অমিতা মজুমদার
পরী ও ফাতেমা
ঘরের পাশের আমগাছের ছায়ায় পরীকে বেঁধে রেখেছে হালিম শেখ। যেকোন সময়ে ও বাচ্চা প্রসব করবে। তাই বাড়ি থেকে দূরে কোথাও পরীকে নিয়ে যাচ্ছে না। পরীর এতটুকু অযত্ন হালিম শেখ করতে দেয় না কাউকে। পরীর খাওয়ার দিকেও কড়া নজর তার। তাই ঠিক সময় ধরে খড় বিঁচালি, ভাতের মাড়, আবার ভূষি-খইল খাওয়ায়।
আজো সেরকমই হাতে ধরে ঘাস খাওয়াচ্ছিল। দাওয়ায় বসে ফাতেমা দেখছিল আর ভাবছিল, হালিম শেখ লোকটা একটা নিরীহ পশুকে কত যত্ন করে। সে কি এই কারণে পরীকে ভালো খাওয়ালে পরী বেশি দুধ দেবে, সেই দুধে আরো বেশি পানি মিশিয়ে বেশি টাকা রোজগার করতে পারবে বলে, না-কি সত্যিই সে পরীকে খুব ভালোবাসে?
ফাতেমা তিন মাসের পোয়াতি। বছর পাঁচেক আগে পাশের গায়ে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে আসে ফাতেমা। হালিম শেখ সে বাড়িতে দিন মজুরি করতে গিয়েছিল। পিতৃহীন ফাতেমাকে ফুফু হালিম শেখের সাথে একদিনের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেয়। সেইসময় ফাতেমার বয়স বছর পনেরো হবে হয়তো। মাকেও জানায় না। আর জানালেও মা কী-বা করতে পারত। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকেতো সেই চাচাদের ঘরে কাজের লোক হয়েই থাকতে হচ্ছে। আর ফাতেমাও বয়েস বাড়ার সাথে সাথে চাচাতো ভাইবোনদের ফাইফরমাশ খেটেই দুটো খাবার খেতো।
বছর পনেরোর ফাতেমার তাই ভালোই লেগেছিল বিয়ে হওয়ায়। ভেবেছিল সবার মতো এখন থেকে সেও নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করতে পারবে। চাচীরা সবসময় বলে এটা আমার সংসার, এখানে আমি যা বলব তাই হবে। সে খুশিমনে হালিম শেখের সাথে তার বাড়িতে এসে ওঠে।
বাড়ি বলতে দুই কামরার বাঁশের খুঁটি আর ছনের চালের ঘর একখানা। দড়মার বেড়া দেওয়া। লাগোয়া ছোট্ট একটু রান্নার জায়গা। চারপাশে দু-চারটে ফলের গাছ কিছুটা আড়াল করে রেখেছে বাড়িটাকে।
বছর না ঘুরতেই সেই বাড়িটাকে একেবারে বদলে দিয়েছে ফাতেমা। দিনমজুর হালিম শেখকে দিয়ে একটা গাইবাঁছুর কিনিয়েছে। বাড়ির লাগোয়া যেটুকু ভিটে, উঠান আছে তাতে নানারকম সবজি চাষ করে ফাতেমা। সে-সব সবজি আশেপাশের বাড়িতেই বিক্রি করে ভালো রোজগার হয়। দুজনের সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে। অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমায় ফাতেমা। তা দিয়ে কয়েকজোড়া হাঁস মুরগী কেনে, তার ডিম বিক্রি করে। আবার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে আরো একটু আয় উন্নতি করে। ফাতেমার ইচ্ছা আর একটু টাকা জমাতে পারলে ঘরখানা ঠিক করবে। ছন বদলে টিনের ছাউনি দেবে ঘরের চালায়। অবসরে আবার প্রতিবেশীদের কাঁথা সেলাই করে দেয়। পনেরো বছরের কিশোরী ফাতেমা যেন দুহাত দিয়ে সংসারটাকে আগলে রাখছে।
দেখতে দেখতে কোথা থেকে পাঁচ পাঁচটা বছর গড়িয়ে যায়। এখন ফাতেমা পূর্ণ গৃহিনী তার সংসারে।
সব মিলিয়ে এই পাঁচ বছরে হালিম শেখের সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। টিনের ঘর, গোটা পাঁচেক গরু এখন তার। গাইগুলো রেখে বলদগুলো কোরবানীর হাটে বেঁচে দেয়। আবার কয়েকটা ছাগলও আছে। দিনমজুর হালিম শেখ পুরোদস্তুর স্বচ্ছল গৃহস্থ হয়ে উঠেছে।
হালিম শেখ বেশ খুশি হয় বৌ এর এমন স্বভাব দেখে। সেও আদর যত্নের ত্রুটি করে না। ফাতেমার মাকেও নিয়ে এসেছে এ বাড়িতে। বিপত্তি শুরু হয় ফাতেমা যখন অন্তঃসত্তা হয়। কেন যেন হালিম শেখ সন্তান চায় না। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই হালিম শেখের কেমন একটা বদল চোখে পড়ে ফাতেমার। কারণে অকারণে তাকে গালমন্দ করে। সে খেয়েছে কি খায়নি জানতেও চায় না। প্রথমদিকে গর্ভপাত করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ফাতেমা কিছুতেই রাজী হয় না। এখনতো সবাই জেনে গেছে।
ফাতেমা বুঝতে পারে না হালিম শেখ কি চায়। এতদিনে ঘরে সন্তান আসছে তাতে তো তার খুশি হবার কথা। এখনতো আর তাদের অভাব অনটনও নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আকাশপাতাল ভেবেও কোন কূলকিনারা পায় না ফাতেমা।
তাহলে কি হালিম অন্য কিছু ভাবছে? সন্তান এলে সংসারে খরচ বাড়বে,ফাতেমা আগের মতো ঘরেবাইরে কাজ করতে পারবে না ফলে তাদের আয় উন্নতি কম হবে, এসব ভাবছে? কিন্তু সব স্বামীরাইতো সন্তান চায়। না-কী অন্যকিছু! পরিবারে স্বচ্ছলতা আসার পর হালিম শেখ কেমন বদলে যাচ্ছে। গঞ্জের হাটে যেদিন যায় ফেরে অনেক রাত করে,মাঝে মাঝে ফেরেই না। পরদিন এসে বলে সব জিনিস বেচাকেনা করতে করতে দেরি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে হাটবার ছাড়াও গঞ্জে যায়। পাশের বাড়ির চাচার সাথে প্রায়ই বলতে শোনে গঞ্জে একটা দোকান নেব ভাবছি। ফাতেমা দুই একবার বলতে চেষ্টা করেছে কী দরকার আমরা তো এখন ভালো আছি। কিন্তু ফাতেমার কথা কানে তোলেনি হালিম শেখ। প্রতিবেশিদের দুই একটা কথা কানে আসে কিন্তু গুরুত্ব দেয় না ফাতেমা। অনেকে বলে গরীবের পেটে কী আর ঘি সয় ! হালিমের পকেটে দুইটা পয়সা আসছে,খেটেখুটে সংসারটা দাঁড় করিয়েছে– এখন মাথা ঘুরে গেছে। ফাতেমা ভাবে সত্যিই কি হালিম শেখের অন্য কোথাও মন পড়েছে! নিজের পেটে হাত বুলায় আর মনে মনে বলে,বাপজান তুই দুইন্নাতে আইলেই তোর মুখ দেখলেই তোর বাপের মন আর অন্যদিকে যাইতে পারবে না।
ভাবনার পালে হাওয়া লাগতে লাগতে হঠাৎ ফাতেমা ধড়মড়িয়ে ওঠে। হালিম শেখ এসে কখন দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।কখন থেকে পানি খেতে চাচ্ছি আর তুই আমল দিচ্ছিস না, বলেই হালিম শেখ ফাতেমার চুলের মুঠি ধরে টান দেয়, তাল সামলাতে না পেরে ফাতেমা দাওয়া থেকে উঠানে পড়ে যায়। কিছু বলার আগেই ঘটে যায় ঘটনাটা। ফাতেমা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। মা দৌড়ে আসে। হালিম শেখ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই ফাতেমাকে তুলে নিয়ে শুইয়ে দেয়। হাতেমুখে পানি দেয়, কিন্তু ফাতেমার জ্ঞান ফেরে না। কিছুক্ষণ পরে ফাতেমা চোখ মেলে তাকায়, নিজের চারপাশ দেখে। কেমন সব কিছু অন্যরকম লাগে। টের পায় তার শরীর থেকে কে যেন বেরিয়ে যাচ্ছে উষ্ণ স্রোতধারা হয়ে।
যেন তার কানে কানে ফিস ফিস করে বলছে ,মা এখনো ফাতেমারা আমাদের স্বাভাবিক আগমনের নিরাপত্তা দিতে পারে না।
কারণে অকারণে হারিয়ে যায় আমার মতো অনেকেই।