পান্ডুলিপি থেকে জীবনানন্দ’র নতুন কবিতা
“যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ”
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ
যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ অন্ধকারে ফুরিয়ে গেছে আজ—
বাধা ব্যথা মানবতার নিয়ম ছেড়ে দিয়ে
এখন যারা গাছ পাথর ও জলের পৃথিবী
হ’য়ে সময় পরিক্রমা করছে সারা দিন ;
আশা আকাশ কপট পাশা ভালোবাসার কাছে
তাদের দাবি শেষ হয়েছে, নারী,
তোমার মুখের উপকণ্ঠে অনুসূর্য হ’য়ে
কবে সঠিক সূর্য হতে পারি ?
চারিদিকে শাশ্বত সব সূত্র ছিড়ে যায় ;
আজকে যুগে প্রতি নিমেষ মৃত্যুসাগর থেকে
অতর্কিতে উঠে এসে সময়পুরুষ নিজে
সমাজ জাতি নর নারী কুল অকুলের বুকে
আঘাত ক’রে অন্ধকারে অবহিত করে ;
প্রতিদিনের অসঙ্গতির থেকে স’রে প্রাণ
কোথাও উপায় পেতে গিয়ে চোরাবালির কোলে
খুঁজছে গিয়ে তবুও ব্যক্তি বস্তুর কল্যাণ।
মৃতেরা তা’ জানে ঠিকই—আজ আঁধারে জীবিতেরাও মৃত—
জানে মরণ কাউকে কিছু না ঠকিয়ে সবের বেশি সফলতা লাভ ;
আজকে রাতে আমাদের এই অধম শতাব্দীতে
বেঁচে থাকা তো পিচ্ছিল—মৃত্যু তো স্বভাব।
তবুও আমি কিছু আলোক চেয়ে জেগে আছি;
মনীষীদের জ্ঞানে কড়িকাহন পেয়ে স্থির
হয় না মন ;— তোমার জলকণিকা ভেঙে জল
করেছ আমায় তোমার মত অনন্ত নদীর।
১৯৫৪-তে জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণের পর তাঁর রেখে যাওয়া পান্ডুলিপি থেকে অধিকাংশ কবিতার পাঠোদ্ধার করেছেন কবি ভূমেন্দ্র গুহ। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। কবির অনুজ অশোকানন্দের নির্দেশেই তিনি কালো ট্রাংকে রাখা পান্ডুলিপির খাতা বের করে কবিতা কপি ক’রে দিয়েছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য; সঙ্গে থেকেছেন কবির অনুজা সুচরিতা দাশ। এভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল “বাংলার ত্রস্ত নীলিমা” গ্রন্থের পলিপি যা সিগনেট প্রেস কিছুটা পরিবর্তিত আকারে প্রকাশ করেছিল “রূপসী বাংলা” নামে। একই ধারায় জীবনানন্দের সপ্তম কাব্য সংকলন “বেলা অবেলা কালবেলা”র পাণ্ডুলিপিও তৈরী করা হয়েছিল, যা প্রকাশে সিগনেট অস্বীকৃত হয়েছিল।
পেশায় শল্য চিকিৎসক কবি ভূমেন্দ্র গুহ ১৯৯৩-এ সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর জীবনানন্দের পান্ডুলিপি থেকে কবিতা উদ্ধারে প্রবৃত্ত হন। তিনি কলকাতায় অবস্থিত ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত পান্ডুলিপির খাতা থেকে একের পর এক কবিতা উদ্ধার ও প্রকাশ করতে শুরু করেন। জাতীয় গ্রন্থাগারের সুসংরক্ষিত কবিতার খাতার সংখ্যা ৪৮টি। এই ৪৮টি খাতায় কবিতার সংখ্যা ২ হাজারের কাছাকাছি বলে অনুমিত হয়। ভূমেন্দ্র গুহ ৩৪টি খাতা থেকে ১৫৭০টি কবিতার মূলানুগ পাঠ ১৪টি খন্ডে প্রকাশ ক’রে গেছেন। ৩৫ (ক) এবং ৩৫(খ)-সহ বাকী সর্বমোট ১৪টি খাতা থেকে কবিতা উদ্ধার করা হয়েছে এবং প্রকাশ করা হয়েছে—যেমন কবির মৃত্যুর অব্যবহিত পর ৪৫ সংখ্যক খাতার “এক অন্ধকার থেকে এসে” কবিতাটি কপি ক’রে বুদ্ধদেব বসুর “কবিতা” পত্রিকার পৌষ ১৩৬১ সংখ্যায় প্রকাশের জন্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সকল কবিতার পাঠোদ্ধার ক’রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয় নি। ৩৫(ক) থেকে শুরু ক’রে বাকী ১৪টি খাতায় কবিতার সংখ্যা নগন্য—জীবনের শেষ পর্যায়ে নানা সমস্যায় বিপর্যস্ত জীবনানন্দ কবিতা লিখেছেন খুব কম। ১৯৫৪-তে—যে বছর অক্টোবরে তাঁর মৃত্যু হয়—সে বছর লেখা কবিতার সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়।
২০০৯-এর প্রথম দিকে ভূমেন্দ্র গুহ’র সম্পাদনায় এবং প্রিয়ব্রত দে’র সার্বিক পরিকল্পনায় কলকাতা থেকে প্রতিক্ষণ প্রকাশনা সংস্থা জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি লেখার খাতার আলোকচিত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সাত বছরের আটটি লেখার খাতার আলোকচিত্র দুই খন্ডে প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৪৯-এর কোনো খাতা ছিল না। এ গ্রন্থের নাম রাখা হয়েছিল “শেষ ছ’বছর”। এগুলো কবিতার পরিচ্ছন্নলিপি তৈরীর খাতা নয়, দিনলিপি লেখার খাতাও নয়। দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে ২০০৯-এ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাস পরই এই পান্ডুলিপিচিত্রের এক প্রস্থ হাতে এসে যায়। ভূমেন্দ্র গুহ দুটো খাতার [১৯৪৮ ও ১৯৫৪] টীকা করেছিলেন এই আশায় যে পাঠক তাতে উপকৃত হয়ে জীবনানন্দের হাতের লেখা পাঠে আগ্রহী ও সক্ষম হবেন। অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে তাঁর আশা অংশতঃ পূর্ণ হয়েছিল। আমি কিছু দিন পর এ খাতায় থাকা জীবনানন্দের চিঠিপত্রের খসড়াগুলো পড়তে শুরু করি। জীবনানন্দ দাশের হস্তলিপি পাঠের তীব্র আগ্রহ ক্ষমতার অভাব অনেকটা পুষিয়ে দিল। কিছু চিঠি পাঠোদ্ধারের পর জীবনানন্দের চিঠিপত্রের একটি সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া গেল।
২০১৫-তে দৃষ্টিগোচর হলো সিগনেট প্রেস প্রকাশিত “রূপসী বাংলা”র কবিতার ‘মুদ্রিত-রূপ’ এবং পান্ডুলিপি-রূপে’র মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাপক ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপত্তিকর পার্থক্য রয়েছে। কবিতা ধ’রে ধ’রে পান্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে এই পার্থক্য নিরূপণ করা গেল ও “রূপসী বাংলা”র একটি মূলানুগ সংস্করণ প্রকাশক জনাব আলমগীর রহমানের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হলো।
২০১৭-তে কলকাতায় তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ হলে শ্রদ্ধেয় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনানন্দের অগ্রন্থিত কবিতাগুলো পুস্তকাকারে প্রকাশের ব্যাপারে সচেতন করেন। যদিও আমি “কৃষ্ণাদশমী” নামে এরকম একটি বই প্রকাশনা করেছিলাম তা কেবল অগ্রন্থিত কবিতার সংকলন ছিল না। “কৃষ্ণাদশমী” জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক পরিকল্পিত কবিতার সংকলন, যার কবিতাগুলো জীবনানন্দ নিজেই নির্বাচন ক’রে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখার খাতায় এই সূচীপত্র পাওয়া গিয়েছিল। তাই “কৃষ্ণাদশমী”তে প্রকাশিত এমনকি গ্রন্থর্ভূত কবিতাও ঢুকে গিয়েছিল। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ইঙ্গিত থেকেই জীবনানন্দের ১১৭টি অগ্রন্থিত কবিতার সংকলন “সূর্য-অসূর্যলোক” প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। পান্ডুলিপি তৈরীর একেবারে শেষভাগে সরাসরি নতুন কবিতা উদ্ধারের বাসনা গাঢ় হ’য়ে উঠলো। শেষপর্যন্ত ৪০ সংখ্যক খাতা থেকে একটি কবিতার পাঠোদ্ধার সম্ভব হলো। জীবনানন্দের হাতের লেখা স্পষ্ট থাকায় কবিতাটির নির্ভুল প্রতিলিপি তৈরীতে তেমন বেগ পেতে হলো না। কাটাকুটি বা বিকল্প শব্দের ইংগিত ছিল না বললেই চলে।
৪০ সংখ্যক খাতার প্রথম পাতায় লেখা । দুটি সময়ের কথা উল্লেখ আছে। এ খাতায় ২০-এর অধিক কবিতা আছে যার মধ্যে উপরিউল্লেখিত নতুন কবিতাটির অবস্থান প্রথম দিকে। তাই অনুমান করা সঙ্গত হবে যে কবিতাটি মে ১৯৪৬-তে রচিত। এ সময় জীবনানন্দ বরিশালে অবস্থান করছিলেন। তবে আর অল্প কয়েকমাস পর তিনি বি.এম. কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা চ’লে যান।
এই চল্লিশ সংখ্যক খাতায় কয়েকটি কবিতা আছে যেগুলো অনেক আগেই পাঠোদ্ধার ক’রে মুদ্রণ করা হয়েছিল, যেমন “মৃত্যুসাগর সরিয়ে সূর্যে বেঁচে আছি—তোমাকে ধন্যবাদ।” যে কবিতাটি আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম রচনাকালে সেটির প্রথম পংক্তি ছিল : “যাদের আসা যাওয়া সবই অন্ধকারে ফুরিয়ে গেছে আজ—”। পরে জীবনানন্দ কিছুটা পরিবর্তন করলে পংক্তিটি দাঁড়ায় : “যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ অন্ধকারে ফুরিয়ে গেছে আজ—”। কোনো শব্দ বা বাক্যাংশ পরিবর্তন করতে চাইলে জীবনানন্দ তা নিম্নরেখাঙ্কিত ক’রে ওপরে বিকল্প শব্দ বা বাক্যাংশ লিখে রাখতেন; পত্রিকায় পাঠানো বা বইয়ে নেয়ার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন। এ কবিতাটির শেষ পংক্তির আগের পংক্তিতে ‘ভেঙে’ শব্দটির নিচে নিম্নরেখা থাকলেও বিকল্প শব্দ লেখেন নি কবি—হয়তো পরে বসাতেন।
উল্লেখ্য যে, পান্ডুলিপিতে কবিতার শিরোনাম দিতেন না জীবনানন্দ। শিরোনাম লিখতেন পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের জন্য পাঠানোর সময়। এরকম অনামাঙ্কিত কবিতার ক্ষেত্রে আমি প্রথম পংক্তি থেকে শিরোনাম নির্ধারণের পক্ষে। তাই কবিতার শিরোনাম নির্বাচন করা হলো “যাদের ক্ষমা অক্ষমা সাধ”।
জীবনানন্দের কবিতা পান্ডুলিপি উদ্ধারের সময় সম্পাদককে কিছু কিছু বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ভূমেন্দ্র গুহ স্থির করেছিলেন পান্ডুলিপির পুরোনো বানানের পরিবর্তে আধুনিক রীতি অনুসরণ করবেন। যেমন : জীবনানন্দ কর্তৃক ব্যবহৃত “সূর্য্য” না লিখে “সূর্য” লিখবেন, দুটো আত্মীয় শব্দ পাশাপাশি থাকলে হাইফেন বসিয়ে সংযুক্ত ক’রে দেবেন। যেমন : “আধো মৃত কৃষকের মুখ” না লিখে লিখবেন “আধো-মৃত কৃষকের মুখ”। আমার অভিমত ভিন্ন। তবে প্রতীয়মান হয় ১৯৪৬-এ বানান নিয়ে জীবনানন্দের মত পরিবর্তন হয়েছিল। এ কবিতায় “সূর্য” লিখতে তিনি—“রেফ (র্ )”-এর পর দ্বিত্ব—এই নিয়ম থেকে সরে এসেছেন। প্রথম স্তবকে “নারী” লিখেছেন হ্রস্ব-ই-কার দিয়ে “নারি”—দ্বিতীয় স্তবকে দীর্ঘ-ই-কার ব্যবহার ক’রে লিখেছেন “নারী”। এই পার্থক্য অসর্তকতাপ্রসূত হলেও বলা দরকার যে দীর্ঘকাল ‘নারী’ লিখলেও জীবনানন্দ জীবনের শেষভাগে ‘নারি’ বানানটি ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় জীবনানন্দ ভুল বানান লিখেছেন এরকম নজীর কবিতার খাতাগুলোতে দৃষ্টিগোচর হয় নি। বানান সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন।
যতি চিহ্নের ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন ঢের। প্রচুর “ড্যাশ (—)” ও “সেমিকোলন (;)” ব্যবহার করতেন। বাংলাদেশে সাধারণতঃ আমরা মোস্তফা জব্বার কর্তৃক উদ্ভাবিত “বিজয়” সফটওয়্যার ব্যবহার করি, কিন্তু এতে দীর্ঘ ড্যাশ (—) দেয়ার ব্যবস্থা নেই। সেমিকোলনের আগে অর্ধ স্পেস দেয়ার রীতি রক্ষার সুযোগও “বিজয়”-এ নেই। ফলে জীবনানন্দের যতিচিহ্ন-রীতি যথাযথভাবে ব্যবহার করা দুরূহ।
তিন স্তবকে বিভক্ত ২৪ চব্বিশ পংক্তির এ কবিতায় পাঠক নতুন সুর পেতে পারেন। চিত্রমালার চেয়ে বক্তব্য হ’য়ে উঠেছে কেন্দ্রবিন্দু। ছন্দের মধ্যেও নতুন ধ্বনিবৈচিত্র্য রয়েছে। ১৯৪৪-১৯৫৪ এই ১০-১২ বৎসরে জীবনানন্দের কবিতায় নতুন কাব্যভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। এ কবিতাটি তার একটি নজীর।