You are currently viewing পাঁচটি প্যারাবল-রফিক জিবরান

পাঁচটি প্যারাবল-রফিক জিবরান

(আধাসিকির মিহিদানা সিরিজ থেকে)

দশচক্ষু পথিকের সাথে

কখনো মহাজ্ঞানীও পথ হারাতে পারেন। কথিত আছে, একদা ঝড়ের কবলে এক দশচক্ষু পথিক পথ হারিয়ে সুর্যডুবি নদীর ধারে জোলা হারু মানিকের গৃহে উপস্থিত হয়। হারুর মন বিচিত্র পথে যাতায়াত করে বিধায় পথিকের সাথে আলাপ জমে ওঠে, সূর্যও ক্রমে ডুবে যায়। হারিকেনের নরম আলোয় কথা চলতে থাকে, চলতেই থাকে যতক্ষণ না ঠোঁট শুকায় তৃষ্ণায়। জোলা অতিথিকে পানীয়শরবত এগিয়ে দেয়, ফাঁকে ফাঁকে একদুলাইন সুর গুনগুন করে। পথিকও নতুন উদ্যমে তার দশচক্ষুর বিবরণ দিতে থাকে। তবে পথিকের বিবরণ শুনতে শুনতে জোলার মনে ক্রমে বিষাদ ও ক্লান্তি ভর করে। ঝড়ের কবলে আটকেপড়া দশচক্ষু পরের দিন বিদায় নিলেও জোলার মনে বিষাদ বাড়তে থাকে, আনন্দ হারিয়ে যায়। তবে এ বিপদে মধুমনতুষি উৎসবে শোনা কয়েকটি লাইন তার স্মরণে আসে— আকাশের সীমা নাই, মন কেনো বাঁধো হায়! মন হোক দেহের নিরাঞ্জনা। নিখিলের বনে বনে গেঁথে দিই বুনোফুল, তুলে আনি আনন্দভাবনা। অনড়তায় চক্ষুও হয়তো মানুষকে অন্ধ করে, বন্দী করে খাঁচায়। জোলা নিজেকে প্রশ্ন করে— আনন্দ না জাগিলে প্রাণে, কি করিব হিয়া, আমার জ্ঞানচক্ষু দিয়া?

 

একটি তৃণের ত্রিকালভ্রমণ

বটবৃক্ষ নীরবে কাঁদে। একান্ত বিষাদ, অজানা তৃষ্ণা অথবা শরীর ও মরমের অচেনা ব্যথায়— এ ধারণা প্রচলিত বৃক্ষ, পঙ্খি, পিঁপড়া ও মৌমাছি সমাজে। বটবৃক্ষের কান্নার বিষয়টি মনুষ্য জাতির কাছে প্রায় অজ্ঞাত যদিও তার ছায়ায় মানুষ আশ্রয় নেয়, গান গায়, কেউ কেউ অনন্তলোকের সাধনাও করে। কথিত আছে একটি তৃণ পরমের কাছে প্রার্থনা জানায় তাকে যেন বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। পরম তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন একটি শর্তে। শর্তে রাজি হয়ে তৃণ ক্রমে বড় হতে হতে আসমানে প্রসারিত হলে পরমের দেয়া শর্ত, অনেকের মত সেও ভুলে যায় । তৃণের মনে ও দেহে অহংকারের শুড়, জিহ্বা ও শাখাপ্রশাখা জন্মায়— নিজেকে সবার উপরে ভাবতে থাকে, আকারে ছোট সকলকে তার বন্দনা করতে বলে। ক্রমে অহমের অন্ধকারে নিজের জন্মদাগও মুছে ফেলে। বটবৃক্ষরূপী তৃণের এরূপ আচরণে বৃক্ষ ও পক্ষীকূল ব্যথিত হয়— মৌমাছি ও পিঁপড়ারা তার শাখায় আসা বন্ধ করে দেয়। পক্ষীকূল শপথ নেয় বটবৃক্ষের কোনো ফল কেউ ছোঁবে না। ফুলে কেউ গুনগুন করতে আসে না, ফল ঝরে পড়ে, পথিকেরা তার ছায়ায় বসতে ভুলে যায়, মধুর সুরও আর ভেসে আসে না। বটবৃক্ষের মনে একাকীত্বের আশংকা, ভয় এবং আতঙ্কের পাথর চেপে বসে। নিজের ছায়াকেই ভয় পেতে শুরু করে, নিজের শরীরই খুন করতে চায় তাকে! ক্রমে সে নিজের অন্ধত্বকে দেখতে শুরু করে। শুরু হয় নিজের প্রকৃতভূতকে ফিরে পাওয়ার সাধনা। পিঁপড়া, বৃক্ষ, পক্ষী এবং মৌমাছিদের কাছে নত হয়। নিরন্তর ক্ষমা প্রার্থনা আর শত বছরের নির্জন ধ্যান থেকে সে বুঝতে পারে— বড় হওয়ার বাসনা মনে জেগেছিল তুলনার ভ্রান্তি থেকে। সকল প্রাণই অনন্য সুন্দর। বটবৃক্ষ এখন তৃণ হওয়ার সাধনা করে, নিজের শরীরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চায়। নিজেকে বলে — কিছুই হয় না কখনো কেউ অপ্রত্যক্ষের সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো ছাড়া।

 

অনেকান্ত প্রেমের বাঁশি

টিয়াদুরের কুহেলিকা ও চৌদ্দভূজের ধাঁধা পেরিয়ে আধাসিকি মাচান থেকে উঠে দাঁড়ায়। টুনটুনির সুর, পাতাদের কম্পন, সোনালী প্রান্তরের নিশ্চিতি ও অভ্যস্ত অলসতার মায়া ঠেলে পা বাড়ায় অনেকান্ত মোড়ের দিকে— মন মজে সিন্ধুর বিন্দুতে, চোখ খোঁজে অদেখা আলো, দেহ চায় শরীরী কামনা, চিত্ত শোনে বহুপথি প্রেমের বাঁশি! আধাসিকি অন্যএক পরমের কথা ভাবে— অনন্য ও অনিশেষ, কল্পনা ও বাস্তবের অলিগলিতে ক্রমাগত বেঁকে যাওয়া— সরল ও জটিল যার সৌন্দর্যশরীর! হাঁটতে হাঁটতে ভাবে— ফিরে আসে সব পাখি, হারানো গান, প্রিয়মুখ, বন্ধুত্ব, বাঁশির সুর, ছুঁড়ে দেয়া চুম্বন, দেহ ও মনের সব কানার হাটবাজার! চুয়ানিতে চুর হয়ে সে গান ধরে— কে কাহারে ভজে রে মন, কে পায় তাহারে? আধাসিকি পথে হাঁটে পথের ধূলায়— মজে একটা সিকি জমলে পরে আরেক সিকির খোঁজে— পথে পাওয়া পথের সিকি পথেই পড়ে থাকে।

(‘টিয়াদুর’ ইচক দুয়েন্দে কথাসাহিত্যিক রচিত একটি মহাগপ্প)।

 

অমৃত ভাণ্ডারের খোঁজে

কথিত আছে, অমৃতের ভান্ডার সর্বদা দেবতাদের দখলে ছিল না। দেবতাদের প্রতিপক্ষ অসুররাও (ভাষান্তরে পৃথিবীর সন্তান) অমৃতের স্বাদ পেয়েছে, যে কারণে পরম্পরায় কিছু মানুষ এর ছিটেফোঁটায় পাগল বা দিওয়ানা হয়ে নানাবিধ শিল্পকর্ম করে থাকে। তবে দেবলোকের প্রতিনিধি দেবীমোহিনী তাঁর রূপের জাল বিছিয়ে এখনো সরলমনা প্রাণীদের ধোঁকা দিতে দ্বিধা করেন না। তবে দেবীমোহিনীর রূপের ছটায় কেউ কেউ বেপথু হলেও দেবতাদের চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয় না, কেননা, অমৃতের স্বাদ জানা থাকায় শিল্পীর সৃষ্টিকর্ম পাগলদশার দৃষ্টান্ত হয়ে স্বর্গের সময়চক্রের বাইরে নৃত্য করতে থাকে। এ কারণে মনে হয়, শিল্প এক চূড়ান্ত পাগলামির প্রকাশ— কেবল মানবমনের পক্ষেই যার রস আস্বাদন সম্ভব।

 

ইস্ক্রুঢিলা রাজকুমার

শহরের সব অলিগলি, পথশিশু, সাধু ও চোরেরা তাকে এক নামে চিনতো। রাস্তার কুকুরেরাও তার সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তো আদর ও প্রশ্রয়ের আশায়। ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক, কবিযশপ্রার্থী তরুণের দল থেকে শুরু করে সমাজবিপ্লবের পথে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত যাত্রীরাও তার সাথে কথা বলতে ভীড় করতো রান্তার মোড়ে, নদীর ধারে, চায়ের দোকানে…। তার ছিল বৃক্ষের মতোন শোনার কান, ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষের কথা শোনার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছিল। তবু সকলের কাছেই সে ছিল ইস্ক্রুঢিলা। কেননা তার কথাগুলি সব সময় মনে হতো যুক্তহীন— অস্পষ্ট, আধাবোল ও অসম্পূর্ণ, চরম অসংলগ্নতা। এক অনন্য বিশৃঙ্খলা! সে ছিল এক মস্ত ধাঁধা। যে কোনো গৃহে তাকে স্বাগত জানানো হতো। আর সে-ই ছিল নগরীর একমাত্র স্বঘোষিত রাজকুমার। আমরা প্রকৃত সত্য জানি না, হয়তো প্রত্যেকেই তার ভেতর কিছু না কিছু প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম, খুব চেনা ও আপন— আইন, নৈতিকতা বা যুক্তির ধূলায় চাপা পড়ে থাকা কোনো সত্তা!