পিপুফিশু
আলী সিদ্দিকী
কিস্তি–৬
টক ঝাল তেতোয় বিশাখা
কলিংবেলটা চিৎকার করছে তারস্বরে। ঘুম জড়ানো চোখ দু’টো লেগে আছে আটার মতো। বহুকষ্টে চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা সাড়ে দশটা। শনিবারের সকালটা সবসময় একটু আয়েসে কাটাতে আমি অভ্যস্ত। শুক্রবারে দীর্ঘরাত জেগে থাকার খেসারত দেই শনিবারে। কাল রাতেও আড্ডা দিয়ে শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। এখন এই সকাল বেলা কে এলো ? আমি গলা উচিঁয়ে বিশাখাকে ডাক দিলাম, বিশু, এ্যাই বিশু ! দেখো না কে এলো ?
কোথায় কে এলো ? কিচেন থেকে ছুটে এলো বিশাখা, কোথায় কে এসেছে ?
কলিংবেল শুনতে পাচ্ছো না তুমি ? আমি কাত হয়ে শুলাম।
কলিংবেল ? হাসলো বিশাখা, আমি তো কিচেনে, বাচ্চারা টিভির সামনে। আমরা কেউ শুনলাম না আর তুমি কিনা ওপর থেকে শুনতে পেলে।
তাই নাকি ? অবাক হয়ে আমি উঠে বসলাম। আমি ভুল শুনেছি ?
হয়তো স্বপ্ন দেখছিলে, হাসে বিশাখা, তোমার তো এটা নতুন নয়। বিয়ের পর থেকে দেখছি, ঘুমের মধ্যে সারাক্ষণ যুদ্ধ করো। বলে চলে গেলো।
হুম ! আমি গুম মেরে গেলাম। হয়তো আশপাশের কোন এপার্টমেন্টে হবে, নয়তো আমার অবচেতন মনে কলিংবেল বেজে উঠেছে। এমনটা কেন যে হয় বুঝি না। ঘুমের মধ্যে যে বকাবকি করি এটা মা সবসময় বলতো। হাসতো, একটা পাগল ছেলে ! সব
যাহোক, এক্ষুণি আমার বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে আরেকটু গড়িয়ে নেই। কিন্তু পেটে খিদে অনুভব করছি। আবার বাচ্চারাও ক’দিন ধরে বায়না করছে থিয়েটারে সিনেমা দেখবে। জুরাসিক পার্ক চলছে থিয়েটার গুলোতে। দুপুরের ভেতর ওটা শেষ করতে পারলে একটু অবসর পাওয়া যেতো। দেখি।
হাত বাড়িয়ে টিভি অন করলাম। সিএনএন – এ দেখলাম একটা লাইভ কাভারেজ দেখাচ্ছে। সাদ্দাম বিরোধী ইরাকীদের একটি অংশ ওয়াশিংটন ডিসিতে সমাবেশের আয়োজন করেছে। টিভি ক্যামেরা যখন সমাবেশস্থল ঘুরিয়ে দেখালো তাতে দেখা গেলো অল্প ক’জন আরবীয় পোষাকধারী ব্যক্তি সভাস্থলে উপস্থিত আছে। বাকী ছড়ানো ছিটানো লোকগুলো সব এদেশীয়। এদেশে নির্বাসিত ইরাকীদের এক মোল্লা গোছের লোক মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, আমরা জুলুমবাজ সাদ্দামের উৎখাত চাই। আমেরিকান সরকারকে আমরা অনুরোধ করছি, তারা যেন এক্ষুণি ইরাক থেকে রক্তপিপাসু সাদ্দামশাহীকে উৎখাত করে। আমরা আমেরিকাকে সব ধরনের সহযোগিতা করবো।
বিশু, এ্যাই বিশু দেখে যাও- আমার ডাক শুনে আবার ছুটে এলো বিশাখা।
তোমার আজকে কি হয়েছে বলো তো ? হাঁপাতে হাঁপাতে বলে সে।
দেখো, হাত ধরে পাশে বসালাম তাকে।
রাজাকারের দল ! বেজন্মার দল ! একটু দেখেই রেগে গেল সে, আচ্ছা বলো তো, নিজের মাতৃভূমিকে ধ্বংস করার জন্যে একমাত্র হারামজাদা ছাড়া আর কেউ কি বিদেশী শক্তিকে ডেকে আনতে পারে ? দুনিয়াটা কি তাহলে নেমকহারাম আর নাফরমানে ভরে গেছে ? তুমি দেখো, এসব আমার সহ্য হয় না।
বিশাখা উঠে দাঁড়ালো।
তুমি কি বুঝতে পারছো না, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরোধী মনোভাবকে অসার প্রমাণ করতে মার্কিন প্রশাসন এই খেলাটা খেলছে ?
এটা তো আদিব আবিরও বোঝে, হাসে বিশাখা, আমাদের রাজাকারদের খেলাটাও কি বাঙালীরা বোঝেনি সেসময় ?
তুমি আমাদের ব্যাপারটার সাথে আজকের ঘটনাকে মেলাচ্ছো কি ভাবে ? আমি তাকাই ওর চোখের দিকে।
ও মা ! তুমি এটাও বোঝো না ? কপট অনুযোগ করে সে, আমাদের রাজাকার আলবদররা নিজের মাতৃভূমিকে পাকিস্তানের পরাধীন রাখতে চেয়েছে ধর্মের নামে আর ইরাকের রাজাকাররা পশ্চিমাদের আহবান করছে গণতন্ত্রের নামে, এখানে ফারাকটা কোথায় শুনি ?
বিশাখার বিচারবুদ্ধি দেখে অবাক হলাম। যদিও সে রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলো না কিন্তু তাদের রাজনৈতিক পরিবার তাকে যথেষ্ট সচেতন করে দিয়েছে। এটা তো সত্যি আমাদের দেশের কোলাবরেটরা কি নির্লজ্জভাবে পাকিস্তানীদের বাঙালী নিধনে সাহায্য করেছে, যা কোন প্রকৃত মানুষ করতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ আজ পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমা করতে পারেনি বরং ঘৃণার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে, তেমনি পশ্চিমাদের পরাক্রমের কাছে দুর্বল ইরাক হয়তো আজ পরাজিত হবে, ক্ষমতায় বসবে কারজাইয়ের মত পুতুল সরকার, যাদের ইরাকের মানুষ কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে না।
আব্বু, এই আব্বু তোমাকে মিসেস রুথ ডাকছে – লিভিং রুমের সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে অর্পিতা ডাক দিলো।
আমি বাথরুমে যাচ্ছি, ওকে বসতে দাও – আমি বাথরুমে এসে ঢুকলাম। মিসেস রুথ আমার সজ্জন প্রতিবেশী। মহিলা একটু ধর্মপ্রাণ। তবে হার্ট আছে বলতে হবে। এই কমপ্লেক্সে আসার পর থেকে মহিলা আমাকে বহুভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। উনি যে কোম্পানীতে কাজ করেন, সেখান থেকে আমার পুরো মাসের টিস্যু পেপারের যোগান দেন। তাছাড়া প্রথম যখন এ এলাকায় আসি, বাচ্চাদের ফ্রি হেলথ ইনাস্যুরেন্সের জন্য আমাকে নিয়ে কয়েক জায়গায় গেছেন। তারপর কোথায় কোথায় সস্তায় ভেজিটেবল পাওয়া যায় আমাকে তার হদিস দিয়েছেন। কোথায় কখন বাচ্চাদের কাপড় চোপড়, স্কুল সামগ্রী, এমন কি গৃহস্থালী জিনিসপত্র সস্তায় পাওয়া যায় তা আমি বা বিশাখাকে যথাসময়ে জানিয়ে যান। আবার বিভিন্ন কোম্পানীর সেল কূপনও অনেক সময় কষ্ট করে যোগাড় করে দেন। একটু কথা বেশী বলার কারনে অনেকে তাকে এড়িয়ে চলে, কিন্তু ভদ্রমহিলাকে আমার বেশ ভালোই লাগে। তার শুধু একটাই কষ্ট, দুই ছেলের কেউই ধারে কাছে থাকে না। তাদের দেখতে তার খুব ইচ্ছে করে, তেমনি নাতি নাতনীদেরও। কিন্তু কেউ তার এ কষ্টটুকু বোঝে না। আমার কাছে সে তার দুঃখের কথাগুলো বলে নিজেকে হালকা করতে চান।
বুঝলে আফসার, বেশী বুড়ো হবার আগেই মরে যাওয়া ভালো, কারো বোঝা হতে হয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ক’দিন আগে আমাকে বলছিলেন।
কিন্তু এদেশে তো বাবা মা কারো বোঝা হয় না, আমি বলি, তোমাদের সোস্যাল সিকিউরিটি আছে, পেনশন আছে, আছে এসিস্ট্যাট লিভিং সিস্টেম- ।
তাও এক ধরণের বোঝা, কর্মহীন জীবনের বোঝা-
কিন্তু রুথ, আমি বলি, যদি তুমি দেখতে সারাজীবন সংসারের জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করার পর আমাদের দেশের বয়স্করা কি নিদারুণ কষ্ট পেয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে তাহলে তুমি আর আফসোস করতে না।
তাই নাকি ?
শোনো, আমার বাবা ছিলো সরকারী চাকুরে। সারাজীবন সরকারী চাকুরী করে আমাদেরকে মানুষ করেছেন। রিটায়ার করার পরও বেকার থাকতে চান নি। কিছু না কিছু করে সংসারে সুখ আনতে চাইতেন। মা তো বাইরে চাকুরী করেন নি। সারাজীবন বাবার দেয়া টাকায় সংসার চালিয়ে গেছেন। কিন্তু যখন বাবা রিটায়ার করলো তখন তারা দু’জনেই অতিদ্রুত বুড়িয়ে গেলো। হারিয়ে ফেললো কর্মক্ষমতা। আমরা সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। হাতিয়েও নেয়া হলো বাবার পেনশনের টাকা। বুড়ো দু’টো মানুষ হয়ে গেলো একেবারে একা। অর্থহীন, সামর্থ্যহীন, শক্তিহীন, চিকিৎসাহীন। তারপর বড়ো কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে চলে গেলো দুনিয়া থেকে।
আহ ! আর বলো না আফসার, সেদিন রুথ খঁকিয়ে উঠেছিলেন, আমি সহ্য করতে পারি না।
এটাই আমাদের দেশের বয়স্কদের সারাজীবনের পরিশ্রমের পরিণতি।
হা জেসাস ! একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মিসেস রুথ।
আজ আবার রুথ এসেছে। বসে আছে লিভিংরুমে। উইক ডে তে আমাদের খুব একটা দেখা হয় না। রুথের স্বামী স্যাম কাজ করে রাতে। দিনভর ঘুমোয়। রুথও বাইরে খুব একটা যেতে পারে না। শনি রোববারে দেখা সাক্ষাত। আজও বোধহয় নিয়মিত সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই এসেছে।
আয়নায় চোখ পড়তে একটু অবাক হলাম। আরে চুল যে সব পাল্লা দিয়ে পাকা শুরু করেছে। কালোর পরিমাণ কমে গিয়ে সাদার পরিমাণ দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে আমিও বুড়িয়ে যাচ্ছি।
আব্বু, তোমার এখনো হয় নি ? অর্পিতা এসে ডাক দেয়।
আম্মু দেখো আমার সব চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে – দরোজা খুলে আমি দুঃখিত গলায় বলি।
আমি বড়ো হচ্ছি, তোমার চুল পাকবে না ? মেয়ে আমার পাকামো করে হাসলো।
তাই বুঝি ? আমি ক্ষুন্ন গলায় বলি।
তাইতো। সে ঘুরে দাঁড়ায়, এখন চলো বুড়ি বসে আছে।
শোন, আমি টাওয়েলটা রাখতে রাখতে মেয়েকে দাঁড় করাই, শোন পাগলী, তুই আমার কাছে কখনো বড়ো হবি না। আমার ছোট্ট অর্পিমনিই থাকবি। তুই বড়ো হলে যে আমাকে ছেড়ে চলে যাবি -।
আব্বু ! মেয়ে আমার কেঁদে ফেললো।
হ্যাঁরে পাগলী, এতো নরম হলে কি চলবে ?
তুমি যেন কতো শক্ত আর কি !
আচ্ছা চল দেখি।
লিভিংরুমে ঢুকতেই মিসেস রুথ উঠে দাঁড়ালেন।
সরি আফসার, তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম- ।
আরে না না, আপনি বসুন – আমি একপ্রকার হাত ধরে তাকে বসিয়ে দিলাম।
একটু গরমের ছোঁয়া পেয়েই বুড়ি শর্ট পরে নিয়েছে। এখানে এ জিনিসটা বেশ চোখে পড়ে। উইন্টার শেষ হবার আগেই সবাই তাকে বিদেয় করতে অস্থির হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মেয়েরা তাড়াতাড়ি ¯িপ্রংয়ের আমেজ নিয়ে আসে। মিসেস রুথকে দেখে এ মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ¯িপ্রং বুঝি এসে গেছে। এখন ফুলে ফুলে সেজে উঠবে বাড়ীর অঙ্গন, মৃতপ্রায় বৃক্ষরাজি বল্গাহীন সবুজে সবুজাভ হয়ে উঠবে, সতেজ প্রকৃতি উঠবে হেসে, বেড়ে যাবে পাখীদের আনাগোনা। আমেরিকার ¯িপ্রং আর ফল-টাই আমি খুব উপভোগ করি।
তা কি মনে করে – আমি মিসেস রুথের সতেজ চোখজোড়ার দিকে তাকাই। আশ্চর্য লাগে ! রুথের বয়েস কম হলেও পঁচাত্তর হবে। অথচ ওর চোখজোড়া একেবারে সতেজ, ঝলমলে। কথা বলার সময় তারুণ্য উপচে পড়ে।
তোমাদের দেশী এক মেয়ে নাম শাহানা, আমার সাথে কাজ করে – রুথ একটু ধরা গলায় বললো, কাল কাজের সময় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। বেচারার দুইটা আঙ্গুল একেবারে থেতলে গেছে। হসপিটালে পাঠিয়েছিলাম। এখন বাসায় আছে। তুমি যদি ওর বাসার ঠিকানাটা দিতে তাহলে এক নজর দেখে আসতাম।
শাহানা ? নামটা চেনা হলেও বুঝতে পারছি না রুথ কার কথা বলছে। সবচেয়ে অবাক লাগছে, আহত এক সহকর্মীকে দেখার জন্যে ওর আগ্রহ লক্ষ্য করে। এদেশে কাজের বাইরে সহজে কেউ সম্পর্ক রাখতে চায় না। কাজের ক্ষেত্রে যতো আন্তরিকতা দেখাক না কেন, কাজ শেষে যে কে সে। খুব কম আমেরিকানই কাজের বাইরে সহকর্মীদের খোঁজ রাখে। যারা রাখে ওরা ব্যতিক্রম। রুথ তাদেরই একজন। মনে মনে ওকে ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু শাহানাকে আমি চিনতে পারছি না।
শাহানাকে তুমি চেনো বিশু ? শেষে বউয়ের দ্বারস্থ হলাম।
লালমিয়ার বউকে বুঝি তুমি চেনো না ? একটু বাঁকা করে কিচেন থেকে গলা বাড়িয়ে বললো বিশু।
ও হ্যাঁ, চিনেছি। আমি একটু গুম হয়ে গেলাম। এই এলাকায় আসার পর প্রথম পরিচয় হয়েছিলো লোকটার সাথে। ফেনীর কাছাকাছি বাড়ী। তেমন কোন বাঙালী না থাকায় একটু ঘন ঘন ওর সাথে দেখা হতো। বাঙালী দোকানে গেলে দুয়েকটা পত্রিকা পেতাম। সেখানেই মূলতঃ লালমিয়ার সাথে বেশী দেখা আর আলাপ হতো। ওর আচার আচরন তেমন পরিশীলিত না হলেও খারাপ লাগতো না। ফলে দু’পরিবারে একটু যাতায়াত হলো। একটু ঘনিষ্টতা। কিন্তু একদিন আরেক বাঙালী ভদ্রলোকের সাথে তার ব্যবহার দেখার পর থেকে আমি একপ্রকার নিস্পৃহ হয়ে গেলাম।
বাংলা পত্রিকার পাতায় ঢাকায় লাদেনের সমর্থনে আয়োজিত মিছিল ও দেশের সর্বত্র লাদেন আর মোল্লা ওমরের বক্তৃতার ক্যাসেট, সিডির সয়লাব হবার সচিত্র প্রতিবেদন পড়ে ওই ভদ্রলোক ক্ষুন্ন হলেন। দোকানীকে বললেন, ভাই আমাদের মতো গরীবদের পেটেই আখেরে লাথিটা পড়বে। আমাদের কি দরকার পড়েছে লাদেনকে নিয়ে মাতামাতি করার ? দেখেন শেষ মেষ ডিবি লটারীটাই বন্ধ হয়ে যায় কি না !
গেলে কি হবে ? আমেরিকায় না এলে কি মুসলমানরা সব মরে যাবে ? আমার পাশে দাঁড়ানো লালমিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধকন্ঠে চিৎকার করে উঠলো। হিস্ হিস্ করে সে আরো বললো, লাদেন উচিত কাজই করেছে, নাসারাদের উচিত শিক্ষাই দিয়েছে।
আপনার এভাবে বলা কি ঠিক হচ্ছে ? ভদ্রলোক বোঝাতে চেষ্টা করলেন।
জ্ঞান দেবেন না, লালমিয়া ততোধিক উত্তেজিত হয়ে ওঠে, বজ্জাতদের দেশে এসে সব শালারাই মোনাফেক হয়ে গেছে।
এ্যাই চোপ ! দোকানী কবির ভাই এবার এগিয়ে আসেন, জীবনে তো গরুর গাড়ী ছাড়া কিছুই দেখোনি, এখানে এসে ডলার কামিয়ে গাড়ী হাঁকিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছো। আর একটা কথা বললে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।
গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে যায় লালমিয়া।
তারপর থেকে আমি নানা উছিলায় লালমিয়াকে এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। তার বউটা মাটির মানুষ। প্রথম প্রথম খুব ফোন করতো। কিন্তু আমাদের তেমন সাড়া না পেয়ে নিজে থেকে চুপ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, তোমাকে আমি ওদের ফোন নাম্বারটা দিতে পারি, মিসেস রুথের দিকে তাকালাম, ওতে চলবে ?
অফকোর্স, অন্তরঙ্গ হাসি ফুটে ওঠলো রুথের মুখে, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আফসার – ।
ইটস্ মাই প্লেজার রুথ – নাম্বারটা লিখে এগিয়ে দিলাম।
ওকে, সি ইউ দ্যান – উঠে দাঁড়ালেন মিসেস রুথ, বাই নাও।
বাই।
রুথ বেরিয়ে যেতেই সকালের নাস্তারর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমাকে বসতে দেখে বাচ্চারাও চলে এলো। ভূনা মাংসের ঘ্রানে আমার ক্ষিদে বুঝি প্রচন্ড বেড়ে গেলো। একটা পরোটা আর একটা নান সাবাড় করে দম নিলাম।
বাব্বা ! অর্পিতা আমার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বললো, যেমন হাপুস্ হুপুস খেলে তুমি, মনে হচ্ছিল ক’দিন কিছুই খাও নি।
খাই নি তো ! আমি ঢক ঢক করে গলায় পানি ঢাললাম, তোমার আম্মু কি আমাকে কিছু খেতে দেয় ?
আবার বলো তো শুনি ? চোখ কটমট করে কপট রাগের ভঙ্গীতে চা হাতে বিশাখা এগিয়ে এলো, আমাকে কে খেতে দেয় জিজ্ঞেস করো তো আম্মু ?
ঠিকই তো, আবির অমনি মা’র পক্ষ নিয়ে নিলো, তুমি তো আম্মুকে কিছু খেতে দাও না। আম্মু কুকও করে আবার সবাইকে খেতে দেয়, ইটস্ নট ফেয়ার -।
হলো তো এবার ? বিশাখা আকর্ণ হাসে, এখন থেকে কথা বলতে হুঁশিয়ার সাহেব -।
হুম ! আমি চায়ের খালি কাপটা টেবিলে রেখে উঠে যাওয়ার ভঙ্গী করে ঝাপটে ধরলাম আবিরকে, আজ তোকে খেয়ে ফেলবো ফেয়ারের বাচ্চা, কাতু কুতু দিয়ে, মিছে কামড়ের ভান করে কিছুক্ষণ হুড়োহুড়ি করলাম ওর সাথে। আদিবটা একপ্রকার চুপচাপ। এটা তার স্বভাব। খালি মিটি মিটি হাসবে। আর সময় সুযোগ বুঝে এটা ওটা আবদার করে বসবে। বিশেষ করে উইক এন্ডে। তার প্রিয় হলো ইয়ো গিয়ো কার্ড, ভিডিও গেম, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ী। আমার যে এর পেছনে কত টাকা গচ্চা যায় তা কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। যা হোক, আমি সাধ্য মত বাচ্চাদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করি।
আজ তোমাদের কি প্রোগ্রাম ? অর্পিতার দিকে তাকালাম।
তুমি থিয়েটারে যাবে বলেছিলে – ।
এক্ষুণি না পরে ?
আগে আমাকে বাজারটা করে দাও না, বিশাখা এসে পাশে বসলো, রান্নার তেমন কিছু নেই।
ও- নো ! আদিব দুঃখী গলায় বললো।
ওকে আদিব, আমি উঠে দাঁড়ালাম, তুমি আর আবির কিছুক্ষণ খেলো, খাওয়ার পর থিয়েটারে যাবো।
হেই আব্বু – দরোজায় ওয়াটার গান নিয়ে এসে দাঁড়ালো আলেক্স আর টনি, আবির আদিব আমাদের সাথে খেলতে পারে ?
কমপ্লেক্সের অনেক বাচ্চাই আবির আদিবদের দেখাদেখি আমাকে আব্বু ডাকে। ভিয়েতনামী আর আমেরিকান সব বাচ্চাই। আমারও ভীষণ ভালো লাগে। আমি এদেরকে আদর করি। এটা ওটা খাওয়াই। আলেক্সের চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম, ওকে। বাট রিমেমবার, নো ফাইটিং আব্বু -।
নো ফাইটিং।
ওদের সাথে আদিব আর আবির বেরিয়ে গেলো হই হই করে। অর্পিতা গেলো টিভির সামনে, ওর রুমে।
হু ! বিশাখা উঠে দাঁড়ালো, তুমি পারো বটে !
পারলে তো আর এমন দীন হীন থাকতাম না বিশু, আমি বেরোতে উদ্যত হলাম, আসলে আমি এক মহা অকম্মা ।
হয়েছে নিজের বাহাদুরী করতে হবে না, কপট অনুযোগ করে সে, জলদি এসো।
যথাজ্ঞা মহাশয়া।
পাগল।
ঘর থেকে বেরিয়েই সিগারেটটা ঠোঁটে ছোঁয়ালাম। রোদে থই থই করছে পৃথিবী।
মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভূবনে -।
********************************