পরশপাথর
আলী সিদ্দিকী
দিনমানের খরতাপে ধুঁকতে ধুঁকতে ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া আমাদের পৃথিবীটা বিকেলের ছায়া গায়ে মেখে নড়ে উঠল। পশ্বিমাকাশের বিচ্ছুরিত আবীরে রঞ্জিত মৃতপ্রায় গাছের পাতাগুলো নেচে উঠল বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে। রৌদ্রশাসনে বন্দীপ্রায় শিশুরদল ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। ছায়াসন্ধানী পাখীরা শেষ বিকেলে গেয়ে উঠল দিনের বাদপড়া গান। চরাচর যেন জেগে উঠল হঠাৎ করে। মানুষের কলবরে গম গম করে উঠল শ্বাসরূদ্ধ সময়। আমার ভেতরের আমিও জেগে উঠল আড়মোড়া ভেঙ্গে। সে আমাকে নিয়ে গেল কলঘরে, আমাকে দিয়ে হাতমুখ ধোয়াল, ঘরে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আমার মুখোমুখী করাল। আলনা থেকে প্যান্ট নামিয়ে গলিয়ে দিল পা, গায়ে চড়িয়ে দিল চিরকেলে পাঞ্জাবী, পায়ে গলিয়ে দিল ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল জোড়া। চুপসে থাকা মানিব্যািগটা পেছনের পকেটে চালান করিয়ে, ক্যাসিও ঘড়িটা বামহাতে পরিয়ে টেনে নিয়ে এল ঘরের বাইরে। উঠোনে আম আর নারকেল গাছ জোড়ার নীচে বসে কুলোয় চাল বাছতে বাছতে তেরচা চোখে তাকাল মা। সেই চোখে রাজ্যের উদাসীনতা, সেখানে প্রখর নৈরাশ্য। মা’র সেই দৃষ্টি যেন দেখল না আমাকে, দেখল বুঝি আমার কায়ার ছায়াকে। তার দৃষ্টি অনুসুরণ করে আমিও খুঁজি আমাকে চারপাশ, কিছুই দেখি না, কাউকে দেখিনা। শুধু দেখতে পেলাম আমার আমি প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে পেরিয়ে আসছি উঠোন, পেরুচ্ছি ধুলোময় রাস্তা। পায়ের তলে পড়ে কঁকিয়ে উঠছে ঝরাপাতা, পদভারে ছিটকে যাচ্ছে শুকনো ধুলো। মনে হলো পাশ দিয়ে মুখচোখ বিকৃত করে কোন চেনামুখ চলে গেল। হাতের সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলার পর ভেতরের আমি ঘাড় ফিরে দেখি ক্রোধান্বিত চোখে থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাবা। আমি দ্রুত পালাতে চাইলাম। সে আমার রাশ টেনে উদ্যত ভঙ্গীতে আমাকে হাটিয়ে নিয়ে এলো বড়ো রাস্তায়।
শীর্ণকায় পরিচিত মানুষগুলো কেউ বিনীত কন্ঠে, কেউবা আমুদে স্বরে আবার সমবয়সী দুয়েকজন অন্তরঙ্গভাবে কিছু কথা যেন বলতে চাইল কিংবা বলল, আমি কিছুই শুনলাম না। যেন দেখতে পেলাম না কিছুই। আমার চোখে সেঁটে আছে ভেতরের চোখ। চেতনায় ভর করে আছে অশরীরী অন্ধশক্তি। আমার দীন বেশভূষা, গনগনে হতাশায় পোড়ো মুখ, রোদজ্বলা অবিন্যস্ত লালচে চুল আর আবেশায়িত চোখ জোড়া বুঝি সবার দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছে বেখাপ্পা। ভেতরের আমি তড়িগড়ি পেরোতে চাই চেনা মানুষ, পথঘাট, মাবুর পড়ো পড়ো চা দোকান, দত্তের ডিসপেনসারি, রাজুর সেলুন, হতশ্রী জনপদের আলো বাতাস। সবাই যেন দেখছে আমাকে, ফিসফিসিয়ে বলছে আমার কথা, হয়তো আফসোস করছে কেউ, কেউবা করছে সমালোচনা। আমি পালাতে চাইলাম।
রাস্তায় গাড়ীর তীব্র হর্ণ। মানুষের বেপরোয়া হট্টগোল। আমি হাঁটতে চাইলাম কিছুদূর। খুঁজে পেতে চাইলাম নিরিবিলি জায়গা। সে চিমটি কাটে আমার হাতে, টেনে নিয়ে টেম্পুষ্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রাখে। কি লজ্জা, কি লজ্জা! এই পরিচিত পরিমন্ডলে কি করে আমি বাদুড়ঝোলা হই টেম্পুতে? সবাই তো চোখ ঠাটাবে, কেউ হাসবে ঠোঁট চিকন করে। আমি রিক্সাকে থামাতে চাইলে সে আমাকে থামাল উল্টো। হাতটা ছোঁয়াল রুগ্ন মানিব্যাগে। আমার আমি কুঁকড়ে গেলাম পলকে। বাবার রাগী মুখ, মা’র বিষন্ন চোখজোড়া ভাবতে চাইলাম। ভাবতে চাইলাম কিছু স্বপ্ন, কিছু আশার কথা। সে আমাকে দিলো না। মাথা নিচু করে কাকের ভঙ্গীতে সে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল টেম্পুর পেছনে। দাঁড়কাকের মত গলাটা খাড়া করিয়ে করুণা, বিষ্ময়, বিদ্রুপমাখা হাজারো চোখের সামনে সে আমাকে যেন নেংটা করে তাড়িয়ে নিচ্ছে। বাইরের আমি মরমে মরে গেলেও ভেতরের আমি হেসে উঠলাম কলকলিয়ে। মনে মনে খিস্তি করলাম ভেতরের আমাকে, দেখ শালা, এই তো আমি। ঝুলে ঝুলেই তো বেঁচে আছি। ঝুলছি টেম্পুতে, ঝুলছি ঘৃণা, অবহেলা, অনাদর আর বিষময় অপমানের রজ্জুতে। বাপ করে ড্রাইভারী আমি করি পোদ্দারি। মেগে মেগে বিএ করেছি যেন জাতোদ্ধার করেছি। ভাবখানা এই, যেন রাজ্যজয় করেছি, ফুঃ জোটে না পিয়নের চাকরী, বাইরে দেখাই বাবুগিরি। এখানে খামচাই, ওখানে ধান্ধা খুঁজি, জোটে না কোথাও কিছু। নেই, নেই কিছু নেই। কামড়া কামড়ি, কাড়াকাড়ি, ধাক্কাধাক্কি কাঁহাতক সওয়া যায়? কোথাও জিততে পারি না, টিকতে পারি না। শরীরে তো বয়েসকালের জোরও নেই। ঠাঁট দিয়ে কতক্ষন টেকা যায়? তাইতো ঝুলে আছি, ঝুলতে ঝুলতে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাবো গহবরে, উচ্ছন্নে যাবো, পঁচে যাবো গলে যাবো, কার বাপের কি, এ্যাঁ।
বন্ধ চোখ খুলে দেখি শহরে আলো জ্বলে উঠেছে ঝলমলিয়ে। নিয়ন সাইনগুলো হাতছানি দিচ্ছে.. ডানো পরিবার, মাছের রাজা ইলিশ বাতির রাজা ফিলিপস্, আমরা সবাই রাজা। রাজা! কে রাজা, কিসের রাজা, কেন রাজা, রাজার কি কাজ, কে বানায় এসব রাজাগজা? কেন বানায় ? সব শালাইতো খাচ্ছে লুটেপুটে, চেটেপুটে। পাবলিক শালা বাঁচলো কি মরলো কে ভাবে? সবশালা গলায় দেশপ্রেমে গদ গদ, জনগণই ক্ষমতার উৎস! শালারা জনগণকে চিড়েচিবড়ে করে ফেলছে, পরনের ত্যানা কেড়ে নিচ্ছে, বলে কিনা দেশ ও জাতির সেবায় আমরা অতন্দ্র প্রহরী! সব বাটপাড়, জোচ্চোর, চশমখোর, লুচ্চা। ওকি! ওরা কারা ? এমন হাতপা ছুঁড়ছে কেন তারা? একদল মানুষ, লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই, শ্লোগান দিয়ে রাস্তা কাঁপিয়ে, আগেপিছে পুলিশ নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে চলে গেলো। আমার ভীষণ হাসি পেলো।
ভেতরের আমাকে বললাম, কি বুঝলে ?
ধান্ধা বুঝলে, ধান্ধা- ভেতরের আমি কলকলিয়ে উঠলো।
কিসের ধান্ধা, কেমন ধান্ধা? বাইরের আমি বেকুব বনে যাই, ওরাতো প্রতিবাদ করছে-
তোমার মুন্ডু, ভেতরের আমি ধমক দিয়ে ওঠে, বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে তো এমন ফ্যা ফ্যা করতে না।
নির্বুদ্ধিতার খোঁচা খেয়ে অপমানিত বোধ করলাম। তাই চুপচাপ একটা সিগারেট ধরিয়ে কোনদিকে যাবো ভাবতে চাইলাম। হয়েছে আর ভাবতে হবে না, কানের কাছে ভেতরের আমি বিদ্রুপ করে উঠলো, যেনো নিজে কতো সিদ্ধান্ত নিতে পারো আর কি!
লজ্জায় অধোবদন হলাম।
হয়েছে হয়েছে, সে আবার খোঁচায় আমাকে, এখন একটু আধো অন্ধকারের ফুটপাতের দিতে তাকাও।
আদিষ্ট হয়ে অন্ধকারময় ফুটপাতের দিকে তাকালাম। সেখানে নগর নন্দিনীদের হাট। নিত্যদিনই তো দেখি। নতুন তো কিছু নেই। দিনের বেলায় ওদের দিকে তাকালে মনে হয় সভ্যতা উলঙ্গ হয়ে ব্যঙ্গ করছে। কঙ্কালময় দেহগুলো রাতের রহস্যে লোভনীয় হয়ে ওঠে হায়েনাদের। এখন ওরা দল বেঁধে খদ্দের ভাগানোর ফিকির করছে। তাকালেই খামচে ধরবে। তারপরও কৌতুকবশে ওদিকে তাকিয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলাম। পথবাতির আলোয় ফুটপাতে দাঁতাল শুয়োরের মত দুজন লোক একমেয়ের সাথে ধস্তাধস্তি করছে। আমি বুঝতে পারলাম পা থেকে মাথার দিকে এক অগ্নিস্রোত সাঁ সাঁ উঠে আসছে। আমি হাত গুটিয়ে পা বাড়াতেই ভেতরের আমি খামচে ধরলো হাত।
হয়েছে বীরত্ব দেখাতে হবে না, এখন চলো।
সে আমাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো।
কোথায় যাচ্ছি? আমি রুখতে চাইলাম তাকে।
কোথাও না আবার সবখানে, হেঁয়ালী করে সে, অদৃশ্য রজ্জু বেঁধে সে আমায় টানতে লাগল। ফুটপাতে মানুষের ভীষণ ভিড়। পড়িমড়ি ছুটছে কেউ, কেউবা নগরীর কোলাহলে বেদিশা, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে উঠতি বয়সের গুলতানি, ছুটন্ত বাস টেক্সী, রিক্সা টেম্পুর কানফাটা চিৎকার আমাকে বিপন্ন করে তুলছে। পা হড়কে একবার পড়ে গেলাম ফুটপাত থেকে। সাথে সাথে খিল খিল করে চলমান দুই আধুনিকা হেসে উঠল। যেন ঝর্ণাধারা। যেন সুর ঝঙ্কার। আহ্! এমন হাসি তো পরী হাসতো। হাসতে হাসতে কাঁদতো, কাঁদতে কাঁদতে হাসতো। কারনে অকারনে। বুকের ভেতর থেকে পরীর এপিসোডগুলো উঠে এসে চোখের তারা দখল করে নিলো। সেই কবে, কতোকাল আগে পরী আমার সুম্ ভেঙ্গে দিয়েছে। আরবী পড়ার মক্তবের দাওয়ায়, বুড়ো মৌলভীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পরী আমায় যুবক করে তোলার সবক দিলো। সেই ছোট্টবেলায় নেশা ধরিয়ে দিলো পরী। তাদের পুকুড় পাড়ে, পেছনের বাগানে, ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে তাদের ঘরে কুসুম ঘ্রানে উম্মত্ত করে দিলো। দলবেঁেধ ছেলেদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অস্থিরতাকে সে নিপুন কৌশলে শান্ত করে দিলো। নেশা নেশা নেশা। প্রতিদিন প্রতিরাত। সবার চোখ এড়িয়ে। যৌনতার পাঠে সিদ্ধপুরুষ করে দিলো আমাকে। কতদিন এমন উম্মাদনায় মেতে ছিলাম আমি? ঠিক মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে পরী হয়ে গেলো অপ্সরী। চোখ ফেরানো যায় না। আড়েঠারে অনেকে বাড়াতে চায় হাত কিšত্ত আমার উগ্রতায় দমে যায় তারা। আমার পরী, পরী আমার। একদিন ঝট করে বিয়ে হয়ে গেলো পরীর। কিছু বুঝে ওঠার আগে প্রথম প্রেম হারিয়ে গেলো অকস্মাৎ। দিশেহারা, উম্মাদ আমি, আরো উগ্র দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠলাম। জ্বালা বুকে, জ্বালা রক্তে, জ্বালা পরাজয়ে। আমি প্রতিহত করতে চাইলাম, রুখে দাঁড়াতে চাইলাম গোঁয়ারের মতো। পরী দিলো না।
কিছু করবে না তুমি, কিছু বলবে না, মাটির দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বললো পরী।
কেন? আমি বিস্মিত, রাগাম্বিত।
তোমাকে বড়ো হতে হবে, অনেক বড়ো, আমার জন্যে জীবন নষ্ট কোরো না।
তাহলে সব মিথ্যে ছিলো, সব অভিনয়?
কিছুই মিথ্যে নয়, তুমি সত্যি হয়ে সূর্য হয়ে বেঁচে থাকবে আমার কাছে আজীবন।
ফুঃ ! পরী গেলো তার নতুন জীবনে। আমাকে করে গেলো নেশাসক্ত। রক্তের নেশা, শরীরের নেশা। বাল্যের রক্তে প্রবিষ্ট তারুণ্যের মাদকতায় আমাকে আমূল বদলে দিয়ে গেলো। বাইরে বাইরে হয়ে গেলাম প্রচন্ড চাপা, ভেতরে অহর্নিশ নেশায় উম্মত্ত। হয়ে উঠলাম পাকা অভিনেতা। শুধু শরীরের জন্যে, যৌনতার জন্যে। যখন যেদিকে সুযোগ মেলে বাড়িয়ে দিলাম হাত। আশ্চর্য পরিবর্তন এলো জীবনে। একে একে সেতারা এলো, এলো দ্যুতি, সুমী, জরু, শিখা। এমনকি বিবাহিতাদের কেউ কেউ (ওদের নাম মনে পড়ছে না)। নেশা শুধু শরীর। প্রতিশোধ। পরীর ওপর, হারানো স্বপ্নের ওপর, অসময়ে জমে ওঠা দুঃখবোধের ওপর। নেশা নিয়ে আসে নতুনতর নেশা। সুরা আমাকে আলিঙ্গন করে পরম মমতায় এবং ক্রমশঃ ভেতরের আমার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ি। বাইরের আমি চালিত হই ভেতরের আমার ইশারায়। কেউ জানে না কেউ বোঝে না। নীরবে এবং একাকী গড়ে তুলি আমার দ্বৈত ভূবন। এতে কারো প্রবেশাধিকার নেই। আমরা দু’জন কথা বলি, হাসি, নেশায় মেতে উঠি, চোটপাট করি, এমনকি হাতাহাতি করি, কারো কিছু বোঝার উপায় নেই। এই যেমন সে কোন খেয়ালে আমায় যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে বাকবিতন্ডা হচ্ছে আমাদের, নাগরিকদের কারো তা বোঝার উপায় নেই। সান্ধাকালীন নাগরিক সমাজ মহাব্যতিব্যস্ত ছোটাছুটিতে। নুলো ভিখেরির দল গড়িয়ে গড়িয়ে কোরাস গেয়ে মানুষকে আকর্ষণ করতে চাইছে। নগরীতে নবাগতরা ছাড়া ওদের এসব নিত্যকার কসরতে কারো কৌতুহল নেই। এসব ভিখেরির দল দেখলে আমার বাবা আবার সইতে পারে না। পকেট হাতড়ে যা ওঠে দান করে দেয়। তার মনটা বড়ো নরম। অথচ শুধু কর্মহীন, বিষয়বুদ্ধিহীন বলে সর্বদা নির্দয় আচরণ করে আমার সাথে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। অতর্কিত পিটে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়ে মুখ তুবড়ে পড়ার উপক্রম হলাম। হতচকিত হয়ে দেখলাম বিকট মুখ হা করা এক নাগরিক ম্যানহালের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি।
আরেকটু হলে তো একেবারে গেছিলে.. ভেতরের আমি কুলু কুলু হেসে ওঠে।
হাসির কি হলো, ধমকে উঠি আমি।
এমন বেভূলো পথ চললে আর বাঁচতে হবে না – সে ভয়ের কাঁটা ফোটাতে চায় গায়ে।
ফু ! আমি মুখ ভ্যাংচালাম, কে চায় বাঁচতে ? আর বাঁচতেওবা হবে কেন?
মরতে চাও? সে যেনো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে চায়।
আমি কি চাই আর কি চাই না তাও তো বুঝি না।
আহারে! ভড়ং দেখে বাঁচি না।
ভড়ংয়ের কি দেখলে?
নিজেই দেখো- বলে ভেতরের আমি চুড়–ৎ করে চলে গেলো আঁধারে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি কিষণলালের ঘরের সামনে। দুই সারির টানা তিনতলা কলোনীর ঘরগুলো রাতের স্পর্শে মাদকাসক্ত হয়ে উঠেছে। দলে দলে নারী পুরুষ কিশোর যুবা আড্ডা দিচ্ছে এদিক ওদিক। তাস পেটাচ্ছে কেউ, কেউ কঙ্কে টানছে ’ভম্ ভোলানাথ’ বলে, কারো হাতে বাংলা বোতল, উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা করছে দাপাদাপি আর উচ্চস্বরে বাজছে হিন্দি গান। তেহারীলালের ঘরের বারান্দায় বসেছে তবলা হারমোনিয়ামের আসর। এক অদ্ভুদ সুর শব্দ আর কোলাহলে মাতাল হয়ে উঠেছে সুইপার কলোনী।
শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে নাগরিকদের বর্জ্য পরিস্কারকদের জন্যে সদাশয় সরকার গড়ে দিয়েছে এই দেয়ালঘেরা আস্তানা। এই হরিজনদের নিয়ে আমি বেশকিছু বইপত্র পড়েছি। তাদের শেকড়হারা ঘৃণামুদ্রিত জীবনের গল্প লিখে কেউ কেউ বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। পাকিস্তানামলে মূলোৎপাটিত এই মানুষগুলো আমাদের বিশাল জনসমাজে একেবারে অপাঙতেয়। যদিও এদের সম্পর্কে বই পড়েছি কিন্তু কখনো তাদের সংস্পর্শে আসিনি। আমার সমাজকর্মী বন্ধু সৌরভের তাগিদে একদিন এই অস্পৃশ্য এলাকায় আসি। সৌরভ এক সমাজসেবা সংস্থায় কাজ করে। রাতদিন বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বেড়ায় । বাচ্চাদের স্কুল, পুরুষ-মহিলাদের সংগঠন পরিচালনা করে। আমরা সবাই পেছনে হাসি। মাষ্টার্স পাশ করে সৌরভ কোথায় বিসিএস ক্যাডার ফ্যাডার হবে, না, সে কিনা বস্তি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্যা ফ্যা করে। এ ব্যাপারে কথা উঠলে সৌরভ একেবারে তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মত তড়বড় করে ওঠে।
‘তোরা বুঝতে চাচ্ছিস না, সমাজের এই অবহেলিত মানুষদের মধ্যে কি সত্যি লুকিয়ে আছে, দরকার শুধু সঠিক পরিকল্পনা আর গাইডেন্স।’
চাকরী করছিস কর বক্তৃতা দিবি না, ফোঁড়ন কাটে ঝন্টু।
বক্তৃতা কিরে, এটাইতো সত্য- মর্মাহত হয় সৌরভ।
তুইও সত্য শেখাচ্ছিস সৌরভ ? জামিল কটাক্ষ করে।
আসলে আমাদের আত্মাটাই পচে গেছেরে- আক্ষেপ করে সৌরভ।
মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে যে সমাজ সেখানে আত্মা কলুষিত সৌরভ, হায়দার দার্শনিক ভঙ্গীতে বলে, সততা মানবতা, শ্রদ্ধা ভক্তি, সমাজসেবা সব কিছুই আজ পণ্য- তুই কি তা বুঝতে পারিস?
সেদিন সৌরভ আর কোন কথা বলেনি। কিন্তু তার মনোকষ্টের স্পষ্ট ছাপ আমি দেখতে পেয়েছিলাম।
একদিন সকালে নিউমার্কেটের মোড়ে তার সাথে দেখা। আমাকে দেখে মোটর দেখে সাইকেল থামিয়ে রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেলো জোর করে। চা সিঙ্গারার অর্ডার দিয়ে তাকালো আমার দিকে।
এক জায়গায় যাবি?
কোথায়?
বয়স্ক মহিলাদের স্কুলে-।
সেখানে আমি কি করবো?
দেখবি কিভাবে এদেশের একেবারে পশ্চাদপদ নারীরা তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে, সৌরভের কন্ঠে দৃঢ়তা ফুটে ওঠে, ওরাও যে এই পৃথিবীর মানুষ এই চিরন্তন বোধটা তারা কিভাবে অর্জন করছে তা দেখবি।
ইচ্ছে হলো সরাসরি না বলে দেই। কিন্তু সৌরভ আমার বন্ধু। সে একটা কাজ করছে- সে যেমনই হোক। ও তার কাজটার যথার্থতা তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তার তো নিজের সম্পর্কে কিছু না কিছু বলার আছে। আমি তো এখনো কিছুই করতে পারলাম না। তার কাজের স্বীকৃতি নাইবা দিলাম কিন্তু বন্ধু হয়ে ও যা করে আনন্দ পাচ্ছে তাকে তো উৎসাহিত করতে পারি। এসব ভেবে রাজী হলাম। মোটর সাইকেলের পেছনে বসে সিগারেট টানতে টানতে যখন এই সুইপার কলোনীতে এলাম তখন চতুর্দিকে দূর্গন্ধ থই থই করছে। আমার নাক কুচঁকে গেলো। অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। পেট মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইলো। বহুকষ্টে নিজেকে ধাতস্ত রেখে সৌরভের পিছু পিছু কলোনীর তিনতলার ছাদে উঠে এলাম। সেখানে বেড়ার একটা ঘরে পচিঁশ ত্রিশজন মহিলা বসে পড়ছে। এক শহুরে শিক্ষিতা মহিলা (যাকে তার ছাত্রীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দেখাচ্ছে) ব্লাকবোর্ডে চিল, শকুন, কুমীর, রাজপাখী শব্দগুলো লিখে উচ্চস্বরে বানান করছে আর ছাত্রীরা সমস্বরে কোরাস করছে। সৌরভ ভেতরে ঢুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে নমস্কারের ভঙ্গী করলো।
‘নমস্কার দাদা’
সৌরভ প্রতি নমস্কার করে শিক্ষিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
‘তা দিদিমণিরা আমরা আমাদের শপথটা পাঠ করে আমাদের অতিথিকে কি শোনাতে পারি?
অতিথি ? সবাই ঘুরে তাকালো আমার দিকে।
আমি কুকঁড়ে গেলাম।
আমার বন্ধু, আপনাদের কাজ দেখতে এসেছে, সৌরভ যেনো আমাকে ভীষণ এক বিপদে ফেলে দিয়েছে। আমি বিরসভাব দূর করার জন্যে প্রাণপণে হাসি ফুটিয়ে রাখলাম। একে একে অবহেলিত মেথরপল্লীর মহিলারা শেখানো শপথ পাঠ করলো, ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারণে কবিতা আবৃতি করলো, দুয়েকজনে যোগবিয়োগ অংক করে দেখালো, এক তরুণী অবলীলায় এঁকে ফেললো বাংলাদেশের মানচিত্র। তরুণীর আঁকার ভঙ্গী দেখে আমি অবাক হলাম। অতি নিপুন টানে তরুণী কালো বোর্ডে চক দিয়ে বাংলাদেশ এঁকে ফেললো। অথচ এদেশ তো তার দেশ নয়, সেতো এখানে অপাঙতেয়। কি করে সে বাংলাদেশকে তার বুকে পুরে নিয়েছে? যেখানে আমরা দেশকে মনে রাখি না সেখানে কিসের অহংকারে সে বাংলাদেশকে ধারণ করেছে? তরুণীকে কয়েকটা প্রশ্ন করি, সে জবাব দিলো সাবলীলভাবে। তার কালো তেলতেলে মুখখানা আনন্দে চকচকিয়ে উঠলো। ওর নাম বুন্দিয়া। বুন্দিয়াকে আমার ভালো লাগলো।
বুন্দিয়ার কারণে আমার এখানে আসা এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। বুন্দিয়ার স্বামী কিষণলাল হয়ে গেছে আমার বন্ধু। বুন্দিয়ার ঝকঝকে ঘরখানা হয়ে গেছে আমার দ্বিতীয় বাসস্থান। যৌবনের ঠাসবুননে বুন্দিয়া আমার ভেতরের আগুনকে বাষ্প করে দেয়। রাতের অন্ধকার গিলে খায় বোধ। আমি আমার অলক্ষে উঠে আসি বুন্দিয়ার সান বাঁধানো যৌবনের ঘাটে। কিষণলাল তার পেটানো শরীরটা নাচিয়ে হাসে আমার অবস্থা দেখে।
‘বাবু বুন্দিয়া তুমারে যাদু কইরছে, তুমি খুন হো গেয়া বাবু।’
নেশা হলে তোমার হুঁশ থাকে না কিষণ-আমি হাল্কা চালে বলি।
হামি টিগ আছে বাবু, বুন্দিয়াকে পুছ।
বুন্দিয়া রহস্য ছড়ায় হাসিতে। কালোসোনার ঝিলিক দেয়া আলোয় দ্যুতি ছড়ায় তার চোখজোড়া। সে আলতো ছোঁয়ায় আমার চুলে বিলি কেটে দেয়। কিষণকে এগিয়ে দেয় কঙ্কে কিংবা মাতাল গেলাস।
কিষণ ঘরে না থাকলেও বুন্দিয়ার আচরণে কখনো কোন ব্যতিক্রম দেখিনি। মেঝেতে বিছানো মাদুরে বালিশ পেতে আমার কাছটাতে বসে কখনো গুন গুন করে, কখনো আমার আঙ্গুল নিয়ে খেলা করে, কখনো দুষ্টুমি করে লম্বা গোঁফটা টেনে দিয়ে হেসে ওঠে খিল খিল করে। তার প্রতিটি কথায় হাসি, চাহনীতে হাসি, চলার প্রতিটা ভঙ্গীতে হাসি ঝরে পড়ে ঝুর ঝুর। বুন্দিয়ার সকল ঐশ্বর্য পুস্পিত হয়ে আমার ভেতর অনাবিল সুখ জাগিয়ে তোলে। বাইরের আমি যতোই দূরে থাকতে চাই ভেতরের আমি ততোই কাছে চলে আসি। আজকের মতো।
এলে তাহলে?
সান্ধ্য পূজোর প্রাসাদ বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো বুন্দিয়া। দেবীর অপরূপ সাজে মোহনীয় লাগছে তাকে। পরিপাটি প্রসাধনে মনে হচ্ছে যেনো এক রাজহংসী। তার শরীর ফুঁড়ে বেরুচ্ছে আতরের সুবাস। পদ্মদিঘির গহীন কালো জলের অতল অন্ধকারের মতো গভীর চোখে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বিলম্ব না করে তার বাড়ানো হাতটা প্রসাদসমেত দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর সম্মোহনী সুবাস হুটোপুটি করছে। মৃদু শব্দে বাজছে হিন্দি ছবির গান। বৈদ্যুতিক আলোয় সাঁতার কাটছে ফ্যানের আবর্তিত বাতাস। আমি মুখোমুখী দাঁড়ালাম তার। তাকালাম চোখের গভীরে। সেখানে তিরতির করে কাঁপছে সুখের হাতছানি। আমার মুঠোয় বন্দী তার হাতখানা হয়ে উঠেছে উষ্ণ। আমি যেন শুনতে পেলাম তার হৃদপিন্ডে বেজে চলা আকুলতার শঙ্খধ্বনি।
তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে? বুক নিঃসৃত আবেগ কেঁপে ওঠে আমার কন্ঠস্বরে।
কদ্দিন আসো নি খেয়াল আছে? ক্ষুন্নতা ছড়ায় তার গলা।
কেন আমার অপেক্ষা করো?
জাগতিক বাস্তবতায় বললাম আমি, তোমার তো সংসার আছে, কিষণলাল আছে, আমার বন্ধু- সে আমার বুকের কাছে এগিয়ে আসে নিঃশব্দে। প্রায় আলতো করে মুখটা আমার বুকে ঠেকিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চুলের ঘ্রাণ আমার পঞ্চোন্দ্রিয়কে সম্মোহিত করে তোলে। আমি সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেলাম। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাতম আমার রক্তে ছোটাছুটি শুরু করলো। ওর শরীর আমাকে সমর্পনের ইঙ্গিত দিলো। ঘরের বাইরে কারো পদশব্দ আমাকে একটু সচকিত করলো। বুন্দিয়াকে সরিয়ে দাঁড়ানোর আগেই ঘরে ঢুকলো কিষণলাল। ওর হাতে কাগজের ঠোঙ্গা। সে হেসে তার নাদুসনুদুস শরীরটা নাচালো, চোখের দৃষ্টি মোলায়েম করে তাকালো আমার দিকে।
তুম কিধার থা বাবু? হামার বুন্দিয়া তুমার লাগি দিওয়ানা হো গেয়া-।
কিষণলাল আমায় টেনে মাদুরে বসালো। তার নীল জামাটা ঘামে ভিজে কিছুটা লেপ্টে আছে শরীরে। মাথার চুল এলোমেলো। গলায় ঝোলানো তকমাটা বেরিয়ে আছে জামার বাইরে। সে বুন্দিয়ার দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গীতে হাসলো। আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ভেতরের ঘরে গেলো সে। ফিরে এসে নীরবে দ’ুটি গেলাস, একপ্লেট চানাচুর, একজগ পানি রাখলো সামনে বুন্দিয়া। ওদের সমাজে আমাদের মতো জড়তা নেই। সংস্কার ওরাও মানে কিন্তু আমাদের মতো রক্ষনশীলতা নেই। কিষণলাল আমাদের যে অবস্থায় দেখেছিলো তা আমাদের সমাজে হলে রক্তরক্তি হয়ে যেতো। যেনো ও কিছু না এমন ভাব কিষণলালের আচরনে।
লেও বাবু গুলজার করলো- কিষণলাল গেলাস এগিয়ে দেয় আমার দিকে।
এতো খরচা না করলে পারো কিষণ- আমি বন্ধুত্বের সুরে বললাম।
খরচা কা লিয়ে তো রুজি বাবু, কিষণ দরাজ গলায় হাসে, খরচা নেহি তো রুজিকা ক্যায়া মাজা হ্যায়?
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। আমরা দু’জন গেলাসের পর গেলাস ঢেলে চললাম গলায়। ঘরে গান বাজছে, বাইরে হুল্লোড় চলছে, বুন্দিয়া রান্না করছে, ফ্যানের বাতাসে উড়ছে নেশাময় রাতের প্রহর।
বাবু তেরা এক বচন চাইয়ে, দিয়েগি?
কিষণলালের হঠাৎ এধরনের প্রশ্নে আমি সচকিত হলাম। ভাবলাম, তাহলে কি কিষণ বুন্দিয়া আর আমাকে অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে দেখে ক্ষুন্ন হয়েছে? তাই এখন আমার কাছে ওয়াদা চাচ্ছে এ তল্লাটে আর না আসার? আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। যথাসম্ভব নিজের মনের ভাব চেপে রেখে সপ্রশ্ন আমি ওর দিকে তাকালাম। নেশায় জ্বলজ্বলে চোখে আগ্রহভরে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হলো ওর দৃষ্টিতে কি এক হৃদয়কাড়া আবেদন ফুটে উঠেছে।
কিসের বচন কিষণ?
তুম বুন্দিয়াকো এক গুডিয়া দে দো বাবু, সে ঝট করে আমার হাত ধরে মিনতি করে ওঠে, হামি লা মর্দ বাবু-।
কি যা তা বলছো কিষণ? আমি চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে।
ম্যা সাচ বোলা বাবু- কিষণ আমার হাত ছাড়ে না, বুন্দিয়া ম্যারা বিবি জরুর রহেগি বাবু, হাম দোনোকা এক গুডিয়া দে দো বাবু-।
সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এও কি সম্ভব এই জগতে? কোন স্বামী, সে যতোই নামর্দ হোক না কেন, অন্যপুরুষের হাতে এভাবে স্ত্রীকে সঁপে দিতে পারে? কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি জানি বুন্দিয়ার যৌবনের অগ্নিশিখা আমাকে ঝাঁপ দেবার আহবান করে প্রতিনিয়ত। ওকে দেখলে আমার ভেতর জেগে ওঠে চিরকালের আকাঙ্খা, তীব্র কামবোধ। আর এই বোধের পালকি বেয়ে ভালোবাসার এক দ্যুতি আলোকিত করেছে আমার হৃদয়। তাই ছুটে আসি অজান্তে, সময়ে অসময়ে। তাই বলে …। না না, এ অসম্ভব দাবী। এ হতে পারে না। বুন্দিয়া তাহলে হারাবে সংসার, আমি হারাবো আমার দ্বিতীয় বাসস্থান, ভালোবাসা।
আমি পা বাড়ালাম দরোজার দিকে।
কিন্তু একি! দরোজা বন্ধ কেন? কে করলো বন্ধ? স্মরণ হলো বেরিয়ে যাবার সময় কিষণ দু’হাতে দরোজার পাল্লা টেনে ধরেছিলো। এটা কি ঠিক হলো? এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলাম আমি। দরোজা থেকে ফিরে তাকিয়ে দেখি বুন্দিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। আমি এগিয়ে গেলাম তার কাছে।
এসব কি হচ্ছে বুন্দিয়া?
তুমি আমায় ভালোবাসো ? পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেলাম আমি। দেখলাম সপ্রশ্ন তাকিয়ে আছে বুন্দিয়া। কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। নেশা গাঢ় হয়ে চেতনায় পলেস্তারা জমিয়ে দিয়েছে। দিশেহারা বোধ হচ্ছে।
তুমি জানো না বুন্দিয়া ?
তাহলে ভয় পাচ্ছো কেন?
ভয় পাচ্ছি? তাইতো কেন ভয় পাচ্ছি আমি? আমি কি কুমার নাকি? এখানে লোক লজ্জার ভয় নেই, দায়দায়িত্বের বালাই নেই, চিরস্থায়ী বন্ধনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তাহলে ভয় কিসের ? বুকের ভেতর জমে থাকা সুপ্ত সংস্কারের? পাপবোধের? আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব দেখে বুন্দিয়া এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। পরম মমতার হাত দিয়ে স্পর্শ করলো আমার বুক।
শোন, আমরা দু’জনে আলাপ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি- মুখের কাছে মুখ এনে বললো বুন্দিয়া।
আলাপ করে? এমন অদ্ভুত কথা কি করে বলছে বুন্দিয়া ভেবে পেলাম না।
হ্যাঁ। বুন্দিয়া আমার চুলে আঙ্গুল চালালো, অন্য যে কারো থেকে তো নিতে পারি, তাই না? কিন্তু নিলে নেবো ভালোবাসার ধন, পরশপাথর।
আমার মুখে আর কোন কথা সরলো না। বুন্দিয়া তার বুকজোড়া উম্মুক্ত করে আমার চেতনাকে ঢেকে দিলো।
তখন ভেতরের আমি হঠাৎ কুল কুল করে হেসে উঠলো, দেখলে তো।
******************************************