অন্তিম স্যালুট
নুসরাত সুলতানা
বেদনা বিধুর লাগলেও শহিদুল সাহেব ভারমুক্ত বোধ করছিলেন অন্য সকলের মতোই। কারণ রক্তের হোলিখেলা তিনি আর নিতে পারছিলেন না। ৪আগষ্ট রাতে এশারের নামাজ শেষে তিনি নিজমনে তিনি বলছিলেন -সৃষ্টিকর্তা তুমি কী আমাগো সহায় হইতে পারো না? আর কত লাশ এই মাটির দাবী? সেনা প্রধানের বক্তৃতা শুনে তিনি দুপুরের খাবার খেতে যান। যদিও ভারমুক্ত বা নিশ্চিন্ত লাগছিল। নিজের কাঁধ থেকে মনে হয় একটা পাহাড় নেমে গেছে। নিজের মাথাটা আজ তার শোলার মতোই হালকা লাগছে। খেতে খেতেই তিনি ভাবছিলেন- শেখ সাইবের বেটির আইজ এই দশা অইল! অথচ তিনি আধুনিক গনতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপকার অইতে পারতেন! ক্ষমতা, দম্ভ আর জনগণের থেইকা দূরে চইলা গ্যালে মানুষের এমন অয়। খেয়ে আবারও তিনি টিভি ছেড়ে দিয়ে বসে যান সংবাদ দেখতে।
কারো হাতে রাজহাঁস, কারো হাতে স্ট্যান্ড ফ্যান, এসি, ট্রাংক, শাড়ি, ব্যাগ,চেয়ার এমনকি বসার টুল। কিছুক্ষণ পর এক যুবকের হাতে দেখা গেলো লাল- কালো বিভিন্ন রঙের অন্তর্বাস। আর সকল লুণ্ঠনকারীর মুখেই বিটকেলে হাসি। গণভবন লুটপাটের এসব দৃশ্যই দেখাচ্ছে সবগুলো টিভি চ্যানেল। শহিদুল সাহেব নিজের মনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে যেতে ভাবেন – ছি! এত নির্লজ্জ ইতর জাতি আমরা! দুইশো টাকায় মনে হয় এরা নিজের স্ত্রী -কন্যার ইজ্জত বিকিয়ে দিতে পারে! গণভবন আমাদের দেশের প্রধান ঐতিহ্য আর সম্মানের জায়গা। সেইটাকে রক্ষা করন গেলো না! এই বিজয় আসলে কী কাজে আইবে! যদিও আগষ্ট মাস কিন্তু সবগুলো টিভি চ্যানেল তাদের স্ক্রীণ থেকে খুলে ফেলেছে কালো ব্যাজ। শহিদুল ইসলাম ভাবেন- পলাইছে একজন মহিলা। কিন্তু তারে স্বৈরাচার যেসব তেলবাজ আর ধান্দাবাজরা বানাইলো হেই ইতরগুলান যাইবে কই? আর কয়জন পলাইবে?
এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি মাগরিবের নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান। রাস্তাঘাটে মানুষের উল্লাস। মসজিদের ইমাম সাহেব বল্লেন- আলহামদুলিল্লাহ মজলুমের জয় হয়েছে জুলুমকারীর পতন হইছে। সবাই বলেন আলহামদুলিল্লাহ। শহিদুল সাহেব ভাবেন এইবার দেশে সুশাসন আসবে। গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, জাতীয় স্বার্থে একতার পথে হাঁটবো আমরা।
০২.
তখন রাত আটটা বেজে গেছে। হঠাৎ করেই দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ। শহিদুল সাহেবের ছোট ছেলে সুমিত পড়ছিল টেবিলে বসে। বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের পৌরনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছেলেকে দরোজা খুলে দিতে বললেন শহিদুল। সুমিত এসে বলে- আব্বা খলিল চাচায় আইছে। আমনেরে ভোলায়। পরনের সাদা লুঙ্গিটা ঠিক করে পরে গায়ে একটা জামা গায়ে চাপিয়ে তিনি সামনের রুমের দিকে অগ্রসর হন। গিয়ে দেখেন খলিল সাহেবের পাংশুটে মুখ। খলিল সাহেবের মুখ দেখে শহিদুল সাহেব জিজ্ঞেস করেন কী খলিল কী অইছে? নেত্রীর পরাজয় মাইননা লইতে পারোনায়? দ্যাহো আওমিলীগের আত ধইরা দ্যাশ স্বাধীন অইছে হে কতা ঠিক। কিন্তু গত পনেরো বচ্ছর হেরা মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুরে খালি বেইচ্চা খাইছে। আওমিলীগ লইয়াও ব্যবসা করছে। টাহা খাইয়া কমিটি বানাইছে। এহন দেকপা হানে দলডাও আবার ঠিক অইবে। খলিল বলে- ভাই আপ্নে আমার বড় ভাই। একলগে আপ্নের লগে আমি আমার ভাই দুইজন মুক্তিযুদ্ধ করছি। আমার বয়স তখন সাত বচ্ছর। কিন্তু আমার তো মনে আছে ভাই অনেক কিছুই। শেখ হাসিনার পতন অইছে অউক। কিন্তু ৩২ নাম্বারে আগুন দেলো ক্যা? বিদ্যুৎ চমকে যায় শহিদুল সাহেবের করোটিতে – আৎকে ওঠেন তিনি। জিজ্ঞেস করেন – কী কইলা খলিল! ৩২ নাম্বারে আগুন মানে! কারা আগুন দেছে? খলিল বলে- ফেসবুক দেহেন। এসব খবর টিভিতে দেহাইবে না এহন আর! শহিদুল সাহেব বলেন। খাড়াও দেহি।
০৩.
৩২ নাম্বার পুড়ে ভষ্ম..। এরকম ক্যাপশনে বেশকিছু পোড়া বাড়ির ছবি দেখতে পান শহিদুল। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে শহিদুল সাহেবের মননে-বোধে, সমস্ত শরীরে। তাঁর বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠে তাঁদের গ্রামের সেই আগুন দেয়া বাড়িগুলো। তিনি ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসে যান আর ভাবেন – এই পাকিস্তানি আগুন কারা জ্বালিয়েছে ৩২ নাম্বারে? মোশতাক, গোলাম আজম, নিজামীর উত্তরসূরীরা কী সংখ্যায় এতই! তারাই বাংলাদেশের ইতিহাসের আতুড়ঘরে আগুন লাগিয়ে ভষ্ম করে দিতে চায়? কাদের জন্য শেখ সাইবে বছরের পর বছর জেল খাটলো? মূহুর্তেই চলে সেইসব আগুন দিনে। সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার সহ এগারো দফা আন্দোলনের দিনগুলোতে। তখন তিনি ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। এই স্লোগানে উত্তাল ঢাকা শহর। শ্রমিকরা ছিল অগ্রগামী সেই মিছিলে বলা যায়। আর নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ। তিনিও বহু হেঁটেছেন এই মিছিলে। ৬৯ এর গন অভ্যুত্থানের পর শহিদুল ভেবেছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সেনাবাহিনীতে যাবেন। ঘরে তুলবেন ডাগর চোখের শ্যামা মেয়ে রাহেলাকে।
৭০ এর নির্বাচনের পরে শহিদুল সাহেব পিতা-মাতাকে বলে রাহেলাকে আংটি পরিয়ে রেখেছিলেন। আংটি পরানোর পর রাহেলাকে তার মনে হইছিল একটা বৃষ্টি ভেজা বেলীফুলের মতো নরোম, কোমল শুভ্র-সুন্দর একটা মেয়ে। খুব ইচ্ছে করছিল যুবক শহিদুলের একটা বার বুকের সাথে পিষে মেরে ফেলতে। মিনিট দুয়েকের জন্য কাছেও পেয়েছিলেন। এগিয়ে যেতেই রাহেলা চোখ গরম করে হাত দিয়ে দূরে সরে যেতে ইশারা করেছিল। অমনি শহিদুল সাহেব হাতজোড় করে বলেছিল – খালি তোমার কপালে একটা চুমা দেতে দেও। রাহেলা যেহেতু চোখ বন্ধ করেছিল। শহিদুল সাহেব চোখদুটো ও নিমিষেই ছুঁয়ে দিয়েছিলেন ওষ্ঠযুগল দিয়ে। রাহেলার মুখটা মুহূর্তেই টকটকে লাল গোলাপের মতো রক্তিম হয়ে উঠেছিল।
ওহ! হঠাৎ করেই আর্তনাদ বেরিয়ে যায় শহিদুল সাহেবের মুখ থেকে। মনে পড়ে যায় রাহেলার জিহবা বের হয়ে যাওয়া মৃত মুখ। ওহ! কী ভয়ংকর দৃশ্য! সবাই যখন শহিদুল সাহেবের বাবা সহ আরও অসংখ্য মৃতের সৎকার করছিলেন ঠিক তখনই রাহেলা সেই দু:সাহসিক কাজটি করে ফেলে । ১০ ই এপ্রিল স্বপ্নডাঙ্গা গ্রামে পাকিস্তানি হামলায় ৫৭ জন শহিদ হয়। জ্বালিয়ে দেয় অসংখ্য বাড়িঘর। আফজাল শেখের নয় মাসের পোয়াতি বউটাকে পাকিস্তান আর্মি পেটে গুলি করে প্রথম। তারপর বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মারে। কন্ঠ ক্যান্সারে আক্রান্ত নব্বই বছরের বৃদ্ধ শুক্কুর আলীর ঘরে আগুন দিলে সেও মারা গেছে আগুনে পুড়ে। কারণ সবাই তাকে রেখে দৌড়ে পালিয়েছে যেখানে যে পারে। আর তখনই রাজাকার করিম মোল্লা পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন রমিজের হাতে তুলে দেয় রাহেলাকে। তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী রাহেলা। ধীর-স্থির চলা, মৃদু ভাষীতা, বড় ডাগর চোখের রাহেলাকে মনে হত শান্ত সরোবর। সেই সরোবরকে পুরো রাত ধরে রক্তাক্ত করেছিল পাঁচ পাকিস্তান হায়েনা সেনা অফিসার। পরেরদিন মুক্তি পেয়ে ফিরেই রাহেলা দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দরোজা ভেঙে রাহেলার ভাই দেখে ঝুলছে তার আদরের বোনটি। রাহেলাকে দাফন করে কবরের মাটি ছুঁয়েই শপথ করেছিল শহিদুল। এইদেশ থেকে পাকিস্তানি ইতর হায়েনা তাড়ানোর যুদ্ধে তিনিও থাকবেন। জীবন দেবেন কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাবেন না। বহু স্মৃতিকাতর আর ক্লান্ত হয়ে শহিদুল সাহেব সেই রাতে ঘুমাতে গেলেন রাত দেড়টায়। যদিও তিনি এগারোটার ভেতরই ঘুমিয়ে যান।
ঘুমের ঘোরে সারারাত তিনি ৭১ সালে অবস্থান করলেন। কখনো অপারেশনে যাচ্ছেন। আবার কখনো সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখছেন। আবার কখনো অপারেশন করে ব্রীজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য নভেম্বর মাসের প্রায় সারা রাত ডোবার ভেতর ডুব দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। যেই পাকিস্তানি আর্মি ব্রীজে উঠেছে অমনি উড়িয়ে দিয়েছেন ব্রীজ। ঘুমে আর জাগরণে অবচেতনে কেটে গেল ৫ আগষ্ট ২০২৪ এর রাত।
০৪.
৬ আগষ্ট শহিদুল সাহেব হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন নিজের সবজি ক্ষেতে। দেখছিলেন পটল, ঢেঁড়স, বরবটি আর লাউয়ের ফলন। বেশদুটো নধরকান্তি লাউ ধরেছে গাছে। রাজিয়ার আছে একটা ড্যাগা মোরগ। ভাবছিলেন তিনি মন্দ হবে না। তখনই মনে পড়ে যায় বড় পুত্রের কথা। বুকের ভেতরটা তাঁর ব্যাথা করে ওঠে বড় পুত্রের জন্য। আর ভাবেন কত দূরে ছেলেটা থাকে! ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যান দেশী বরবটি গাছগুলোর দিকে। চারটা গাছ আছে মাচানে। বেশ কয়েকটি সবুজাভ শাদা, পেটমোটা বরবটি তোলেন তিনি। বৃক্ষ আর লতার কাছেই বুঝি তিনি প্রশ্রয় খুঁজছিলেন। তিনি দেশের এসব দুরাবস্থা আর নিতে পারছিলেন না। বারবারই তিনি ভাবছিলেন – মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটা মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বলে গনতন্ত্রকে ধূলিস্যাৎ করে দেশটা নরক বানিয়ে দিয়েছে। আর ছাত্র জনতার নামে যাদের উত্থান হল- তারা বোধকরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধি শক্তি। এরা সব ধ্বংস করতে চায়, মুছে দিতে চায়। এমন সময় তার স্ত্রী রাজিয়া ফোন নিয়ে এসে বলে- আমনেরে বড় পোলায় ফোন দেছে। শহিদুল সাহেব বলেন- দেও, দেও। ফোন ধরেই সজল বলে- আব্বা বাংলাদেশের এ কোন পরিস্থিতি! বঙ্গবন্ধুর মুর্তি, লালনের মুর্তি, রবীন্দ্রনাথের মুর্তি সব ভাঙচুর হইতেছে। আর্মির পোশাক পইরা জাতির পিতার মুর্তি ভাঙছে আব্বা। জাতির পিতার মুর্তিতে প্রস্রাব করছে। এরা কারা আব্বা? দেশের মুক্তিযোদ্ধারা কই? শহিদুল সাহেব বলেন- বাবা আমরা সবাই হতবাক হয়ে যাচ্ছি! দ্যাশ কী আবার পাকিস্তান বানাইতে চায় এরা? এরা আসলে কারা? এরা কী বাংলাদেশের মানুষ! সজল বলে- আব্বা – আপনে নিজের দিকে খেয়াল রাইখেন। আইয়া জানি আপনেরে সুস্থ শরীরে পাই। আর কারো সাথে তর্ক-বিবাদ করবেন না এখন।
চায়ের দোকানে বসে রাজনৈতিক আলাপ করবেন না। শহিদুল সাহেব হঠাৎ যেন শরীরে একটা ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করলেন। প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলেন- বাবা বয়স প্রায় বাহাত্তুর ছুঁই ছুঁই। কখন যে কী হয়! তোমরা দুই ভাই মিলেমিশে থাকবা। নেও তোমার মার লগে কথা বল।
ক্ষেতের আইলে বসে পড়লেন শহিদুল। সেদিনের দৃশ্যপটগুলো সিনেমার মতো ভেসে উঠতে থাকে তার মানসপটে। ছয় মাসের গর্ভ নিয়ে বউ প্রবেশ করে বাসর রাতে। বরের পা ছুঁয়ে সালাম করেই কান্নায় ভেঙে পড়ে
স্ত্রী। স্বামী হাত ধরে তুলে বলে- কেন কানতেছ তুমি? তোমার কোনো অমর্যাদা কোনোদিন অইবে না রাজিয়া। শুধু আইজ এই রাইতে কতা দেও – তুমি কোনোদিন এই সন্তানরে বলবা না যে আমি ওর জন্মদাতা না। রাজিয়া তিনি বুকে নিয়ে বলেছিলেন – দেখো জাভেদ আমার বন্ধু, সহযোদ্ধা। মরণের সময় আত ধইরা অনুরোধ করছে- রাজিয়ারে তুই ঘরে তুইললা লইস বন্দু। ও খুব ভালো মাইয়া। তুই সুখী অবি। তুই একটা অবিবাহিত মাইয়া পাইলি না এই যা।
শহিদুল সাহেব ভাবেন – সত্যিই এত সহনশীল, উদার নারী রাজিয়া! অভিযোগ কী জিনিস রাজিয়া জানে না!
এরপর শহিদুল সাহেবের ঔরসজাত ছেলে সুমিত। দুই ভাইকে তিনি ভিন্ন চোখে না দেখতে চেষ্টা করেছেন বরাবরই । বড় ছেলে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করিয়ে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছেন পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে কুয়ালালামপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক । যদিও শহিদুল সাহেব সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ অব্দি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা হয়ে ওঠেনি। তাই যোগদান করেছিলেন নিজের এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ছোট পরিসরে চাকরি,নিজের জমিতে কৃষি, সন্তান-সংসার, দুই ছেলের ঘরে দুই নাতি নিয়ে তিনি মোটামুটি সুখী মানুষ। কিন্তু তেপ্পান্ন বছরে দেশই তাঁকে শান্তি আর স্বস্তি দেয়নি। রাজনীতি তিনি কখনো করেননি। কিন্তু দেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এসবের স্থান তাঁর হৃদয়ের গভীরে। ধমনীতে রক্তের ভেতরেই বহমান। যদিও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের প্রতি রয়েছে চরম বিতৃষ্ণা। এবং আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসা আর ধর্মান্ধদের মদদ দেয়ায়ও তিনি ছিলেন রীতিমতো সংক্ষুব্ধ।
০৫.
জলিল হাওলাদার তখন চৌদ্দ বছরের যুবক। নিজেদের গ্রাম স্বপ্নডাঙ্গা আক্রান্ত হওয়ার পর নয় মাস তিনি সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন ঝালোকাঠি, নলছিটি, আর মূলাদী এলাকায়। একরাতে এসেছিলেন মায়ের সাথে দেখা করতে। তার পরেরদিন চলে যাবার সময় ছোট ভাই খলিল গো ধরে বসে বড় ভাইয়ের সাথেই যাবে। যারা তাঁর প্রিয় পিতাকে হত্যা করেছে। সেও তাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। জলিল কিছুতেই নিতে চায় না ভাইকে। কিন্তু দুই পা জড়িয়ে ধরে অনড় বসে থাকে খলিল। আর জুড়ে দেয় কান্না। তারপর সব অপারেশনে ভাইয়ের সাথে থেকেছে বরাবর। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। কোনো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মুক্তিযোদ্ধাকে পানি খাইয়েছে। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের সহচর্যে কেটে গেছে মুক্তিযুদ্ধের শেষের চার মাস। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আগে না করলেও ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পরে সনদ নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে খলিল সাহেব এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কারণ বি.এ তে তার ইতিহাস বিষয়টি ছিল। স্কুলে যোগদান করেই তিনি এম.এ এবং বি.এড শেষ সম্পন্ন করেছিলেন। চার মেয়ে আর তাদের মা’কে নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল সংসার। কিন্তু মেয়েদের মা জাহানারা বেগমের বিভিন্ন রোগব্যাধিতে গেছে কৃষি জমি অনেক। তারপর বড় মেয়ের বিয়ে দেয়ার সময় ও ছাড়তে হয়েছে বেশ কিছু। এখন স্কুলের চাকরিই একরকম ভরসা। যদিও বড় মেয়ের বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি হয়েছে। জামাই ও খুব অনুদার নয়। বড় মেয়ে মাঝে মাঝেই বাবা-মাকে সহযোগিতা করে। মেঝ মেয়ে জেমী পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। খলিল সাহেবের খুব আশা এই মেয়েটা বি সি এস ক্যাডার হবে। কোটা আন্দোলন হলেও খলিল সাহেব ভেবেছিলেন অন্তত ১০% কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান থাকবে। নাতীদের হয়তো থাকবে না, যুক্তিও হয়তো সেভাবে নেই। যদিও জেমী নিজেও কোটা আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বলেছে তার চাকরির জন্য কোটা লাগবে না। নিজের মেধা এবং পড়াশোনা দিয়েই সে উৎরে যেতে চায়..।
০৬.
একের পর এক মুর্তি ভাঙছে, মাজার ভাঙা চলছে দেশে। এমনকি মেহেরপুর মুজিব নগরের মূর্তিগুলোও ভেঙে ফেলেছে। ভেঙে ফেলেছে ফুলার রোডের অসংখ্য মুর্তি। মাথায় হাত দিয়ে ভাবেন শহিদুল সাহেব এ কাদের তান্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে? এদেশ আসলে কোন দেশ! এরপর দেখা গেল পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি! অথচ এই নিয়ে কারো কোনো হেলদোল নেই। শহিদুল সাহেব আরও ভাবেন শেখের বেটি এত এত ল্যাখক, কবিগো পদক দেল! হেরাই বা কই? কেওর তো টু শব্দডাও শোনোন যায় না। সব বসন্তের কোকিল উড়ে গেছে বুঝি! কেউ আর জাতির পিতা, জাতির পিতা বলে কু উ, কু উ করতেছে না! সব শালা বাটপার। লেখক নামের কলঙ্ক! আর হাসিনা এগো পদ-পদবী-পদক -পয়সা সব দেছে! শহিদুল সাহেব আজকাল মসজিদ বা বাজারেও যান না। দুই ছেলেরই কড়া নিষেধ আছে। বলছে আপাতত চায়ের দোকানেও যাবা না। নিজের ঘরে বসেই অবসর সময়ে মাওলানা আবুল কালামের জীবনী পড়েন, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ পড়েন।
সেদিনও সন্ধ্যার পরে আসে খলিল সাহেব। খুব খুশি হয়ে যান শহিদুল। বুকে জড়িয়ে ধরেন ছোট ভাইকে। দুই ভাইকে রাজিয়া সেমাই রান্না করে দিয়েছে। সাথে চা। খেতে খেতেই খলিল বলে- ভাই স্কুলের পরিবেশ ভালো ঠেহিনা। অই রাজাকারের বাচ্চা আব্দুল রমজান আমারে হুনাইয়া হুনাইয়া কয় -কোনো স্বৈরাচারের দালাল ইস্কুলে রাখমু না। বাড়ি পাডাইয়া দিমু। নিজে নিজে রিজাইন দেলেই ভালো। নাইলে জোর কইরা দেওয়াইননা অইবে। ভাই কয়েন তো আওমিলীগ করছে ভাই। আমি কী রাজনীতি করছি? আর ইতিহাসের শিক্ষক ইসাবে ২৬ মার্চ, ১৬ ই ডিসেম্বর ছাত্র-ছাত্রী গো অনুষ্ঠানে আইতে আগ্রহী কইররা তোলতাম।এইডা কী আমার দোষ? ভাই দেহেন আরও দুই বচ্ছর চাকরি ডা না থাকলে আমি এই মাইয়া দুইডা আর অগো মায়রে লইয়া যামু কই? জেমীর পড়ার খরচ তো ও নিজেই চালায়। শহিদুল সাহেব বলেন- ম্যানেজিং কমিটি তো তোমারে স্কুলের বেতন দিয়া রাকতে রাজি অইছে। তুমি এত চিন্তা কর ক্যা খলিল? অই পক্ষ উত্তর দেয়- ভাই আপ্নে জানেন না চাইরোদিকে ছাত্রগো আতে শিক্ষক লাঞ্চনার ঘটনা ঘটতেছে। ভাই যাই আমি। জানি না কপালে কী আছে! খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখা গেলো খলিল সাহেবকে। শহিদুল তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে। তার মনে হল- একটা চরম বিপর্যস্ত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। একরকম বলা যায় একটা লাশ হেঁটে যাচ্ছে…।
০৭.
অন্যদিনের মতো সেদিন খলিল সাহেব নবম শ্রেণিতে ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন। পড়াচ্ছিলেন পাল আমল। দ্বিতীয় মহীপালের কথা বলতে গিয়েই আসছিল কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা। সেখান থেকেই সিরাজুদ্দৌলা, দেশ ভাগ, মুক্তিযুদ্ধ সবই চলে আসছিল। এরভেতর দশ-বারো জন যুবক প্রবেশ করে। কোনো অনুমতি ছাড়াই। খলিল সাহেব বলেন- কেলাসে ঢোকতে অইলে শিক্ষকের অনুমতি নেওন লাগে। তোমরা হে জানো না? তোমরা না আমার ছাত্র? অমনি এক যুবক বলে- চুপ কর শালা দালাল! তোর আর চাকরি নাই, কেলাসও নাই। আকাশ থেকে পড়েন খলিল সাহেব। বলেন- চাকরি নাই মানে? সাথে সাথে চার-পাঁচ জন বলে নাই মানে নাই। তুই আওমিলীগের দালালি অনেক করছস। একজন বলে- উনার সাথে ভদ্রভাবে বল। তারপর বলে স্যার আমরা রিজাইন পত্র লেইককাই আনছি। আপনের কষ্ট কইরা লেখোন লাগবে না। খলিল সাহেব বলেন- যদি সই না করি? অমনি একযোগে বলে- করন আপনের লাগবোই। তারপর তারা রিজাইন লেটার ধরে হাতে কলম ধরিয়ে দেয়। আর জোর করে কলম ঘুরিয়ে নাম লিখিয়ে নেয়। খলিল সাহেব আর পেছনে না ফিরে বাড়ি চলে যান। গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম দেন। স্ত্রী ডাকলে রাত আটটায় ওঠেন। স্ত্রীকে যখন জিজ্ঞেস করে- কী অইছে আমনের? খলিল সাহেব প্রথমে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। কিন্তু পরক্ষণেই বেহুশ হয়ে পড়ে যান। বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
০৮.
শহিদুল সাহেব নিজেই যান টি এন ও অফিসে। যাতে খলিল সাহেবের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হয়। টি এন ও সাহেব তাঁকে বসিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যখ্যা করেন। চা খাওয়ান তারপর বলেন তাদের পক্ষে এখন কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা অন্তিম স্যালুট দেয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা এখন ২৪ এর শহীদ নিয়ে ব্যস্ত? শহিদুল সাহেব বিস্ফারিত চোখে বলেন- এই জন্য সম্মুখ যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করছি? এইজন্য ৩০ লক্ষ শহীদ প্রাণ দিছে? চার লক্ষ মা-বোন ইজ্জত দিছে? একটা অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চাইতেও বড়! টি এন ও বলেন- ৫৩ বছরের আগের যুদ্ধ নিয়া পইড়া না থাইকা বর্তমান শহীদ আর আহতদের কথা ভাবতে হবে রাস্ট্রকে। শহিদুল সাহেব শুধু একবার তাকিয়ে বলেন- নিকুচি করি এই বেকুব রাস্ট্রের! তার মনে পড়ে ছোট্ট মুক্তিযোদ্ধা খলিলের ছুটোছুটির কথা, কিভাবে অস্ত্র এনে দিতো সেই কথা, কিভাবে স্লোগান দিত সেই কথা..। কেমন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতো ছোট্ট খলিল। তিনি বড্ড স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
হঠাৎ শহিদুল সাহেবের চোখ ফেটে দুফোঁটা অশ্রু তার গাল বেয়ে বুকের পশমে গিয়ে আটকে যায়। তারপরই মনে পড়ে খলিলের লাশের কথা। কি যে কষ্ট আর বেদনার ছাপ খলিলের মুখে! যেন অপমান, পরাজয় আর গ্লানির এক বিমূর্ত ছবি সেই মুখ! শহিদুল সাহেবের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে..।
ফিরে তিনি বাজার থেকে কিনে আনেন দুটি জাতীয় পতাকা। যেন খলিলের লাশটাকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়া যায়। আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন তিনিই খলিলকে অন্তিম স্যালুট দেবেন। মৃত খলিলের দিকে যেতে যেতে তিনি স্লোগান ধরেন- তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা, যমুনা।
একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার..
****************************