You are currently viewing পিপুফিশু, কিস্তি-৪ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু, কিস্তি-৪ || আলী সিদ্দিকী

পিপুফিশু

আলী সিদ্দিকী

কিস্তি-৪

চিরায়ত কর্মচক্রে

কাজটা তেমন কঠিন কিছু নয়। চাকুরীদাতা সংস্থার কর্মী স্যালী যখন আমাদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল তখনই বুঝে নিয়েছি কি করতে হবে। সম্পূর্ণ অটোম্যাটিক পদ্ধতিতে ফিনিশড্ প্রোডাক্টের কোয়ালিটি ইন্সপেকশন। করতে হবে টাইমলি ম্যানারে, ঘন্টায় নির্দ্দিষ্ট করে দেয়া সংখ্যানুসারে। কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় কথা ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত কোন কথা বলা যাবে না। দুই শিফটে কোম্পানীর কাজ চলে। ডে টাইম আর নাইট টাইম। ডে টাইম শুরু ভোররাত পাঁচটা থেকে দুইটা। ব্রেক টাইম দুইটা। প্রথম ব্রেক সকাল সাড়ে নয়টায়, কোম্পানী প্রদত্ত। দ্বিতীয় বা লাঞ্চ ব্রেক দূপুর সাড়ে বারোটা থেকে একটা, নিজস্ব টাইম। সম্পূর্ণ ধুমপানমুক্ত ফ্যাসিলিটিজ। কেউ ধুমপান করতে চাইলে পার্কিং লটে রাখা নিজের গাড়ীতে বসে করতে পারে, তাও ব্রেক টাইমে।
গড় গড় করে স্যালী আমাদের পুরো বিষয়টির ব্রিফিং দিলো। কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম মাঝে মধ্যে তার ডানচোখটা ’ চোখ মারার’ ভঙ্গী করে। এটা একপ্রকার স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারনে হয় বলে শুনেছি। আমার এক আত্মীয়াকেও এমন ভঙ্গী করতে দেখেছি। এই চোখ মারা নিয়ে সেই আত্মীয়াকে অনেকবার বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। স্যালী এমন কোন সমস্যায় কখনো পড়েছে কি না জানতে ইচ্ছে হলেও ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিবেচনা করে গলায় উঠে আসা কথাটা গিলে ফেললাম।
তার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বস বার্ব ব্রেইনার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আমাদের। তার পুরুষালী চেহারায় রয়েছে এক ধরনের কর্মঠতার ছাপ। তার ঠোঁটে ঝুলে আছে মৃদু হাসি। হাসিটাকে আরেকটু প্রশস্ত করে বললো, এ্যানি কোয়েশ্চনস্ ?
ইয়েস, জন তার জ্যাকেটের জীপারটা ওপর দিকে টেনে তুললো, পিপল ক্যান নট বি কোয়ায়েট টেন লং আওয়ার্স ..
দ্যাট মিনস্ ইউ লাইক টু টক, জনের কথা কেড়ে নিয়ে সুন্দর করে হাসলো বার্ব, তুমি কথা বলতে পারো, তবে কাজের ক্ষতি করে নয়। আর আমাদের সিস্টেমটাই এমন তোমারই সময় হবে না – বলে অমায়িক হেসে দরোজার দিকে এগিয়ে গেল, মাথাটা ঈষৎ ঘুরিয়ে বললো, ফলো মি-।
স্যালীর কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে আমরা বার্বকে ফলো করলাম। করিডোর ধরে একটু এগিয়ে এসে একটা বন্ধ দরোজার সামনে দাঁড়ায় সে।
ক্লক ইন – বার্ব জনকে ইশারা করে। একটু আগে পাওয়া লাল অক্ষরে টেম্পরারী লেখা কার্ডটা সে দ্রুত স্ক্যান করলো। একটা যান্ত্রিক শব্দ করে নীল বাতি জ্বলে উঠতেই হাতল ধরে টান দেয় বার্ব। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলোকে একটা ঝাঁকি দিয়ে পেছনে সরাতে সরাতে বলে, প্রতিদিন এটা ইউজ করতে হবে ঢোকার সময়। যত্ন করে রাখতে হবে।
ভেতরে ঢুকে একটু বাঁয়ে ঘুরে আবার দাঁড়ালো একটা লাল রঙয়ের ছোট্ট মেশিনের সামনে, এটা হলো ওয়ার্কিং স্ক্যাজুয়ালে পাঞ্চ ইন এন্ড পাঞ্চ আউটের মেশিন। অবশ্য যখন তুমি তোমাকে দেয়া মেশিনে জব শুরু করবে তখনো এই মেশিনে ওয়ার্ক অর্ডার লগ অন ও লগ অফ করতে হবে। চলো জব কিভাবে লগ অন ও লগ অফ করতে হয় সেটা দেখিয়ে দেই। ভেরী ইজি। দু’একদিনেই সব ধরে ফেলতে পারবে।
পাঁচ বছর ধরে আমেরিকায় কাজ করছি। বার্ব যা দেখালো এ সম্পর্কে ধারণা থাকলেও একেবারে ’ প্রথম শিখছি, জানছি’ এমন ভাণ করে রইলাম। কারন, বস্ অলওয়েজ রাইট। এটা জীবন দিয়েই শিখেছি। বার্ব মেশিন টার্ণ অন আর অফ করা শিখিয়ে দিলো আর ইন্সপেকশনে কি কি দেখতে হবে বুঝিয়ে দিলো।
তবে, বার্ব যাবার সময় একটু থেমে মুখে হাসি ছড়ালো, টার্গেট থেকে কমপক্ষে ২০% সবাই বেশীই করে, তোমাদেরও তাই করতে হবে।
প্রথম দিন বলেই মেশিন রপ্ত করতে সময় লাগলো। ঘন্টা হিসেবে টার্গেটে আমরা দু’জনেই পৌঁছতে পারলাম না। ফার্স্ট ব্রেকে আমি বাইরে চলে এলাম। গাড়ীতে বসে সিগারেট ধরালাম। দেখলাম অনেকেই এ সময় বাইরে এসে গাড়ীর দরোজা খুলে আয়েসে সিগারেট ধরিয়েছে। সকাল থেকে আর বরফ পড়েনি কিন্তু গতকালের বরফ ঝড়ে পুরো পার্কিং লটে যে বিশাল পাহাড় জমে গিয়েছিলো তা জায়গায় জায়গায় ¯তূপ করে রাখা দেখে সহজে বোঝা যায়। পার্কিং লটের পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বরফাচ্ছাদিত পত্রপল্লবহীন গাছ। সেখানে আটলান্টিক থেকে ছুটে আসা বিবাগী বাতাসেরা রাগী ঝংকার তুলছে। গাড়ীর ভেতরে কনকনে ঠান্ডা। দ্রুত সিগারেট শেষ করে আমি ফ্যাক্টরীর ভেতর চলে এলাম। সদ্য পাওয়া ক্লজেটে জ্যাকেটটা ঝুলিয়ে রেখে চলে এলাম কাজের জায়গায়। দেখি জন অনেকের সাথে জম্পেশ আড্ডা জমিয়ে ফেলেছে। বেশীর ভাগই মেয়েরা। তাও আবার মনে হচ্ছে ভিয়েতনামীজ। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশটাকে ধ্বংস করার জন্যে আমেরিকা এক সময় পোড়ামাটির নীতি গ্রহন করেছিলো, হত্যা করেছিলো হাজার হাজার ভিয়েতনামীজ, সেই ভিয়েতনামের যুদ্ধে তাকে বরন করতে হয়েছে শোচনীয় পরাজয়। পরাজিত হলেও তারা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের পক্ষাবলম্বনকারী ভিয়েতনামীদের আমেরিকায় সেটেল হবার সুযোগ করে দেয়। আজ পুরো আমেরিকায় হাজার হাজার ভিয়েতনামীর বাস। বড়ো বিচিত্র আমেরিকানদের মন!
আমি হাসিমুখে তাদের সাথে পরিচিত হলাম।
অবাক হলাম জনের আচরন দেখে। অল্প সময়ে সে সকলের সাথে বেশ সাবলীল হয়ে উঠেছে। আসলে এটাই তার প্রধান গুণ। কথা বলার উচ্ছ্বাসে তার বাদামী চোখ ঝোড়া ছড়াচ্ছিলো অপূর্ব দ্যুতি। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে তার কথা। এমন মুগ্ধ শ্রোতা পেলে কোন বলিয়ে কি আর থামতে চায় ?
কিন্তু জনকে থামতে হলো।

ব্রেক টাইম শেষ হয়ে এসেছে।
ওয়ার্ক স্টেশনের দিকে যেতে যেতে সে ছুটে এলো আমার কাছে, আতিক তোমার কি কাল বিকালের কথা মনে আছে ?
কাল বিকালে কি ? আমি একটু ভাবলাম।
সেন্টার সিটিতে। এন্টি ওয়ার ডেমোনেস্ট্রেশন -। মনে নেই ?
ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে । কিন্তু আমার যাওয়া কি ঠিক হবে ? আমি দ্বিধান্বিত গলায় জানতে চাইলাম। পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি এবং মাঝেমধ্যে সিএনএনও দেখাচ্ছে, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে সম্ভাব্য ইরাক আক্রমনের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। মানুষ জানে সেপ্টেম্বর ইলেভেনের সাথে সাদ্দামের সম্পর্ক না থাকলেও, এমনকি তার কাছে উইপন্স অফ মাসডেস্ট্রাকশন পাওয়া না গেলেও, নব্বুইয়ের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর সাদ্দাম সিনিয়র বুশকে যেভাবে অপমান করেছে তার শোধ নেবার জন্যে হলেও জুনিয়র বুশ ইরাকে আক্রমণ চালাবে, তা নিশ্চিত। ভূ- রাজনীতির নোংরামি আর কর্পোরেট শাসিত আমেরিকার কর্পোরেট জায়ান্টদের স্বার্থ তো আছেই। আরো আছে জুইসদের গভীর ষড়যন্ত্র। এমনিতে মুসলমানরা আমেরিকানদের কাছে এখন জুজুতে পরিণত হচ্ছে, বিশেষতঃ প্রচার মাধ্যমে সেভাবেই তুলে ধরা হচ্ছে। যদি ডেমোনেস্ট্রেশনে গেলে এফবিআইয়ের চোখে পড়ি, তাহলে তো মুশকিল। নাইন ইলেভেনের পর থেকে একটা চরম আশংকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।
অসুবিধা হবে না, জন আশ্বাস দিলো, তুমি র‌্যালীতে না গিয়ে বরং অনেকের সাথে পরিচিত হতে পারবে, চলো। আমি বলছি তোমার ভালো লাগবে।
ঠিক আছে- র‌্যালী দেখার আগ্রহে সম্মত হলাম।

*************************************