পূর্ব প্রকাশের পর
পলাশ মজুমদার
সকাল থেকে অফিসের কাজে ডুবে আছি। দম ফেলার ফুরসত নেই। এমন সময় অচেনা নম্বর থেকে কল। পাশের জনের কথা বিবেচনায় রেখে সব সময় রিংটোন অফ রাখি। ভাইব্রেশন হচ্ছে। রিসিভ করছি না। আবার কল। তবু ধরছি না। এবার মোবাইল সাইলেন্ট মুডে রাখি। কল বন্ধ নেই। বিরতিহীনভাবে আসছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন—কল ধরছেন না কেন? আপনার সমস্যাটা কী?
নারীকণ্ঠ শুনে চমকে উঠি। কোনো ছেলে এভাবে ফোন দিয়ে এমন প্রশ্ন যদি করত, নির্ঘাত ঝাড়ি দিতাম। শত হলেও আমি তো পুরুষ।
মনে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তৎক্ষণাৎ। মেয়েটি কি আমার পূর্বপরিচিত? যদিও মেয়ে না মহিলা, বুঝতে পারছি না। এমন কণ্ঠস্বর কখনো শুনিনি। কেন জানি মনে হলো, মেয়েটি সুন্দরী হবে। রেগে গেলে সুন্দরী মেয়েদের কণ্ঠস্বর এমন শোনায়।
পুলিশ নয়তো! আজকাল অনেক মেয়ে পুলিশে চাকরি করে। কেউ আবার আমাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করছে নাকি! কেন ফোন করল অচেনা সুন্দরী!
মুহূর্তের মধ্যে সাতপাঁচ অনেক কিছু ভেবে ফেললাম। ভয়ও হচ্ছে একটু। ঘাবড়ে গেলেও সাহস স য় করে পাল্টা প্রশ্ন করি—কে আপনি? কাকে চাচ্ছেন?
আমি আপনাকে চাচ্ছি। মেয়েটির কণ্ঠস্বর তীব্র শোনায় আমার কানে।
আমার মনে হয়, আপনি কোথাও ভুল করছেন। কার কাছে ফোন দিয়েছেন স্পষ্ট করে তার নাম বলুন। নইলে লাইন কেটে দেব। একটু সাহসী হই আমি।
নিশ্চিত হয়েই আমি ফোন করেছি। অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি আপনার ফোন নম্বর। মেয়েটির নিশ্চিন্ত গলার আওয়াজ।
এবার আমার গায়ে ঘাম দেওয়া শুরু হয়। কী করেছি আবার! কেউ কি আমাকে বিপদে ফেলার চক্রান্ত করছে! মেয়েটিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে না তো। নানা চিন্তা ভিড় করে মাথায়।
আপনি কে বলছেন, প্লিজ? নামটা বলুন। অনুনয় আমার কণ্ঠে।
আমি যে হই না কেন, আপনি আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছেন কীভাবে? আপনাকে কে বলেছে আমার জীবনকাহিনি।
মানে? আমার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়।
আপনি এবারের ঈদে ‘শ্রী’তে আমাকে নিয়ে গল্প লেখেননি? পরে সেই গল্পটি আবার ফেসবুকে পোস্ট করেননি?
এতক্ষণে আমি বাস্তব জগতে ফিরে আসি। কত গল্প লিখি। সেসব কত পত্রিকায় ছাপা হয়। কোন পত্রিকায় কোনটা লিখেছি, পরে মনেও থাকে না। এই ঈদে প্রায় পাঁচটি পত্রিকা ও লিটল ম্যাগে গল্প লিখেছিলাম। ভাবতে লাগলাম, ‘শ্রী’তে কোন গল্পটি লিখেছি!
কাকে নিয়ে লিখেছেন গল্পটি? প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ে মেয়েটির কণ্ঠস্বরে।
তার ঝাঁজালো কথায় আমার সংবিৎ ফিরে আসে—এটা আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে; তবে গল্পের সত্তর ভাগই বানানো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের ক্লাসে ‘¯িœগ্ধা’ নামে এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। সে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলত না। পরে লন্ডনে গিয়ে সে পুরোপুরি পাল্টে যায়। আমার এক বন্ধু তার কাহিনি আমাকে বলেছিল।
বিশ্বাস করি না আপনার কথা। আপনি আস্ত একটা মিথ্যুক। সত্যি করে বলুন, আমার কথা আপনাকে কে বলেছে?—এবার মেয়েটির কথাগুলো বেশ বিরক্তিকর শোনায়।
এদিকে পাশের ডেস্কে বসে কাজ করছে সহকর্মী সৌরভ। আমি নিশ্চিত সে এই কথোপকথন শুনছে। সেটা ভেবে মেয়েটিকে অনুরোধ করি, আপনাকে রাতে কল দেব।
কেন? এখন কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করে।
আমি অফিসে আছি। কাজের অনেক চাপ। বেশি কথা বলা যাচ্ছে না। এখন রাখছি। খুব চাপা স্বরে বলি যেন সৌরভ বুঝতে না পারে।
অপর প্রান্ত আমার কথা কিছুতেই শুনতে রাজি নয়। একদম নাছোড়বান্দা দেখছি। উপায়ান্তর না পেয়ে কল কেটে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের সুইস অফ করে দিই।
টেবিলের ওপর অনেকগুলো ফাইল পড়ে আছে। আজকের মধ্যে সব চেক করতে হবে। আগামীকাল জমা দিতে হবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। একটি ফাইল খুলে পড়ার চেষ্টা করি; কিন্তু মন বসাতে পারি না। অস্বস্তির মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করে।
মাত্র তিনটা বাজে। অফিস ছুটি হবে পাঁচটায়। কী করব ভেবে পাই না। সৌরভ আমার উদ্বেগ টের পেয়ে বলে—চলেন দাদা, নিচ থেকে একটু ঘুরে আসি। মনে হচ্ছে আপনি খুব টেনশন করছেন। ঘুরে এলে চাপ কমতে পারে।
সহকর্মী হলেও সৌরভ আমার খুব কাছের মানুষ। বন্ধুর মতো। ভার্সিটিতে ও আমার ডিপার্টমেন্টে পড়ত। সে হিসেবেও জুনিয়র। আমার সঙ্গে ওর রসায়ন বেশ ভালো। ওর কথায় সায় দিয়ে বলি—চলো তাহলে। চা-কফি কিছু খেয়ে একটু হেঁটে আসি।
নামতে নামতে সৌরভ প্রশ্ন করে—কে ফোন দিয়েছে? কোনো সমস্যা হয়নি তো? ফোন পাওয়ার পর আপনার চেহারা এমন ফ্যাকাশে হলো কেন?
দ্বিধা না করে ওকে গল্পটির কথা বলি। গল্পের সঙ্গে এই ফোনের সম্পৃক্ততাবিষয়ক কথাটিও সংক্ষেপে শেয়ার করি।
অবাক হয়ে সৌরভ বলে—গল্পটা আমি পেনসিল পেজে পড়েছি। আমার স্ত্রীও পড়েছে। দারুণ লিখেছেন। আপনাকে প্রশ্ন করব ভেবেও করা হয়নি পাছে আপনি কিছু মনে করেন। এটা কি আসলে সত্য ঘটনা? আমার মনে হয় শতভাগ সত্য।
উত্তর না দিয়ে মনে মনে হাসি। তৎক্ষণাৎ সৌরভ গল্পটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে। একপর্যায়ে সৌরভ বলে, আপনার অনেক গল্প পড়লেও এমন ধাঁচের গল্প আর পড়িনি। বিশেষত যেভাবে শেষ করেছেন। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। ঘণ্টা খানেক কিছু ভাবতে পারিনি। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে অনেক প্রশ্ন। যদি লিখতে পারতাম, গল্পটির শেষ থেকে আমি লিখে ফেলতাম আরেকটি গল্প।
ওর কথায় সায় দিয়ে বলি—জানো, অনেক পাঠক গল্পটির পরবর্তী পর্ব লিখতে অনুরোধ করছেন। কয়েকজনকে কথা দিয়ে বলেছি, চেষ্টা করে দেখব।
কফি খেতে খেতে সৌরভকে বলি—এই প্রসঙ্গ বাদ দাও। ভালো লাগছে না আর। অফিসের বিষয় বা অন্য কোনো কিছু নিয়ে কথা বলো।
কমন সার্ভিস বিভাগের ম্যানেজার আনোয়ার সাহেবের পরকীয়া প্রেমের কথা বলে সৌরভ আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে; কিন্তু আমি ওর কথায় স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে যোগ দিতে ব্যর্থ হই। তবু জোর করে মুখে হাসি ফোটাই।
কিছুতেই সেই ফোনের কথা মাথা থেকে নামাতে পারছি না। আমার সঙ্গে এভাবে কেউ কখনো কথা বলেনি। বারবার মনে হচ্ছে, গল্পটা যেখানে শেষ হয়ে গেল, সেখান থেকে আবার শুরু হতে যাচ্ছে নতুন কোনো গল্প।
গল্পের পরও গল্প থাকে। একটি গল্প জন্ম দিতে পারে আরেকটি গল্পের। কিংবা এক গল্পের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে অন্য গল্পের বীজ।
দুই.
বাসায় ফিরেও মোবাইল অন করি না। কুঁকড়ে থাকি। আমি আসলেই ভিতু। রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। ভ‚তের ভয় আমার তীব্র। বসের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না। শোভা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বিয়ের তিন মাস পরে; ভিতুর সঙ্গে সংসার করবে না বলে। এত দিনে একা একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
চাকরির বাইরে বাকি সময়টুকু লেখালেখি আর বই নিয়ে পড়ে থাকি। আমার চলাফেরা অনেকটা কবি জীবনানন্দ দাশের মতো। লাবণ্য দাশ হয়তো সংসার ছেড়ে যাননি, তবে কবিকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। কেবল কবির নির্লিপ্ততার জন্য। এ যুগের মেয়ে বলে শোভা সব ছেড়ে যেতে পেরেছিল। হয়তো এখন সে অনেক ভালো আছে; সংসার করছে অন্য পুরুষের সঙ্গে। শোভাও আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। শোভা কাউকে দিয়ে ফোনটি করায়নি তো!
ভয়ের কারণে কখনো প্রেম করতে পারিনি। স্কুলজীবনে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম কিশোরী অর্পিতাকে। ভার্সিটিতে চুমকি নামের একটি মেয়ে চার বছর আমার পেছনে লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত সাড়া না পেয়ে ও ধুম করে বিয়ে করে ফেলে মা-বাবার পছন্দের পাত্রকে।
চুমকির কথা মনে হলে এখনো অপরাধবোধ জাগে, ওর প্রতি আমি অবিচার করেছি। বন্ধুদের কাছে শুনেছি, চুমকি বিসিএস দিয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিল। এদিকে আমি হয়েছি সরকারি অফিসের এক কেরানি।
চুমকির কথাও মনে ভাসছে। এই ফোনটা চুমকির নয় তো! ওর সঙ্গে আমি কখনো ফোনে কথা বলিনি। তাই ফোনে ওর কণ্ঠস্বরের সঙ্গেও পরিচিত নই।
হঠাৎ অযাচিত উপদ্রবের আভাস পাচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার শান্তি শেষ করে দেবে এই মেয়ে।
ভয়ে ভয়ে মোবাইলের সুইস অন করতেই খুদে বার্তার ঝড়। রীতিমতো হুমকি। তিনটা বার্তা পড়তে না পড়তেই ওই নম্বর থেকে কল। পরপর তিনবার দেওয়ার পর কল রিসিভ করি। সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ি—ফোন বন্ধ রেখেছেন কেন? আপনার দেখছি আক্কেল জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব। মেয়েদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই?
আপনি যা ভাবছেন তা নয়। অফিসে কাজের অনেক চাপ ছিল। এই মাত্র বাসায় এলাম। এবার বলুন কী বলতে চান। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব নিরাবেগ রাখার চেষ্টা করি।
গল্পটি তো আমার। একটুও এদিক-ওদিক হয়নি। শতভাগ মিলে গেছে। আপনি জানলেন কী করে? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মেয়েটি।
আমি একদম হতভম্ব। কী বলে মেয়েটা? কোনো ভণিতা ছাড়া বলি, গল্পের বেশির ভাগই আমার কল্পনা। সত্যি বলছি, আমার সহপাঠী এক মেয়ের জীবনের কিছু অংশ গল্পটির মধ্যে আরোপ করেছি মাত্র।
না। আমি বিশ্বাস করি না। মেয়েটি খুব উচ্চ স্বরে বলে। অনেকটা চিৎকারের মতো শোনায়।
কোনো ক‚লকিনারা না পেয়ে বলি—আচ্ছা, মানলাম আপনার সব কথা। তো আমি এখন কী করব? সেটা বলুন।
আপনাকে তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সঙ্গে একবার দেখা করবেন।
কীভাবে? কোথায়?
আমার বাসায়—মেয়েটা বলে।
আপনার বাসায় কে কে আছে?—আমি জানতে চাই।
আমি এখন একা থাকি। হাজবেন্ডের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
ওনার নাম কী?
তার নাম ছিল অপূর্ব।
আর আপনার প্রাক্তন প্রেমিক কি শিমুল নামের কেউ? সে কি ডাক্তার ছিল?—প্রশ্ন করি আমি।
একদম।
আমি তো পুরাই তাজ্জব। কী বলব, ভাষা খুঁজে পাই না। কীভাবে এই দজ্জাল মেয়ের হাত থেকে বাঁচব! একটু অনুনয় করে বলি—রাত অনেক হয়ে গেছে। আমার অফিস আছে কাল। রাত জাগলে দিনে কাজ করতে পারি না। এবার ফোনটা রাখি।
প্রশ্নই আসে না। আপনাকে কথা বলতে হবে। তবে ফোন রাখতে পারি এক শর্তে।
কী শর্ত? জানতে চাই আমি।
আগামীকাল আপনাকে আসতে হবে।
শর্তের কথা শুনে আরও ভয় পাই। আজকাল কত ধরনের ঘটনা ঘটছে। যদি বø্যাকমেল করে। আটকে রেখে মুক্তিপণ চায়।
অগত্যা ছাড়া পাওয়ার জন্য সান্ত¡নার সুরে বলি—ঠিক আছে। কখন আসব?
আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায়। ধানমন্ডি চারের একুশ নম্বর বাড়ির ফ্ল্যাট নাম্বার…। আচ্ছা, ঠিকানাটা টেক্সট করে দিচ্ছি। আসছেন তো?
আসছি। দেখা হবে।
তিন.
রাতে দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। বারবার নিজেকে ধিক্কার দিই, কেন এমন গল্প লিখতে গেলাম। আবার ভাবি, গল্প লিখে কোনো ভাষার কোনো লেখক কি কোনো কালে আমার মতো এমন বিপদে পড়েছে!
অকস্মাৎ মনে পড়ে ইংরেজ লেখক উইলিয়াম সমারসেট মমের কথা; তিনি বই লিখে এক নারী পাঠক দ্বারা প্যারিসের ফয়টস্ রেস্টুরেন্টে একরকম নির্যাতিত হয়েছিলেন। ওই নারী নবীন লেখকের সরলতার সুযোগ নিয়েছিল সেখানে।
স্ত্রীকে ধরে রাখতে পারিনি। একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারলাম না। তেমন কোনো যোগ্যতাও আমার নেই। আস্ত একটা অথর্বের জীবন পার করছি।
এপাশ-ওপাশ করতে করতে নানা বিষয়ের সঙ্গে গল্পটার বিভিন্ন দিক নিয়েও ভাবি। আবার কল্পনা করি, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলে কী বলব! কীভাবে রক্ষা পাব তার খপ্পর থেকে! আমি তো কথার পিঠে কথা বলতে পারি না।
কখন ভোর হয়েছে, টের পাইনি। নিচে নেমে ভোরের নরম আলোয় জোরে জোরে হাঁটি। আমি হাই প্রেশারের রোগী। হার্টেও একটু সমস্যা আছে। টেনশন করলে জটিলতা বাড়তে পারে। হাঁটলে অনেকটা উপশম হবে মনে করে রমনা পার্কে কয়েক চক্কর দিই। পার্কের বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবি। মানুষের চলাচল দেখি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বাসায় ফিরি। প্রচÐ খিদে অনুভব করছি। মনে পড়ে, কাল রাতে কিছু খাইনি। অথচ কিছু মুখে দিতেও ইচ্ছে করছে না। কফি খেতে খেতে ফেসবুকে চোখ বুলাই। একজন পাঠিকা ওই গল্প নিয়ে বড় একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সামান্য সমালোচনা করলেও বেশির ভাগই প্রশংসা। অন্য সময় হলে মনটা ভরে যেত। ধন্যবাদ দিতাম। ভালোবাসা জানাতাম। এখন বিরক্ত লাগছে। মুখে একটা তেতো ভাব অনুভব করছি। ফোনটা টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলি। রাগ হচ্ছে গল্পটির ওপর। আমার আজকের সমস্যার মূল তো এই গল্প।
কোনো বন্ধুকে ফোন দিয়ে সহযোগিতা নেব কি না, ভাবি। পরক্ষণে চিন্তাটা উড়িয়ে দিই। কাউকে বিরক্ত করা বোধ হয় ঠিক হবে না। গল্প লিখে বিপদে পড়ার কথা শুনলে হাসবে। ইয়ার্কি করবে। হয়তো বলবে, মেরুদÐহীন লেখক।
চার.
বাসার কাছে আমার অফিস। হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। লেখালেখিতে সময় দেব বলে অফিসের কাছে বাসা নিয়েছি। অফিস শেষে কোনো দিকে যাই না। লেখক মহলেও আমার তেমন সার্কেল নেই। মুখচোরা স্বভাবের বলে সবাই এড়িয়ে চলে। এতে বরং আমার সুবিধা হয়েছে। আড্ডা দিই না বলে অনেক সময় বেঁচে যায়।
অফিসে এসে দেখি, কেউ নেই। ঘড়িতে মাত্র আটটা। এত তাড়াতাড়ি আসার জন্য জিব কাটি। ভয়ে আর উত্তেজনায় আমি যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য।
গতকালের ফাইলগুলো নিয়ে বসি। মনোযোগের অভাবে কাজে ভুল করি। একই লাইন বারবার পড়তে হয়।
দিনের শুরু বসের বকাঝকা দিয়ে। ভুল না করে করব কি! মাথায় তো ঘুরছে কেবল আজকের সন্ধ্যার সম্ভাব্য পরিস্থিতি। কীভাবে সামাল দেব!
শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে দ্পুুরে বাসায় চলে আসি। সামান্য ভাত মুখে দিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করি। কিছুতেই ঘুম আসে না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাই।
সেগুনবাগিচা থেকে ধানমন্ডি যেতে দুই ঘণ্টা তো লাগবে। রাস্তায় যে জ্যাম। যদি দেরি হয়ে যায়। তখন ঠিক কথা শোনাবে। এ রকম ভাবতেই ফোন, আপনি রওনা হয়েছেন তো?
ভয়ে ভয়ে বলি, আমি পথে আছি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়ি—এত মিথ্যা বলেন কীভাবে? আপনি এখনো বাসা থেকেই বের হননি। বাইরে থাকলে গাড়ির আওয়াজ শোনা যেত।
না। মানে বের হচ্ছি আরকি। আমতা আমতা করে বলি আমি।
তাড়াতাড়ি বের হন। আমার সাতটা মানে ঠিক সাতটা। এক মিনিট দেরি হলেও সহ্য করব না। কাটা কাটা কথা মেয়েটার।
প্লিজ আমার কথা শুনুন। আজ না এলে হয় না। পরে কোনো সময় দেখা করব। খুব নরম সুরে কাঁদো কাঁদো গলায় আমি বলি।
আমার কথা পুরোটা শুনেওনি। অপর প্রান্ত সপাট করে লাইন কেটে দেয়।
এমন কণ্ঠে অনুরোধ করলে পাষাণেরও হৃদয় গলে। এই মেয়ে আসলে কে? কেন আমার পেছনে লেগেছে? থানায় যাব নাকি। মোবাইল নম্বরটি পুলিশকে দিয়ে জিডি করলে কেমন হয়। বলব, গল্প লেখার জন্য এক মেয়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে এই নম্বর থেকে। আবার ভাবি, পুলিশ শুনলে নিশ্চিত হাসবে। বলবে, এত ভিতু হলে লেখেন কেন। লেখা বাদ দিয়ে অন্য কাজ করেন। গান করুন। গিটার বাজান। নাটক করেন। নাচেন। কুদেন। যা খুশি তা করেন। লিখতে হলে মেরুদন্ড সোজা রাখতে হয়।
পাঁচ.
ধানমন্ডি এলাকাটা আমার মোটামুটি চেনা। তিন নম্বর রোডে একটা সময় নিয়মিত আসতাম। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। তখন ফরাসি ভাষা শেখার নেশা চেপেছিল। সতীনাথ ভাদুড়ি আমার প্রিয় লেখক। কমলকুমার মজুমদারও। দুজনেই ফরাসি সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাঁরাই আমার ফরাসি শেখার প্রেরণা। মূল ভাষায় ফরাসি সাহিত্য পড়ব এই আশায় ভর্তি হয়েছিলাম আলিয়ঁসে। বছরখানেকের মতো শিখেছিলাম। এত কঠিন ভাষা কেউ শেখে! এমন দুর্বোধ্য আর বিদঘুটে! অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিই।
না শিখতে পারলেও আমার ফরাসি প্রেমটা কিন্তু উবে যায়নি। মনে মনে তখন বলতাম, কোনো ফরাসি রমণী আমার প্রেমে পড়লে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতাম। হায়, সেই ভাগ্য কপালে জোটেনি। হয়তো সেই আশায় ক্যাফেতে বসে থাকতাম। একা একা কফি খেতাম। তা ছাড়া ক্যাফেতে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগত।
সেই পরিচিত স্থানে বসে পরপর দুই কাপ কফি খাই। পাশে একটি ছোট মেয়ে পিয়ানো বাজানো শিখছে। পাশের গ্যালারিতে চলছে ছবি প্রদর্শনী। আমাকে এসবের কিছুই টানছে না। পুরোনো দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করি। সে যেন গত জন্মের ব্যাপার। তখন লেখালেখি করতাম না; কেবল পড়তাম। নির্বিঘ্ন ছিল দিন। পাঠকের নিরুপদ্রব ভ‚মিতে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতাম। লেখক হয়ে এখন কত জ্বালা!
ঘড়িতে প্রায় সন্ধে সাড়ে ছয়টা। ভাবি, মেয়েটিকে অনুরোধ করে বলি এই ক্যাফেতে চলে আসেন; এখানে আমরা প্রাণ খুলে আড্ডা দেব।
এখান থেকে ওই বাড়িটি মাত্র দুই মিনিটের পথ। অনায়াসে আসতে পারে। এই কথা ভেবে কল দিই। একবার দুবার তিনবার।
রিং হচ্ছে; কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না।
আবার কল দিতে বুঝতে পারি নম্বরটি বন্ধ।
তারপর যতবার কল দিই একই কথা আমার কানে আসে। এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মেয়েটি মনে হয় ইচ্ছে করে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে, যদি কল দিয়ে আমি অপারগতা প্রকাশ করি। আবার ভাবি, না গেলে যদি সাতটার পর কল দিয়ে তুলোধুনা শুরু করে। আতঙ্ক গ্রাস করে আমাকে। আরও দশ মিনিট সময় হাতে আছে।
অগত্যা ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাই। বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে। কী যে কী হয় কে জানে! নির্ধারিত ফ্ল্যাটে উঠে কলিং বেল চাপি। কেউ দরজা খোলে না। একবার। দুইবার। তিনবার। এভাবে প্রায় দশ মিনিট কেটে যায়।
ফেরার জন্য লিফটের দিকে এগোতেই দরজাটা ঠাস করে খুলে যায়। চোখ ফিরিয়ে দেখি এক বৃদ্ধা। বয়স কম করে হলেও সত্তর হবে; তবে বয়সের তুলনায় বেশ শক্ত। তিনি জানতে চান—কে আপনি? কার কাছে এসেছেন?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি—এই ফ্ল্যাটে কি স্নিগ্ধা থাকে? ওনাকে একটু ডেকে দিন। উনি আমাকে আসতে বলেছেন।
বৃদ্ধা যেন আকাশ থেকে পড়েন—এখানে তো ¯স্নিগ্ধা নামের কেউ থাকে না।