‘একলা পথের সাথী’: একটি নিবিড় পর্যালোচনা
মেহনাজ মুস্তারিন
বইমেলা উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকগুলো বইয়ের প্রচারণা চোখে পড়ছিল। সত্যি বলতে, বইয়ের নামটা আমার কৌতুহল বাড়িয়ে তুলেছিল অনেকগুন। আমার জানামতে, এ সময় যাঁরা লিখছেন পাপড়ি রহমান তাঁদের মধ্যে অনন্য। নব্বই দশকের কথা সাহিত্যিক, পাপড়ি রহমানের বেশকিছু গবেষণাধর্মী গ্রন্থও বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকগুলো পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। শুরুতেই বলেছি বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরি হবার অন্যতম কারন এর চমৎকার নামকরণ! আমাদের দেশে একজন নারী লেখককে লেখালেখি ও বই প্রকাশের বেলায় কী ধরণের বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার একটা ইংগিত এই বইয়ে থাকবে— এমন অনুমান আমি একা না, লেখালেখির সাথে যুক্ত বহু নারীরও করার কথা। লেখালেখি নিয়ে আমি নিজে কিছু চ্যালঞ্জের মুখোমুখি হই; আমার মনে হয়েছিল এই বই থেকে একটা পথরেখার সন্ধান পাবো, না বলা অনেক কথার উত্তর হয়তো পেয়ে যাব তাঁর লেখায়। সেই ভাবনা থেকে একদিন বইটি সংগ্রহ করলাম।
আহমদ ছফার “বাঙালি মুসলমানের মন” গদ্যে মুসলমান-মন বলতে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে পুরুষের মন। সেখানে আলাদা করে মসুলমান নারীদের মন নিয়ে আলোচনা নাই। যে কোন সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য নারীর মন ও মনন নিয়ে আলাদা করে আলোচনা থাকাটা জরুরি। দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ লেখক প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান, অথবা, এর গুরুত্বটা সেভাবে বুঝতে পারেন না। অপরদিকে, তসলিমা নাসরীনের মতো কতিপয় নারীবাদীরা যেভাবে নারীর মন বুঝতে চেষ্টা করে, সেটাও আমাদের মাটির সাথে যায় না। বাঙালি, সেটা হিন্দু হোক কি মুসলমান, আমাদের নারীদের নিজস্ব একটা মনস্তাত্ত্বিক জগত আছে। সেই জগতের সন্ধান দূরের কথা, উপযুক্ত আলোচনার অভাবে নারী লেখকদের সংকট ও সম্ভাবনার জায়গাগুলোও সেভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
উনিশ শতকে রোকেয়া শাখাওয়াৎ মেয়েদের জন্য যে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন, সেখানে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটিই ছিল মূখ্য। রোকেয়া মেয়েদের এগিয়ে যাবার যে পথ দেখিয়েছেন, সেই পথ বেয়ে পরবর্তীতে বহুসংখ্যক নারীকে আমরা উঠে আসতে দেখেছি। আমার মধ্যে এ নিয়ে কোন সংশয় বা সন্দেহ নাই যে, এঁদের সকলকে এক সংগ্রামময় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তো রোকেয়া-সূচিত সেই সংগ্রাম বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার একটা ছোঁয়া পাপড়ি রহমানের লেখায় পাবো, এমন আশা নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করলাম। কোন বিরতি না দিয়ে এক দমে শেষ করেছি। পড়তে পড়তে একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম! প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখক হিসেবে তাঁর সংগ্রামে যে একাকিত্ব অনুভব করলাম, তাতে হতাশা বেড়েই গেল। সাহিত্য জগতে নানারকম জটিলতার যে জায়গাগুলো পাপড়ি রহমান স্পর্শ করেছেন, তা হৃদয়ের কুঠরীতে ধাক্কা দেবার মতো। পড়তে গিয়ে বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল— এই সাহিত্যের জগত বড়ই বেখেয়ালি। না বোঝে পরিবার, না সমাজ, না সুস্থ কোনো হাত বাড়ানোর জন্য পাশে আছে কোন আপনজন।
বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে লেখককে পাওয়া যায় সস্তায়, অথবা বলা যায় মাগনায়। হাতে গোনা দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে এখানে লেখা, বিশেষকরে সাহিত্যের লেখাকে কেউ কেন পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে না, তার নানা কারণ আছে। আমি সেদিকে যাবো না। তবে, অনেকগুলো কারণ পাপড়ি রহমানের লেখায় উঠে এসেছে খুব পরিষ্কারভাবে। বিশেষ করে প্রকাশকদের নিয়ে যে গভীর হতাশা লেখকদের মধ্যে দেখি, তার একটা করুণ চিত্র এই বইয়ে পাওয়া যাবে। অর্থ পরিশোধ না করে লেখকের কাছ থেকে পাওয়া পান্ডুলিপিকে বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া, প্রকাশের পর লেখককে কোন টাকা-পয়সা না দেওয়া, লেখককে না জানিয়ে একের পর এক সেই বইয়ের সংস্করণ প্রকাশ করাটা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য না। এসব দেখলে ভয় লাগে, বই প্রকাশের ইচ্ছেটা মরে যায়। পাপড়ি রহমানের মতো নামকরা লেখকদের যখন এই হাল, তখন নতুন কিংবা অপরিচিত লেখকের বেলায় কী ঘটছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। পান্ডুলিপি নিয়ে দ্বিতীয় যে সমস্যাটি দেখতে পাই তা হচ্ছে লেখা সংশাধন করতে বলা। লেখকের মনোভূমির স্বাধীনতা এক প্রয়োজনীয় বিষয়, একে এড়ানোর উপায় নাই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পেশাদার সম্পাদনা পরিষদ গড়ে ওঠেনি। তেমন কোনকিছু থাকলে তাদের মতামত গ্রহন না করার কোন কারণ নাই। সেক্ষেত্রে, লেখকের পক্ষে তার লেখায় কোন কোন অংশে সম্পাদনা পরিষদের আপত্তি আছে তা জানা সম্ভবপর হতো। তার পরিবর্তে ঢালাওভাবে পান্ডুলিপিকে খারিজ করে দেয়াটা সুবিবেচনার না। একটা জিনিষ বুঝতে হবে, একজন লেখককে ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের দিন মাসের পর মাস খেটেখুটে তার নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভর করে একটা বইয়ের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করতে হয়। পান্ডুলিপি গৃহীত না হলে তার কারণটুকু জানিয়ে দেয়া– এই সম্মানটুকু একজন লেখক প্রত্যাশা করতেই পারে।
বইয়ের গভীরে পৌঁছে অজস্রবার ভেবেছি, ঢাকার মতো রাজধানী শহরেই তাঁর যে হাল, সেখানে আমাদের মতো মফস্বল শহরের মেয়ে যদি নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তবে তার চলার পথ কতটা মশৃণ হবে! সেদিক থেকে পাপড়ি রহমান সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। লিখার জগতে তিনি এত বিশিষ্ট জনদের সহযোগিতা, সহর্মমিতা পেয়েছেন, যা আমার কাছে অকল্পনীয়! কাদের সাহচর্য পাননি তিনি? সৈয়দ শামসুল হক এবং তাঁর স্ত্রী ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক তো তাঁকে বটবৃক্ষের ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। তবু, তাঁর আক্ষেপ দেখবার মতো। বইয়ের পরতে পরতে যে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেটা কিছুটা কম হলেই বোধহয় ভালো হতো। আরেকটা বিষয় আমার ভালো লাগেনি, সেটা পুরুস্কার। ভালো লেখকদের পুরস্কার নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে কেন? লিখার উদ্দেশ্যটা আসলে কী? আমার তো মনে হয়, উদ্দেশ্য সৎ থাকলে এবং তা নিয়ে মাথা ঘামালে যাদের জন্য লিখছেন অনেক দ্রুত সেই মানুষগুলোর চেতনা ও মননে পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাবে।
বইয়ের শুরুটা একঘেয়েমি। ধৈর্য ধরে এই অংশ পার হতে পারলে মাঝামাঝি পৌঁছানোর পরে রস আস্বাদন শুরু হবে। স্মৃতিগদ্য, তবে, বইয়ের কিছু অংশে এক অদেখা – অনতি তরুন কবির আগমন ঘটতে দেখি, যিনি পাপড়ি রহমানের কাছে লেখা তাঁর চিঠিতে বৃক্ষ আর বিহঙ্গের কথা বলতেন। লেখক একে প্রেম বলে স্বীকার না করলে কী হবে, পাঠক কিন্তু ধরেই নেবে সেই সব কথার ভাঁজে লুকিয়ে ছিল গভীর প্রেম। নিচের উদ্ধৃতি দেখুন:
যদি বলি—
আমি পাতার সাথে কথা বলছি…
আমি ফুলের সাথে কথা বলছি…
আমি রোদের সাথে কথা বলছি…
আমি আমার কথা বলছি, আমি তোমার কথা
বলছি….
আমি আমাদের কথা বলছি…
মিষ্টি সেই সময়ের কথা বলছি..
লেখায় ভালো দিক যেমন আছে, তেমন আছে সীমাবদ্ধতা। প্রথমেই যে জিনিস যে কারো নজরে পড়তে বাধ্য, সেটা উত্তাপ ছড়ানো। বইয়ের বহু জায়গায় এই জিনিষ যে পরিমানে ছড়িয়েছে সেই পরিমানে আলো ছড়ায়নি। সাহিত্যের কাজ কি উত্তাপ ছড়ানো? আমার দ্বিমত আছে তাতে। কোথাও পড়েছিলাম— সূর্যের উত্তাপ শুষে নিয়ে আলোটুকু ছড়িয়ে দেয় বলেই চাঁদ এত সুন্দর, জ্যোৎস্না নিয়ে তাই এত মাতামাতি। জালালুদ্দিন রুমি থেকে বলতে পারি— বজ্রপাত না, বরং বৃষ্টির পানিই বৃক্ষ ও তরুলতাকে সবুজ শোভন করে। উত্তাপ শুষে নেবার জায়গায় লেখক তাঁর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলে কষ্টগুলো অনেক বেশি হৃদয় ছুঁয়ে যেত বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে চেপে যাওয়া। খারাপ লাগার মতো বিষয়গুলো বলতে চেয়েও বলতে পারেন নি, বা উহ্য রেখেছেন। যে কারো মনে হতে পারে, লেখক আরেকটু সাহস সঞ্চয় করলেই পারতেন। আমার দ্বিমত এখানেও। সাহিত্যের আরেকটি কাজ হচ্ছে রূপক বা মেটাফোর তৈরী করা। নানান রূপকের আড়ালে হেন বিষয় নাই যার প্রকাশ সম্ভব না। একজন কথাসাহিত্যিক রূপক তৈরী করতে পারবেন না, এটা আমি মানতে নারাজ। হতে পারে, আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে লেখক এখানে সাহিত্যের দায়টুকু উপেক্ষা করে গেছেন।
এমন উল্লেখযোগ্য কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই বইয়ে আমাদের যে প্রাপ্তি তা কিন্তু কম না। সেজন্য, পাপড়ি রহমানকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তাঁর একনিষ্ঠতা, সাহস, মনোবল, সর্বপরি সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগাধ প্রেম তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে স্বপ্নের জগতে।
শেষ পর্বে এসে লেখক একটু বেশি তাড়াহুরো করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। প্রকাশের চাপ থাকলে এমন হয়। এটা আমার অনুমান যে, বইমেলার কারনে শেষ পর্ব সেই যত্নটা পায়নি। বইমেলা এমন এক চাপ যা অনেক লেখক নিতে পারে না। আচ্ছা, মেলা উপলক্ষে কেন বই ছাপতে হবে? সারাবছর ধরে যে বই ছাপানো হয়, সেখান থেকে বাছাই করা বই নিয়ে মেলা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যাহোক, দ্রুত সমাপ্তির পথে না গিয়ে, চমতকার একটা সারমর্ম টেনে শেষ করা হলে অনেক ভালো হতো বলে আমার বিশ্বাস। লেখায় শেষ চিহ্নটুকুর ভেতরেও জোনাকির ম্লান আলোর ছটা রয়েই গেল। এতে করে আগামী প্রজন্ম, যারা আশার পথ চেয়ে আছেন তাঁরা কতটুকু আলো পাবে সেটাই ভাবনার! একটা আক্ষেপ রয়েই গেল— আগামী প্রজন্মের নারী লেখকদের জন্য কোন দিকনির্দেশনা নাই; থাকলে বইটি পূর্ণতার পথে আরেক ধাপ অগ্রসর হতো বলে আমার অভিমত।
আগ্রহী পাঠক, লেখক, বিশেষ করে নারী লেখকদের অবশ্যই বইটি পড়া উচিত। তাহলে তাঁরা তাঁদের নিজের সংগ্রামের সাথে লেখকের সংগ্রামের মিলগুলো দেখে প্রত্যয়দীপ্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। একজন নারী লেখকের ঘাত প্রতিঘাতের চিহ্ন যে কতটা গভীর, কতটা ব্যথার হতে পারে, তা বুঝতে পাপড়ি রহমানের বইটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। স্যালুট জানাই পাপড়ি রহমান আপনাকে। আপনার আলোয় আলোকিত হোক আগামী প্রজন্ম। উল্লেখ্য, পাপড়ি রহমানের আত্নজীবনী ‘আমার একলা পথের সাথি’ বইটি ২০২৩ সালে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত।৷
***********************************
মেহনাজ মুস্তারিন
কবি ও কথাসাহিত্যিক
======================