেক করলো, স্টেথিস্কোপ দিয়ে বুকে পিটে চেক করলো। হাতের পালস্ দেখলো, আবার কানের মধ্যে কি একটা দিয়ে টেম্পারেচার দেখলো। সাথে সাথে প্রশ্ন করতে লাগলো হাজার রকম।
তোমার ফ্যামিলি আছে ? ছেলে মেয়ে ?
সায় দেয়ার সাথে সাথে ভড়কে গেলাম। বাচ্চারা সব স্কুলে, বিশাখা কাজে। বাচ্চাদের পিক আপ করে আমারই নিয়ে আসার কথা। এখন বিশাখাকে খবর দিতে হবে, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা এক্সিডেন্টের কথা শুনলে আতঙ্কগ্রস্থ হবে, কিন্তু ওদের না জানিয়েও উপায় নেই। তেমন ঘনিষ্টজনও নেই যে, খবর দিলে ছুটে আসবে। আমি জানি বিশাখা শোনার সাথে সাথে দিশেহারা হয়ে যাবে। নিজে ড্রাইভিং পারে না বলে আরেকজনের সাথে রাইডে সে কাজে যায়, এখন কাজ থেকে কিভাবে আসবে ? অবশ্য ওকে একটা টেলিফোন ইনডেক্স দিয়েছি, ওতে ট্যাক্সি ক্যাব কোম্পানীর ফোন নাম্বার আছে, বুদ্ধি করে ক্যাব নিয়ে আসলেই হয়। বাচ্চাগুলো আমাকে হসপিটালে দেখলে ভড়কে যাবে ভেবে চিন্তিত হলাম।
ইমার্জেন্সীতে ঢোকার পরে প্রথমেই নার্সকে ডাকলাম। তাকে বললাম, আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করতে চাই।
তুমি কি হেঁটে ফোনের কাছে যেতে পারবে ? সুদর্শনা নার্স মধুমাখা কন্ঠে বললো ( আচ্ছা নার্সগুলো এতো সুন্দর হয় কেন ? মনে পড়লো কবিবন্ধু শাহিদ আনোয়ার হাসপাতালের শুভ্র নার্সকে নিয়ে একটা চমৎকার কবিতা লিখেছিলো, অবশ্য পুরো কবিতাটা এখন মনে পড়ছে না)।
তা পারবো।
তাহলে আমাকে ধরে চলো- বলে সে হাত বাড়িয়ে দিলো।
আমি সঙ্কুচিত হাত বাড়িয়ে তার কোমল হাত ধরে করিডোরে এগিয়ে গেলাম। ফোনের কাছে এসে সে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো।
তুমি কথা বলে নাও, আমি এক্ষুনি আসছি।
আমি বিশাখার অফিসে ফোন করলাম। রিশেপসনিস্ট একটু সময় নিয়ে লাইন দিলো। মনে হলো বিশাখা অবাক হয়েছে। সচরাচর অফিসে আমরা ফোন করি না। তেমন অবশ্য প্রয়োজনও পড়ে না।
কি ব্যাপার, ফোন করেছো যে ?
বউয়ের গলা শুনতে ইচ্ছে হলো- আমি সহজ ভঙ্গি করলাম।
তুমি মিথ্যা বলছো ? অবিশ্বাস বিশাখার গলায়।
তা ঠিক, ওকে উৎকন্ঠিত করতে চাইলাম না, তুমি কি চলে আসতে পারবে ?
কেন ? সত্যিই সে উৎকন্ঠিত হলো।
তেমন কিছু না, স্বাভাবিক গলায় বললাম, পেছন থেকে গাড়ীতে একজনে ধাক্কা দিয়েছে, আর পুলিশ আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে হাসপাতালে-।
বলো কি ? ওর কথা আটকে গেলো।
আরে আমার কিছু হয় নি পাগল, অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম, বাচ্চাগুলোকে স্কুল থেকে আনতে হবে। শোন তুমি ট্যাক্সি কল করে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসো।
আমি আসছি। ত্রস্তকন্ঠে বললো সে।
শোন বিশু, আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, অস্থির হয়ো না বাচ্চারা ভড়কে যাবে। পারলে আতিককে একটা কল কোরো।
আচ্ছা রাখি।
বিশাখা ফোন রেখে দিলো।
আমি বেডে ফিরে এলাম।
ডাক্তার এলো হাসিমুখে। আমাকে পরীক্ষা করে সে জানালো, হাতের রিস্টের এক্সরে করতে হবে, মাথার সিটিস্ক্যান করতে হবে, প্রয়োজনে এমআরআইও করতে হতে পারে।
এক্সরে’র ব্যাপারে আপত্তি নেই, কিন্তু কখনো সিটিস্ক্যান কিংবা এমআরআইয়ের মুখোমুখি হইনি। না জানি তা কেমন। ভেবে একটু চিন্তিত হলাম। গুরুতর কিছু না হলে এসবের প্রয়োজন কেন হবে ? কিন্তু আমি তেমন কিছু অনুভব করছি না। সেটা বলতেই মধ্যবয়েসী ডাক্তার হেসে ফেললেন।
আমি বলছি না যে, সিরিয়াস ইনজুরি আছে। কিন্তু যেহেতু অটো এক্সিডেন্ট সেহেতু হানড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম হওয়াই আমার প্রথম কাজ। ডোন্ট ওরি এবাউট ইট। ইউ উইল বি অলরাইট।
ডাক্তার চলে গেলে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। এই এক্সিডেন্ট আমার অনেক ক্ষতি করে দিলো। গাড়ী অইলোকের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী ঠিক করে দেবে ঠিকই, মাঝখানে কাজের ক্ষতি হয়ে গেলো। অবশ্য চেষ্টা করলে লস্ট ইনকামের ক্ষতিপূরণও আদায় করা যাবে। এদেশের আইনগুলো জীবনকে খুবই গভীরভাবে স্পর্শ করে যায়। আমার দেশটাও যদি এমন আইনের মাধ্যমে চলতো তাহলে মানুষের ভোগান্তি অনেক কমে যেতো।
ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
=========================