পহেলা বৈশাখ ও বাঙালী জাতিসত্তা
আলী সিদ্দিকী
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ এলে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রায় আওয়ামী ছাত্রলীগ কর্মীদের মেয়েদের উপর হামলা ও বর্বোরচিত শ্লীলতাহানি করার দৃশ্যটি আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভিডিও ফুটেজ দেখার পরও অপরাধীদের শনাক্ত করতে না পারার যে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা জাতি দেখেছে- ক্ষমতাবলে যতোই এই ঘায়ের উপর প্রলেপ দেয়া হোক না কেন, সময়ের পাতায় তা অক্ষয় হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনার ”ইলিশ-পান্তা খেলেই বাঙালী হওয়া যায় না” উক্তি, আওয়ামী ওলামা লীগের “মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুয়ানী উৎসব” ঘোষণা এবং ছাত্রলীগের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহনকারী নারীদের শ্লীলতাহানি করার ঔদ্ধত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। দঙ্গলবাজদের স্পর্ধা তখুনি সীমাহীন হয়ে ওঠে যখন তাদের মাষ্টার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়।
বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতিকে আঘাত করার অপপ্রয়াস নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে (দ্বিজাতি তত্ত্ব- হিন্দুজাতি ও মুসলিম জাতি। যা অবৈজ্ঞানিক ও জবরদস্তিমূলক। ধর্মভিত্তিতে জাতি নয়, সম্প্রদায় হয়। ) বাঙালী জাতিকে বিভক্ত করে বিজাতীয় পাঞ্জাবী, সিন্ধি ও বেলুচদের অধীনস্থ করে দেয়া হয়। আর তখন থেকেই বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উপর নানামুখী আক্রমণ শুরু হয়। উর্দু হরফে বাংলা লেখা, রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করা, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা, স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমকে সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষমূলক করে তোলাসহ বিভিন্নভাবে বাঙালী জাতিসত্তার উপর আঘাত নেমে আসে। পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলামীর মতো তৎকালীন মুসলিম আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও পাকিস্তানীদের অনুসরণ করতো। কিন্তু মাতৃভাষার অধিকার, বাঙালীর ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সত্তা রক্ষার্থে গড়ে উঠা আন্দোলনে এবং দেশব্যাপী জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগৃতি রাজনীতিতে মেরুকরণ নিয়ে আসে।
পশ্চিম পাকিস্তানী ভূস্বামী প্রভাবিত ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী জাগরণের ভেতর নিজেদের ভবিষ্যত দেখতে পায়। তারা ভোল পালটে আওয়ামী লীগ নামধারণ করে এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদী প্রপঞ্চকে রাজনীতির পুঁজিতে পরিণত করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সামগ্রিকভাবে বাঙালী জনমানসে জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফূরণ ঘটে তা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাবে সূচিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্রোতধারায় যুক্ত হয়ে যায়। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশে দেশে বেগবান হওয়া উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। প্রথম থেকেই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ও স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে ছিলো পূর্ববাংলার বামপ্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহ। ভাষা আন্দোলনে তাদের সক্রিয়তা ছিলো প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের পাতিবুর্জোয়া ও উঠতি পুঁজিপতিদের দল দ্রুতই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল্ধারায় চলে আসে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো জনপ্রিয় শ্লোগানগুলোকে তাদের মেনিফেস্টোভুক্ত করে নিজেদের গ্রহনযোগ্য করে তোলে। তৎকালীন প্রভাবশালী কমিউনিস্ট পার্টি দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানী প্রায়উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের নামে মৌলিকভাবে হটকারী সিদ্ধান্তের কারণে মুসলিম আওয়ামী লীগ ভোল পালটে দ্রুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল করতে সক্ষম হয়েছিলো।
ফলশ্রুতিতে চুয়ান্ন সালের নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মূলতঃ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে ছিলো না। লক্ষ্য ছিলো, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী দল হিসেবে সর্বপাকিস্তানী সরকারের নেতৃত্ব দেয়া। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও ভূস্বামীরা সামরিক বাহিনীর সাথে আঁতাত করে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে অপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়ে যায় এবং অপ্রস্তুত বেসামরিক মানুষ পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে বেশুমার হত্যার শিকার হয়। সামগ্রিক জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ হলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ এককভাবে নিজেদের দখলে রেখে দেয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ যখন ক্রমশঃ দীর্ঘায়িত জনযুদ্ধে পরিণত হচ্ছিলো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছিলো মুক্তিযুদ্ধের উপর, তখন আওয়ামী পাতিবুর্জোয়া নেতৃত্ব দ্রুত যুদ্ধের সমাপ্তি টানার সিদ্ধান্ত নেয়। ত্রিশলক্ষ প্রাণ ও দুইলক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামক এক রক্তাক্ত সূর্য।
হাজার বছরের ইতিহাসে একটি জাতিরাষ্ট্র বাঙালী জাতির এক অনন্য অর্জন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ হয়ে ওঠে নতুন কুরুক্ষেত্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে প্রথমেই চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ যারা মূলতঃ আওয়ামী লীগভুক্ত ছিলো। ক্ষমতা বঞ্চিত হয়ে তারা “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের” শ্লোগান নিয়ে গণযুদ্ধের ডাক দেয়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে প্রচুর তরুণ প্রাণ ঝরে যায় অকালে এবং দেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির তৎপরতা বেড়ে যায়। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নটি মুখ থুবড়ে পড়লো।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে ঠেলতে ঠেলতে পাকিস্তানী ভাবধারার স্রোতে ফেলে দিলো। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মূলস্তম্ভের বিকৃতি ঘটানো হলো ইচ্ছাকৃতভাবে। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো আস্তাকুঁড়ে। স্বাধীনতাবিরোধীরা দখল করে রাষ্ট্রক্ষমতা, বাংলাদেশ পরিণত হয় এক ধর্মরাষ্ট্রে। আঘাতের পর আঘাত করা হলো বাঙালী জাতিসত্তার উপর, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর, বিকৃত করে ফেলা হলো রক্তমাখা সংবিধান।
আওয়ামী লীগ বরাবরই ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় বাঙালী জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। সোচ্চার হয়েছে তেয়াত্তরের সংবিধান পুনরুদ্ধারে, লড়াই করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে সাথে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আর এই যৌথ লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে। বাঙালী জাতি পঁচাত্তরে মুখ থুবড়ে পড়া স্বপ্নকে নিজেদের ভেতর পুনর্জাগরণ ঘটায় এবং সুতীব্র আকাঙ্খা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে জাতিসত্তার আলোকে ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশ গড়ে তোলার।
কিন্তু ক্রমশঃ মানুষের চোখ ছানাবড়া হতে শুরু করলো, ভাঁজপড়া শুরু হলো কপালে, মনের ভেতর ঘাঁই মারতে লাগলো সন্দেহ। প্রথম বড়ো ধাক্কাটি এলো, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখার মাধ্যমে। স্বৈরাচারী এরশাদ সংযুক্ত রাষ্ট্রধর্ম আওয়ামী লীগ বাতিল করবে (এমন প্রতিশ্রুতিও আওয়ামী লীগ দিয়েছিলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে) এটা ছিলো সার্বজনীন প্রত্যাশা। কিন্তু তাতে পানি ঢেলে দেয়া হলো। জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী ছিলো দ্বিতীয় প্রত্যাশা। সেটা নিয়ে নানামুখী ধুম্রজাল রচনা করা হলো। মুখরক্ষার্থে কতিপয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হলেও স্বজনপ্রীতির কারণে দাগী যুদ্ধাপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং অপর ধর্মান্ধ দল হেফাজতের সাথে আঁতাত করে দেশকে মদিনা সনদের আলোকে পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহন করে। পাঠ্যক্রমকে ধর্মীয়করণ করে, ওলাম লীগ দিয়ে নারীবিরোধী ফতোয়া দেয়ায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসা নির্যাতনে চোখ বন্ধ করে রাখে, বাউলদের উপর নির্যাতনে নির্বিকার হয়ে থাকে, ৫৭ ধারায় নাগরিক অধিকারে তালা লাগায়, ধর্মীয় কূপমুন্ডকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশব্যাপী উন্মত্ততা সৃষ্টিতে নীরবে ইন্ধন দেয়, বিজ্ঞান শিক্ষককে হেনস্থা করার জন্য বন্দী করে রাখা হয়, ইত্যাদি আওয়ামী লীগের বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তির পরিচয়কে যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তাছাড়া দেশকে পাকাপোক্ত গণতান্ত্রিক শাসন উপহার দেয়ার পরিবর্তে বিনানির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সিভিল স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার পরিবর্তে প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তোলা হচ্ছে মৌলবাদের চর্চাকেন্দ্র। আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা সম্প্রসারনের পরিবর্তে পশ্চাদমুখী ধর্মশিক্ষার অন্ধকার গহবরে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধারক হিসেবে বাঙালী জাতি যে রাজনৈতিক দলকে সুদীর্ঘকাল বিশ্বাস করে এসেছে, আস্থা রেখেছে, দেশের-জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে বিনা বিচারে-সেই আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে বাঙালী জাতিসত্তার পরিচর্যার পরিবর্তে বায়ান্ন ও একাত্তরের শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আরবীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে অবাধ করে দিয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার ও থাকার জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধকে – বাঙালী জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করেছে কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে বেঈমানি করেছে। তারা পাকিস্তানামলের মুসলিম আওয়ামী লীগের চরিত্রধারণ করে ভেতর থেকে বাঙালী জাতিসত্তার উপাদান বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় ব্রতী হয়েছে। তারা এখন ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আস্থায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় এবং বাংলাদেশকে একটি আরবীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
এই মুসলিম আওয়ামী লীগের কাছে বাঙালী জাতির এখন আর কোনো প্রত্যাশা থাকতে পারে না এবং আওয়ামী লীগেরও বাঙালী জাতিকে আর কিছুই দেবার ক্ষমতা নেই। বাঙালিয়ানা চর্চা এখন তাদের শুধুই লোক দেখানো। জাতীয়তাবাদের খোলসে আওয়ামী লীগ এখন আক্ষরিক অর্থে জাতিদ্রোহীদের গোত্রভুক্ত হয়ে গেছে। জাতিসত্তার অস্তিত্বের জন্য বাঙালী জাতিকে বিকল্প শক্তি খুঁজতে হবে।
কবি ও কথাসাহিত্যিক।